শুক্রবার, ৮ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

জমিদার রবীন্দ্রনাথ

জমিদার রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিজীবনে বৈচিত্র্যের কোনো অভাব নেই। বাংলা সাহিত্যকে দুই হাত ভরে দিয়ে গেছেন তিনি। কবিতা-গান, গদ্য-নাটক সবকিছুতেই ছিল তার সমান পারদর্শিতা। সাহিত্যে নোবেলজয়ী প্রথম বাঙালি রবীন্দ্রনাথের ১৫৪তম জন্মদিন উপলক্ষে আজকের বিশেষ আয়োজন।

রবীন্দ্রনাথের জন্ম ধনী এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারে। পিতামহ প্রিন্স (দ্বারকানাথ ঠাকুর) নামে এবং পিতা মহর্ষী (দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর) নামে খ্যাত। নিজে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, স্বল্পকালের জন্য হলেও ইংরেজ সরকারের নাইট উপাধিধারী। লোকচক্ষে অভিজাতকুলতিলক। কিন্তু তার প্রকৃত পরিচয়টা যে তার নিজের হাতে গড়া সে কথা কম লোকই ভেবে দেখেন। বংশের ধারা রক্ষা করে চলাই যদি অভিলাষ হতো তা হলে জোড়াসাঁকোর প্রাসাদ ছেড়ে গ্রামবাংলার পথে-প্রান্তরে, খাল-বিল-নদী পথে ঘুরতেন না এবং শান্তিনিকেতনের মাটি ও খড়ের ঘরে বাস করতেন না। মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে উপরোল্লিখিত চার জমিদারির দেখাশোনার দায়িত্ব দেন রবীন্দ্রনাথকে। এর পাঁচ বছর পর ১৮৯৬-এর ৮ আগস্ট ওই জমিদারিসমূহের সর্বময় দায়িত্ব দেন (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি)। জমিদারির কাজে তিনি নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। পুরাতন বিধি পরিবর্তন করার বিরুদ্ধে ছিলেন পুরাতন কর্মচারীরা। দুর্বোধ্য কার্যপ্রণালি পদ্ধতির পরিবর্তে তিনি যে নতুন বা সহজ পদ্ধতির প্রবর্তন করেন তা অনুকরণ করার জন্য পার্শ্ববর্তী জমিদাররা তাদের কর্মচারীদের পাঠাতেন তা জানার জন্য।

প্রজাদরদি রবীন্দ্রনাথ কৃষকের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে খুব ভাবতেন। সে সময় সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাংক বলে কোনো ধারণাই ছিল না। তখন তিনি প্রজাদের মিতব্যয়িতা, সংঘবদ্ধ হয়ে কর্ম, এবং সহায়তার অভ্যাস শিক্ষা দেওয়ার জন্য ১৯০৫ সালে পতিসরে কৃষকের জন্য কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। তার ব্যাংক খোলার পর বহু গরিব প্রজা প্রথম সুযোগ পেল ঋণমুক্ত হওয়ার। আশাহীন মানুষের মাঝে ভরসা জোগাতে তিনি বলেছেন- ''সকল দেশেই গরিব বেশি ধনী কম। তাই যদি হয় তাহলে কোন দেশকে বিশেষ করিয়া গরিব বলিব? যে দেশে গরিব ধনী হইবার ভরসা রাখে সে দেশে সেই ভরসাই একটা মস্ত ধন। আমাদের দেশে টাকার অভাব আছে এ কথা বলিলে সবটা বলা হয় না। আসল কথা, আমাদের ভরসার অভাব। তাই যখন আমরা পেটের জ্বালায় মরি তখন কপালের দোষ দিই।''

রবীন্দ্রনাথ জার্মানি ও আয়ারল্যান্ড থেকে সমবায়ের সাফল্যের উদাহরণ গরীবী হটাতে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি তার নোবেল বিজয়ের অর্থ দিয়ে সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন। কৃষির সম্ভাবনা এবং কৃষিকে আধুুনিকায়নের কথা বহু আগেই তিনি ভেবেছিলেন। তাই তিনি তার পুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং তার বন্ধুপুত্র সন্তোষ মজুমদারকে অঙ্ফোর্ডে না পড়িয়ে আমেরিকার ইলিনয়েজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিতে উচ্চশিক্ষা লাভে জন্য পাঠিয়েছিলেন। তিনি তার জামাতা গগন গাঙ্গুলিকে জ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ, পশুপালন সম্পর্কে উন্নত শিক্ষার জন্য বিদেশ পাঠিয়েছিলেন। একজন প্রজাদরদি জমিদার রবীন্দ্রনাথ কবি হিসেবেও জমিদার তিনি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'সম্মানের চির নির্বাসনে সমাজের উচ্চ মঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে- সেখান থেকে সমস্ত দেশটাকে, দেশের মানুষকে আমি দেখতে পাইনি।' তিনি সম্মানের উচ্চ আসনে বসতে যাননি, সম্মানের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তার বিচার করা হয়েছে। বিচারে অভিযুক্ত হয়ে তিনি বিনয়ে বলেছেন- 'তোমরা যাদের চাষি-মজুর বল তাদের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় ছিল না এমন নয়। তবে পরিচয়টা যতটা ঘনিষ্ঠ হতে পারত ততটা তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারিনি। তিনি তাই তো লিখেছেন, 'মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে, ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে।'

