শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভাওয়াইয়া গানে প্রাকৃতজনের প্রকৃত জীবন

তুহিন ওয়াদুদ

ভাওয়াইয়া গানে প্রাকৃতজনের প্রকৃত জীবন

বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার এবং আসামের কিছু অঞ্চলের মধ্যে দীর্ঘ দিন থেকে গীত হওয়া এক প্রকার লোকসংগীত হচ্ছে ভাওয়াইয়া। লোকসংগীতের সব বৈশিষ্ট্যই এ গানের মধ্যে বিদ্যমান। এ গানের ভাষা-গায়কী সব কিছুতেই রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। গবেষণায় উঠে এসেছে এ গানের ভাষা মূলত রাজবংশীদের ভাষা। রাজবংশীয় সাধারণ মানুসেরই এ গানের স্রষ্টা। ভাওয়াইয়া গানের নামকরণে রয়েছে বিচিত্র মত। কেউ বলেছেন বাউদিয়াদের গান হচ্ছে ভাওয়াইয়া গান। কেউ বলেছেন ভাও (ভাব) শব্দ থেকে ভাওয়াইয়া শব্দের উত্পত্তি। কেই বলেছেন ‘ভাওয়া’ শব্দ থেকে ভাওয়াইয়া শব্দটি গ্রহণ করা হয়েছে। ভাওয়াইয়া গানের প্রাণপুরুষ আব্বাস উদ্দীনের মতে— ‘ভাওয়াইয়া গান উত্তরবঙ্গ তথা কোচবিহারের নিজস্ব সম্পদ। উদাস হওয়ার মতো এই সুরের গতি, তাই এর নাম ভাওয়াইয়া।’ এ ছাড়াও আরও অনেক মত রয়েছে ভাওয়াইয়া গানের নামকরণ নিয়ে।

ভাওয়াইয়া গানের গায়কীতে রয়েছে সব সংগীত থেকে স্বতন্ত্র এক মাত্রা। ভাওয়াইয়া গানের সুরে একটি ভাঁজ বা ভাঙন রয়েছে। সেই ভাঙন কেন ভাওয়াইয়া গানে বিদ্যমান সেটা নিয়েও বিস্তর আলোচনা রয়েছে। ভাওয়াইয়া গানের সুরের ভাঙনে রয়েছে একটি সাধারণ ঐক্য। যেমন রংপুর-দিনাজপুর এলাকায় গরুর গাড়ি কিংবা মহিষের গাড়ির ব্যাপক প্রচলন ছিল। কৃষিনির্ভর এ এলাকায় গাড়ি চলত অসমতল পথে। গাড়ি চালিয়ে গান গাওয়ার সময়ে গাড়িয়ালের সুর আপনা থেকেই ভেঙে যেত। পরবর্তী সময়ে তাই ভাওয়াইয়া গান গাওয়ার সময়ে এই ভাঙনটি রীতিতে পরিণত হয়। কোচবিহার এলাকার নদীগুলো ছিল তুলনামূলক কম প্রস্থের। এখানে নদীর পানি ছিল খরস্রোতা। এই খরস্রোতা নদীর পানিতে যখন মাঝি নৌকা চালিয়ে এ গান পরিবেশন করত তখন ঢেউয়ের ধাক্কায় কিংবা স্রোতের পাকে নৌকার মাঝির গানের সুর ভেঙে যেত। এ অঞ্চলে হাতি শিকার করা হতো এবং হাতি পোষা হতো। হাতির পিঠে যখন মাহুত উঠে গান পরিবেশন করত তখন হাতির চলার ধাক্কায় গানের সুর ভেঙে যেত। এসব কারণে ভাওয়াইয়া গানের সুরে স্বতন্ত্র সুরের ভাঙন পদ্ধতি যুক্ত হয়েছে। সুরের যে স্থানে ভেঙে দেওয়া হয় সেখানে একটি অতিরিক্ত ‘হ’ ধ্বনি যুক্ত হয়। ফলে গান গাওয়ার সময়ে সুরের মাঝে মাঝে ‘হ’ ধ্বনিযোগে গানগুলো গাওয়া হয়।

ভাওয়াইয়া গান মূলত প্রাকৃতজনের গান। মাটিসংলগ্ন জীবনের গান। এ গানে যে জীবন উঠে এসেছে তা রাজা-বাদশাহদের জীবন নয়। ব্রাহ্মণ কিংবা জমািদারের জীবন নয়। নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবন আর নিম্নবর্গীয় মানুষের ভাষাই এ গানের প্রাণ।

এ গানের প্রধান তিন চরিত্র গাড়িয়াল, মৈষাল আর মাহুত। এলাকার সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করেই এই তিন চরিত্র প্রাধান্য লাভ করেছে। কৃষিনির্ভর ভাওয়াইয়া অঞ্চলে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। তাই অনেকগুলো গানে গাড়িয়ালের কথা এসেছে। যারা গরু-মহিষের গাড়ি চালায় তাদের গাড়োয়ান বলা হলেও এ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় সেটাকে বলা হয় গাড়িয়াল। ভাওয়াইয়া গানে ঘুরে ফিরে বহুবার এসেছে গাড়িয়ালের কথা। জমির মালিকদের ছিল গরুর গাড়ি। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষরা সেই গাড়ি চালাত। সেই গাড়িয়ালদের ঘিরে প্রেমবিরহের অসংখ্য ভাওয়াইয়া গান পাওয়া যায়। যেমন— ও কি গাড়িয়াল ভাই/ কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে

অন্য একটি গানে দেখা যায় বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি যাওয়ার সময়ে বাবার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তে মেয়ের করুণ আকুতি ফুটে উঠেছে। এই গানেও গাড়িয়ালকে উদ্দেশ্য করেই মেয়ের সেই আর্তি পরিদৃশ্যমান হয়ে উঠেছে— ওকি গাড়িয়াল বাই—/ ওরে আইস্তে/ বোলান গাড়িয়াল ওরে ধেরে বোলান গাড়ি/ ওরে এক নজর দেকিয়া লই মোর দয়াল বাপো বাড়ি

ভাওয়াইয়া গানের মধ্যে যে তিন শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব তারা সবাই নিম্নবর্গীয়। গাড়িয়াল, মৈষাল আর মাহুত। গাড়িয়াল গাড়ির মালিক নন, মাহুত হাতির মালিক নন আর মৈষাল মোষের মালিক নন। তিন শ্রেণিই অন্যের আশ্রিত। অন্যের কাছে নিজেদের শ্রম বিক্রি করে। ভাওয়াইয়া গান যে খেটে খাওয়া অভাবী-বঞ্চিত প্রাকৃত জনের জীবনছবি এই তিন শ্রেণি তার সাক্ষ্য বহন করে। মৈষাল অন্যের বাথানে মোষ দেখাশোনার কাজ করে। এই কাজ অনেক কঠিন। মৈষালের জীবনে সঙ্গী হিসেবে দেখা দেয় দোতারা। সেই দোতারায় কাটে নিঃসঙ্গতার নীরবতা। দোতারার তালে কণ্ঠে বেজে ওঠে ভাওয়াইয়া সুর। মাহুত-গাড়িয়াল-আর মৈষালকে উদ্দেশ করে রচিত গানগুলো মেয়ের নানান আবেদন-নিবেদন, ব্যথা-দীর্ঘশ্বাসে হলেও এ গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছিল ছেলেরাই।

ভাওয়াইয়া গানের আর এক প্রাকৃতজনের প্রতিনিধি মাহুত। এক সময়ে বন্য হাতিদের শিকার করা হতো এবং সেগুলো লালন-পালন করা হতো। যারা লালন-পালন করত তাদেরই মাহুত বলা হয়। গাড়িয়াল বন্ধু কিংবা মৈষাল বন্ধুর সঙ্গে গ্রামের সাধারণ-সরল নারীর যে সম্পর্ক, তাদের জন্য যে করুণ আর্তি মাহুত বন্ধুর জন্যও অভিন্ন টান। মাহুতেরাও অনেকদিন বাড়ি ছেড়ে গিয়ে থাকত। তাদের জীবনও ছিল অনেকটাই নিঃসঙ্গ। মাহুতের প্রতি নারীর অন্তর্গত বেদনার স্বরূপ চিত্রিত হয়েছে এ গানটিতে— আজি আউলাইলেন মোর বান্ধা ময়াল রে/ আরে হাতির পিঠিৎ থাকিয়ারে মাহুত/ কিসেয় বাটুল মার মাহুত রে—/ ওরে পরের কামিনিকি রে দেখিয়া/ জ্বলিয়া রে কেনে মর রে

ভাওয়াইয়া গান সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতিজাত। এ গানের ভাষা-ভাব সবকিছুই প্রাঞ্জল। এসব গানে খুব বেশি রূপক-প্রতীক-ইঙ্গিতের ব্যবহার নেই। ভাওয়াইয়া গানের কয়েকটি ধরন পরিলক্ষিত হয়। সেই ধরনের ওপর ভিত্তি করে ভাওয়াইয়া গানের শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। অনেকেই চটকা গানকেও ভাওয়াইয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে শ্রেণিবিন্যাস করেছেন। অনেকে আবার চটকা গানকে আলাদা করে বিচার করেছেন। পাঁচ ভাগে ভাওয়াইয়া গানকে ভাগ করা হয়েছে। (ক) চিতান ভাওয়াইয়া, (খ) ক্ষীরোল ভাওয়াইয়া, (গ) দরিয়া বা দীঘলনাসা ভাওয়াইয়া, (ঘ) মইষালী ভাওয়াইয়া ও (ঙ) করুণ বা গড়ান ভাওয়াইয়া।  ভাওয়াইয়া গান একজনের মুখ থেকে আরও একজনের মুখ হয়ে কালপরম্পরায় চলে এসেছে। সেজন্য দেখা যায় প্রায় একই রকম গান, হয়তো কয়েকটি শব্দ বদলে গেছে। আমাদের লোকজ-জীবনের, লোকসংস্কৃতির এক অভিচ্ছেদ্য অংশ ভাওয়াইয়া গান। রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের বাইরে অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ ভাওয়াইয়া গানের ভাষা বুঝতে না পারলেও তার সুরের ব্যঞ্জনায় মোহিত হয়।

সর্বশেষ খবর