সোমবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

একজন সফল মানুষের নাম জহুরুল ইসলাম

ব্যারিস্টার রফিক-উল হক

জহুরুল ইসলাম সম্পর্কে ধারণা এ দেশের খুব কম মানুষের। দেশের বেশির ভাগ লোকই তাকে চিনেন একজন বড় বিজনেসম্যান হিসেবে। যারা তার সঙ্গে মিশেছেন এবং যারা তার প্রতিষ্ঠানে কাজ বা চাকরি করেছেন তারা হয়তো কিছুটা জানেন। এখন দেশে অনেক টেলিভিশন চ্যানেল হয়েছে। তখনকার দিনে একটাই টেলিভিশন চ্যানেল ছিল- বিটিভি। একদিন বিটিভির এক কর্মকর্তা আমাকে ধরল তার একটা ইন্টারভিউর ব্যবস্থা করে দিতে। এ কর্মকর্তা বললেন, অনেকে জহুরুল ইসলামের নাম শুনেছেন কিন্তু দেখেননি।

বিটিভির এ কর্মকর্তার অনুরোধে আমি তাকে বললাম একটা ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য। তিনি প্রথমে সম্মত হলেন না। খুব চাপাচাপির পর বললেন ঠিক আছে তবে কী প্রশ্ন করবে এবং এর উত্তর কি দেব বলে দেন। আমি বললাম আপনি এটুকু উত্তর দেবেন।

সামান্য ব্যবসা শুরু করে অনেক বড় ব্যবসা, শিল্প কল-কারখানা করেছেন। প্রচুর অর্থ কামিয়েছেন, কিন্তু দান-খয়রাত করেছেন দুই হাতে। তার নিজের এলাকা বাজিতপুরে অনেক বিধবা এবং গরিব মানুষকে প্রতি মাসেই আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন অতি গোপনে। তিনি প্রচারবিমুখ ছিলেন।

আনফরচুনেটলি তিনি যখন সিঙ্গাপুরে মারা যান, তখন আমিও ছিলাম সিঙ্গাপুরে। আমার ড্রাইভার টেলিফোনে তার মৃত্যু সংবাদ আমাকে জানাল। সংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলাম। সিঙ্গাপুরে মসজিদে জানাজা পড়িয়ে ডেডবডি ঢাকায় পাঠানো হলো।

জহুরুল ইসলামের সঙ্গে আমার স্মৃতি অনেক। তার অফিসে গেলে প্রথমেই ডাবের পানি পান করতে দিতেন। তারপর কথা শুরু করতেন। শেষের দিকে খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। সব সময় দেখতাম হাতে একটা ছোট ব্যাগ। তাতে নানা রকমের ওষুধ থাকত। আমার স্ত্রী তাকে একদিন বললেন, ‘ভাই আপনার ওষুধগুলো দেখান তো, কিসব ওষুধ খান সারাক্ষণ’। আমার স্ত্রী ডাক্তার ছিলেন, তিনি জহুরুল ইসলামকে বললেন ভাই আসলে অল্প বয়স থেকে কন্ট্রাক্টরি করছেন, মাঠে-ময়দানে ঘুরেছেন, ধুলাবালি থেকে আপনার এই অসুখ হয়েছে। আপনাকে এতসব ওষুধ খেতে হবে না। আমার স্ত্রীর কথা শুনে তিনি বললেন, বলেন কি ভাবী! ওষুধ কিছু বদলে দিয়েছিলেন আমার স্ত্রী। পরে তিনি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন।

জহুরুল ইসলাম যে কত বড় বিজনেসম্যান ছিলেন তা বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও অনেক বড় বিজনেস করেছেন। আবুধাবিতে বেদুইনদের থাকার জন্য বিল্ডিং করে দেবেন বলে সেখানকার রাজার সঙ্গে কন্ট্রাক্টে এসেছিলেন। সেখানকার বেদুইনরা টেন্ট করে থাকত মরুভূমিতে।

