শুক্রবার, ৮ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

রবীন্দ্রনাথের প্রেমিকারা

নুসরাত সুলতানা

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সত্যিকার অর্থেই ছিলেন প্রেমিকজন। তার নারীভক্ত ও অনুরাগীর সংখ্যা ছিল অসংখ্য। তাদের মধ্যে তিনজনের কথা এখানে তুলে ধরা হলো।

কাদম্বরী দেবী : রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কাদম্ব্বরী দেবীর বিয়ে হয় ৫ জুলাই ১৮৬৮ সালে। তখন কাদম্ব্বরী দেবীর বয়স ৯ বছর। জ্যোতি ঠাকুর নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার ফলে কাদম্ব্বরী তাকে খুব একটা কাছে পেতেন না। অন্যদিকে কাদম্বরী দেবীর বিয়ের সময় রবির বয়স ছিল সাত বছর। প্রায় সমবয়সী রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কাদম্ব্বরী দেবীর খেলার সাথী। রবীন্দ্রনাথের ২২ বছর বয়সে হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিতভাবেই বিয়ে হয় ১১ বছর বয়সী ভবতারিনী দেবীর সঙ্গে, ৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩ সালে। এই বিয়ের চার মাস কয়েকদিন পর কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার কারণ জানা থাকলেও তা প্রকাশ্যে আসেনি। কাদম্ব্বরীর অকালমৃত্যু কবির মনে গভীর শোকের ছায়া রেখে যান। রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাষাতেই তা চিঠি, গান বা কবিতার মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে পরোক্ষভাবে ব্যক্ত করেছেন। জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন- 'আমার ২৪ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে।' কাদম্বরী দেবীর অপ্রত্যাশিত মৃত্যু সম্পর্কে অনেকে ধারণা করেন তাদের গভীর কোনো সম্পর্ক ছিল। কাদম্ব্বরী দেবীর মৃত্যুর চার বছর পর কবি লিখেছিলেন- 'তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে' গানটি।

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো : রবীন্দ্রনাথের বন্ধু ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর জন্ম ৭ এপ্রিল ১৮৯০ আর্জেন্টিনার বুযেন্স আয়ার্সে। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল তৎকালীন অভিজাত পরিবারের রীতি অনুযায়ী স্বগৃহে এক পরিচারিকার কাছে। শৈশবে তিনি ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেননি। কৈশোরে ওকাম্পো অভিনেত্রী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের অনুমতি পাননি। তবে পরিণতি বয়সে ওকাম্পো একজন লেকক, সম্পাদক ও নারীনেত্রী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। ওকাম্পোর লেখালেখির সূচনা হয়েছিল দান্তের 'দ্য ডিভাইন কমেডি'র ওপর একটি সমালোচনা পড়ে। নিয়মিত লেখালেখি করতেন বিভিন্ন পত্রিকায়। ১৯১২ সালে তার বিয়ে হয়। কিন্তু দেবরের সঙ্গে গভীর প্রেম জড়িয়ে পড়ায় মাত্র আট বছরের মাথায় দাম্পত্যে বিচ্ছেদ ঘটে। তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। ওকাম্পো ২৯ বছরের জ্যেষ্ঠ কবির অপার স্নেহ ও নৈকট্য লাভের আশায় ব্যাকুল হয়ে পড়েন। কিন্তু তাদের দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। দেখা হওয়ার সুযোগ হয় ১৯২৪ সালে। ওই বছর পেরু এবং মেক্সিকাে ভ্রমণের পথে অসুস্থ হয়ে পড়লে রবীন্দ্রনাথ আর্জেন্টিনায় যাত্রা বিরতি নেন। ওই সময় কবি সান ইসিদ্রোতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথ্য গ্রহণ করেন। ওকাম্পোর বাড়িতে কবি প্রায় দুই মাস অবস্থান করেছিলেন। কবি তাকে 'বিজয়া' ডাকতেন। বিজয়ার সান্নিধ্যে শুরু হয়েছিল 'পূরবী' কাব্যের প্রস্তুতি। এ সময় তিনি পূরবীর ৩০টি কবিতা রচনা করেছিলেন। ১৯২৫ সালে যখন 'পূরবী' কাব্য বই হিসেবে মুদ্রিত হয় তখন সেটি বিজয়াকেই উৎসর্গ করা হয়। উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল-'বিজয়ার করকমেল'।

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল ১৯৩০ সালে প্যারিসে। ওই সময় তার উদ্যোগে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের একক চিত্রকলার প্রদর্শনী হয়। এ সময়টা কবি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে উল্লেখ করেন। ওকাম্পোর সঙ্গে প্রথম দেখাতেই দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ওকাম্পো এবং রবিঠাকুরের বিভিন্ন লেখায়। প্রথম কবির সান্নিধ্য পেয়ে উচ্ছ্বসিত ওকাম্পো এক চিঠিতে লিখেছিলেন- 'এই সান্নিধ্যের সময়ে, আমি আপনার নৈকট্য পেয়ে আনন্দিত ছিলাম, আর আপনি যে সান্নিধ্যকে ঠেকিয়ে রেখেছেন দূরে, এই বেদনায় আমি কষ্ট পেয়েছি।'

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্যারিসে ইউনেস্কোর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। ১৯৪৬-এ নুরেমবার্গ ট্রায়ারে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৫৩-তে আর্জেন্টিনার শাসক পেরনের প্রকাশ্য বিরোধিতার জন্য কারাবাসে ছিলেন ওকাম্পো। ১৯৬৩-তে তার মুখগহ্বরে ক্যান্সার ধরা পড়ে। তাতে মোটেও দমে যাননি তিনি। ১৯৬৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছিলেন। ওই বছর তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধি পান। তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনা একাডেমি অব লেটারসের প্রথম নারী সদস্য। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর লেখা প্রথম বই প্রকাশ হয় ১৯২৩ সালে ফ্রেঞ্চ ভাষায়। বইয়ের নাম 'ডি ফ্রাসিসকা'। তার আরও ১০টি বইয়ের একটি সিরিজ বের হয়; যা 'টেসটি মোনিস' নামে খ্যাত। ১৯৩১-এ তিনি 'সুর' নামে একটি ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছিলেন। এই ম্যাগাজিনটি ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যে বিপুল প্রভাব ফেলেছিল। বিখ্যাত লেখকরা এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ওকাম্পো বাংলাদেশের সমর্থনে আর্জেন্টিনায় জনমত সৃষ্টিতে অনন্য অবদান রাখেন। তার নেতৃত্বে ১৯৭১-এর ১১ জুন আর্জেন্টিনার প্রগতিশীল লেখক শিল্পী প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে সাহায্য প্রেরণের জন্য দাবি উত্থাপন করেন। এই মহীয়সী নারী ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৯ সালে দেহত্যাগ করেন।

তোমি কোরা : বিদুষী জাপানি নারী তোমি কোরা আজীবন কবিগুরুর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। মাদাম তোমি কোরা ছিলেন তার সময়কার শীর্ষস্থানীয় নারীনেত্রী। শিক্ষাবিদ হিসেবেও তিনি ছিলেন সুনামের অধিকারী। জাপানের পার্লামেন্ট ডায়েটে তিনি দুবার নির্বাচিত হন। জাপানের প্রথম নারী শিক্ষার্থী হিসেবে মনস্তত্ত্ব বিষয়ে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

রবীন্দ্রনাথ তার নোবেল পুরস্কার লাভের তিন বছর পর জাপান সফর করেন। তোমি কোরা তখন ২০ বছর বয়সের তরুণী। কবিগুরুর কথা তিনি প্রথম শোনেন তার শিক্ষক ড. নারুসেই জিনজোর কাছে। শ্রেণিকক্ষে জাপানের এই খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কথা বলেন তার শিক্ষার্থীদের। তিনি যে শুধু বিশ্বসেরা কবি নন, ঋষিতুল্য ব্যক্তিত্ব- এ তথ্যও তোমি কোরা জানতে পারেন তার প্রিয় শিক্ষকের কাছ থেকে।

রবীন্দ্রনাথ জাপান সফর করেন তার জীবনের এক দুঃসময়ে। বাবা, প্রিয়তমা স্ত্রী ও দুই সন্তানের মৃত্যুশোকে আক্রান্ত অবস্থায়। জাপানের প্রথম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নারুসেই জিনজো ছিলেন সুনামের অধিকারী।

জাপানের পার্লামেন্ট ডায়েটে তিনি দুবার নির্বাচিত হন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতাকালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তোমি কোরার পরিচয়। কবি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকালে তার কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে ছাত্রীদের শোনাতেন। ইংরেজি না জানায় বেশিরভাগ ছাত্রীর তা বোঝার উপায় ছিল না। কিন্তু তোমি কোরা যেহেতু ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন সেহেতু তিনি কবিতাগুলো তার নোটবইয়ে লিখে নিতেন। সেগুলো জাপানি ভাষায় অনুবাদ করে সহপাঠীদের শোনাতেন। কবির কবিতাসংবলিত 'স্ট্রে বার্ড' বা দিকভ্রান্ত পাখি নামের নোটবইটি তিনি আজীবন মহামূল্যবান সম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করেছেন। কবির সঙ্গে তোমি কোরার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে।

১৯১৯ সালে কবির নিউইয়র্ক সফরকালে আবারও দেখা হয় তোমি কোরার সঙ্গে। তিনি তখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ১৯২৪ সালে তোমি কোরার আমন্ত্রণে কবি তৃতীয়বারের মতো জাপান সফর করেন। এ সফরকালে তোমি কোরা দোভাষীর পাশাপাশি তার বক্তৃতা অনুবাদেও ভূমিকা রাখেন। রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু তার অনুরাগীদের মনে রেখেছিলেন।

 

 

সর্বশেষ খবর