শিরোনাম
বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৪ ০০:০০ টা

জেল-জীবন

জেল-জীবন

গণমানুষের কবি, সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন হাজার রকম বৈচিত্র্যে ভরা। তার জীবনের নানা অংশজুড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর গণমানুষের অধিকার আদায়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ তখন ইংরেজদের কুশাসনের দাবানলে পুড়ছিল। আর তাই কবি কাজী নজরুল ইসলামের সবচেয়ে বড় বৈরী পক্ষ ছিল ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী। সঙ্গত কারণেই ব্রিটিশদের সইতে পারতেন না নজরুল। অন্যায়ের বিপক্ষে-সত্যের পক্ষে ও শোষিত মানুষের জন্য কথা বলতে গিয়ে নজরুল ব্রিটিশ শাসকের রোষানলে পড়ে জেল পর্যন্ত খেটেছেন। শুধু তাই নয়, নজরুলের লেখার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করে ব্রিটিশ সরকার। কাজী নজরুলের লেখা যুগবাণী, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দুসহ মোট ৫টি গ্রন্থ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। বলা বাহুল্য বাংলা সাহিত্যে সমকালীন অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের এত গ্রন্থ একত্রে কখনো বাজেয়াপ্ত হয়নি। তাই নজরুলের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ রাজরোষের মাত্রা এখান থেকেই অনুমান করা যায়। ১৯২২ সালে নজরুল 'ধূমকেতু' নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। পত্রিকাটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশ পেত। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ধূমকেতুর দ্বাদশ সংখ্যায় 'আনন্দময়ীর আগমন' নামক একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটি ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ফলে এই কবিতায় নজরুলের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম রাজদ্রোহের মামলা হয়। একই বছরের ৮ নভেম্বর রাজদ্রোহের অপরাধে নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত নজরুলের বিচার হয়েছিল কলকাতার আলীপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। পরবর্তীতে এই মামলার রায়ে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। রায় ঘোষণার পরের দিন তাকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আগে থেকেই নজরুলের কাব্য চেতনা আর সৃষ্টিশীল দ্রোহের সঙ্গে পরিচিত ছিল সাধারণ মানুষ। এবার কারাবরণ করে নজরুল সমগ্র দেশবাসীর কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠেন। এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার 'বসন্ত' নাটকটি কবির নামে উৎসর্গ করেন। দিনটি ছিল ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি। এদিকে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল নজরুলকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে হুগলি জেলে স্থানান্তর করা হয়। আলীপুরে নজরুল ছিলেন বিশেষ শ্রেণির কয়েদি। কিন্তু হুগলিতে স্থানান্তরের পর নজরুলকে বিশেষ শ্রেণির কয়েদির মর্যাদার পরিবর্তে সাধারণ শ্রেণির কয়েদির অবস্থানে নামিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় নজরুল তার বিখ্যাত 'শিকল পরার গান' জেলে বসেই রচনা করেন। জেলখানার ভিতর অকথ্য নির্যাতন আর বৈষম্যের শিকার হয়ে নজরুল এখানেও বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। শুরু করলেন আন্দোলন। আন্দোলনের সূত্র জেলখানায় পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি, ভাতের বদলে মাড় ভাত ও রাজবন্দীদের নির্যাতনের প্রতিবাদ। এসব বন্ধের দাবিতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল হুগলি জেলে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। দিনের পর দিন তিনি অনশন চালিয়ে যেতে থাকেন। সে সময়কার কবির জেলজীবন সম্পর্কে খুব পরিষ্কার ধারণা পাওয়া না গেলেও নজরুলের জেলজীবনের করুণ মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরে কলকাতার আনন্দবাজার ও দেশ পত্রিকা। সেখানে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত একাধিক বিশ্লেষণী লেখায় নজরুলের সেই সময়কার অনশন সঙ্গীদের ভাষ্যে ফুটে ওঠে নজরুলের জেলজীবন। হুগলি জেলে কবি নজরুলের সঙ্গে মৌলভী সিরাজউদ্দীন এবং বাবু গোপাল চন্দ্র সেনও অনশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এভাবে নজরুল একটানা অনশন করে যান ৩৯ দিন। আশপাশের শুভাকাঙ্ক্ষী ও সাধারণ মানুষ নজরুলের পরিণতির কথা চিন্তা করে অাঁতকে উঠলেও নজরুল তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অবিচল। সেই সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং নজরুলকে চিঠি লিখে অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলং থেকে এ বিষয়ে তাকে টেলিগ্রাম পাঠান। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- 'খরাব‘Live up hunger strike. Our Literature claims you.’ কিন্তু টেলিগ্রামটি নজরুলের হাতে পৌঁছায়নি। জেল কর্তৃপক্ষ 'অফফৎবংং রং হড়ঃ ভড়ঁহফ' লিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে টেলিগ্রামটি ফেরত পাঠায়। জেল কর্তৃপক্ষ প্রকৃত ঠিকানা জানলেও ইচ্ছা করেই টেলিগ্রামটি নজরুলের কাছে না পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ফেরত পাঠায়।

রবীন্দ্রনাথ এ ঘটনায় দারুণ মর্মাহত হন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও নজরুলের অনশনে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি শিবপুর থেকে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মে হুগলি জেলে গিয়ে নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা ও অনীহার কারণে তিনি দেখা করতে পারেননি। ফলে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি হতাশ হতে হয়েছিল তাকে। চুরুলিয়া থেকে নজরুলের মা জাহেদা খাতুনও নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে ব্যর্থ হন। এসব সংবাদ খুব দ্রুতই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সমগ্র দেশবাসী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। অতঃপর শেষ পর্যন্ত অনশনের ৩৯ দিন পর কুমিল্লার মাতৃসম বিরজা সুন্দরী দেবীর অনুরোধে তারই হাতে লেবুর রস পান করে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন। তিনি ছিলেন কখনো রাজনীতিবিদ, কখনো কবি, ব্রিটিশদের কাছে তিনি ছিলেন এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। বার বার কারাভোগ করেছেন, নির্যাতিত হলেও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি, পিছিয়ে আসেননি কখনই। লড়াই চালিয়ে গেছেন সারা জীবন।

 

 

সর্বশেষ খবর