শুনতে আশ্চর্য লাগবে অনেকের, তিনি এমনসব মেশিনপত্র সেখানে নিয়ে গেলেন যেখানে প্রতিদিন একটা মেশিনে তিনটা করে বাড়ি তৈরি করে দেওয়া যেত। এরকম পাঁচটি মেশিন ছিল। ১৫টি বাড়ি তৈরি হতো প্রতিদিন, ক্রেনে তুলে ওই মরুভূমিতে এসব বাড়ি বসিয়ে দেওয়া হতো। আমি নিজের চোখে দেখেছি, আমি ওখানে গিয়েছি। অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করবেন না যে একজন বাঙালির পক্ষে এত বড় প্রজেক্ট নেওয়া সম্ভব। তিনি সফল হয়েছিলেন। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল ওই প্রজেক্টে। আবুধাবি, দুবাই, আগে মরুভূমির দেশ ছিল। জহুরুল ইসলাম এ দেশ থেকে লোক নিয়ে গিয়ে কাজ করেছেন। গাছ লাগিয়েছেন, পরিচর্যা করে মরুভূমিকে সবুজ বানিয়েছেন।

আবুধাবিতে জনতা ব্যাংকের শাখা খোলা হয়েছিল। মেইনলি তার জন্য করা হয়েছিল সেটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাংকে অঘটন হয়ে গেল। জহুরুল ইসলামের কোনো দোষ ছিল না। রাজার ভাইপো এ ব্যাংক থেকে লোন চায়। লোন চাইলে তো না করার সাহস নেই। ব্যাংক লোন দিল। কিন্তু রি-পে করে না। সে দেশের প্রথায় রাজা বা রাজপরিবারের কারও বিরুদ্ধে কেস করা যায় না। তখনকার রাজা শেখ জায়েদ বিন সুলতান। তিনি বললেন, আমার ভাইপোর বিরুদ্ধে কেস করুন, কিন্তু রাতে শুনানি করতে হবে। রাত ১২টা পর কেউ যেন না জানতে পারে রাজার পরিবারের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে কেস করা হয়েছে। রাত ১২টার পর কোর্ট বসত। কেউ যেন না দেখে। বিচার হলে দেখা গেল টাকা-পয়সা পাওনা আছে, কিছু দিল তার ভাইপো আর কিছু রাজা পরিশোধ করে দিল। এক সময় ব্যাংকের শাখা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।

জহুরুল ইসলাম সবসময় পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন। আমি একদিন তার সঙ্গে লন্ডন গিয়েছিলাম বিমানে। সেই পাজামা-পাঞ্জাবি পরা। এয়ারপোর্টে নামার সঙ্গে সঙ্গে স্কট করে লোক এসে তাকে গার্ড দিয়ে নিয়ে গেল।

লন্ডনে তার অফিস ছিল টপ পজিশনে। খুব ভালো জায়গায় বিরাট বাড়ি ছিল, খুব দামি বাড়ি।

ওভার অল জহুরুল ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে আমি বলব তার মতো মানুষ বাংলাদেশে আর দ্বিতীয় একজন দেখি না। তিনি শুধু বড় মাপের একজন বিজনেসম্যানই ছিলেন না, অনেক বড় মনের অধিকারী  মানুষও ছিলেন।

কোনো কিছুর প্রয়োজন হলেই তখন সবাই চলে যেতেন জহুরুল ইসলামের কাছে। তিনি কাউকে বিমুখ করেছেন শুনিনি। জহুরুল ইসলাম শুধু বিজনেস বা ইন্ডাস্ট্রিই করেননি, স্কুল, কলেজ, হাসপাতালসহ অনেক জনহিতকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তিনি তার নিজ গ্রামে ৫০০ শয্যার একটি আধুনিক হাসপাতাল এবং একটি মেডিকেল কলেজ ও একটি নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। দেশের বাইরে থেকেও ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসে। তিনি রাজনীতি করতেন না, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন না, অথচ এ দেশের অনেক নামিদামি রাজনীতিবিদ তার কাছ থেকে নানাভাবে সহায়তা পেয়েছেন। শুনতে ভালো লাগে অনেক রাজনীতিবিদ এ সত্য কথাটি গোপন না করে জনসমক্ষে বলে থাকেন, জহুরুল ইসলাম যদিও তার দান-অনুদানের কথা সব সময় গোপন রেখেছেন। তবে আমার দুঃখ হয় এমন একজন মানুষ যিনি দেশের জন্য এত কাজ করেছেন, এত লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন অথচ বাংলাদেশের কোনো সরকারই প্রকৃত অর্থে তার কাজের যেমন সঠিক মূল্যায়ন করেনি, তেমনি তাকে রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মান যেমন একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক কোনো কিছুই প্রদান করেননি। তবে মানুষ হিসেবে চিরকাল তিনি আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন তার মহত্ত্বের জন্যই।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট

ইমেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর