শনিবার, ৬ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

সেই আগুনসুন্দরী প্রিন্সেস ডায়ানা

প্রিন্সেস ডায়ানা। সৌন্দর্য আর ফ্যাশনে ছিলেন অদ্বিতীয়। ছিলেন ইংল্যান্ডের রাজবধূ। তার কোলেই আসে রাজপরিবারের দুই উত্তরাধিকারী প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারি। ডায়ানা দেশ থেকে দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে। দানশীলতায় ছিলেন অগ্রগণ্য। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্ল্যামারাস ডায়ানা ছিলেন আইকন। কিন্তু পরকীয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে রাজপ্রাসাদ ছাড়তে হয়েছিল তাকে। তারপরও জড়ান নতুন প্রেমের গুজবে। সৌন্দর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে কেলেঙ্কারি। সেই কেলেঙ্কারি এড়াতেই দ্রুতবেগে গাড়ি ছুটিয়েছিল চালক। কিন্তু হায়! কথিত বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান প্রিন্সেস অব ওয়েলস, ডায়ানা—

তানভীর আহমেদ

সেই আগুনসুন্দরী প্রিন্সেস ডায়ানা

আগুনসুন্দরীর মাথায় রাজমুকুট

সৌন্দর্যে তার সামনে সবই ম্লান হয়ে যেত। ফ্যাশনেবল ডায়ানাকে দেখে প্রেমে পড়েননি এমন বোধহয় কমই ঘটেছে। রাজপুত্র চার্লসের ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। ডায়ানাকে দেখে তার প্রেমে মজেছিলেন চার্লস। আর রাজপুত্রকে কে ফিরিয়ে দেবে? ডায়ানা শুধু রাজপুত্র চার্লসকেই মুগ্ধ করেননি, নিজেও প্রেমের জলে ভেসেছেন। তারই সূত্র ধরে বিয়ে। ইংল্যান্ডের রাজপরিবারে বাজে বিয়ের ঘণ্টা। রাজবধূ হয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করেন ডায়ানা। ঘটনা বর্ণনায় যত সহজ মনে হোক না কেন, বিষয়টা এমন নয়। কারণ ইতিহাস বলে, ৩০০ বছরের ইতিহাসে প্রিন্সেস ডায়ানা হলেন প্রথমজন যিনি রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারীকে সরাসরি বিয়ে করলেন। অনেকের মনেই প্রশ্ন ওঠে কে এই ডায়ানা?

প্রিন্সেস অব ওয়েলস ডায়ানার জন্ম ১৯৬১ সালে। রাজ পরিবারের সঙ্গে তাদের বেশ লম্বা সময় ধরেই সম্পর্ক ছিল। বাবা স্পেন্সার আর অষ্টম আর্ল স্পেন্সারের সন্তান ছিলেন ডায়ানা। একাডেমিক পড়াশোনায় সুবিধা করতে না পারলেও নাচ ও ধর্মীয় গানে বেশ পারদর্শী ছিলেন। দানশীলতায় তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। ফ্যাশন আইকন ডায়ানা ছিলেন তার সময়ে সবচেয়ে বেশিবার ক্যামেরাবন্দী হওয়া সেলিব্রেটি।

 

ডায়ানা কাহিনী

♦ বিয়ের আগে প্রিন্সেস ডায়ানাকে অনেকে লেডি ডায়ানা নামে ডাকতেন। তখন তার আসল নাম ছিল ডায়ানা ফ্রান্সেস স্পেন্সার। এরপর তাকে ‘হার রয়াল হাইনেস দ্য প্রিন্সেস অব ওয়েলস’ বলে ডাকা হয়। কিন্তু রাজপুত্রের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর রানীর একান্ত অনুমতিতে তাকে শুধু দ্য প্রিন্সেস অব ওয়েলস ডাকা হয়।

♦ ডায়ানা শৈশব থেকেই বেশ লাজুক ছিলেন। শান্তশিষ্ট স্বভাবের কারণে তার মনোযোগ ছিল তীক্ষ। তিনি শাস্ত্রীয় ব্যালে সংগীত এবং নাচ দুটিতেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেন।

♦ গুণের অভাব ছিল না তার তবে প্রচলিত শিক্ষায় সফল হননি। দুবার ‘ও লেভেল’ পরীক্ষা দিয়েও ফেল করেন তিনি।

♦  সাত বছর বয়সেই তার বাবা-মায়ের বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর পড়াশোনাতে এগিয়ে যেতে পারেননি। পুরো শৈশব এবং কিশোরজুড়ে ডায়ানা ব্যালে চর্চা করেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি এটি তার  পেশা হিসেবে বহন করতে পারেননি। কারণ এ কাজের জন্য বেশ লম্বা ছিলেন। এই উচ্চতার ফলে তার ব্যালে করতে অসুবিধা হতো।

♦  ডায়ানা ১৭ বছর বয়সে প্রথম কাজ করা শুরু করেন। তখন আলেকজান্দ্রার আয়া হিসেবে কাজ করেন।

♦ তারপর তিনি একটি প্রাক স্কুলে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তিনি, তার বোন সারাহ এবং তার বেশ কিছু বন্ধুর জন্য কিছু পরিষ্কারের কাজেও হাত লাগিয়েছেন। রাজবধূ হওয়ার আগে বিভিন্ন পার্টিতে একজন অতিথি সেবিকা হিসেবে কাজ করেন।

♦ প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে তার বিয়ের দৃশ্য ৭৪টি দেশে সম্প্রচার করা হয়। যা ৭৫০ মিলিয়ন মানুষ উপভোগ করেন। ১৬ বছর পরে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সম্প্রচারে ২.৫ বিলিয়ন দর্শকের নজর ছিল।

♦   প্রায় ১০০টি দাতব্য প্রতিষ্ঠান সমর্থন করার কারণে তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়।

♦ যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার প্রিন্সেস ডায়ানাকে ‘পিপলস রাজকুমারী’ শিরোনামে ভূষিত করেন।

 

ডায়ানার অন্যরূপ

১৯৮৩ সালের দিকে ডায়ানা একবার জনসম্মুখে বলেন, রাজবধূ হওয়ার পর দায়িত্ববোধ বেশ চাপের। তবে  তা মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছি।

সত্যিই তাই করছিলেন। অনেকেই ডায়ানার জীবনের একটা দিকই কেবল আলোচনা করেন। তার সৌন্দর্য, ফ্যাশন আইকন হয়ে ওঠা। রাজপুত্রের সঙ্গে প্রেম, বিয়ে আর কেলেঙ্কারির নানাদিক। তারপর মৃত্যু। তবে এসবের বাইরে ডায়ানা রাজবধূ হিসেবে বেশ দায়িত্বশীল ও ব্যস্ত জীবন কাটিয়েছেন। দেশ থেকে দেশে রাজবধূ হিসেবে ছুটে যেতে হয়েছে তাকে। সে তো গেল কাগজে-কলমে ছোটাছুটি। বৃত্তের বাইরে এসে তিনি তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে ছুটে গেছেন। রাজবধূ বলে নিজের চারপাশে ঐশ্বর্য আর ক্ষমতার বলয় গড়ে তোলেননি। বিলাসী জীবনে গা ভাসাননি। ১৯৮০ এর মাঝামাঝি সময় থেকে তিনি মানুষের কাছে ছুটে যেতে শুরু করেন। বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতেন তিনি। মানবসেবায় নিজেকে পুরোপুরি ঢেলে দিয়েছিলেন ডায়ানা। রাজবধূ হিসেবে যা ছিল অনন্য নজির। তিনি স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে বেশি মনোযোগী ছিলেন। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার হয়ে তিনি মানুষের কাছে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে উদগ্রীব ছিলেন। ডায়ানা রাজবধূ হওয়ার পর বাকি জীবন এইডস আক্রান্তদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, এইডস বিষয়ক জনসচেতনতা তৈরিতে কাজ করে যান। একই সময়ে তিনি ‘ভূমি মাইন’ বিষয়েও কাজ শুরু করেন। ডায়ানা আরও কাজ করেছেন গৃহহীনদের জন্য। যুবক, মাদকাসক্তদের নিরাময় ও সচেতনতা তৈরিতে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তিনি প্রচুর পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায় দান করতেন। দানশীলতার কারণে তিনি বিশ্বজুড়ে খ্যাতি লাভ করেন। দুস্থ মানুষের কাছে তিনি আশ্রয়দাত্রী, সেবাদাত্রী হয়ে ওঠেন। দরিদ্র, অসহায় মানুষেরা তাকে ভালোবাসতেন। তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন ওয়েলসের নিউরোলজি ও নিউরোসার্জারি বিষয়ক জাতীয় হাসপাতালের সঙ্গে। এর মাধ্যমে তিনি গবেষণা ও আধুনিক চিকিৎসা প্রদানে বিশেষজ্ঞদের উৎসাহিত করেন। যা পরবর্তীতে ব্যাপক  প্রশংসা কুড়ায়। শিশুদের নিয়েও তিনি অনবরত কাজ করে গেছেন। তাদের শিক্ষা প্রদান ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে ডায়ানা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। অসুস্থ শিশুদের কাছে তিনি নিজে ছুটে যেতেন ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতেন। এই কাজগুলোর সীমানা কিন্তু বাঁধা ছিল না। ডায়ানা সারা পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে গেছেন। যেখানেই তাকে ডাকা হয়েছে সেখানেই তিনি ছুটে এসেছেন। মানবসেবায় ডায়ানার এই যাত্রা ছিল অতুলনীয়। দেশ থেকে দেশে তিনি বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার হয়ে কাজ করেছেন। মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের কাছে গিয়ে তাদের আলিঙ্গন করেছেন। ডায়ানা ভারতের কলকাতায় মাদার তেরেসার অনাথশালায় এসেছিলেন। ১৯৯৫ সালের দিকে তিনি গোটা মস্কো ছুটে বেড়ান। এ সময় অসহায় ও অসুস্থ শিশুদের হাসপাতালগুলোতে যান।

ডায়ানা সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হন এইডস নিয়ে কাজ করার কারণে। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি এইডস আক্রান্ত রোগীদের কাছে প্রতিনিয়ত ছুটে যান। তিনি তাদের সঙ্গে হাত মেলাতেন, জড়িয়ে ধরতেন। অথচ সে সময় মানুষ এইডস আক্রান্তদের থেকে দূরে সরে থাকত, রোগটি ছোঁয়াচে ভেবে। তখনো বিশ্ববাসী জানত না এইডস ছোঁয়াচে নয়। এইডসের ওষুধ আবিষ্কার, এইডস আক্রান্তদের সেবা প্রদান ইত্যাদি কাজের জন্য তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করেন। ১৯৯৭ সালের দিকে আফ্রিকায় ছুটে গিয়েছিলেন এ নিয়ে কাজ করতে। নেলসন মেন্ডেলার সঙ্গে তিনি দেখা করেন ও এইডস রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি দান করেন। এ ছাড়া ডায়ানা ছিলেন হলো (এইচএ এল ও) ট্রাস্টের একজন কর্মী। এই সংস্থার মাধ্যমে তিনি ভূমি মাইন বিষয়ক প্রচারণা চালান। ভূমি মাইনগুলো সরিয়ে নিতে, নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে ডায়ানা বছরের পর বছর কাজ করে যান। গৃহহীনদের আবাস গড়ে দিতে ডায়ানা যোগ দিয়েছিলেন ‘সেন্টারপয়েন্ট’-এর সঙ্গে।

 

প্রেম, বিয়ে তারপর...  কেলেঙ্কারি!

প্রিন্স চার্লস আর ডায়ানার প্রণয় কাহিনী বিশ্বজুড়ে বহুল আলোচিত ছিল। না হয়ে উপায় নেই। রাজপুত্রের প্রেম বলে কথা। তাও আবার এমন একজনের সঙ্গে যার সৌন্দর্যে ডুবে রয়েছে গোটা পৃথিবী। ১৯৭৫-এ স্যানড্রিংহ্যামে থাকার সময়েই দুটি পরিবার পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হয়। তারপর একাধিকবার তার সঙ্গে চার্লসের দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। সেখান থেকেই প্রেম জমে ওঠে। খবরটি চাপা থাকেনি। প্রিন্স চার্লস আর প্রিন্সেস ডায়ানার বিয়ের কথা তখন ফলাও করে প্রচার করে বিশ্বের প্রভাবশালী সব গণমাধ্যম। কিন্তু রাজপরিবারেই তখন নানাকাণ্ড। এ খবর তো বেশ চাউর হয়ে ওঠে যে রানী এলিজাবেথ এই বিয়েতে সায় দিচ্ছেন না! অবশ্য শেষ পর্যন্ত গুঞ্জন সত্যি হলো না। রানী এলিজাবেথ বিয়ের অনুমতি দিলে তোড়জোড় শুরু হয়। সে সময় প্রিন্স চার্লসের বয়স ছিল ৩২ আর প্রিন্সেস ডায়ানার বয়স ২০। রাজকীয় বিয়ে বলে কথা। বিয়ে হয় লন্ডনের সেন্ট পল ক্যাথিড্রাল চার্চে, ২৯ জুলাই ১৯৮১। এই বিয়ে গোটা বিশ্বের নজর কাড়ে। সারা পৃথিবীর রেডিও ও টেলিভিশনে খবরটা সম্প্রচারিত হয়। হাজার হাজার লোক ক্যাথিড্রাল থেকে বাকিংহাম প্রাসাদের সামনে হাজির হন। বিশ্বের প্রায় ৫০০ কোটি মানুষ টেলিভিশনের সামনে বসে দেখেন এই রাজকীয় বিয়ে। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে রাজ পরিবারে বিয়ের উৎসব। রাজকীয় জাহাজ ব্রিটানিয়াতে চড়ে হানিমুন করলেন তারা। এরপর দিন পেরোতে থাকল। কিন্তু সময় চলতে চলতে সম্পর্কের টানাপড়েন দেখা দিল। শুরুর দিকে মানিয়ে চলা তারপর বাড়ল তিক্ততা। বাজারে মুখরোচক খবরের অভাব হয় না। কেউ কেউ বলতে থাকল ভালো নেই এই দম্পতি। প্রিন্স চার্লস নাকি আজকাল ডায়ানাকে সময় দেন না। এ নিয়ে ভিতরে ভিতরে কলহ বাধছিল। দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকল। প্রিন্সেস চার্লসের দিকে যখন অপরাধী হওয়ার আঙ্গুল ওঠে তখন ডায়ানাকে জড়িয়েও কথা ওঠে। দুজনেই দুজনকে সন্দেহ করতে থাকলেন। এভাবে কেটে যায় প্রায় সাত বছর। দুই ছেলে প্রিন্স উইলিয়াম আর হ্যারির জন্মের পর তিক্ততা আসে তাদের সম্পর্কে। ১৯৮৯ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। সাইরিল রিনান নামে এক অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা এবং জেন নরগোভ নামে আরেকজন মিলে গোপনে আড়ি পেতে ডায়ানা ও জেমস গিলাবের কথাবার্তা রেকর্ড করেন। গিলাব ছিলেন ডায়ানার বিয়ে-পূর্ব জীবনের বয়ফ্রেন্ড। আর এই কথোপকথনটি ওই সময়ের। ক্যাসেট প্রকাশের পর সারা বিশ্বে আলোড়ন ওঠে। কেঁপে ওঠে রাজপ্রাসাদও। তবে উল্টো প্রিন্স চার্লস নিজেও একেবারে অভিযোগহীন ছিলেন না। তাকে ঘিরেও কেলেঙ্কালি ছড়ায়। স্ত্রীকে পাশে রেখেই চুটিয়ে  প্রেম করে যাচ্ছিলেন দীর্ঘদিনের বান্ধবী ক্যামিলা পার্কারের সঙ্গে। বিষয়টি টের পেয়েছিলেন ডায়ানা। ডায়ানা গিলাবে সংলাপের দুই সপ্তাহ আগের ঘটনা এটি। ডায়ানা গিলাবের সংলাপ ছিল প্রেমাকুতিতে ভরা। কিন্তু চার্লস আর ক্যামিলার কথোপকথন ছিল যৌনাবেদনে ভরপুর।

এসব নিয়ে সংসার আর চলছিল না। ঘরে অশান্তি, বাইরে মিডিয়ার বাড়াবাড়ি। সব মিলিয়ে তাদের একসঙ্গে সংসার করা কঠিন হয়ে ওঠে। ১৯৯২ সালের ৯ ডিসেম্বর ডায়ানা ও চার্লস আনুষ্ঠানিকভাবে আলাদা থাকার ঘোষণা দেন।

এরপর আর রাজবধূ নন ডায়ানা।  ব্যক্তি জীবনে প্রেমের খোঁজ হয়তো করেছেন। সে নিয়ে মিডিয়ার মাথাব্যথা কম ছিল না। বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটানোর পর ডায়ানার সঙ্গে এক মিসরীয় ধনকুবেরের প্রেমের কথা জানাজানি হয়। তাদের ছুটি কাটাতে গিয়ে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব মিডিয়া। মিসরীয় ধনকুবেরের নাম দোদি আল ফাহাদ। পাপারাজ্জিদের তাড়া খেয়ে গাড়ি দুর্ঘটনায় ডায়ানার সঙ্গে দোদি আল ফাহাদও মারা যান।

 

আজও অমীমাংসিত মৃত্যুরহস্য

ক্যামেরার চোখ সব সময় খুঁজত ডায়ানাকে। যেখানেই যেতেন সেখানেই ওতপেতে তাকা ক্যামেরাম্যানদের আলোর ঝলক চোখ ধাঁধিয়ে দিত ডায়ানা। এই ক্যামেরা অত্যাচার চালাত পাপারাজ্জিরা। তারাই ডায়ানার ব্যক্তিগত জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন। বছরের পর বছর ডায়ানাকে তাড়া করে ফিরছিলেন তারা। রাজবধূ হওয়ার পর থেকে শুরু। বিভিন্ন সামাজিক ও দাতব্য কর্মকাণ্ডে দেশে দেশে ছুটে ফিরতেন ডায়ানা। আর তার গ্ল্যামার, সৌন্দর্য ছিল ক্যামেরাম্যানদের কাছে হটকেক। এরই মাঝে বিয়ের আগের বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ডায়ানার প্রেমময় ফোনালাপ ফাঁস। এক পর্যায়ে বিয়ে বিচ্ছেদ। আবার নতুন করে প্রেমে জড়াচ্ছেন, একান্তে কারও সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন— এসব গুজব তাড়া করেছে তাকে। বিয়ের পর ডায়ানা কার সঙ্গে প্রেম করছেন, তার ব্যক্তিগত জীবনের ছবি তুলতে মরিয়া হয়ে ওঠে পাপারাজ্জির দল। ততদিনে বাজারে খবর আসতে শুরু করে ডায়ানা এক ধনকুবের দোদি আল ফাহাদের সঙ্গে প্রেম করে বেড়াচ্ছেন। সমুদ্র সৈকতে তাদের দুজনের ছবি প্রকাশের পর পাপারাজ্জিদের চোখ ফাঁকি দিতে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার চেষ্টা ছিল ডায়ানার। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট পাপারাজ্জিদের তাড়া খেয়ে পালানোর চেষ্টা করেন ব্রিটেনের সুন্দরী রাজপুত্রবধূ ডায়ানা ও তার প্রেমিক। ডায়ানা ও দোদি কালো রঙের মার্সিডিজ এস২৮০ গাড়িতে ছিলেন। প্যারিসের রিজ হোটেল থেকে বের হয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি ছোটান গাড়ি চালক। গাড়িটির চালকের আসনে ছিলেন হোটেলটির নিরাপত্তা বিভাগের উপ প্রধান হেনরি পল। প্যারিসের পন্ট-ডি-আলমা রোড টানেল পাড় হওয়ার সময় দুর্ঘটনা ঘটে। দোদি-ডায়ানাকে বহনকারী মার্সিডিজ গাড়িটি ঘণ্টায় ৬৫ মাইল  বেগে আঘাত করে টানেলের ১৩তম স্তম্ভকে। কংক্রিটের এ স্তম্ভের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার পরিণামে গাড়িটি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। গাড়িটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান প্রিন্সেস ডায়ানা, তার বন্ধু দোদি ও গাড়িচালক হেনরি পল। ডায়ানার মৃত্যুর পরই নানা রহস্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যপ্রমাণ বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বন্ধু দোদি আল-ফাহাদসহ তার মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতে আসা কিছু তথ্য বলছে, হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন আলোচিত এই রাজবধূ। বিবিসি, গার্ডিয়ান, টেলিগ্রাফ এ ধরনের ইঙ্গিত দেয় এমন বেশ কয়েকটি খবর প্রকাশ করে। দোদির বাবা মোহাম্মদ ফায়েদও চেষ্টা করেছিলেন ওই দুর্ঘটনাটিকে হত্যাকাণ্ড বলে প্রমাণের।  ফরাসি পুলিশ দাবি করেছিল, গাড়ি চালক হেনরি পল মাত্রাতিরিক্ত মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তবে সে অভিযোগের বিপক্ষে দাঁড়ায় দোদির পরিবার। এ ছাড়া প্রশ্ন রয়েছে আরও নানা বিষয়ে। যেমন রহস্যজনকভাবে কখোনই মার্সিডিজ কোম্পানি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত গাড়িটির ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করেনি। মারাত্মকভাবে আহত ডায়ানাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিতে ৭৫ থেকে ৯৫ মিনিট লেগেছে। প্যারিসের ব্যস্ত মুহূর্তে দুর্ঘটনাস্থল থেকে এ হাসপাতালে পৌঁছাতে বড়জোর ১১ মিনিট লাগার কথা। তাছাড়া মৃত্যুর কয়েক মাস আগে বিবিসির প্যানোরমা অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ রাজপরিবারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন ডায়ানা। তার সঙ্গে এই দুর্ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে কিনা এমন সংশয় পোষণ করেন অনেকে। তবে এ সবই ধারণাপ্রসূত আশঙ্কা। ডায়ানার মৃত্যু হত্যা নাকি নিছকই দুর্ঘটনা তা আজও রহস্যই রয়ে গেছে। ডায়ানার মৃত্যুর পর ১৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এই রহস্যের সমাধান হয়নি।

সর্বশেষ খবর