শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মোসাদের কুখ্যাত যত অভিযান

সাদিয়া ইসলাম বৃষ্টি

মোসাদের কুখ্যাত  যত অভিযান

মোসাদ। ইসরায়েলি গোয়েন্দা বিভাগ। বিভিন্ন কারণে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মোসাদ জড়িয়েছে নানারকম আলোচনা-সমালোচনায়। কখনো প্রশ্নবিদ্ধ অভিযান চালিয়ে বিশ্বজুড়ে সমালোচনা কুড়িয়েছে। এসব অভিযান পরিচালনার কারণে মোসাদের ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক দিকটাই বেশি নজর কাড়ে। মোসাদেরই কয়েকটি অভিযান নিয়ে লিখেছেন- সাদিয়া ইসলাম বৃষ্টি

 

পারমাণবিক চোরাচালানি

 

১৯৬০ সাল। আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ায় অবস্থিত নিউক্লিয়ার ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট বা নিউমেকে হঠাৎ করে পারমাণবিক অস্ত্র ও জিনিসপত্র চুরির ঘটনা ঘটে। অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে চেষ্টা করা হয় কোথায় চুরি যাওয়া বা হারানো জিনিসগুলো রয়েছে সেটা খুঁজে বের করার। কিন্তু লাভ হয় না কিছুই। তখন সবচেয়ে বেশি কর্মী নেওয়ার মতো প্রতিষ্ঠান ছিল এই নিউমেক। যেটি এসব নানা কারণে হঠাৎ করেই সবার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। গুজব ছড়ায় নিউমেক নিজেদের পারমাণবিক বিক্রিয়ার ফলে রাস্তায় নানারকম ক্ষতিকারক রেডিয়েশন ছড়িয়ে দিয়েছে। তাদের কাছ থেকে চুরি যাওয়া ইউরেনিয়াম আর অস্ত্রগুলো পুঁতে রাখা হয়েছে চারপাশের নানাস্থানে। মাটির নিচে। যে কোনো সময়ই বিস্ফোরিত হতে পারে সেগুলো। ভয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় জনসাধারণ। কিন্তু নিউমেকের ভেতরের সবাই এটা নিশ্চিত জানত যে, এসব গুজব কেবলই গুজব। এবং গুজবগুলো যে ছড়িয়েছে সে আর কেউ নয়, ইসরায়েলি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি- মোসাদ। নিউমেকের প্রতিষ্ঠাতা জালমান শিপারো ছোটবেলা থেকেই ইহুদিদের প্রতি প্রচণ্ডভাবে সমব্যথী ছিলেন আর তাদের সাহায্য করতে সবসময়ই তৎপর ছিলেন।

আর তার এই মনোভাবই তাকে মোসাদের হাতে এই সরঞ্জামগুলো পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছে বলেও মনে করেন অনেকে।

তবে আমেরিকা থেকে হঠাৎ করেই এভাবে এতগুলো পারমাণবিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম হাওয়া হয়ে যাওয়ার খবর শুনে বসে থাকেনি প্রশাসন। তদন্ত করেছে তারা। তবে তদন্ত চলাকালীন সময়েও আরও একবার চুরির ঘটনা ঘটে। আর সেবারের চুরিটা আইএসওআরএডি নাম সংস্থাটির দ্বারা করা হয়েছে এবং ইসরায়েলই সেটা করেছে বলেও জানা যায়। যদিও সত্যিটা কি এবং কি করে এসব হলো কখনো জানা যায়নি। শিপরোকে এ জন্য অভিযুক্ত করা হলে নিজেকে নির্দোষ এবং নিরপরাধ বলে দাবি করেন নিউমেকের এই প্রতিষ্ঠাতা।

 

 

অবৈধভাবে অস্ত্র বিক্রি

 

