বুধবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ভারত দেখা

লাকমিনা জেসমিন সোমা

ভারত দেখা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া থেকে শুরু করে বন্ধুত্বের বিরল সব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সাল থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশের জামাই প্রণব মুখার্জি দুই দেশের তারুণ্যের মেলবন্ধনে চালু করেন ‘হান্ড্রেড-মেম্বার বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন প্রোগ্রাম’। এর আওতায় বরাবরের মতো এবারও রাষ্ট্রপতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভারত ভ্রমণ করেন বাংলাদেশের ১০০ তরুণ প্রতিনিধি। রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে ২ থেকে ১১ অক্টোবর ভারতের দিল্লি, আগ্রা, জয়পুর, রাজস্থান, কলকাতাসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখার সুযোগ পান বাংলাদেশের তরুণরা। তাদেরই একজন এই প্রতিনিধি। তার ভারতভ্রমণের এক ঝলক নিয়ে রকমারির এ আয়োজন।


ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল

রাষ্ট্রপতি ভবনে নড়াইলের জামাইবাবু

কচি ঘাসের ওপর দিয়ে নির্ভয়ে হেঁটে বেড়ায় ময়ূর। সবুজ পাতার ফাঁকে মনের আনন্দে গান গায় পাখিরা। পছন্দ মতো জায়গা খুঁজে বাসা বাঁধে কবুতর। বর্ণনা শুনে কল্পনায় এটিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত কোনো এক উন্মুক্ত বাগান কিংবা পার্ক বলে মনে হলেও আসলে এটি ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনের চিত্র। বর্তমানে যেখানে বাংলাদেশের জামাই ও বিশাল ভারত রাষ্ট্রের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির নিবাস।

আকাশছোঁয়া অট্টালিকা নয়, তবুও বিশাল। দিগন্তজুড়ে বিস্তৃত এক শৈল্পিক আভিজাত্যের অনন্য নিদর্শন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন। ভারতের মতো একটি বিশাল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভিভাবকের সরকারি বাসভবন, ভাবতে গেলেই কেমন যেন শিরদাঁড়া শক্ত হয়ে ওঠে। অথচ এর ভিতরেই এমন কিছু রয়েছে যা কাটখোট্টা অনুভূতিগুলোকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছোঁয়ায় সৃষ্টি হয় টুকরো টুকরো ভালো লাগা। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ও যাবতীয় রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার ভিতরও যে এক ধরনের সরলতা বা সিগ্ধতা আছে তা এই ভবনের মূল ফটকে ঢুকতেই বোঝা যায়। ময়ূর কিংবা পাখ-পাখালির স্বাধীন বিচরণ দেখে মনে হয় প্রকৃতির কাছে সবাই সমান। রাষ্ট্রপতির বাসভবন ছাড়াও তার কর্মস্থল, অতিথি কক্ষ, হলঘর, ফুলের বাগান, নিরাপত্তা কর্মীদের থাকার জায়গা, সংশ্লিষ্ট সেবা কার্যক্রমে নিয়োজিত অফিস ও খোলা জায়গাসহ প্রায় ৩২০ একর জমি নিয়ে বিস্তৃত এই ভবন এলাকা। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই ভবনের অন্যতম আকর্ষণ হলো দরবার হল। এখানে বিশাল সিংহাসনে বসতেন ব্রিটিশ অধিপতি। আজ সেখানে সিংহাসন নেই। বরং কারুকার্যখচিত সোনারাঙা এক জাঁকজমক চেয়ারে বসেন রাষ্ট্রপতি। এই চেয়ারে বসেই সেদিন বাংলাদেশের তরুণ প্রতিনিধি দলের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রণব মুখার্জি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি হয়ে সংবর্ধনা কেবল ভারত থেকে পাইনি, পেয়েছি বাংলাদেশ থেকেও। আমি বাংলাদেশের জামাই। শ্বশুরালয় সূত্রে বাংলাদেশের নড়াইলে চিত্রা নদীর পাড়ে আমার অনেক স্মৃতি।’ মূল ভবনটিতে রয়েছে ৩৪০টি কক্ষ। এর মধ্যে ৬৩টি লিভিং রুম, ২২৭টি কলাম (সিঁড়িঘর), ৩৭টি ঝরনা (ছাদের উপরসহ) এবং প্রায় ১২ মাইল করিডোর। ভবনের অন্যতম আভিজাত্য হলদেটে পাথরের ড্রইংরুম। এখানে মন্ত্রিসভা, স্পিকারসহ সাংবিধানিক মর্যাদাসম্পন্ন পদের ব্যক্তিরা শপথ নেন রাষ্ট্রপতির কাছে। দরবার হলের পাশেই আলো ঝলমলে অশোক হল। কাঠের তৈরি এই মেঝেতেই বিদেশি অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানো হয়। ভবনের একাধিক লাইব্রেরির মধ্যে মূল লাইব্রেরিটিতে রয়েছে ১৮০০ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে প্রকাশিত প্রায় দুই হাজার দুর্লভ বই। ভারতের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় ভবনটিই এখন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন।বিখ্যাত ব্রিটিশ স্থপতি স্যার এডউইন লুটিয়েনস এই ভবনের ডিজাইন করেছিলেন। ভবনটি নির্মাণে ব্রিটিশ সরকার অনুমোদন দিয়েছিল চার লাখ পাউন্ড। এটি চার বছরের মধ্যে নির্মাণের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ১৭ বছর লেগে যায়। হিন্দু, বৌদ্ধ, মোগল, গ্রিক, রোমান স্থাপত্যের আদলে নির্মিত প্রাসাদটি তৈরি করেন প্রায় ২৯ হাজার শ্রমিক। এই রাষ্ট্রপতি ভবনের পেছনেই রয়েছে আকর্ষণীয় মোগল গার্ডেন যা জম্মু ও কাশ্মির গার্ডেন, তাজমহল গার্ডেন এবং পার্সিয়ান ও ভারতীয় বিভিন্ন স্থাপত্যের অনন্য নকশার আদলে তৈরি করেছিলেন এডউইন।


 

 

তাজমহল

প্রিয়তমার প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টান্ত, নাকি নান্দনিক স্থাপত্যের নিদর্শন? রাজকীয় সমাধি, নাকি ইতিহাসের সাক্ষী? শৌখিন রাজা সম্রাট শাহজাহানের বিলাসিতা নাকি অন্য কোন রহস্য? যে অদ্বিতীয়কে দেখলে মানুষের ভিতর এমন হাজারো প্রশ্নের বিচ্ছুরণ ঘটে সেই দুর্লভ স্থাপনার নাম তাজমহল। ভারতের আগ্রায় অবস্থিত গোম্বুজাকৃতি এই মহলের বেদির উপর দাঁড়াতেই কেমন যেন শুভ্রতার আভিজাত্যে মন ভরে যায়। চোখ ধাঁধানো নকশায় নিজের অজান্তেই হৃদয়ে গেঁথে যায় এর অপার সৌন্দর্য। মোগল ইমারত তৈরিতে সম্রাট শাহজাহানই প্রথম এই সাদা পাথরের প্রচলন শুরু করেছিলেন। তবে কেবল শিল্পীর কারসাজিতে নয়, প্রকৃতিও এখানে উজাড় করে দিয়েছে তার প্রেম। আর সে কারণেই তাজমহল সংলগ্ন চিরযৌবনা যমুনার বুক থেকে আসা øিগ্ধ বাতাস মনকে ভীষণভাবে শান্ত করে দেয়। হৃদয়ে জন্ম দেয় শতকোটি রঙের অফুরান ভালোবাসার অন্যরকম এক অনুভূতি। প্রিয়জনের জন্য হৃদয়ের জমিনে জন্ম দিতে ইচ্ছে হয় এমন আরও একটি তাজমহল।

মোগল সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম (যিনি মমতাজ মহল নামে পরিচিত) তাদের এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন। প্রিয় স্ত্রীর মৃত্যুতে প্রচণ্ড শোকাহত হয়ে পড়েন সমৃদ্ধশালী সম্রাট শাহজাহান। এরপরই তিনি তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই অপূর্ব সৌধটি নির্মাণ করেন। যেটির কাজ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে এবং শেষ হয় ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে। তাজমহলের পুরো চত্বরটি বেলে পাথরের দুর্গের মতো দেওয়াল দিয়ে তিন দিক থেকে বেষ্টিত। নদীর দিকটিতে কোনো দেওয়াল নেই। তাজমহল তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী নকশার উপর, বিশেষ করে পারস্য ও মোগল স্থাপত্য অনুসারে। তাজমহলের প্রধান কক্ষটিতে মমতাজ মহল ও শাহজাহানের স্মৃতিফলক বসানো হয়েছে। তাদের কবর রয়েছে এর এক স্তর নিচে। তাজমহলের সামনের চত্বরে একটি বড় চারবাগ (মোগল বাগান পূর্বে চার অংশে বিভক্ত থাকত) করা হয়েছিল যা বর্গাকৃতির ১৬টি ফুলের বাগানের জন্য তৈরি করা হয়। বর্তমানে এগুলো সবুজ মখমলের মতো ঘাসে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মাজার বা তাজমহলের দরজার মাঝামাঝি বরাবর বাগানের মধ্যখানে একটি উঁচু মার্বেল পাথরের পানির চৌবাচ্চা বসানো আছে। এখানে তাজমহলের প্রতিফলন দেখা যায়। এছাড়া বাগানে আরও বেশ কিছু বৃক্ষশোভিত রাস্তা এবং ঝরনা আছে। সমাধির উপরের মার্বেল পাথরের গম্বুজই সমাধির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, তৎকালীন দেওয়াল ঘেরা আগ্রা শহরের দক্ষিণ অংশের একটি জমিতে তৈরি করা হয়েছিল তাজমহল। জমির মালিক ছিলেন মহারাজা জয় শিং। শাহজাহান তাকে আগ্রার একটি বিশাল প্রাসাদ দেওয়ার বদলে জমিটি নিয়েছিলেন। তবে তাজমহলের নির্মাণ কাজ শেষ হতে না হতেই শাহজাহান তার পুত্র আওরঙ্গজেব দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আগ্রার কেল্লায় গৃহবন্দী হন।


 

 

আম্বার ফোর্ট

ঢং...ঢং...ঢং...। যেন রণাঙ্গনের দামামা বেজে চলেছে। রাজপ্রাসাদজুড়ে প্রকম্পিত হচ্ছে সেই বাজনা। বাজনার তালে রাজসভার বিশাল গেট দিয়ে সারি বেঁধে ঢুকছে সুসজ্জিত ও প্রশিক্ষিত হাতির দল। এই জীবন্ত চিত্রের স্থান রাজস্থানের আম্বার ফোর্ট বা আম্বার প্যালেস। চোখ ধাঁধানো রাজ্যের এই দেওয়ান-ই-আম বা প্রজাদের জন্য উন্মুক্ত দরবারে দাঁড়ালে মনের অজান্তেই ফিরে যেতে হয় ১৬০০ শতকের রাজা মান সিংহর আমলে। যদিও অপূর্ব এই রাজপ্রাসাদটি ১৫০০ শতকে নির্মাণ শুরু করেছিলেন রাজা মানেশ। জয়পুর থেকে ১১ কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে চার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত শহরের উপর এটি নির্মিত।

হিন্দুয়ানি বৈশিষ্ট্যে গড়া এই অপরূপ স্থাপত্যের নকশা দেখলে যে কেউ রাজপুতদের উন্নত সংস্কৃতিমনার প্রশংসা করবেন। এখানে পাথরের খোদাই করা মূর্তি কিংবা দেওয়ালে সূ² আয়নার কাজ থেকে শুরু করে রাজ্যের প্রতিটি কোনায়-কানায় দেখা যায় শিল্পের ছোঁয়া। আম্বার ফোর্টের মূল চারটি আকর্ষণ হলো- দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস (রাজ্য পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বৈঠক হল), শীষ মহল বা আয়না প্রাসাদ (জয় মন্দির) এবং সুখ নেওয়াজ। এর মধ্যে ‘সুখ নেওয়াজ’ প্রাচীন বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর নির্মাণ। এই মহলের নিজ দিয়ে এমনভাবে কৃত্রিম উপায়ে পানির স্রোত প্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়েছিল যাতে রাজা গরমের দিনে এখানে বসে শীতল পরশ অনুভব করতে পারেন।

 আম্বার ফোর্টের ইতিহাসে বাংলাদেশের যশোর জেলার নামটিও লেখা আছে। তৎকালীন যশোরের রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে রাজা মানসিংহ পুরস্কার হিসেবে এই দুর্গে একটি মন্দির পেয়েছিলেন যা দুর্গের প্রধান প্রবেশদ্বার তথা গণেশ গেটের পাশেই অবস্থিত। আম্বার ফোর্টের সঙ্গেই রয়েছে জয়গড় ফোর্ট যা যুদ্ধকালীন বা বিপদের মুহূর্তে রাজপরিবারের অধিক নিরাপদে থাকার জন্য বানানো হয়েছিল। উজ্জ্বল চকচকে সাদা মার্বেল পাথর ও লাল বেলেপাথরে তৈরি এই ফোর্টের সামনে একটি হ্রদ আছে যেখানে স্বচ্ছ পানিতে দুর্গের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। এর সৌন্দর্য বিমোহিত করে পর্যটকদের।


 

 

শান্তিনিকেতন

নামের মতোই শান্তির এক নিকেতন, শান্তিনিকেতন! যেখানে শুরু হয়েছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনালি কৈশোর। কেটেছিল জীবনের বেশিরভাগ সময়। আজও সেখানকার প্রকৃতির মাঝে ফুটে ওঠে বিশ্বজয়ী কবির সবুজ মন আর সমৃদ্ধ রঙিন জীবনের প্রতিচ্ছবি। কলকাতা থেকে ১৫৯ কিলোমিটার দূরত্বে বীরভুম জেলার বোলপুরে অবস্থিত কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত এ জগৎ। মূলত এটি একটি আশ্রম ও শিক্ষাকেন্দ্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মালোচনার জন্য ১৮৬৩ সালে এখানে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কবি এখানে প্রথম এসেছিলেন ১২ বছর বয়সে। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়।  শান্তিনিকেতন ভবন আশ্রমের সবচেয়ে পুরনো বাড়ি। সব মিলিয়ে ররীন্দ্রনাথের পাঁচটি বাড়ি রয়েছে এখানে।  উত্তর কোণে বিচিত্রা ভবন। শুভ্র এ ভবনের দোতলায় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি নিয়ে গড়ে উঠেছে জাদুঘর।  জাদুঘরে কবির ব্যবহৃত ফুলদানি থেকে শুরু করে নিজ হাতে তৈরি কাঠের বাক্স, বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া উপহার। উদয়ন, কবিগুরুর আরেক বাসভবন। এখানে বসেই কবি আশ্রমবাসী ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে কবিতা পাঠ, নাটক ও জলসার আয়োজন করতেন। এর অদূরেই দেখা যায় শ্যামলী নামের সুন্দর বাড়িটি। ১৩৪২ সনের ২৫ বৈশাখ জন্মদিনে এ বাড়িতে উঠেছিলেন কবি। এর পাশেই পুনশ্চ। ১৯৩৬ সালে শ্যামলী থেকে পুনশ্চতে এসে ওঠেন তিনি। এ বাড়ির খোলা বারান্দা কবির ভীষণ প্রিয় ছিল। পুনশ্চের কাছেই উদীচী নামে কবির দোতলা বাড়িটি। ১৯১৯ এর শেষদিকে এ বাড়িতেই থাকতেন তিনি। ছিমছাম মনোরম এ বাড়িগুলোর অদূরেই উপাসনা গৃহ। পাশেই সযত্নে রাখা আছে কবির ব্যবহৃত গাড়ি। বাড়িগুলোর দক্ষিণ পাশে ঐতিহাসিক ‘ছাতিমতলা’। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এখানে বসে উপাসনা করতেন। এসব ছাড়াও এখানকার দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্যগুলোও দেখার মতো। শান্তিনিকেতন দেখে শান্ত মনে ফেরার সময় কেবল একটি কথাই মনে পড়ে। আর তা হলো মৃত্যুর কিছুদিন আগে কবি এ শান্তিনিকেতন সম্পর্কে লিখেছিলেন- যখন রব না আমি মর্তকায়ায়/তখন স্মরিতে যদি হয় মন/তবে তুমি এসো হেথা নিভৃত ছায়ায়/যেথা এই চৈত্রের শালবন।


 

 

ইন্ডিয়া গেট

রাষ্ট্রপতি ভবনের অদূরেই নয়াদিল্লির রাজপথে বীর সেনাদের রক্তের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে ইন্ডিয়া গেট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তৃতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে যেসব ব্রিটিশ ও ভারতীয় সেনা জীবণ উৎসর্গ করেছিলেন তাদের স্মৃতিকে অম্লান রাখতেই এই সৌধটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

গুর’ত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই সুউচ্চ ইন্ডিয়া গেটের সঙ্গে বাংলাদেশেরও একটি আবেগীয় এবং ঐতিহাসিক বন্ধন রয়েছে।

 আর তা হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে আনতে যেসব ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছিলেন তাদের স্মরণে এই ইন্ডিয়া গেটেই স্থাপিত হয়েছে ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’। আগে পঞ্চম জর্জের একটি মূর্তি এই স্মৃতিসৌধের ছাইনি নিচে ছিল। ছাইনির তলাটি এখন ফাঁকা।

সেই মূর্তিটি অন্রান্য মুর্তির সঙ্গে দিল্লির করোনেশন পার্কে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

প্যারিসের আর্ক দে ত্রিম্ফের আদলে -সাদা বেলে পাথর ও গ্রানাইড পাথরে ১৯৩১ সালে নির্মিত এই সৌধটির নকশা করেন স্যার এডউইন লুটিয়েনস।

রাষ্ট্রপতি ভবন থেকেও এই সুউচ্চ গেটটি দেখা যায়। বিশেষ করে গেধুলি বেলায় এর সৌন্ধর্যে বিমহিত হয় দর্শনার্থীরা। গেটের মাথার উপর খেলা করে ভারতীয় আকাশের সোনালী আলো।

 প্রতিদিন হাজার হাজার দেশী বিদেশী পর্যটকরা আসেন এই গেট দেখতে। এখানে বাহারি মিষ্টি পানের দোকান থেকে শুরু করে ভারতীয় ঐতিহ্যগাথা নানা সরঞ্চামাদি নিয়ে হাজির হন ভ্রাম্মমান দোকানীরা।


 

 

রেড ফোর্ট

মোগল রাজাদের প্রায় ২০০ বছরের আবাসস্থলের নাম রেড ফোর্ট বা লাল কেল্লা। কেবল বসবাসের জন্য নয়, মোগল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন উৎসব ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এটি। চোখ ধাঁধানো অপূর্ব নির্মাণশৈলীর এ বিশাল লাল রঙের কেল্লাটি ভারতের সমৃৃদ্ধ প্রাচীন স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন। তাছাড়া ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক সাক্ষী। পঞ্চম মোগল সম্রাট শাহজাহান তৎকালীন স্থপতি ইসলাম শাহ সুরিকে দিয়ে এটি নির্মাণ করেছিলেন। প্রায় আড়াই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ দুর্গের যে মহলটিতে সম্রাটের পরিবারবর্গ বাস করতেন সেটি বেশকিছু সুপরিকল্পিত পরিখার মাধ্যমে যমুনা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছিল। যমুনার পানিতে এই পরিখাগুলোকে তুলনা করা হয় স্বর্গীয় স্রোতের সঙ্গে। সে কারণে এ মহলকে বলা হয় নূর-ই-বেহেশত। কেল্লার প্রধান দুই গেট হলো লাহোর গেট এবং দিল্লি গেট। কেল্লার দেওয়ান-ই-আম বা সর্বসাধারণের সভাস্থলে রত্নখচিত এক সিংহাসনে বসে সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযোগের কথা শুনতেন সম্রাট। আর রাজ্য পরিচালনা সভার সদস্যদের জন্য ছিল দেওয়ান-ই-খাস। এটি মার্বেল দ্বারা নির্মিত সভাকক্ষ। এ কক্ষে সম্রাটের জন্য তৈরি ময়ূর সিংহাসনটি ছিল চুনিপাথর, মণিমুক্তা ও হীরা-জহরতের মতো অপরিমেয় মূল্যের রত্ন দ্বারা খচিত। এছাড়া মার্বেলের একটি একক খণ্ডে তৈরি রঙমহল এ কেল্লার এক অত্যাশ্চর্য নির্মাণ যেখানে পদ্ম-আকৃতির একটি ঝরনা রয়েছে। এখানে সম্রাটের পত্নী ও প্রণয়িনীরা থাকতেন। বর্তমানে নক্করখানার উপরের তলাটিতে ইন্ডিয়ান ওয়্যার মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অবস্থিত। ইতিহাসের এ সাক্ষীকে ঘিরে থাকা অন্য আকর্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে সেলিমগড় দুর্গ, হাম্মাম বা রাজকীয় স্নানাগার, শাহী বুর্জ (শাহজাহানের ব্যক্তিগত কর্ম অঞ্চল) এবং মোতি মসজিদ বা পার্ল মসজিদ। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত ব্রিটিশ শাসকদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করলে বিজয় প্রতীক হিসেবে ওইদিন লালকেল্লায় প্রথমবারের মতো ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। তারপর থেকে প্রতি বছরই ভারতের স্বাধীনতা দিবসে এখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে পতাকা উত্তোলন করা হয়।


