সোমবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

প্রচারবিমুখ দরদি একজন মানুষ

মনোজ রায়

প্রচারবিমুখ দরদি একজন মানুষ

নিজ কর্মক্ষেত্রে জহুরুল ইসলাম

আজ ১৯ অক্টোবর। এই জনপদের প্রথম ও প্রধান বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তা জহুরুল ইসলামের প্রয়াণ দিবস। ২০ বছর আগে এই দিনে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। ৬৭ বছর আয়ুষ্কালের ৪৭ বছরই তিনি মেতেছিলেন কর্মযজ্ঞে। মেধা, সৎ সাহস, একাগ্রতা আর অধ্যবসায় মিলিয়ে জয় করেছেন বহু কিছু। কর্ম এবং শুধুই কর্ম ছিল তার ধ্যান ও স্বপ্ন। যে স্বপ্নকে বহুলাংশে বাস্তবে রূপ দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন নিষ্ঠা এবং চেষ্টাই পারে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে।

মরহুম জহুরুল ইসলাম কত বিরাট মাপের মানুষ ছিলেন তা জানতে হলে তার ঘটনাবহুল জীবনকে জানতে হবে। সাধারণ থেকে কীভাবে অসাধারণ হয়েছেন, কর্মবিমুখ বাঙালিকে কীভাবে কর্মমুখী করে তুলতে সচেষ্ট ও সফল হয়েছিলেন তার বর্ণনা দিতে গেলে নিবন্ধটি হবে নাতিদীর্ঘ। আমি মাত্র বছরতিনেক তার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম। তার কাছেই শুনেছিলাম কোথা থেকে শুরু করে কোথায় পৌঁছেছিলেন মাত্র ৪৭ বছরের কর্মজীবনে। তার কর্মযজ্ঞের বিবরণ রূপ কথাকেও হার মানাবে।

জীবন শুরু করেছিলেন একজন ছোট ঠিকাদার হিসেবে। ক্রমেই বিস্তৃত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। গড়ে তুলেছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষিখামার, হাসপাতাল, শিল্প-কারখানাসহ আরও কত কিছু। এ দেশে অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসার পথিকৃৎ তিনি। দেশের সীমানা পেরিয়ে আরব দুনিয়ায় গড়ে তুলেছেন নতুন নতুন জনপথ, শহর, উপশহর।

ইসলাম গ্রুপ- এ দেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত একটি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের নাম। জহুরুল ইসলাম তার মেধা আর শ্রম দিয়ে নিপুণ হাতে গড়ে তুলেছেন এ প্রতিষ্ঠানটি। ‘বিন্দু থেকে সিন্দু’ এ প্রবাদ বাক্যটি তার জীবনে ষোলআনা সত্য হয়েছে। জীবনকে সমৃদ্ধ করেছেন বিভিন্ন আয়োজনে, বিন্দু বিন্দু থেকে তাকে সিন্দুতে রূপ দিয়েছেন তিনি। আয় করেছেন কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ, যার সিংহভাগ ব্যয় করেছেন গণমানুষের কল্যাণে।

আত্মপ্রচারে বড় বেশি বিমুখ ছিলেন বলেই হয়তো এ প্রজন্ম জানে না তার অবদানের কথা। নীরবেই তিনি এসেছিলেন এ পৃথিবীতে, নীরবেই চলে গেছেন। মাঝখানের এ দিনগুলোতে জীবনের অর্থ খুঁজে বেড়িয়েছেন কর্মের মধ্যে আর সেই সাধনাই তাকে পৌঁছে দিয়েছে পরম সার্থকতায়। আত্মবিশ্বাস ও প্রাণশক্তির প্রাচুর্য দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন একেকটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে যেমন কর্মসংস্থান হয়েছে অনেক মানুষের, তেমনি সারা দেশের মানুষ পাচ্ছে সেবা।

একটি জনগোষ্ঠীর ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম যেমন অনস্বীকার্য তেমনি প্রয়োজন হয় অর্থনীতির বিকাশ। জহুরুল ইসলাম এ জনপদের অর্থনীতির বুনিয়াদকে দৃঢ় করতে, মানুষকে কর্মমুখী করতে, আত্মপ্রত্যয়ী করতে কত কিছুই না করেছেন। এ দেশে পাট শিল্প, ওষুধ শিল্প, কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে তুলেছেন অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করতে।

জাতীয় দুর্যোগে বার বার সামনের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি মানব কল্যাণে।

বাঙালির সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর তাদের এ দেশীয় দোসরদের হিংস্র থাবায় রক্তাক্ত হয়েছে এ জনপদ। প্রাণ হারিয়েছেন কত নিরপরাধ মানুষ। সম্ভ্রম হারিয়েছেন কত নারী। রাজনীতি বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জহুরুল ইসলাম কোনো দিন প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ করেছেন বলে শোনা যায়নি। রাজনীতির অঙ্গন থেকে যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করেও জাতির এ চরম দুর্দিনে নিশ্চুপ বসে থাকেননি। তার শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই ছিল এই জনপদে। কিন্তু এসবের মায়া ত্যাগ করে তিনি ঝুঁকি নিয়ে দেশান্তরী হয়েছিলেন হায়েনাদের থাবা থেকে মানুষকে মুক্ত করার কর্মযজ্ঞে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে।

মুক্তিযুদ্ধ তখন পুরোদমে। প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে ব্যস্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এবং একই সঙ্গে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। জহুরুল ইসলাম লন্ডনে দেখা করলেন বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে। তার হাতে তুলে দিলেন মোটা অঙ্কের অনুদান। সে অর্থের ওপর ভর করেই লন্ডনে শুরু হলো বাংলাদেশ মিশনের কাজকর্ম।

এক সাগর রক্ত পেরিয়ে জন্ম নিল স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক চক্রান্ত থেমে নেই। সদ্য স্বাধীন দেশটি যাতে আঁতুড় ঘরেই প্রাণ ত্যাগ করে তার সব চেষ্টাই করেছে পশ্চিমা অনেক রাষ্ট্র। তার ওপর ১৯৭৪ সালের প্রাকৃতিক বিপর্যয়। দেশ বড় ধরনের সংকটে। অসংখ্য মানুষ নিরন্ন, অভুক্ত। জহুরুল ইসলাম এগিয়ে এলেন। তার নিজ জেলা কিশোরগঞ্জের ১৩টি উপজেলার নানা স্থানে চালু করলেন লঙ্গরখানা। তারই অনুজ নাভানা গ্রুপের কর্ণধার শফিউল ইসলাম কামাল সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানালেন ব্যাংকে তখন ইসলাম গ্রুপের সঞ্চিত অর্থ ছিল দেড় কোটি টাকা। লঙ্গরখানা চালাতে গিয়ে এ টাকা ব্যয় হয়ে যাওয়ার পর জহুরুল ইসলাম সাহেব তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে লঙ্গরখানা চালু রাখতে। নিরন্ন মানুষের খাবার জোগাতে এ সময় আরও দেড় কোটি টাকা তখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়েছিল।

জহুরুল ইসলাম দ্রুত এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। হয়তো বুঝেছিলেন তার সময় ফুরিয়ে আসছে। তার সব স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিয়ে যেতে পারেননি। সৃষ্টিকর্তা তাকে মাঝপথ থেকে ডেকে নিয়ে গেলেন।

যে গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি, সেখানেই শেষ শয্যা নিয়েছেন তারই হাতে গড়া ৫০০ শয্যার আধুনিক হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের পাশে দৃষ্টিনন্দন মসজিদের আঙিনায় শ্যামল ছায়ায়। তার অন্যতম কীর্তি ‘জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল’ এ দেশের চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার একটি উন্নত বিদ্যাপীঠ ও সেবাদান কেন্দ্র। শুধু এ দেশের নয়, উপমহাদেশের প্রায় সব দেশ থেকেই শিক্ষার্থীরা এখানে আসেন চিকিৎসক হতে। শিক্ষাজীবন শেষে নিজ নিজ দেশে ফিরে যান মানবসেবার ব্রত নিয়ে। রাজধানীর বাইরে সম্ভবত এটিই প্রথম ও সর্ববৃহৎ চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়। 

জহুরুল ইসলাম প্রকৃত অর্থেই ছিলেন একজন ধার্মিক। ধর্মপ্রাণ আর ধর্মান্ধতার পার্থক্য বুঝতে হলেও তার জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক ভাবনা মুহূর্তের জন্যও তাকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি।

জহুরুল ইসলামের মৃত্যু তার পরিবারের ও স্বজনদের জন্য অবশ্যই বেদনার, কিন্তু এ দেশের বহু মানুষের কাছে তার এভাবে চলে যাওয়া বড় বেশি কষ্টের। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে শুধু এটুকুই বলা যায়- জহুরুল ইসলামের মতো মানুষের জন্ম যত বেশি হবে, সমাজের অবহেলিত গরিব-দুঃখী মানুষের বেঁচে থাকার সুযোগ ও সম্ভাবনা তত প্রসারিত হবে।

লেখক : সাংবাদিক

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর