বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

ডেয়ারিং বেয়ার গ্রিলস

রণক ইকরাম

ডেয়ারিং বেয়ার গ্রিলস

নাম তার বেয়ার গ্রিলস। বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়মানব। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাডভেঞ্চার শো ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’-এ তার অবিশ্বাস্য সব স্টান্ট, ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা, অদম্য সাহস, বেঁচে থাকার জন্য অনায়াসে বিভিন্ন অখাদ্য-কুখাদ্য গিলে ফেলার ক্ষমতা তাকে পরিণত করেছে রহস্যময় ব্যক্তিতে। অনেকেই জানেন না তিনি একাধারে একজন সাবেক বিশেষ সেনা কমান্ডো, এভারেস্টজয়ী এবং বর্তমানে বিশ্ব স্কাউট সংস্থার প্রধান। শুধু তাই নয়, তার ব্যক্তিগত জীবনও হার মানায় রোমাঞ্চকে। তাকে ঘিরেই আজকের আয়োজন—

 

অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় সেই কিশোর

জন্ম ১৯৭৪-এর ৭ জুন। পুরো নাম অ্যাডওয়ার্ড মাইকেল বেয়ার গ্রিলস। বাবা মাইকেল গ্রিলস ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ এবং মা সারা গ্রিলস। তার নামটা অবশ্য বাবা অথবা মায়ের দেওয়া ছিল না। নাম দিয়েছিলেন বেয়ারের বোন লাটা পসিট। বেয়ার আয়ারল্যান্ডে বেড়ে ওঠেন চার বছর পর্যন্ত। ছোটবেলা থেকেই বেয়ারের মধ্যে ডানপিটেপনা জড়িয়ে ছিল দারুণভাবে। নৌকা চালানো এবং পাহাড়ে চড়া শিখেছেন একেবারে ছোটবেলায়। আট বছর বয়সে তিনি কাব স্কাউট হন। একই বয়সে বেয়ারের বাবা তাকে মাউন্ট এভারেস্টের একটি ছবি দেন। তখন থেকেই তার মনে গেঁথে যায় এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন। এখান থেকেই হয়তো অ্যাডভেঞ্চারের বীজ বপিত হয়েছিল বেয়ারের কচি মনে।

কৈশোরে শেখেন স্কাই ডাইভিং এবং মার্শাল আর্ট। কে জানত সেই ছোট্ট ছেলেটিই এক সময় হয়ে ওঠবে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাডভেঞ্চার ম্যান!

ইটন হাউস, লুগ্রোভ স্কুল এবং ইটন কলেজে পড়াশোনা করেছেন। ইটন কলেজের ছাত্রাবস্থায় তিনি সেখানকার প্রথম পর্বতারোহণ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ইংরেজি ভাষা ছাড়াও স্প্যানিশ এবং ফরাসি ভাষাও জানেন। পড়াশোনা শেষ করে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। এ সময় তিনি বিভিন্ন পরিবেশে বেঁচে থাকার কলাকৌশলগুলো রপ্ত করেন।

 

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির...

রবি ঠাকুরের এই লাইন সম্ভবত তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। কেবল ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি প্রমাণ করেছেন অদম্য ইচ্ছা থাকলে জয় করা সম্ভব যে কোনো প্রতিকূলতাকেই। কোনো পরিস্থিতিতেই যেন হারতে শেখেনি ইংল্যান্ডের এই ছেলেটি।

বর্তমানের দুনিয়া কাঁপানো দুঃসাহসী বেয়ার গ্রিলসকে এক সময় বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল! এমনকি ধারণা করা হয়েছিল চিরতরে হাঁটার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলবেন তিনি। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর বেয়ার ইউনাইটেড কিংডম  স্পেশাল ফোর্স রিজার্ভে কাজ করেন।

স্পেশাল এয়ার সার্ভিসে তিনি ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিন বছর কাজ করেন। ১৯৯৬ সালে জাম্বিয়ায় একটি প্যারাসুট দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন। এ সময় বেয়ারের চিরতরে হাঁটার ক্ষমতা বন্ধের আশঙ্কা দেখা দেয়।

তখন তার পিঠের হাড় এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে ডাক্তাররা বলেই দিয়েছিলেন, তার সুস্থ হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে বাধ্যতামূলকভাবেই সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিতে হয় তাকে। কিন্তু দুঃসাহসী বেয়ার হার মানেননি। কিন্তু মেডিকেল সায়েন্স আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেন বেয়ার। কারণ একটাই— মনের জোর।

মাত্র ২৩ বছর বয়সেই এভারেস্টের চূড়ায়

১৯৯৬ সালের সেই প্যারাশুট দুর্ঘটনার পর প্রায় এক বছরের বেশি সময় বেয়ার সব কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করেন। তখনই তার শৈশবের লালিত স্বপ্ন মাউন্ট এভারেস্ট জয় করার নেশা চেপে বসে মনে। অদম্য বেয়ার তার দুর্ঘটনার ১৮ মাসের মধ্যেই মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় চড়ে বসেন। ১৯৯৮-এর ১৬ মে মাত্র ২৩ বছর বয়সী একটা ছেলে এভারেস্টের শৃঙ্গ জয় করে ফেলেন।

একটা পরিসংখ্যান বলে এটাই প্রথম। এত কম বয়সী কোনো মানুষ এর আগে এভারেস্ট জয় করতে পারেনি। তবে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। বাবার কাছ থেকে পাওয়া বেয়ারের যে শুধু এভারেস্ট জয় করার কৃতিত্ব রয়েছে তা কিন্তু নয়। ডেমন্ড হিলারির পর সবচেয়ে কম বয়সে ব্রিটেনের হয়ে হিমালয়ের সবচেয়ে দুর্গম শৃঙ্গ ‘আমা ডাবলান’ পিক জয়েরও রেকর্ড রয়েছে বেয়ারের।

বেয়ার তার আত্মজীবনী ‘মাড সোয়ে অ্যান্ড টিয়ারস’-এ লিখেছেন ২৬ মে ১৯৯৮ সালের সকালটা তার জীবনের সেরা সকাল। তিনি সেদিন পৃথিবীর সূর্য ওঠা দেখেছিলেন এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে। বেয়ার এভারেস্ট রওনা হওয়ার সময় তার বাবার দেওয়া এভারেস্টের বড় পোস্টারটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। ২০০১ সালে বেয়ারের বাবা প্রয়াত হন। বেয়ার সেদিন হারিয়েছিলেন তার আইডলকে।

 

ফ্যাক্ট ফাইল : একঝলক

>> ছোটবেলায় বেয়ারের প্রিয় টিভি শো ছিল ম্যাকগাইভার।

>> বেয়ার  কারাতে ব্ল্যাক বেল্টপ্রাপ্ত।

>> ১৯৯৮ সালে ২৩ বছর বয়সে এভারেস্ট জয় করার পর সর্বকনিষ্ঠ এভারেস্ট জয় করে গিনেস বুকে নাম লেখান। পরে এ রেকর্ড ভাঙা হয়েছে।

>> মাউন্ট এভারেস্ট জয় করতে তার সময় লেগেছিল মাত্র ৯০ দিন।

>> ব্রিটিশ স্পেশাল এয়ার সার্ভিসে তিন বছর কাজ করার পর এভারেস্ট জয়ের বছরখানেক আগে প্যারাশুট নিয়ে লাফ দিতে গিয়ে একটি দুর্ঘটনায় পড়েন। দুর্ঘটনায় তার মেরুদণ্ডের তিনটি হাড় ভেঙে যায়।

>> বেয়ার গ্রিলসের লেখা ‘ফেসিং আপ’ বইটি ব্রিটেনে সেরা ১০ বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় ছিল। পরবর্তীতে আমেরিকায় বইটি প্রকাশিত হয়।

>> বেয়ারের মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের ঘটনা নিয়ে একটি ডিওডোরেন্ট কোম্পানি তাকে নিয়ে বিজ্ঞাপন  তৈরি করলে তিনি সর্বপ্রথম টিভিতে আসেন।

>> তার প্রথম টিভি শো ছিল চ্যানেল ফোর-এ। নাম ছিল ‘এসকেপ টু দ্য লিজিয়ন’।

>> এরপরই তিনি ডিসকভারি চ্যানেলে ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ নামে একটি টিভি শো করেন, যেখানে এক ঘণ্টার ১২টি পর্ব ছিল।

>> ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ আমেরিকার এক নম্বর টিভি শো হিসেবে জায়গা করে নেয়। পৃথিবীর ২০০ দেশে ১.২ বিলিয়ন দর্শক এ শোটি দেখেন।

>> ২০০৭ সালে তিনি প্রথম ব্যক্তি হিসেবে একটি শক্তিচালিত প্যারাগ্লাইডারে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ার উপরে উড্ডয়ন করেন। তার এই প্রচেষ্টা ২.৪ মিলিয়ন ডলার অনুদান জোগাড় করে।

>> ২০০৯ সালে ৩৫ বছর বয়সে পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ চিফ স্কাউট হিসেবে তিনি স্কাউট অ্যাসোসিয়েশনে নিযুক্ত হন।

>> ১৯৯৭ সালে তিনি সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে হিমালয়ের আমা দাবলাম শৃঙ্গে চড়েন।

 

বারাক ওবামাও তার ভক্ত

বিশ্বজুড়ে তার অনেক ভক্ত। কিন্তু এই ভক্ত তালিকায় যদি উঠে আসে বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টের নাম তাহলে চমকে উঠতেই হয়। শুধু ভক্ত হলেও না হয় সাধারণ ঘটনা মানা যেত, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ওবামা যদি হন তার শোয়ের সঙ্গী তাহলে সেটা কিন্তু আরও বড় চমক। আলাস্কার কনকনে ঠাণ্ডায় বেয়ারের অতিথি হয়েছেন পর্দার কোনো তারকা নন, স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা! বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী এই ব্যক্তির সঙ্গে তিন দিন কাটান বেয়ার। নিরাপত্তার কথা ভেবে ওবামা ও বেয়ার গ্রিলসের ‘রানিং ওয়াইল্ড’ অনুষ্ঠানের এই পর্বের দৃশ্যধারণের দিনক্ষণ গোপন রাখা হয়। তবে আলাস্কায় সিক্রেট সার্ভিসের প্রতিনিধিও ছিলেন। এর আগে তারকাদের নিয়ে এমন সুরক্ষা ব্যবস্থায় কাজ করেননি বেয়ার। এর মধ্যেও মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একলা সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এই পর্বে ভল্লুকের আধা-খাওয়া স্যামন মাছ খেয়েছেন ওবামা। জঙ্গলে একা বেঁচে থাকার জন্য যা যা করার প্রয়োজন, সবই করেছেন তিনি। বিশ্বের পরিবেশ দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে পরিবেশের জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার বার্তা দিতে চেয়েছেন ওবামা।

 

সত্যিকার বিস্ময়মানব

অনেকেই ভাবতে পারেন, বেয়ার গ্রিলস তো শুধু টিভিতে মুখ দেখানো একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। এরকম তো বহু মানুষই আছেন বিশ্বের আনাচে-কানাচে। কিন্তু বেয়ারের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা তাকে ‘স্পেশাল’ হতে সাহায্য করেছে। তাতে কি? ‘দেয়ার ইস নাথিং ডেঞ্জারাস ইন লাইফ, দ্যান নট টেকিং রিস্ক’— জীবনে ঝুঁকি না নেওয়ার চেয়ে বড় ভুল আর কিছুতে নেই। ব্রিটেনের স্পেশাল এয়ারফোর্সের সদস্য ছিলেন বেয়ার গ্রিলস। আর তার ভয়ানক সব অ্যাডভেঞ্চার করার কৌশল আমরা দেখতে পাই এই স্পেশাল এয়ারফোর্সের দেওয়া প্রশিক্ষণের কারণেই। ২০০৫ সালে ২৪,৫০০ ফুট উঁচুতে প্যারাশুটে উঠে ডিনার করার অবিশ্বাস্য রেকর্ডটাও বেয়ার করেছেন। তার মতো স্কাইডাইভার পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া কঠিন। সাহারা মরুভূমি থেকে আন্টার্কটিকা, সাইবেরিয়া, আমাজন— পৃথিবীর সেসব দুর্গম জায়গা থেকে বেঁচে ফিরে আসার পথ মানুষকে দেখিয়ে দেন বেয়ার।

তার অনুষ্ঠানে বেয়ার গ্রিলস সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করেছেন, হেলিকপ্টার থেকে প্যারাশুট নিয়ে নেমেছেন, প্যারাগ্লাইডিং করেছেন, বরফ-আবৃত পাহাড় বেয়েছেন, গভীর অরণ্যের আগুনের মধ্য দিয়ে দৌড়েছেন, সাপ, পোকামাকড় কীট-পতঙ্গ খেয়েছেন, মরুভূমির কড়া রোদ থেকে বাঁচতে প্রস্রাবভেজা টিশার্ট দিয়ে মাথা আবৃত করেছেন, সাপের খোলসের মধ্যে প্রস্রাব জমিয়ে রেখে পান করেছেন, হাতির মল নিঃসৃত তরল পান করেছেন, হরিণের বিষ্ঠা খেয়েছেন, কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন,সিলের চামড়াকে পোশাকের মতো বানিয়ে সাঁতারের সময় হ্রদের হিমশীতল পানি থেকে বাঁচতে সেটি পরিধান করেছেন, জলপ্রপাত থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, বাঁশ দিয়ে ভেলা বানিয়ে সাগর পাড়ি দিয়েছেন, সাগরের তলদেশে যন্ত্র ছাড়াই মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী শিকার করে খেয়েছেন। দুর্গম পরিবেশে টিকে থাকার জন্য এমনি হাজারো কৌশল তিনি তুলে এনেছেন নিপুণভাবে।

জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’-এর জন্য যার এত খ্যাতি সে বেয়ার বিতর্কে জড়িয়েছেন এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই। এরপরও বেয়ার পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন। আট থেকে আশি সবাই তার ভক্ত। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ২০০৯ সালে বেয়ার ব্রিটিশ স্পেশাল এয়ারফোর্সের চিফ স্কাউন হন। এত কম বয়সে এ পদে বসার রেকর্ড বিশ্বে আর কারও নেই। বেয়ারের মতো জনপ্রিয় বক্তা খুব কম রয়েছে।  বিভিন্ন বিশ্ব রেকর্ডের মালিক বেয়ার গ্রিলস বিভিন্ন মানবকল্যাণ ও জনহিতকর কর্মকাণ্ডেও জড়িত আছেন সমানভাবে।

 

 

 

ব্যক্তিগত জীবনে বেয়ার খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। ২০০০ সালে বেয়ার বিয়ে করেন তার ছোটবেলার সঙ্গী সারা ক্যানিংকে। তিন পুত্র সন্তানের গর্বিত বাবা বেয়ার গ্রিলস। তারা হলেন- জেস, মার্মাডিউক এবং হাকলবেরি। লন্ডনে টেমসের পাশে গোটা একটা আইল্যান্ড কিনে সেখানে নিজের স্বপ্নের রাজপ্রসাদ গড়েছেন বেয়ার।

 

টেলিভিশনে রাজত্ব

দুঃসাহসী, দুর্ধর্ষ অভিযাত্রী বলতে এ সময়ে যদি কারও নাম উচ্চারণ করতে হয়, তাহলে সবার আগেই চলে আসে বেয়ার গ্রিলসের কথা। পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক, দুর্গম জায়গায় প্রতিকূল পরিবেশে কীভাবে টিকে থাকতে হয় তা তিনি আমাদের দেখান নিজের জীবন বিপন্ন করে। বেয়ার গ্রিলসের এ খ্যাতির পুরোটাই কিন্তু টেলিভিশনের কল্যাণে। চলুন পরিচিত হই তার খ্যাতিমান কিছু টেলিভিশন শো’র সম্পর্কে—

এস্কেপ টু দ্য লিজিওন

২০০৫ সালের কথা। বেয়ার গ্রিলস এবং তার ১১ জন সহযোগী সাহারা মরুভূমিতে একটি সারভাইভাল মিশন চালান। এখান থেকে সাহারা মরুভূমিতে প্রশিক্ষণের ওপর এস্কেপ টু দ্য লিজিওন নামে একটি টেলিভিশন শো নির্মাণ করেন।

এটি যুক্তরাজ্যের চ্যানেল ফোর এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি চ্যানেলে প্রচারিত হয়। প্রথম নির্মিত টেলিভিশন শো-তেই আশাতীত সাড়া পাওয়ায় উদ্যমী হয়ে ওঠেন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বেয়ার। ২০০৮ সালে বেয়ারের এ শোটি যুক্তরাজ্যের হিস্টোরি চ্যানেলে পুনঃপ্রচারিত হয়।

বর্ন সারভাইভাল/ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড

এস্কেপ টু দ্য লিজিওনের সাফল্যের পর বেয়ার চ্যানেল ফোরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন এবং একটি টিভি শো শুরু করেন যার নাম দেওয়া হয় ‘বর্ন সারভাইভাল’।

 এটি যুক্তরাজ্যের চ্যানেল ফোর-এ প্রচার করা হয়। একই অনুষ্ঠান অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রে ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড নামে প্রচারিত হয়। এছাড়া ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার অনেক দেশে এটি আল্টিমেট সারভাইভাল নামে ডিসকভারি চ্যানেলে প্রচারিত হয়। এ অনুষ্ঠানে, বেয়ার গ্রিলসকে কোন প্রতিকূল পরিবেশে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই পরিবেশে প্রতিকূলতার মধ্যে কীভাবে বেঁচে থাকতে হয় সেটাই দর্শকদের সামনে তুলে ধরেন গ্রিলস।

এ অনুষ্ঠান দেখে এখন অনেকের বিভিন্ন ধরনের মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে যেমন মনোবল শক্ত হওয়ার পাশাপাশি খাবার গ্রহণে খুঁতখুঁতে ভাবটা এখন আর অনেকের মধ্যে নেই। যেমন খাবারে চুল, পিঁপড়া, তেলাপোকা বা কীটজাতীয় কিছু পেলেই আগে খাবার খাওয়া বন্ধ হয়ে যেত। তরকারিতে হলুদ, মরিচ, মসলা কম হলেই খেতে অরুচি লাগত। মাংস সিদ্ধ কম বা শক্ত থাকলে খেতে ইচ্ছা করত না। এ ধরনের ছোটখাটো সমস্যা বেয়ার গ্রিলস তার এ জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাধান করেছেন।

ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড শুরু হয় ২০০৬ সালে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় টেলিভিশন শোতে পরিণত হয়।

২০০৬ থেকে ২০১২ এর মার্চ পর্যন্ত তিনি চ্যানেল ফোর তথা ডিসকভারি চ্যানেলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকেন এবং মতের অমিল হওয়াতে চ্যানেল ফোর এ অনুষ্ঠানটি বানানো বন্ধ করে দেয়। সারা বিশ্বে ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’-এর দর্শক প্রায় ১.২ বিলিয়ন।

ওর্স্ট কেস সিনারিও

২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডিসকভারি চ্যানেলে খুব খারাপ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার কৌশল নিয়ে বেয়ারের নতুন একটি শো শুরু হয়। বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এর ১২টি পর্ব প্রচারিত হয়েছিল।

আরও কিছু শো

এছাড়াও বেয়ার গ্রিলসের অন্য শোগুলোর মধ্যে রয়েছে বেয়ারস ওয়াইল্ড উইকেন্ড, গেট আউট এলাইভ উইথ বেয়ার গ্রিলস, এসকেপ ফ্রম হেল, দ্য আইল্যান্ড, মিশন সারভাইব, সারভাইবর গেমস  প্রভৃতি অন্যতম।

ডিওডোরেন্টের বিজ্ঞাপন থেকে খ্যাতির শীর্ষে

বেয়ার গ্রিলস নিজেও সম্ভবত ভাবেননি যে টেলিভিশনই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। এভারেস্ট জয়ের পর একটি ডিওডোরেন্টের বিজ্ঞাপনে প্রথমবারের মতো ছোটপর্দায় নিজেকে তুলে ধরেন বেয়ার।

এরপর অ্যাডভেঞ্চার শো দিয়ে রাতারাতি ওঠে আসেন খ্যাতির শীর্ষে। তবে নিজের শো ছাড়াও খ্যাতিমান হয়ে ওঠা বেয়ারকে আরও কিছু ক্ষেত্রে টিভিতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ইংল্যান্ডের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নির্মিত সেনাবাহিনীর মাদকবিরোধী টিভি ক্যাম্পেইন, বিশ্বখ্যাত হ্যারডস শপের বিজ্ঞাপন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তার অংশ নেওয়া টিভি অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফ্রাইডে নাইট উইথ জোনাথন রোজ, অপরাহ উইনফ্রে শো, দ্য টুনাইট শো উইথ জে লেনো, দ্য  লেট শো ডেভিড লেটারম্যান ইত্যাদি।                                                                                                     

 

লেখক বেয়ার

১৫টি বইয়ের লেখক বেয়ারের আত্মজীবনী বিশ্বের সেরা বেস্ট সেলারগুলোর মধ্যে একটি। নাম ‘মাড, সোয়েট অ্যান্ড টিয়ারস’। ২০১০ সালে চীনে সবচেয়ে প্রভাব তৈরি করা বইয়ের পুরস্কার পায় বেয়ারের এ আত্মজীবনীটি। এমনকি ব্রিটেনে ‘সানডে টাইমসের’ বিচারে টানা ১০ সপ্তাহ বিশ্বে বেস্ট সেলারের তালিকায় এক নম্বরে ছিল ‘মাড সোয়েট অ্যান্ড টিয়ারস’।

বেয়ারের প্রথম রচিত বইয়ের নাম ফেসিং আপ। এটি যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বেশি বিক্রীত বইয়ের তালিকায় স্থান পায়। এটি যুক্তরাষ্ট্রে দ্য কিড হু ক্লাইম্বড এভারেস্ট নামে প্রকাশিত হয়।

এভারেস্টে তার অভিযান এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত দ্বিতীয় বই  ফেসিং দ্য ফ্রোজেন অশেন ২০০৪ সালে উইলিয়াম হিল স্পোর্টস বুক অব দ্য ইয়ার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর