বুধবার, ৬ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

উত্তাল সমুদ্রে মৃত্যুযাত্রা

উত্তাল সমুদ্রে মৃত্যুযাত্রা

অবৈধভাবে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার যাত্রায় বছরের পর বছর ধরে হাজারো মানুষ প্রাণ দিচ্ছে ভয়ঙ্কর যাত্রা পথে। দেশের সীমান্তবর্তী কয়েকটি এলাকা কক্সবাজার থেকে রওনা হওয়া এ মানুষগুলোর স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে সমুদ্রে ডুবে গিয়ে নয়তো প্রতারক দালালদের হাতে বন্দী থেকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে। তবু থেমে থাকে না অবৈধ পথে বিদেশযাত্রা। বঙ্গোপসাগর পথে বাহন তাদের সাধারণ ট্রলার কিংবা কার্গো বোট। এভাবে সমুদ্রে মালয়েশিয়ায় পৌঁছতে সময় লাগ ৭ দিন ৭ রাত। স্বপ্ন বুকে অবৈধ পথে যাত্রা করা মানুষগুলোকে বুঝানো হয় ওই সময়টা কোনোভাবে পার করতে পারলেই হলো, তারপর মালয়েশিয়া কিংবা থাইল্যান্ড। সেখানে গেলেই মিলবে অনেক বেতনের চাকরি। জীবন বদলে নেওয়ার এই সুযোগ পেতে ট্রলারে চেপে বসে মানুষগুলো। ঘুণাক্ষরেও টের পায় না তারা উত্তাল সমুদ্রের বুকে হারিয়ে যেতে বসেছে। নিজের জীবনকে এক অনিশ্চয়তার হাতে তুলে দিয়ে অবৈধভাবে সাগর পথে পাড়ি দিয়ে অজানায় হারিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি দেওয়া সাগর পথের এসব যাত্রীর বেশির ভাগেরই সলিল সমাধি ঘটে সেই উত্তাল সাগরেই। অনেকে বন্দী হয় বাংলাদেশি বা ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে আটক হয়। তারপর কারাবাস। মাসের পর মাস বিভিন্ন দেশের কারাগারে তাদের বন্দী থাকতে হয়। অনেকে সমুদ্র আর পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পৌঁছে যায় থাইল্যান্ড সীমান্তে। সেখানে গেলেই চোখ ফোটে তাদের। সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে দালালরা তাদের নিয়ে বন্দী রাখে গহীন অরণ্যে। জঙ্গলের ভিতরে তাঁবু গেঁড়ে শত শত মানুষের ওপর শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। খেতে দেওয়া হয় না। একবেলা খেতে দিলে আরেকবেলা দেয় না। যে কাপড়ে এসেছে সে কাপড়েই থাকতে হয় মাসের পর মাস। পরিবারের সঙ্গে যোগযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। কপাল পোড়া এই মানুষগুলো ভাগ্যে এরপর নৃশংস মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই লেখা থাকে না। এই পরিচিত ঘটনাগুলো বারবার ঘটছে বাংলাদেশের সীমান্ত উপকূল দিয়ে বাংলাদেশি, মিয়ানমারের অধিবাসীদের যারা অবৈধ পথে চলছিল সমুদ্রপথে। প্রতি বছরই চলছে মালয়েশিয়া নয়, থাইল্যান্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়া যাত্রা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সেখানে যাচ্ছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। ভালো উপার্জনের আশায় এসব লোকজন বিক্রি করে দিচ্ছেন ঘরবাড়ি, জমিজমা। টাকা তুলে দিচ্ছেন দালালদের হাতে। আর এ কাজটি করতে গিয়ে গরিব, দিনমজুর, মধ্যবিত্ত মানুষ মোকাবিলা করছেন সাগরের উত্তাল ঢেউ। প্রবল বৃষ্টি। ভয়ঙ্কর প্রাণী। বেশির ভাগই ধরা পড়ছেন কোস্টগার্ডের হাতে। জেল খাটতে হয়। অনেকে পালিয়ে বেড়ান। পথে পথে ঘুমান। না খেয়ে পার করছেন দিন। আর যারা অর্ধাহারে-অনাহারে ওইসব দেশে পৌঁছেন তাদেরও শান্তি নেই। স্বল্প খরচে বিদেশ পাড়ি দিয়ে এসব লোকজনকে করতে হয় মানবেতর জীবনযাপন। হাজারো স্বপ্ন নিয়ে দালালদের হাতে সবকিছু তুলে দিয়ে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হলেও ধরা পড়ে না মানবপাচারের কাজে জড়িত মূল হোতারা।

তারা থেকে যায় আড়ালে। বাংলাদেশ, ভারতের মানব পাচার চক্রের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ায় থাকা চক্র। মানব পাচারের জন্য গোপন রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে কক্সবাজার জেলার টেকনাফের সমুদ্র রুটটি।

সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার জন্য একজন লোকের কাছ থেকে নেওয়া হয় ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। বলা হয় সেখানে গিয়ে বাকি টাকা দেওয়ার। এ কাজটির জন্য তারা স্থানীয়ভাবে খোঁজ করে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা আদম পাচারকারীদের। স্থানীয় এজেন্টদের মধ্যে থাকে সিন্ডিকেট। সেখান থেকেই যোগাযোগ করা হয় পাচারকারীদের। একটি ট্রলারে ১১০-১৪০ জন পর্যন্ত লোক নেওয়া যায়। এদের শুকনো খাবার হিসেবে দেওয়া হয় গুড় ও চিড়া। ৭ দিনের হিসাবে ১০ বস্তা চাল, ২০ কেজি শুঁটকি ও ২ মণ আলু থাকে। এই ৭ দিনে শুধু সাত বেলা ভাত দেওয়া হয়। ট্রলারে ২ হাজার লিটার তেল লাগে। থাইল্যান্ড সীমান্ত গিয়ে সেখানে দালাল চক্রের কিছু সদস্য রয়েছে। তারা থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়া সীমান্ত পারাপার করতে জনপ্রতি ৭০-৮০ হাজার টাকা নেয়।

অবৈধ পথে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে আসা শ্রমিকরা দিনের বেলায় কাজ করে নিজের বাসায় ফিরতে পারে না। তাই তারা সে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পাহাড়ে রাত কাটান। তবে সেখানে পৌঁছার পর থাইল্যান্ডের নৌ ও কোস্টগার্ড বাহিনীর হাতে আটক হন অনেকে। মানুষ পাচারের এ কাজে জড়িত রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। লোক পাঠানোর কাজে বহু সিন্ডিকেট পৃথকভাবে কাজ করছে। এসব সিন্ডিকেটের মধ্যে বাংলাদেশিরা যেমন থাকেন, তেমনি থাকেন মিয়ানমারের রোহিঙ্গারাও। দালালদের কাছে নিঃস্ব হয়ে ভারতের আন্দামান দ্বীপ ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন কারাগারে মানবেতর দিন কাটাতে হয় অসংখ্য হতভাগ্য মানুষকে।

মানবপাচার রোধ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে মানবপাচার প্রতিরোধে সবার আগে দরকার সচেতনতা।

 

সর্বশেষ খবর