শুধু অন্যদেশ থেকে নিজেদের কাছে অস্ত্র পাচার করা নয়, নিজেদের কাছ থেকে অন্যদের কাছেও দরকার মতো অস্ত্র চোরালান করাটাও আরেকটি খুব পরিচিত কাজ মোসাদের।

এমনিতে ইসরায়েল সব সময়ই ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করত। কারণ তাদের ছিল বাড়তি অস্ত্র আর ইরানের ছিল টাকা। যেটা একজন আরেকজনকে দিয়ে দিলে দুজনেরই সোনায় সোহাগা অবস্থা হতো। ফলে একটা সময় সবার চোখের সামনেই অস্ত্র বিক্রি করেছে ইসরায়েল ইরানের কাছে আর নিয়েছে নগদ টাকা। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় সমস্যা তৈরি হয় যখন এই অস্ত্র বিক্রিকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এতে আরও বেশি করে চুপিচুপি সেটা চলছিল। আর এ ক্ষেত্রে কাজটা করছিল মোসাদ।

সাদ্দামকে পছন্দ করত না ইরান বা ইসরায়েলের কেউই। ফলে তাকে উৎখাত করতে জোরালোভাবে এ সময় অবৈধ উপায়ে অস্ত্র বিক্রি শুরু হয়। আমেরিকা পুরো ব্যাপারটি জানত। তবে এ নিয়ে তারাও খুব একটা কথা বলতে চায়নি। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার তো নয়ই। কার্টার সে সময় পুরোপুরিই এ ব্যাপারটির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেন। পুরোদমে চলতে থাকে অস্ত্র বিক্রি।

হয়তো চলতোও। তবে হঠাৎ করে এ প্রক্রিয়ায় বাধা পড়ে যখন ১৯৮১ সালে ইসরায়েল থেকে ইরানে যাওয়ার পথে সোভিয়েট ইউনিয়নের টার্কির সীমান্তে গিয়ে ধ্বংস হয় একটি বিমান। ব্রিটিশ খবরের কাগজ দ্য অবজারভারে পুরো ঘটনা প্রমাণসহ ফলাও করে প্রচার করা হয়। এ কাজে তাদের সাহায্য করে মোসাদের সঙ্গে জড়িত অস্ত্র ব্যবসায়ী ইয়াকম নিমরোদি।

তবে পুরো প্রক্রিয়াটির প্রস্থাবক কি আমেরিকা ছিল, নাকি ইরান বা ইসরায়েল সেটা জানা যায়নি। এ তো গেল কেবল ইরানে অবৈধভাবে অস্ত্র বিক্রি। এ ছাড়াও পিএলওর কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে নিকারাগুয়ার কাছে বিক্রিসহ হাজার হাজার অবৈধ অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ছিল মোসাদ।

 

আবার সালামেহ

 

 

একবার সালামেহকে হত্যার চেষ্টায় বিফল ও প্রচণ্ডভাবে সমালোচিত হয়েও থেমে থাকেনি মোসাদ। এ ঘটনার পাঁচ বছর পরে আবার তারা চেষ্টা করে সালামেহকে মেরে ফেলার। খুঁজতে শুরু করে তাকে। তবে এর ভেতরে আরেকটি ছোট্ট ব্যাপার জানতে ভুলে গিয়েছিল তারা। সেটা হচ্ছে পাঁচ বছরের মধ্যে সালামেহ নগণ্য এক সালামেহ থেকে হয়ে উঠেছিল সিআইএর সম্পদ। সালামেহর সব ধরনের যোগাযোগ, জানা-শোনা- সবটা নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল সিআইএ ফিলিস্তিনের পক্ষ থেকে আমেরিকার ওপর কোনো রকমের আক্রমণ প্রতিহত করতে। মোটকথা সিআইএর হয়ে কাজ করছিল তখন সালামেহ।

যেটা জানত না মোসাদ। তবে জানার চেষ্টা করেছিল তারা। কিন্তু সালামেহের সঙ্গে থাকা সুসম্পর্কের দরুন স্পষ্টভাবে মোসাদকে ‘কোনো সম্পর্ক নেই’ জানিয়ে দেয় সিআইএ। ফলে শান্তিতে নিজেদের কাজে এগিয়ে যায় মোসাদ। সালামেহর তখন প্রথম স্ত্রীকে ছেড়ে নতুন স্ত্রী ১৯৭১ সালের মিস ইউনিভার্স জরজিনা রিজকের সঙ্গে নতুন সংসার। সিআইএর কাছ থেকে ফিলিস্তিনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আর হানিমুনের কিছু অর্থ ছাড়া কিছুই নেয়নি সালামেহ নিজের সাহায্যের জন্য। ফলে সিআইএ কখনোই কাউকে জানায়নি সালামেহর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা।

মোসাদ তাই কোনোভাবেই সালামেহর সঙ্গে সিআইএর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ না পেয়ে অনুসরণ করতে থাকে সালামেহকে। তার ঘর, বাড়ি, চলার গতিবিধি- সবটা জেনে নেয় মোসাদের সদস্য এরিকা চেম্বারস ছদ্মবেশে গিয়ে। আর এরপর মোসাদ ঠিক করে কি করে মারা হবে সালামেহকে। প্রতিদিন পিএলওর প্রধান দফতরে যাওয়াটা নিত্যনৈমত্তিক কাজ ছিল সালামেহের। মোসাদ সদস্যরা এই পথের মাঝেই একটা ভক্সওয়াগনে করে প্রচুর বোমা আর বিস্ফোরক রেখে দেয়। সালামেহ পাশ দিয়ে যেতেই সেটা উড়িয়ে দেয় তারা। ঘটনাস্থলে সালামেহ আর তার গাড়িচালক ছাড়াও মারা যায় মোট নয়জন।

 

 

সুন্দরী নারীর টোপ

 

নিজেদের কাজে কখনো যদি কোনো শত্রু এসে পড়ে মোসাদের সামনে তাহলে সেই শত্রুকে হয় সঙ্গে সঙ্গেই নেই করে দেওয়া হয়, কিংবা নেওয়া হয় অন্য কোনো পদ্ধতি। আর এই অন্য কোনো পদ্ধতির ভেতরেই মোসাদের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পদ্ধতিটি হচ্ছে হানিট্র্যাপ বা সুন্দরী নারীর টোপ। এই টোপ দেওয়ার সময় সঠিক মানুষকে বেছে নিয়ে তাকে কোনো এক নারীর প্রতি ভালোবাসায় আসক্ত করে ফেলে মোসাদ। আর তারপরই শুরু হয় আসল খেলা। টোপ গিলে ফেললেই যেমন শিকারকে খেলিয়ে খেলিয়ে জালে তোলা হয়, তেমনি এই নারীরাও কাক্সিক্ষত মানুষটিকে নিয়ে যায় মোসাদের ডেরায় আর ধরিয়ে দেয়। এরপরের ব্যাপারটা মোসাদই জানে। ঠিক এমনটিই ঘটনা ঘটেছিল বিজ্ঞানী ও দিমোনা নিউক্লিয়ার কমপ্লেক্সের টেকনিশিয়ান মোরদেশাই ভানুনুর সঙ্গে। সিদ্ধান্ত নেন ইসরায়েলের পারমাণবিক কার্যক্রমের পরিকল্পনা নিয়ে ব্রিটিশ খবরের কাগজ সানডে টাইমসে কিছু গোপন কথা প্রকাশ করার। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই তাকে সুরক্ষিত থাকতে বলে দেওয়া হয় ওপর মহল থেকে। কিন্তু খুব একটা পাত্তা দেননি ভানুনু এই নির্দেশকে। অন্য সব দিনের মতোই সেদিনও রাস্তায় বের হন তিনি আর রাস্তাতেই তার আলাপ হয় সিন্ডি নামের এক (ছদ্মনাম) সুন্দরীর সঙ্গে। ভানুনু খুব যে আকর্ষণ বোধ করেছিলেন সিন্ডির দিকে, তা না। তবে কথা চালিয়ে যান তিনি আর এক পর্যায়ে জানতে চান সিন্ডি মোসাদের সদস্য কিনা। সিন্ডি ভান করে, সে এই নামটা প্রথমবার শুনছে। এরপর তারা ধীরে ধীরে একে অন্যের প্রতি দুর্বল হয় এবং সিন্ডির বোনের বাড়িতে বেড়াতে গেলে মোসাদের সদস্যরা গ্রেফতার করে ভানুনুকে। নিয়ে যায় কারাগারে ১৮ বছরের জন্য। প্রথমে সিন্ডিকে নির্দোষ ভাবলেও পরে ভানুনু জানতে পারেন সিন্ডি আসলে মোসাদেরই এক কর্মী- শেরিল হানিন।

