বুধবার, ১১ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

কলকাতার ভূত রহস্য

কলকাতার ভূত রহস্য

ভূতের ব্যাপারটাই ভারি অদ্ভুত। ভূত শব্দটার মধ্যে রয়েছে অজানা রহস্য। রয়েছে গা ছম ছম করা ভাব। ভূত আছে কি নেই এ নিয়ে গবেষণাও হয়েছে বিস্তর। অদৃশ্য, অলৌকিক, কাল্পনিক অবয়বটি কি আসলেই আছে! একটু গভীরভাবে ভাবলে হয়তো মনে হবে এর কোনো অস্তিত্বই নেই। এটা গুরুত্বপূর্ণও নয়। কিন্তু এসব প্যারানরমাল অ্যাক্টিভিটিজ খুলে দিচ্ছে অজানা রহস্যের দরজা। রয়েছে এসব মিথের আড়ালে রহস্যময় গল্পগুচ্ছ। যা অনেকের কাছেই অজানা। হালফিল কলকাতায় বড্ড ভিড়, অনেক আলো। রাতকে দিন করে দেওয়ার মতো আলোর ম্যাজিক রয়েছে এখানে। আর সেই আলোর অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আছে অজানা ইতিহাস। লিখেছেন— আবদুল কাদের

 

কল্পনা নাকি সত্যি!

কলকাতার পৌরাণিক ইতিহাসে বহু প্যারানরমাল ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীন সময়ের কর্তাদের শহরে এখন বহু স্থানে অশরীরী দাপিয়ে এখনো নাকি বেড়ায়। এই তো কিছুদিন আগে ঘটে গেল এক বিরাট দুর্ঘটনা। সবার চোখের সামনে মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয়েছিল অনেক দুর্ভাগা মানুষ। নিশ্চই মনে পড়ছে ৩১ মার্চের ভেঙে পড়া বিবেকানন্দ উড়াল সড়কের ঘটনা। তারপর কেটে গেল কয়েক মাস। কলকাতা ফিরে এসেছে পুরো ব্যস্ততায়। কিন্তু যে মানুষগুলো ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাদের অবস্থা কেমন? উড়াল সড়ক বিপর্যয়ের পরে ধ্বংসস্তূপ না থাকলেও পোস্তার স্থানীয় বাসিন্দাদের মন থেকে দুর্ঘটনাটি ফিকে হয়ে যায়নি। বরং আতঙ্ক, আর্তনাদ, মৃত্যু মিলিয়ে এক অদ্ভুত, অলৌকিক বা কাল্পনিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। বিপর্যয় জন্ম দিচ্ছে অলৌকিক সব ঘটনার। সড়ক বিপর্যয়ের পরে আহত, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষগুলো প্রবল যন্ত্রণায় ছটফট করে সাহায্য চেয়েছিলেন। বর্তমানে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে সব। কিন্তু এখনো নাকি গণেশ টকিজ এলাকায় দিনরাতে কোনো কোনো আগন্তুক স্থানীয়দের পানি চাইছেন! প্রবল গরমে পানি চাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পানি দিতে গিয়েই যেন হুঁশ ফেরে, চোখের পলকে আগন্তুক উধাও! তাহলে কি কোনো অশরীর? দু-একজন নয়, এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকেরই। এখানেই শেষ নয়! একই এলাকা থেকে ট্যাক্সিতে উঠেছেন যাত্রী। কিছুটা এগোতেই চালক পেছন ফিরে দেখেন খালি ট্যাক্সি; আসনটাই যে ফাঁকা! তাহলে একটু আগে ওঠা যাত্রী গেল কোথায়? এমন কিছু কি সত্যিই হচ্ছে? ঘটনার সত্যতা নিয়ে বাড়ছে রহস্য। স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘রোজই এরকম কিছু না কিছু শুনছি। কিন্তু নিজের কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি এখনো। অনেকেই দাবি করেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই বেশি রাত করে বাড়ি ফেরেন বলে ভয় পাচ্ছেন। স্থানীয় এক প্রতিনিধি বলেন, ‘যেহেতু সড়কের কিছু অংশ এখনো রয়েছে তাই অনেকেই চাইছেন বাকি অংশটাও ভেঙে ফেলা হোক।’ তবে, সত্যি অলৌকিক অভিজ্ঞতা হয়েছে, এমন ব্যক্তির খোঁজ মিলছে না এখনো। তাই রহস্যের শেকড় বাড়ছে ক্রমে। ঘটনাটি স্বাভাবিকভাবেই পোস্তা বা গণেশ টকিজ এলাকায় আটকে থাকেনি। মেট্রো, ট্রেন, বাস হয়ে শহর, শহরতলিতে ছড়িয়ে পড়েছে।

