শুক্রবার, ৮ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের বিশ্বভ্রমণ

বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের বিশ্বভ্রমণ

* জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথ ও আলবার্ট আইনস্টাইন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বাংলা ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। তার জীবনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পর্যটকের ন্যায় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। প্রথম দেশভ্রমণের সুযোগ অবশ্য পেয়েছিলেন ১১ বছর বয়সে। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশভ্রমণের নেশা তাকে বছরের অধিকাংশ সময়ই দেশান্তরী করে রাখত। বাবাই তাকে দেশভ্রমণে নিয়ে যান। প্রথমে তারা আসেন শান্তিনিকেতনে। এখানে বসেই রবীন্দ্রনাথ তার প্রথম নাটক 'পৃথ্বীরাজ পরাজয়' রচনা করেন। এই নাটকটির পাণ্ডুলিপি তার জীবদ্দশাতেই হারিয়ে যায়। শান্তিনিকেতনে কিছুকাল কাটিয়ে চলে যান পাঞ্জাবের অমৃতসরে। এখানে থাকাকালীন স্বর্ণমন্দিরে শিখদের ভজন ও উপাসনা পদ্ধতি চাক্ষুষ করেন পিতাপুত্র। এরপর আসেন ডালহৌসির নিকট বক্রোটা পাহাড়ের চূড়ায়। ওই সময় রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের পাঠ নিতে থাকেন। ১৮৭৮ সালে সদ্য যুবক রবীন্দ্রনাথ দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গেলেন ইংল্যান্ডে। উদ্দেশ্য ছিল ব্যারিস্টার হওয়া। প্রথমে এলেন ব্রাইটনে। ভর্তি হলেন সেখানকার একটি পাবলিক স্কুলে। পরে ১৮৭৯ সালে ভর্তি হলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষ না করেই দেশে ফিরে আসেন।

রবীন্দ্রনাথ মানুষ ও কবি হিসেবে যা হয়ে উঠেছিলেন তা তিনি হতে পারতেন না যদি পূর্ব বাংলার গ্রামদেশে না আসতেন, আর যদি লাভ না করতেন পদ্মাপাড়ের মরমী বাউলদের অন্তরঙ্গ সাহচর্য। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২। এই সময় পর্বের মধ্যে ১২টি বিশ্বভ্রমণ কর্মসূচি। আর তারই মাধ্যমে ৫টি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশভ্রমণ করেন রবীন্দ্রনাথ। যৌবনে দুবার ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন তিনি। প্রথমবার ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশে। দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন ১৮৯০ সালে। কেন গিয়েছিলেন, তার কারণ ঠিক স্পষ্ট নয়। ১৯১২ সালে তৃতীয়বার ইংল্যান্ডে গেলেন ব্যক্তিগত চিকিৎসার উদ্দেশে। এই সময়েই ইয়েটস প্রমুখ ইংরেজ কবি ও বিজ্ঞজনদের সঙ্গে তার পরিচিতি। 'গীতাঞ্জলি'র ইংরেজি অনুবাদ রবীন্দ্রনাথ পাঠ করে শোনালেন এই নতুন বন্ধুমহলে। সবাই মুগ্ধ। ইয়েটস স্বয়ং লিখে দিলেন বইটির ভূমিকা। এরপর ১৯১৩ সালে এই বইটির জন্যই রবীন্দ্রনাথ পেলেন সাহিত্যে নোবেল। উল্লেখ্য, এই তৃতীয় বিলেত সফরের সময়েই দীনবন্ধু সি এফ অ্যান্ডরুজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল। ১৯১৬-১৭ সাল প্রথমে জাপানে ও পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ কতকগুলো বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতামালায় সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ সোচ্চার হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ উভয় দেশেই প্রত্যাখ্যাত হন রবীন্দ্রনাথ। তবে তার এই বক্তৃতাগুলো সংকলিত হয়ে থাকে 'ন্যাশনালিজম' (১৯১৭) সংকলনে। ১৯২০-২১ সাল নাগাদ আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ভ্রমণে যান রবীন্দ্রনাথ। এই সফরকালে পাশ্চাত্য দেশগুলোতে সংবর্ধিতও হন তিনি।

১৯২৪ সালে যান চীন সফরে। সেখান থেকে আবার যান জাপানে। এবারও জাতীয়তাবাদবিরোধী বক্তৃতা দেন জাপানে। ১৯২৪ সালের শেষ দিকে পেরু সরকারের কাছ থেকে সে দেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ পান রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু পথে আর্জেন্টিনায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। পেরুর বদলে থেকে যান সে দেশেই। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথেয়তায় কাটান তিনটি মাস। অসুস্থতার জন্য পেরু যাওয়া বাতিল হয়ে যায়। ১৯২৬ সালে বেনিতো মুসোলিনি রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানান ইতালিতে। ১৯২৭ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ চার সঙ্গীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চললেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভ্রমণে। দেখলেন বালি, জাভা, কুয়ালালামপুর, মালাক্কা, পেনাং, সিয়াম ও সিঙ্গাপুর। ১৯৩০ সালে শেষবার ইংল্যান্ড গেলেন অঙ্ফোর্ডে হিবার্ট বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। এরপর গেলেন ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৩২ সালে ইরাক ও পারস্য ভ্রমণ করলেন। ১৯৩৪ সালে গেলেন সিংহলে। এই ছিল তার শেষ বিদেশ সফর। একাধিক বইয়ে রবীন্দ্রনাথ লিপিবদ্ধ করেছিলেন তার বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতা।

এই বইগুলো হলো : 'য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র' (১৮৮১), 'য়ুুরোপ-যাত্রীর ডায়েরি' (১৮৯১, ১৮৯৩), 'জাপান-যাত্রী' (১৯১৯), 'যাত্রী' ('পশ্চিম-যাত্রীর ডায়েরি' ও 'জাভা-যাত্রীর পত্র', ১৯২৯), 'রাশিয়ার চিঠি' (১৯৩১), 'পারস্যে' (১৯৩৬) ও 'পথের সঞ্চয়' (১৯৩৯)। সাক্ষাৎ করেছিলেন অরি বেরগস, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রস্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস, রোম্যা রোলাঁ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে। জীবনের শেষ পর্বে পারস্য, ইরাক ও সিংহল ভ্রমণের সময় জাতিগত ভেদবুদ্ধি ও জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তার বিতৃষ্ণা তীব্রতর হয়েছিল মাত্র। আর জীবনব্যাপী বিশ্বভ্রমণের ফলে ভারত ও পাশ্চাত্যের মধ্যে আদান-প্রদানের পথটিই প্রশস্ত করেছিলেন কবি। * রকমারি ডেস্ক

 

 

সর্বশেষ খবর