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বাঙালি শিক্ষিত সমাজে একটি 'দোনোমোনা' ভাব ছিল, এখনো আছে। তাকে ফেলতেও পারে না, আবার গিলতেও পারে না। এখনো আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজের কাছে নানা কথা শোনা যায়, অথচ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন প্রজাহিতৈষী জমিদার। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে একজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট তার রিপোর্টে বর্ণনা করেন- 'জমিদার মাত্রই যে হৃদয়হীন হন না তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বিশিষ্ট কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।' 'নায়েব কর্মচারীরা যাতে প্রজাদের ওপর কোনো প্রকার জবরদস্তি না করে সেদিকে তার প্রখর দৃষ্টি ছিল।' ফসলহানির কারণে ১৩১২ বঙ্গাব্দে এক বছরে তিনি কৃষকদের উদারভাবে ৫৮ হাজার টাকা খাজনা মাফ করেন। গ্রামের মানুষের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে গ্রামের রাস্তাঘাট সংস্কার করেছেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করেছেন। বিভিন্ন গ্রামে যে স্কুল স্থাপন করেন তার জন্য বছরে বরাদ্দ ছিল সাড়ে বারো শ টাকা। প্রজাদের মধ্যে যারা অন্ধ বা বিকলাঙ্গ এবং যারা উচ্চশিক্ষা নিতে চায় তাদের জন্য মাসিক বৃত্তি নির্ধারণ করে দেন। নদী ভাঙনে, ঝড় কিংবা অগি্নকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের জমিদার রবীন্দ্রনাথ অর্থ সহায়তা দিতেন।

শাহজাদপুরে অবস্থানকালে আগুনে পুড়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত এনায়েতপুর থেকে কয়েকজন গ্রামবাসী এসেছিলেন জমিদার রবীন্দ্রনাথের কাছে। তিনি তৎক্ষণাৎ তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা ও নগদ টাকা প্রদান করেন। প্রজাদের জন্য জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বার ছিল অবারিত। সকাল-সন্ধ্যা-রাত যখন-তখন প্রজারা তার সাক্ষাৎ পেতেন। তিনি লিখেছেন, 'কোনো কোনো দিন দরবারে নাওয়া-খাওয়ার সময় কেটে যেত। তাতেই আমি আনন্দ পেতাম। যতদিন পল্লিগ্রামে ছিলাম ততদিন তাকে তন্ন তন্ন করে জানার চেষ্টা আমার মনে ছিল। কাজের উপলক্ষে এক গ্রাম থেকে আর এক দূর গ্রামে যেতে হয়েছে, শিলাইদহ থেকে পতিসর, নদী-নালা-বিলের মধ্য দিয়ে-তখন গ্রামের বিচিত্র দৃশ্য দেখেছি। তিনি শিলাইদহে গ্রামবাসীদের বয়স্ক শিক্ষারব্যবস্থা করেছিলেন। একজন শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হয়। একটি ঘর উঠানো হয়েছিল গ্রামের মাঝে। সন্ধ্যায় সেখানে গ্রামবাসী বই, পুঁথিপাঠ শুনে জ্ঞান অর্জন করবে এই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু নানা অজুহাতে ছাত্র জুটল না। তবে মুসলমান গ্রামবাসী জমিদারকে অনুরোধ করে 'ওরা যখন স্কুল নিচ্ছে না তখন আমাদের একজন পণ্ডিত দিন আমরা তাকে রাখব। তার বেতন দেব, তাকে খেতে দেব।' ওই স্কুলটি দীর্ঘদিন ছিল। শিলাইদহ কাছারিবাড়ি থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত উঁচু করে রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথ তার 'স্বদেশী সমাজ' প্রবন্ধে লিখেছেন, "সমগ্র দেশ নিয়ে চিন্তা করবার দরকার নেই। আমি একলা ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিতে পারব না। আমি শুধু জয় করব একটি বা দুটি ছোট গ্রাম, এদের মনকে পেতে হবে, এদের সঙ্গে একত্রে কাজ করবার শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। সেটা খুব সহজ নয়, খুব কঠিন কৃচ্ছ্রসাধন। আমি যদি কেবল দুই-তিনটি গ্রামকেও মুক্তি দিতে পারি অজ্ঞতা-অক্ষমতার বন্ধন থেকে, তবে সেখানেই সমগ্র ভারতের একটি ছোট আদর্শ তৈরি হবে।" জমিদারির কাজে বসে রবীন্দ্রনাথ মানুষের নানা সমস্যার সমাধান করতেন আন্তরিকতার সঙ্গে। শাহজাদপুরের মাদলা গ্রামের দরিদ্র জেলের রামগতির খাজনা বকেয়া হওয়ায় জমি নিলামে ওঠার উপক্রম হয়। জেলে রামগতি একটি চিতল মাছ নিয়ে জমিদার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি মাছের দাম পরিশোধ করে দেন এবং রামগতির খাজনাও মওকুফ করে দেন।

* রকমারি প্রতিবেদক

 

 

সর্বশেষ খবর