 

খালেদ মাশালকে হত্যার চেষ্টা

 

১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে হামাসের এক বোমা বিস্ফোরণে ইসায়েলের ১৬ জন মানুষ মারা যায় আর ১৬৯ জন আহত হয়। অবশ্য এ ঘটনায় মারা যায় বোমারুরাও। তবে সে জন্য নিজেদের প্রতিশোধ নেওয়া থেকে পিছিয়ে যায়নি মোসাদ।

পরিকল্পনা করে তারা এই হামলার প্রতিশোধ হিসেবে হামাস নেতা খালেদ মাশালকে হত্যা করার। আর এ জন্য তখন নতুন নির্বাচিত হওয়া বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর কাছ থেকেও অনুমতি পান তারা। নতুন এক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে খালেদ মাশালকে হত্যার চেষ্টা করা হয় যেটা কিনা ডাক্তারি পরীক্ষায় কেউ বুঝতে পারবে না। আর এ কাজ সম্পন্ন করতে সে বছরই কানাডার পাসপোর্ট জাল করে জর্দানে চলে যায় মোসাদের সদস্যরা। খালেদ মাশাল নিজের এসউইভি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর বাসা পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তাটুকু পার হওয়ার সময় তাকে মারা হবে এরকমটাই পরিকল্পনা করা হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় বেরি বিডস আর সিন কেনডালকে। পরিকল্পনামতো সবটাই ঠিক ছিল। হাতে একটা কোকের ক্যান নিয়ে তৈরি ছিলেন বেরি আর সিন। খালেদের কাছে যেতেই কোকের ক্যান খুলে তার দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়া আর সেই সময়েই তাকে রাসায়নিক দ্রব্য দ্বারা মেরে ফেলাটাই ছিল তাদের কাজ। কিন্তু সবটা গড়বড় হয়ে যায় যখন গাড়ি থামতেই খালেদ মাশালের মেয়ে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে দৌড়তে শুরু করে আর তার পেছনে ছুটে যায় খালেদ আর তার গাড়িচালক। বাইরে থেকে সংকেত দেওয়া হয় কাজটা থামিয়ে দেওয়ার।

কিন্তু সেদিকে তখন মনযোগ ছিল না বেরি বা সিনের। নিজেদের কাজ চালু রাখে তারা আর শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। কাজটা সম্পন্ন না করেই। তদন্ত করে জানা যায় মোসাদের নাম।

ইসরায়েল আর মোসাদ প্রচণ্ড সমালোচিত হয়। রেগে যায় জর্ডান। রেগে যায় কানাডাও তার মিথ্যা পাসপোর্ট ব্যবহারের জন্য। পরবর্তীতে বেরি আর সিনকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে এর বদলে মুক্তি দিতে বলা হয় জেলে আটক হামাস নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকেও।

 

 

লিলহ্যামারের প্রতিশোধ

 

ঘটনার শুরু ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকের মাধ্যমে। সে সময় সন্ত্রাসী সংগঠন ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের গুলিতে মারা যায় ইসরায়েলের এক শরীরচর্চাবিদ। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে যায় মোসাদ। ফিলিস্তিনি ভাষান্তরকারী ওয়ায়েল জুয়েইটারকে প্রথমে হত্যা করে তারা। এরপর মারে প্যারিসে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের ঊর্ধ্বতন মাহমুদ হামশারিকে। কিন্তু এতটুকুতেই থেমে থাকেনি তারা। তাদের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল মিউনিখ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী আলি হাসান সালামেহ। সুতরাং তাকে খুঁজতে থাকে মোসাদ আর শেষে নিশ্চিত হয়, সালামেহ এখন নরওয়েতে রয়েছে। দ্রুত সেখানে চলে যায় মোসাদের দল।

এত মানুষ একসঙ্গে লিলহ্যামারে খুব কম আসে। এমনিতেও খুব একটা বড় শহর নয় এটি নরওয়ের। ফলে ব্যাপারটা চোখে পড়ে পুলিশের। তারা নজর রাখছিল চারপাশে। সূ² নজর রেখে চলেছিল শহরের সবদিকে। অন্যদিকে নজর ফেরায়নি মোসাদ কর্মীরাও সালামেহের ওপর থেকে। তবে ছোট্ট একটা ভুল হয় তাদের। তারা সালামেহ ভেবে হোটেলের এক সামান্য পরিবেশক আহমেদ বোওচিকিকে সালামেহ ধরে বসে থাকে। ভুলটা কেবল তখনকার সময় মোসাদের এই অপারেশনের সবচাইতে আত্মবিশ্বাসী নেতা মাইক হারারিই করেনি। ভুল করেছিল ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর আর মোসাদ দুজনের হয়েই কাজ করা গুপ্তচর কেমাল বেনামানেও। এতে বাড়ি ফেরার পথে অহেতুক নিজের প্রাণটা খোয়ায় বোওচিকি। চারপাশে পুলিশ সতর্ক ছিল। ঝটপট চলে আসে তারা ঘটনাস্থলে। দলনেতাসহ বাকি সবাই চলে যেতে পারলেও ধরা পড়ে মোট ছয়জন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে মোসাদের এই ঘৃণ্য চক্রান্তের কথা। বেশ সমালোচিত হয় মোসাদ আরও একবার তখন নিজেদের এমন কাজের জন্য। ইউরোপে চালানো সেফ হাউস, ড্রপ বক্স, সিক্রেট ফোন নাম্বারস-সহ সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় তারা।

 

 

 

নকল পাসপোর্ট

২০১০ সালে হঠাৎ করেই আবার

সমালোচনার শীর্ষে উঠে আসে মোসাদ, যখন অস্ট্রেলিয়ার পাসপোর্ট নকল করে দুবাইয়ে প্রবেশ করে হামাস নেতা মাহমুদ আল মাবহোকে খুন করে তারা। এ সময় তিনটি নকল পাসপোর্ট ব্যবহার করে মোসাদের কর্মীরা। তারা এর আগেও এরকমটা করেছে বলে ধারণা করে সে সময় অনেকে। তবে অস্ট্রেলিয়া এ ঘটনায় প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয় এবং পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়, তাদের এই কর্মকাণ্ডে ইসরায়েলের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে। শুধু অস্ট্রেলিয়াই নয়। এ ঘটনায় রেগে যায় জার্মানি, ফ্রান্স. আয়ারল্যান্ড ও ব্রিটেনসহ বেশকিছু দেশ।

যারা দাবি করে নিজেদের দেশে মোসাদের কর্মীদের নকল পাসপোর্ট দেখিয়ে প্রবেশের ব্যাপারে সন্দেহ নিয়ে। এর আগে মোসাদকে নিয়ে কাজ করা ভিক্টর অস্ট্রোভস্কির মতে এভাবে পাসপোর্ট নকল করা আর যে দেশে প্রবেশ করছি সেটার ভাষা বা বলার ভঙ্গি নকল করাটা এমন কোনো বড় ব্যাপার নয়। সুতরাং এটা হতেই পারে। তিনি এটাও দাবি করেন, মোসাদের একটা আলাদা সংস্থাই রয়েছে যাদের কাজ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পাসপোর্টকে নকল করে নিজেদের নামে ব্যবহার করা। কারণ এতে করে বেশ কয়েকটি সুবিধা পায় তারা।

 নিজেদের কাজের দায়ভার অন্যদের ওপর চাপাতে পারে, দেশের ভেতরে সম্পর্ক নষ্ট করে দিতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলের নাগরিক হওয়ার ফলে যে বাড়তি ঝামেলার ভেতর দিয়ে যেতে হয় সেটা পরিহার করা যায়।

তবে মোসাদ ভিক্টরের এ দাবিগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেয়। যদিও সবাই জানে, শুনতে খুব এটা ভিত্তিহীন আদতে এ দাবিগুলো অসত্য নয়। আর এ জন্যই সতর্কতামূলক নানারকম ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন সবাইকে ভিক্টর। এর ভেতরে ২০১১ সালে কিছু ব্রিটিশ-ইসরায়েলি নাগরিকের পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে তাদেরও সতর্ক করে দেন তিনি মোসাদের পক্ষ থেকে আসতে পারা কোনো আক্রমণ বা বার্তার ব্যাপারে।

 

 

বৈরুতের বোমাবাজি

 

১৯৮৩ সালের কথা। হঠাৎ করেই ফিলিস্তিনের এক শিয়া সন্ত্রাসী হামলায় বৈরুতের কাছে আমেরিকার মেরিন ব্যারাকের একটি ট্রাকে রাখা বোমা বিস্ফোরিত হয়ে মারা পড়ে প্রায় ২৪০ জন আমেরিকান।

মোসাদ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ভিক্টর অস্ট্রোভস্কির মতে এটা আরও আগেই জানত ইসরায়েল যে আমেরিকায় হামলা হবে এবং প্রত্যেকটা খুঁটিনাটিই জানত। মোসাদের প্রধান নাহুম আদমোনি খুব ভালো করেই হিজবুল্লার একটি দল বোমা রাখছে আমেরিকার ট্রাকে সেটা জেনেও কেন সতর্ক করেননি আমেরিকাকে? তাও নিজের মিত্র হওয়া সত্ত্বেও? নিজের মতামত দিতে গিয়ে ভিক্টর জানান, এখানে জড়িয়ে রয়েছে মোসাদের লাভের ব্যাপার। কারণ যদি ফিলিস্তিনের কোনো বোমা হামলায় আমেরিকার কিছু মানুষ মারা যায় তাহলে ফিলিস্তিনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক আরও খারাপ হয়ে যাবে। এছাড়াও আমেরিকা বেশ বড় দেশ।

একটু কিছু হারালে তার গায়ে লাগবে না। কিন্তু ফিলিস্তিনের সঙ্গে আমেরিকার বাজে সম্পর্ক ইসরায়েলকে এনে দেবে অনেক বেশি স্বস্তি।

আর সব ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনকে গুঁড়িয়ে দিতে সাহায্য পাবে তারা আমেরিকার। এসব ভেবেই শেষ পর্যন্ত আমেরিকাকে জানায়নি তারা। তবে সেটা যে একেবারেই জানায়নি তা নয়। খানিকটা বিপদের আশঙ্কা জানিয়েছিল তারা আমেরিকাকে। তবে ওরকম তো হরহামেশাই আসতে থাকে। তাই খুব একটা আমলে নেয়নি আমেরিকা। তবে পুরোটা অর্থাৎ নিজের জানা সবটা যদি মোসাদ আমেরিকাকে বলত তাহলে হয়তো ঘটনাটি ঘটত না বেইরুতে। কিংবা ঘটলেও এতগুলো মানুষ মারা পড়ত না।

সর্বশেষ খবর