 

 

চোখি ধানি : রাজস্থান

রাজস্থান। নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মরুভূমি, উট আর রাজকীয় ধাঁচের পোশাক পরিহিত নারী-পুরুষের ছবি। কল্পনায় চলে আসে রাজা-বাদশাহদের নির্মিত ঝলমলে এক শহর। বাস্তবেও তাই। ভারতের এ স্টেটে আজও প্রচলিত রয়েছে সেই ঐতিহ্যবাহী নাচ, গান, পোশাক, খাবারসহ অনন্য সব সংস্কৃতি। শহরজুড়ে গোলাপি রঙের বাড়িঘর এবং প্রাচীন রাজাদের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন ও রং-বেরঙের সংস্কৃতি চর্চাই এ শহরকে বানিয়েছে গোলাপি শহর। রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর। লোকে বলে, ভারতের এ প্রদেশটি সংস্কৃতির দিক থেকে এতই সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ যে দু-এক দিনে ঘুরে সবকিছু দেখা সম্ভব নয়। রাজস্থানের সামগ্রিক সংস্কৃতিকে এক আকাশের নিচে বসে উপভোগ করতে তৈরি করা হয়েছে ‘চোখি ধানি ভিলেজ’। এটি এমন একটি গ্রাম যেখানে রাজস্থানের অনন্য সব সংস্কৃতিকে একসঙ্গে পরিকল্পিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

জয়পুরের টংক রোডে অবস্থিত চোখি ধানি ভিলেজের শুরুতেই প্রবেশ দ্বার। দর্শনার্থীরা এখানে আসা মাত্রই ঢোল-ডাগর বাজিয়ে অভ্যর্থনা জানায় ধুতি পাঞ্জাবি আর পাগড়ি পরা একদল লোক। গলায় মালা ও কপালে চন্দনের টিকা লাগিয়ে অতিথিদের বরণ করে নেন রাজস্থানীরা। এরপরই দেখা যায় মিনি রাজস্থান। বিশেষ করে রাতেরবেলায় এটি স্বপ্নের মতো মনে হয়। গাছে গাছে দেখা যায় হারিকেন জাতীয় এক ধরনের আলোকসজ্জা। নির্দিষ্ট দূরত্বে সারি সারি ছাউনিসহ মঞ্চ। ছাউনিগুলোর একেকটিতে অবিরাম চলছে ঐতিহ্যবাহী ঘুঙর নাচ, পটের নাচ, কালবেলিয়া-সর্প নাচ কিংবা ভোপাভুপি নাচ। কোথাও চলছে পাপেট শো বা পুতুল নাচ। আছে বায়োস্কোপ, জাদুর খেল কিংবা সার্কাস সরূপ অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড। একপাশে রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী ঝলমলে পোশাক পরিহিত নারীরা বসে দর্শনার্থীদের হাত রাঙিয়ে দিচ্ছেন মেহেদির রঙে। চোকি ধানিতে উট কিংবা হাতির পিঠে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেকে। ঐতিহ্যবাহী পোশাক, নাগরা জুতা, চুড়ি, শাড়িসহ রাজস্থানকে তুলে ধরে এমন অনেক কিছুই কিনতে পাওয়া যায় এখানে। তবে এখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ চোখি ধানি খাবার। শালপাতার প্লেট ও বাটিতে কমপক্ষে ৩০ প্রকারের স্থানীয় খাবার পরিবেশন করা হয় এ রাজ্যে।  সব মিলিয়ে এক জমজমাট অবস্থা! রাজকীয় অভিজ্ঞতা!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর