শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০১৪ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার- আহমদ রফিক

সমাজ পরিবর্তনের যে স্বপ্ন দেখেছিলাম তা আজও সোনার হরিণ

ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক হিসেবে খ্যাত আহমদ রফিকের জন্ম ১৯২৯ সালে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের চতুর্থ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। রাজনীতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় আকর্ষিত আহমদ রফিক বাহান্নর ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এবং পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ষাটের দশক থেকে সাহিত্যকর্ম ও শিল্পব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত, বর্তমানে পুরোপুরি সাহিত্যকর্মে। একসময় একাধিক সাহিত্য ও বিজ্ঞান পত্রিকার প্রকাশনা এবং সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্র গবেষক ও লেখকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- শেখ মেহেদী হাসান

সমাজ পরিবর্তনের যে স্বপ্ন দেখেছিলাম তা আজও সোনার হরিণ

আপনার ছেলেবেলার গল্প শুনতে চাই।

আমার জন্ম ১৯২৯ সালে কুমিল্লায়। জন্মের পর থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত গ্রামেই ছিলাম। মাত্র দেড় বছর বয়সে আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন মেঘনার নৌকাডুবিতে। গ্রামের পাঠশালায় পড়াশোনার শুরু, সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি। বড় ভাই তখন নড়াইলে, ডিস্ট্রিক বোর্ডে চাকরি করতেন। উনি চাইলেন সবাই একসঙ্গে থাকতে। সে উদ্দেশ্যে '৩৭ সালের মে অথবা জুন মাসে আমরা নড়াইলে চলে গেলাম। নারায়ণগঞ্জ থেকে 'ভৈরব' নামে একটি ইস্টিমার চলত। মালবাহী এবং অনিয়মিত এই স্টিমারটি আসত সিলেট থেকে। তাতে যাত্রীও তুলত। কাঠের তৈরি চমৎকার বিশ্রামাগার ছিল। ভৈরব ইস্টিমারে চেপে নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ, তারপর রাজবাড়ী থেকে ট্রেনে ফরিদপুরের ভাটিয়াপাড়া ঘাট। এরপর মধুমতি পার হয়ে নড়াইল। চিত্রা নদীর পাড়ের শহরটিতে আমার স্কুলজীবন কেটেছে।

কৈশোরে আপনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, কেন?

কৈশোরে আমি ভাবুক প্রকৃতির ছিলাম। প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে ভালো লাগত। স্কুলজীবনে পড়াশোনা ও প্রগতিশীল রাজনীতি আমাকে আকর্ষণ করে। কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশিত 'ভগত সিং ও তার সহকর্মীরা' নামে একটি পুস্তিকার কথা আজও মনে পড়ে। বইটি পড়ে খুব অভিভূত হয়েছিলাম। স্বাধীনতা আন্দোলনও আমার মাথায় ঢুকেছিল বেশ ভালো করেই। ওই সময় কাজী নজরুলের লেখা গান ও কবিতা আমাকে ভীষণ আড়োলিত করে। এজন্য নজরুল আমার প্রিয় কবি। ১৯৪৫ এ সেই কৈশোরে নজরুলের 'অগি্নবীণা' বইটি কলকাতার ডিএম লাইব্রেরি থেকে ভিপিপি করে আনিয়েছিলাম। বইটি এখনো আমার কাছে আছে। আমার জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মূল কারণ নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ও কাজী নজরুল ইসলাম। সুভাষ বসুর স্বদেশ চেতনা, স্বাধীনতার স্পৃহা আমাকে মুগ্ধ করে। এই দুজন আমার কৈশোরে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নড়াইল মহকুমা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছিলাম।

ওই সময় তো কমিউনিস্টরা একটু জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল?

১৯৩৯ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো, '৪১ এ এসে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করল। পরিপ্রেক্ষিতটা পাল্টে গেল। কমিউনিস্টদের জেল থেকে মুক্ত করে দেওয়া হলো। আগে স্লোগান ছিল 'না এক পাই না এক ভাই'। মানে যুদ্ধে যোগ না দেওয়ার পক্ষে। কিন্তু জনযুদ্ধের ফলে কমিউনিস্টরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। নড়াইল শহরের আশপাশে গিয়ে দেখেছি, সাধারণ মানুষ বলছে কমিউনিস্টরা ব্রিটিশের দালাল। বিষয়টি এখন স্পষ্ট বুঝতে পারি, ওই সময় কমিউনিস্টদের রণনীতি ভুল ছিল। সম্প্রতি অনিন্দ প্রকাশ থেকে আমার একটি বই বেরিয়েছে, 'দেশ বিভাগ : ফিরে দেখা'। বইটি রচনা করতে গিয়ে আমি লক্ষ্য করেছি, দেশ বিভাগের সময় লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পাঞ্জাব থেকে আরম্ভ করে বাংলাদেশ পর্যন্ত কোটি মানুষ শরণার্থী হয়েছে। তাদের দাবি ছিল ভারতীয় মুসলমানদের জন্য আলাদা বাসস্থান। অথচ সাড়ে তিন কোটি ভারতীয় মুসলমানকে পেছনে ফেলে রেখে আসা হলো। এ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

নড়াইল থেকে মুন্সীগঞ্জ চলে গেলেন কেন?

ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পরে আমি মুন্সীগঞ্জ সেজো চাচার বাসায় চলে যাই। সেজো চাচা সেখানেই চাকরি করতেন। আমি তার বাড়িতে থেকে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে আইএসসিতে ভর্তি হই। কলেজটিও বেশ নামিদামি। সাহিত্য সমালোচক, প্রাবন্ধিক অরবিন্দ পোদ্দার ছিলেন আমাদের কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক। ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। প্রতিদিন বিকালে তার সঙ্গে হাঁটতে যেতাম। সাহিত্য নিয়ে কথা হতো। তখন রাজনীতিবিদ অজয় রায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি আমার এক বছর সিনিয়র, কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। সেজো চাচার মেজো ছেলে একেএন আহমদ (বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বিতীয় গভর্নর) তার ডাকনাম ছিল সেলিম। তিনি বয়সে আমার পাঁচ বছরের বড়। তাকে সেলিম দা বলে ডাকতাম। তার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে 'সোভিয়েত কমিউনিজম', 'ইলিওশন অ্যান্ড রিয়ালিটি'সহ বিভিন্ন মার্কসবাদী বই পড়ি। ফলে আমার জীবনে একটা পরিবর্তন আসে। সারাক্ষণ পড়াশোনার মধ্যে ডুবে থাকতাম। ১৯৪৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আইএসসি পরীক্ষা দিয়ে মেধা তালিকায় স্থানসহ প্রথম বিভাগে পাস করি। এরপর চলে আসি ঢাকায়। ঢাকায় আমাদের কোনো আত্দীয়-স্বজন নেই। ঢাকা ছিল ছোট শহর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি বিভাগে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম। ফরম ফিল-আপও করেছিলাম, অনাবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হতে হবে জেনে পরে ভর্তি হয়েছিলাম ঢাকা মেডিকেলে। প্রথম কিছুদিন বাইরে ছিলাম, পরে মেডিকেলের প্রথম যে বাঁশের বেড়ার হোস্টেল হলো সেখানে উঠেছিলাম। তখন খুব মেধাবী ছাত্র মেডিকেলে ভর্তি হতো। ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র থাকাকালে আমি বাম রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম।

ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় আপনি ভাষা আন্দোলনে জড়িত হয়েছিলেন?

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস। তখন স্লোগান তোলা হয় 'ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়'। আমরা ভেবেছিলাম, বিপ্লব আসন্ন, সমাজ পরিবর্তন ঘটবে। সুতরাং সমাজ পরিবর্তনের জন্য কাজ করা একটা সামাজিক দায়। তখন আমার পড়াশোনার ঝোঁকের চেয়ে রাজনৈতিক তৎপরতা বেড়ে যায়। সেই ধারাবাহিকতায় আমার ভাষা অন্দোলনে যোগ দেওয়া। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের ২৭ জানুয়ারির ভাষণ থেকে শুরু করে ছাত্রসমাজের প্রতিটি সভায় আমি ছিলাম। পরবর্তীতে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে যে আন্দোলন শুরু হলো তার প্রতিটি মিছিলে যোগ দিয়েছি। এ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দুটো দিক- ১৪৪ ধারা ভাঙা ও পুলিশের গুলিবর্ষণে রফিক-বরকত-জব্বার প্রমুখের শাহাদাতবরণ; যে কারণে আন্দোলনে প্রবল তীব্রতা দেশব্যাপী ছড়িয়ে যায়।

ভাষা আন্দোলনের চরিত্রটা ঠিক কী ধরনের ছিল?

ভাষা আন্দোলনের চরিত্রটি ছিল সর্বদলীয়। কমিউনিস্ট, জাতীয়তাবাদী বা ইসলামপন্থি, সবাই একই ছাতার নিচে চলে এসেছিল। এটা না হলে মাদ্রাসার ছাত্র লোকমান মোহম্মদ আমিনী বলতে পারত না একুশ তারিখ তার পাশে কীভাবে একজন গুলিবিদ্ধ হলো। আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল এর স্বতঃস্ফূর্ততা আর সাধারণ ছাত্ররা এর নায়ক, রাজনৈতিক বা যুব ছাত্রনেতারা নন। তার একটা উদাহরণই দেই যখন আমতলার মিটিং শেষে সবাই মেডিকেল হোস্টেলে জমায়েত হলো, মিছিল-স্লোগান দিয়ে অ্যাসেম্বলির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাসের জন্য পারছিল না, তখন কিন্তু এই সমাবেশ পরিচালনায় জন্য কোনো নেতা ছিলেন না। অলি আহাদ, আবদুল মতিন, জাহেদি কেউ না। তার প্রমাণ হলো অলি আহাদের 'জাতীয় রাজনীতি' পড়লে দেখবেন, গুলি চলার কথা শুনে আমরা দৌড়ে গেলাম। এর অর্থ তারা মধুর ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিলেন। অর্থাৎ সমাবেশে নেতৃত্ব দিতে তারা কেউ ছিলেন না। কাজেই এ আন্দোলন যেমন ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত, একইভাবে সাধারণ ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত এবং তা দেশজুড়ে চলেছে। এ রকম আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই। ১৯৫২-এর ২০ ফেব্রুয়ারি বিকালবেলা আমরা দেখলাম সেক্রেটারিয়েট রোড ধরে মাইক্রোফোন লাগানো একটি ঘোড়ার গাড়ি আসছে, তাতে ঘোষণা করা হচ্ছে ঢাকায় এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি, সভা সমিতি নিষিদ্ধ ইত্যাদি। আমার এখনো মনে আছে, ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে নবাবপুরে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভা হয়েছিল। রাজনীতিবিদরা চাচ্ছিলেন না ১৪৪ ধারা ভাঙা হোক। তখন পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ঠিক ওই মুহূর্তে সরকারের সঙ্গে সংঘাতে গেলে নির্বাচন পিছিয়ে যাবে। কাজেই তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য তারা ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বললেন_ অলি আহাদ, আবদুল মতিন ও গোলাম মাওলা। তাদের চাপাচাপিতে ওই সভার সভাপতি আবুল হাশিম রাজি হলেন, 'ঠিক আছে, কাল একুশ তারিখ ছাত্রসভায় যে সিদ্ধান্ত হবে; কিন্তু যদি এর বিপরীত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তবে সংগ্রাম পরিষদ বিলুপ্ত হবে।' বিলুপ্ত করার ক্ষমতা তার ছিল না, কারণ এটা ৩১ জানুয়ারি কর্মিসভায় তৈরি হয়েছিল। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। মিটিং চলাকালীন রাত ৮টার পর ফজলুল হক, ঢাকা হলে কী হচ্ছে তা জানার জন্য আমার বন্ধু গাজীউল হক, আনোয়ারুল হক খান, সায়ীদ আতিকুল্লাহদের সঙ্গে আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে। তাদের সঙ্গে দেখা করার পর আমি হোস্টেলে ফিরে দেখি (২০ নম্বর ব্যারাকের ৬ নম্বর রুম) তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড নেতা শহীদুল্লাহ কায়সার আমার রুমে পায়চারি করছেন। তার সঙ্গে আমার কথা হলো। কমিউনিস্ট পার্টিও সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছিল। পরদিন সকালবেলা গাজীউল হকের সভাপতিত্ব্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ, নবকুমার ইনস্টিটিউট, কামরুন্নেসা স্কুল, ইডেন কলেজসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সমবেত হয়েছিলেন। সাধারণ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙেছিল। প্রথম ১৪৪ ধারা ভেঙেছিল সদ্য প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তাকেসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল সবাই পুলিশের হাতে ধরা দেব না, কারণ সবাই জেলে গেলে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। আমি বলি, ওইদিন ১৪৪ ধারা না ভাঙলে একুশ হতো না, একইসঙ্গে গুলি না চললে একুশ হতো না।

বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতে দেরি হলো কেন?

তৎকালীন সরকার অনড় ছিল, তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হতে দেবে না। ১৯৫৩ সালে আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, শহীদ দিবসের মতো এত বড় মিছিল আর কখনো দেখিনি। আমার চোখে এখনো ভাসে, মানুষের মিছিল যেন সমুদ্রের জলস্রোত। মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে নবাবপুর, রথখোলা, পাটুয়াটুলি, ইসলামপুর, উর্দু রোড, আজাদ অফিস ঘুরে পরে বিকালে আরমানিটোলায় জনসভা হয়। এ জনসভায়ও প্রচুর লোক উপস্থিত ছিল। মেয়েরা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিচ্ছিল। আন্দোলন যখন চাঙ্গা তখন কিছু রাজনৈতিক নেতার আনাগোনা বেড়ে গেল। তবে মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি গোলাম মাওলাকে অস্থায়ী আহ্বায়ক করে নতুন করে সর্বদলীয় কমিটির তৎপরতা শুরু করা হয়। এ আন্দোলন ঢাকায় চলে ৫ মার্চ পর্যন্ত। চলে দেশের সর্বত্র। ২২ ফেব্রুয়ারির মিছিলে স্লোগান ওঠে 'শহীদ স্মৃতি অমর হোক'- সে প্রেরণায় মেডিকেল হোস্টেলের রাজনীতিমনস্ক ছাত্ররা ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের শ্রমে ছোটখাট একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করে। নকশা অাঁকেন বদরুল আলম। আর ঠিকাদার পিয়ারু সরদারের ইট, বালি, সিমেন্ট নিয়ে সেটা তৈরি। এটি হয়ে দাঁড়ায় আন্দোলনের নতুন প্রেরণা। তাই ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকালে পুলিশ সেটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।

পরে ১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল নতুন করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ গঠিত হয়। আতাউর রহমান খান এর আহ্বায়ক। এর ফলে রাজনৈতিক নেতারা চলে এলেন সামনের সারিতে। তারা অবশ্য কাজও করেছেন পরে। এরপর সরকার নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য বিচারপতি এলিসকে নিয়ে একটি কমিশন গঠন করে। দেখা গেল মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে আমার পাশের রুমে থাকত ব্রিগেডিয়ার আবদুল মালিক। সে সহ আরও চার-পাঁচজনকে ডাকা হয় কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে। আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কাউকে ডাকা হয়নি। এলিস সাহেব মনগড়া প্রতিবেদনে সরকারের সাফাই গাইলেন। ইত্তেফাকসহ বেশ কিছু পত্রিকা এলিসের রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করল। এরপর ১৯৫৬ সালে এসে বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেল।

আপনার যাবতীয় কাজের প্রেরণা কোথায় পান?

বোধহয় ছোটবেলা থেকে সাহিত্য পাঠই আমার প্রেরণা। আমি নড়াইল স্কুলে নবম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুলের লাইব্রেরিটা খুব সমৃদ্ধ ছিল। ওই সময় আমি 'সিলেক্টেড পয়েমস অব শেলি অ্যান্ড ওমর খৈয়াম' লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়েছিলাম। একজন শিক্ষক আমাকে বইটি দিতে চাননি। ভাবছিলেন ওই বয়সে আমি এই বই পড়ে কী করব? পরে অন্য একজন শিক্ষক বললেন_ দিয়ে দাও, দিয়ে দাও। এরপর উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া অবস্থায় পড়েছি বিদেশি সাহিত্যের বিভিন্ন বই। পড়াশোনার একটা জগৎ আমার ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হয়, সেটাই আমাকে লেখালেখির ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

আপনি চিকিৎসা পেশার সঙ্গে যুক্ত না থেকে সাহিত্যিক ও রবীন্দ্র গবেষক হয়ে উঠলেন কীভাবে?

ছোটবেলায় পিতৃহীন হওয়ায় বড় ভাই ছিলেন আমার অভিভাবক। তার ইচ্ছাকে আমি গুরুত্ব দিয়েছি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৬ সালে। আমি চতুর্থ ব্যাচের ছাত্র। তখন চিকিৎসা বা সিভিল সার্ভিস পেশার বেশ কদর ছিল। সে জন্যই মেডিকেল কলেজে ভর্তি।

তবে আমি শিল্প ব্যবস্থাপনা ও লেখালেখিতে মন দিলাম। আমি যদি ১৯৪৭ সাল থেকেই ধরি তাহলে বলব, রবীন্দ্রচর্চার দিকটাই বেশি ছিল। আমি আমার শুরু থেকে যুক্তিহীন ভক্তির

চেয়ে যুক্তি দিয়ে সব কিছু দেখার চেষ্টা করেছি। আমি ভক্তিবাদের পক্ষে নই। আমাদের দেশে প্রথম দিকে রবীন্দ্রচর্চা ভক্তিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। রবীন্দ্র অনুরাগীর সংখ্যাও তখন কম ছিল না। এদেশে 'রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র' গঠন করলাম। নিয়মিত পত্রিকাও বের করতাম। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আমি চিত্রকলা, নৃতত্ত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করেছি।

অবসর কীভাবে কাটে?

অবসর নেই। এক সময় গান শোনা ও টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখার অভ্যাস ছিল। এখন বই পড়া ও লেখার জগৎ সব গ্রাস করে নিয়েছে। মৃত্যুর আগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লেখার কাজ শেষ করে যেতে চাই।

পঞ্চাশের দশকে সমাজ পরিবর্তনের যে স্বপ্ন দেখেছিলাম দুঃখের বিষয় তা আজও সোনার হরিণই রয়ে গেল। হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একদিন এ পরিবর্তন ঘটাবে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে বৈষম্যহীন সমাজ, রাষ্ট্র হবে গণতান্ত্রিক ও সেকুলার।

 

সর্বশেষ খবর