 

কলকাতা মিউজিয়াম

কলকাতা শহুরে কর্তাদের যেসব কিংবদন্তি ছড়িয়ে রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ভারতীয় জাদুঘর। ১৮১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নির্মিত প্রথম সংগ্রহশালা। বিচিত্র সব শব্দ আর উদ্ভট ঘটনার রাজ সাক্ষী জাদুঘর এবং তার আশপাশের এলাকা। মিউজিয়ামটি নিয়ে কলকাতাবাসীর জল্পনাকল্পনার কমতি নেই। এ মিউজিয়ামের পাশের রাস্তাটি অর্থাৎ সদর স্ট্রিট আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে সেখানে থাকতেন ওয়্যারস্ট্রিংসের স্পিক সাহেব। এই স্পিক সাহেবের কাছ থেকেই শুরু হয়েছিল এক আশ্চর্য ঘটনার। এই রাস্তার উপরেই স্পিক সাহেবের কাছে এক বিশেষ আরজি নিয়ে এসেছিলেন এক শিখ যুবক। শিখ যুবকটি কৃতকার্য না হওয়ায় তিনি চড়াও হন সাহেবের  ওপর। ঘটনা তখন তুঙ্গে, হঠাৎই শোনা গেল রাইফেলের তীব্র শব্দ। লুটিয়ে পড়ল যুবকের রক্তাক্ত দেহ। রাত বিরাতে এ স্মৃতি নাকি এখনো ফিরে আসে। শোনা যায় গুম গুম শব্দ। এখানেই শেষ নয়। আরও আছে, একবার জাদুঘরের ছাদের স্কাইলাই পরিষ্কার করতে গিয়ে দুটি শোকেসের মাঝে চাপাপড়ে মৃত্যু হয় এক মজুরের। গভীর রাতের অন্ধকারে কে যেন কাপড় মুড়ি দিয়ে আজও বেড়িয়ে যায়। কাঠের বাক্সে শুয়ে রাখা নিথর মমিতেও এমন কাহিনী কম নেই। এখনো নাকি মধ্যরাতে নর্তকীর নাচের শব্দ ভেসে ওঠে। কে বা কারা এসব ঘটনার সৃষ্টি করছে আজও সবার কাছে অজানা। এমনি সব ভয়ঙ্কর ও রহস্যময়ী ভুতুড়ে কাহিনী কি লিখেছিলেন অবনিন্দ্রনাথ ঠাকুর! যে লেখার পাণ্ডুলিপি আজও মিউজিয়ামে সংরক্ষিত।

 

সাউথ পার্কস্ট্রিট সিমেট্রি

কলকাতা শহরের এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে রাতবিরাতে চলে অলৌকিক সব কর্মকাণ্ড ও প্যারানরমাল অ্যাক্টিভিটিস। নিমতলা, ক্যাওড়াতলা শ্মশান ঘাট খানিকটা আলোময় দেখালেও শহরের প্রাচীন সিমেট্রি ও কবরখানাগুলো কিন্তু এখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন। সাউথ পার্কস্ট্রিট সিমেট্রি তেমনি একটি গোরস্থান। প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৭৬৭ সালে। আবছা অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল আর ঘন গাছপালায় ঘেরা গোরস্থানে গেলেই গা ছম ছম করে ওঠে। এখানে ব্রিটিশ সৈনিকের কবর সবচেয়ে বেশি। বলা চলে সাহেবি গোরস্থান। শোনা যায়, রাত হলেই নাকি কফিন থেকে জেগে ওঠে শত বছরের পুরনো আত্মা। একবার তো ঘটেই গেল বিপত্তি। সন্দীপ রায়ের ফেলুদা সিরিজের ‘গোরস্থানে সাবধান’-ছবির শুটিংয়ের উদ্দেশ্যে একবার সিমেট্রির দরজা খোলা হয়েছিল। ব্যাস উলটপালট করে দিল শুটিং সেটে থাকা সবার মন। অদ্ভুত সব শব্দ আর ছায়ায় ভয়ে শিহরিত হয়ে উঠল সবাই। এরপর থেকে আজ অবধি কেউ সেখানে ভুলেও পা বাড়ায়নি। এরকম আরও একটি সেমিট্রি রয়েছে লোয়ার সারকুলার রোডে। ঠিক আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোডের ওপরে। পর্যটকরা ঘুরতে আসেন ঠিকই কিন্তু রাত হলে ঢোকার সাহস হয় না কারও। এক পর্যটক ছবি তুলতে গিয়ে সাদা পোশাকের আবছা মহিলাকে দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পার্ক সার্কাসের বিশাল কবরখানার মতো স্থান, এ শহরে খুব কম রয়েছে। পার্কস্ট্রিটের আশপাশেরর স্থানীরা খুব সকালে এবং সন্ধার পর তাদের জানালা বন্ধ করে রাখেন। না জানি আবার কখন কি ঘটে যায়। প্রচুর গাছ-গাছালি ঘেরা কবরখানাতে স্থানীয়রা বহুদিন ধরেই অশরীরী অস্তিত্বের টের পান।

 

রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব

ঘোড় প্রতিযোগিতায় মুখরিত থাকে ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব খ্যাত রেসকোর্স ময়দানটি। দিনের আলোয় তেমন সমস্যা রাতে এখানে ঘটে যায় অলৌকিক সব ঘটনা। কে বা কারা যেন ঘোড়া নিয়ে ছুটে বেড়ান এখানে। স্পষ্ট দেখতে পাওয়া ঘোড়া নিমিষেই বাতাসে মিলিয়ে যায়। এর সঠিক মতাদর্শ না পেলেও ইতিহাসে রয়েছে একটি কাহিনী। রয়্যাল পরিবারের ব্রিটিশরা এখানে ঘোড় সওয়ার করতেন। একবার এক ব্রিটিশ জর্জ উইলিয়ামস তার বিখ্যাত সাদা ঘোড়া নিয়ে ময়দান চষিয়ে বেড়াতেন। অপরূপ সাদা ঘোড়াটির নাম ছিল প্রাইড। প্রচুর রেস আর ট্রফি জেতায়, প্রাইডকে তখনকার সময় এক নামেই চিনত। উইলিয়ামস ঘোড়াটিকে নিজের প্রাণের চাইতেও বেশি ভালোবাসতেন। কিন্তু একবার অ্যানুয়াল টার্ফি টুর্নামেন্টের আগে আকস্মিকভাবেই প্রাইড অসুস্থ হয়ে পড়ে। উইলিয়ামস প্রাইডের প্রচুর যত্নআত্তি করেও লাভ হয়নি। যার ফলাফল অ্যানুয়াল ট্রফি হেরে যান। এরপরই একদিন সকালে জর্জ দেখে, খোলা ট্রাকের ওপরে মরে পড়ে আছে তার প্রিয় সাদা ঘোড়াটি। প্রাইডের শোক আর মায়ায় জর্জও বেশিদিন পৃথিবীতে ছিলেন না। কিন্তু এখনো প্রত্যেক শনিবার পূর্ণিমার রাতে দেখা যায় জর্জ ও প্রাইডকে। রেসকোর্সজুড়ে সে বীরবিক্রমে পরিক্রম করে। প্রাইড এখনো জীবিত রেসকোর্স ময়দানে, এমনকি কলকাতাবাসী তাকে উইলিয়াম সাহেবের সাদা ঘোড়া হিসেবেই চেনে।

 

ন্যাশনাল লাইব্রেরি

বেলভেটিয়া হাউস, কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি। বইয়ে ঠাসা লাইব্রেরিতে সন্ধ্যা নামলেই যার রূপ পালটে যায়। অন্ধকারে এর মাঠ পেরিয়ে নাকি ছুটে যায় অশ্বারোহী। বলডাস্কের ভিতর থেকে নাকি ভেসে আসে কনসার্টের করুণ সুর। শোনা যায় পালকির আওয়াজ। কে যায় কিংবা কার সুরেলা কণ্ঠে ভেসে আসে। কোনো সদুত্তর নেই। তবে ইতিহাসের কিছু ইঙ্গিত আছে। ১৭ আগস্ট ১৭৮০, সেদিন সকালে এখানে ডুয়েল শুরু হয় রয়্যাল হেস্টিংস আর ফিলিপ ফ্রান্সিসের। সেই গুলির লড়াইয়ের নেপথ্যে ছিলেন পরমা সুন্দরী ম্যাডাম গ্রান্ট। তাদের প্রণয়ের স্মৃতি নাকি আজও ফিরে ফিরে আসে লাইব্রেরি চত্বরে।

গুলিবিদ্ধ ফ্রান্সিসকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পালকিতে করে। আর হেস্টিংস বেলভেটিয়া হাউসে আসতেন ঘোড়ায় চড়ে। তাহলে সে ইতিহাস কি কিছু বলতে চায়! এখনো সন্ধারাতে গা ছমছম করে লাইব্রেরির করিডর বরাবর হেঁটে গেলে। অনেকে নাকি সেই অশরীরী আত্মাদের স্বচক্ষে প্রত্যক্ষও করেছেন। কেউবা শুনতে পান পায়ের আওয়াজ, কেউবা আবার ঘন ঠাণ্ডা শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুভূতি টের পান। অনেকেই বলেন, ঠিক জায়গায় বই রাখা না হলেই নাকি এমন ঘটনার সাক্ষী হতে হয়। রাতে লাইব্রেরির গার্ডরা বইয়ের পাতা ওল্টানোর আওয়াজও পান। ন্যাশনাল লাইব্রেরি ভূতের অস্তিত্ব কর্মচারী থেকে রাজনৈতিক নেতাদের মুখেই বারবার উঠে এসেছে।

 

রাইটারস বিল্ডিং

দিনের বেলায় সরকারি কাজের দরকারি দপ্তর। রাতে এখানেই শুন্য লবিতে কি সব নাকি হয়। সন্ধ্যার পর কেউই এই বাড়িটিতে থাকার সাহস দেখান না। যারা রাত কাটিয়েছেন, তাদের অনেকেই মাঝরাতে হঠাৎ কান্না, হাসি কিংবা চিৎকারের শব্দ শুনতে পেয়েছেন। নাইট গার্ডরা বলেন এখানের পাঁচ নম্বর ব্লক জায়গাটা নাকি সুবিধের নয়। বারান্দা দিয়ে কারা যেন হেটে বেড়ায়। শোনা যায় টাইপের শব্দ। মনে হয় খুব মনোযোগ দিয়ে কারা যেন কাজ করছেন। দোতলায়র সিড়িতে কারা যেন ভেসে উঠেই মিলিয়ে যায়। হঠাৎ করে কে যেন চিৎকার করে ওঠে। যদিও এসবের কোন সদুত্তর মেলাতে পারেনি কতৃপক্ষ। তবে ইতিহাস বলে এখানেই এক সময় ছিল ভাং আর কলা গাছের জঙ্গল। একবার বেশ কয়েকজন ব্রিটিশকে এখানে কবর দেয়া হয়ছিল। লর্ড ভ্যালেন্টিনে লেখায় তথ্য মেলে দিল্লি থেকে আসা নব্য রাইটারদের মধ্যে ঘোড়ায় টানা গাড়ির খেলা কিংবা ডুয়েল চলতো। এতে করে সর্বদাই লেগে থাকতো খুন জখম। এমন বহু ঘটনার কথা আজও কলকাতাবাসীর মুখে মুখে। বিনয়, বাদল, দিনেশের হাতে কর্নেল সিমসনের ঘটনাও কি ফেলে দেয়া যায়! এসব ঘটনার আগে এখানে সরকারী কর্মীদের থাকতো। এরপর বহু দশক ধরেই ভবনটির বহু ঘর বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। বলাবাহুল্য বর্তমানে রাজ্য সরকারের দফতর হলেও ভৌতিক কর্মকান্ড একদম কমেনি।

 

আরও ভূত!

 

হেস্টিং হাউস

আলিপুরের হেস্টিংস হাউসের অলৌকিকতা সম্পর্কে কম-বেশি সবারই জানা। এখানের ভৌতিক কর্মকাণ্ডে মানুষ বিশ্বাস করেন স্বয়ং হেস্টিংস এখানে আসেন। তখনকার পরাধীন ভারতের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস বাড়িটি তৈরি করে এখানে থাকতেন। বর্তমানে এটি কলকাতা ইউনিভার্সিটির ওম্যান্স কলেজ। রাতে ঘটে যতসব অলৌকিকতা। ঘোড়ার গাড়ি ছুটিয়ে আসতে দেখা যায় কোনো এক ইংরেজকে। অনেকে বলেন ওয়ারেন হেস্টিংসই নাকি ঘোড়ায় জড়ে আসেন। ঘরে ঢুকে ব্যস্ততার ছলে বিরক্তি নিয়ে ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেন। আবার এমনও দেখা যায় ঘোড়া হাঁকিয়ে চলে যান। এই তো বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা নতুন বছরের মধ্যরাতে হেস্টিংস হাউসে নিউ ইয়ার পার্টি চলে বলে শোনা যায়। একই রকমভাবে ফুটবল খেলতে আসা এক শিশুর মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া এখানে পাওয়া অপঘাতে মৃত্যুর লাশ। লাশগুলো ছিল কাটাছেঁড়া। আবার এ জায়গা সম্পর্কে শোনা যায়, অশরীরী আত্মারা সবচেয়ে বেশি এখানেই ঘোরাঘুরি করে।

 

পুতুলবাড়ী

কলকাতা শহরের আহিরিটোলার বাড়ি নিয়ে রহস্য আজও সবার মুখে মুখে। বাংলা সাহিত্যে পুতুলের বাড়িটি নিয়ে সত্যজিৎ রায় ও লিলা মজুমদারের কিছু ভয়ঙ্কর গল্প রয়েছে। এটা কলকাতা শহরের সবচেয়ে রহস্যজনক স্থান। গভীর রাতে তো বটেই এমনকি ভরদুপুরেও কিছু অশরীরীর উপদ্রব রয়েছে এখানে। এর নেপথ্যে আসলে কি! এক সময় বাড়িটিতে এক বড়লোক মনিব বাস করতেন। বাড়ি দেখাশোনায় কয়েকজন দাসীও কাজ করত। মনিব দাসীদের সঙ্গে জোরপূর্বক যৌনসম্পর্ক করতেন। কিছু দাসী মনিবের এ অত্যাচারের প্রতিবাদ করায় তাদের হত্যা করা হয়। হত্যার পর বাড়ির পেছনে তাদের লাশ মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল। এরপর কতকাল পার হলো কিন্তু আজ অবধি মাঝে মাঝে রাতে মেয়েলি কণ্ঠের অশরীরীদের কান্নার শব্দ শোনা যায়। স্থানীয়দের ধারণা মনিবের এ পাপের কারণে এখনো পুতুলবাড়ীতে অশরীরী আত্মার আনাগোনা।

 

আকাশবাণী

কলকাতার পুরনো ভুতুড়ে বাড়ির মধ্যে এক নম্বর গারস্টিন প্লেস এবং দ্বিতীয় এর প্রথম অফিস। আকাশবাণীর পুরনো দফতর গারস্টিন প্লেসে বারবার দেখা গিয়েছে অশরীরী আত্মা। ফাঁকা লম্বা করিডর, অজস্র স্টুডিও আর ব্রিটিশ অবকাঠামো মিলিয়ে আকাশবাণীর ভুতুড়ে অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। আকাশবাণীর প্রথম দফতর উঠে যাওয়ার পর গারস্টিন প্লেস ভোল বদলেছে। এক সময়ের জনপ্রিয় রেডিও স্টেশন ছিল এটি। কেউ কেউ এখানে দেখেন হ্যাট-কোট পরিহিত, সিগারেট মুখে ইংরেজ সাহেবদের ছায়া যারা মাঝে মধ্যেই ঘরে প্রবেশ করতেন আর অভ্যেসবশত ফাইলপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতেন। আবার কেউ কেউ দেখেন মধ্যরাতে রেকর্ডিং রুমের বারান্দায় কে যেন গান শুনছেন। হয়তো বেতারের আশ্চর্য বিজ্ঞানী সে যুগের মনে জন্ম দিয়েছিল এসব ভুতুড়ে বিশ্বাসের। এখনো নানা স্টুডিও থেকেই রাতে ভেসে আসে যান্ত্রিক সুর। বলাই বাহুল্য, সেই যন্ত্রগুলো কোনো মানুষ বাজায় না।

উইপ্রো অফিস

কাগজ উলটপালট করা, একটি বস্তু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া এখানকার প্রতিদিনকার কাণ্ড। কলকাতার উইপ্রো অফিসের নৈমিত্তিক ঘটনা এটি। অফিসের চতুর্থ তলায় নাকি ভূতদের আড্ডাখানা। সল্টলেকের অফিসটির আগের ইতিহাস ভয়াবহ। এখানে আগে ছিল জলাশয় আর জঙ্গল। ধর্ষণ, হত্যা, অত্যাচার, নেশা সব কিছুই চলত এখানে। এক সময় এটা পরিত্যক্ত কবরখানা ছিল। অনেকে এখানে আত্মহত্যা করত। যার সবই চলত লোকচক্ষুর আড়ালে। মূল অফিসটি কবরখানার উপরে তৈরি। রাতে নাইটগার্ডরা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার শিকার হন। অফিসের চার তলা থেকে নাকি চিৎকার, শোরগোল শোনা যায়। এমনকি রাতে রক্তাক্ত মেয়ের ছায়া আর কান্নায় গোটা উইপ্রো ভৌতিক হয়ে ওঠে।

 

পৌরসভা কার্যালয়

রাজশেখর বসু কবেই বলে গিয়েছিলেন, ‘এই কলকাতা শহরে রাস্তায় যারা চলাফেরা করে— কেউ কেরানি, কেউ দোকানি, কেউ মজুর, আর কেউবা অন্য কিছু। তা মোটেই নয়। তাদের মধ্যে সর্বদাই দু-চারটে ভূত পাওয়া যায়। তবে চিনতে পারা দুষ্কর।’ আসলে গোটা কলকাতা ভুতুড়ে রহস্যেঘেরা। তার মধ্যে কলকাতা মিউনিসিপাল করপোরেশন বাড়িটি অন্যতম। উনিশ শতকের এই লাল বাড়িটি শহর কলকাতার ব্রিটিশদের বহু ঘটনার রাজ সাক্ষী। রাত ৩টা বাজলে নাকি এখানেও একটু বেশি থম থমে। পৌরসভার এই বাড়িটিও অনেক আশ্চর্যের কেন্দ্রবিন্দু। অনেকেই এখানে বিচিত্র সব আওয়াজ আর ভৌতিক ঘটনার মুখোমুখি হন। পৌরসভার লাল বাড়িটির ভিতর প্রায়শই মহিলা কণ্ঠে কান্নার শব্দ শোনা যায়।

 

হাওড়া ব্রিজ

কলকাতার হাওড়া ব্রিজ। আগের নাম ছিল মল্লিক ঘাট। মূলত এটি শহরের প্রধান ফুলের বাজার। ফুলের বাজার হলেও এটি ফুলের মতো পবিত্র নয়। বহু প্রেতাত্মা ঘুরে-বেড়ায় হাওড়ার চারপাশজুড়ে। কলকাতা শহরে সুইসাইড কিংবা অত্মহত্যার প্রবণতা হরহামেশাই ছিল। শহরের যতগুলো সুসাইড জোন রয়েছে তার মধ্যে হাওড়া ব্রিজ অন্যতম। এ হাওড়া ব্রিজকে কেন্দ্র করে ভয়ার্ত পরিবেশ সব সময়েই ছিল। হাওড়া ব্রিজ থেকে প্রচুর মানুষ গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। মল্লিক ঘাটে যেসব কুস্তিবিদ ভোররাতে মুগুর ভাজতে গঙ্গার পাড়ে যায়, তাদের কাছে এই দৃশ্য খুব স্বাভাবিক। তবে ঘাটটিও খুব একটা নিরাপদ নয়। পা পিছলে অনেকের অপমৃত্যুও ঘটেছে। দেখা যায়, কেউ যেন ডুবে যাচ্ছে, আর পানির ওপর একটা হাত ছটফট করছে। কেউ যদি বাঁচাবার উদ্দেশ্যে ঝাঁপ দেয় তাহলে তারও প্রাণ শেষ। এ রহস্যের কূলকিনারা পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয় আত্মহত্যার কারণে অনেকের আত্মা মুক্তি পায় না। এসব আত্মা কিংবা অশরীরী মানুষকে আত্মহত্যায় প্রভাবিত করে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর