রবিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

কৃষক পরিবার থেকে রাইসিনা হিলে

রামনাথ কোবিন্দ

কৃষক পরিবার থেকে রাইসিনা হিলে

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ঐতিহ্য মেনে বিশেষ বগিতে করে রামনাথ কোবিন্দকে দিল্লিতে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়

ভারতের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দ। কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝে দেশটির ১৪তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। অথচ এই রামনাথ কোবিন্দ ছিলেন এক খেটে খাওয়া সাধারণ পরিবারের সন্তান। তার বাবা ছিলেন কৃষক, ছিল না কোনো জমি। দরিদ্রতা ছিল নিত্যসঙ্গী। একটি মাত্র ঘরে ঠাসাঠাসি করে বাস করেছেন পুরো পরিবার। দুবেলা খাবার যোগাতেই যে পরিবারের কর্তার হিমশিম খেতে হয়, সে পরিবারের কোনো শিশু স্কুলের গণ্ডি পেরোবে এমনটি ভাবাই ছিল দুঃসাধ্য। তবু প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন রামনাথ কোবিন্দ। প্রতিদিন কয়েক মাইল দূরের স্কুলে গেছেন পায়ে হেঁটে। বার বার বাধাগ্রস্ত হয়েও নিরাশ হয়ে ফিরে যাননি। সেই রামনাথ কোবিন্দ আজ ভারতের প্রেসিডেন্ট। তার অবিশ্বাস্য এই যাত্রার গল্প লিখেছেন— তানিয়া তুষ্টি

 

গ্রাম থেকে প্রেসিডেন্ট ভবনে সাদামাটা মানুষটি

গ্রামের সবার বাবা রামনাথ  কোবিন্দ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর পরিণত হয়েছেন গোটা ভারতবর্ষের বাবা।  নিজেকে এগিয়ে নিতে নিরন্তর কাজ করেছেন এই  মানুষটি

 

কানপুরের পরৌখ গ্রামের ছোট্ট ছেলে রামনাথ কোবিন্দ। ছেলেবেলা থেকেই একটি দুঃস্বপ্ন তাড়া করে বেড়ায় সেই রামনাথকে। দাউ দাউ করে জ্বলা আগুন থেকে না ফেরা মায়ের স্মৃতি অনেকটাই ঝাপসা। ছেলেবেলাতেই ধাক্কা দিয়ে গিয়েছিল সেই ঘটনাটি। ছোট একটি কাঁচাঘরে পাঁচ ভাই দুই বোনের মধ্যে রামনাথ সবার ছোট। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে এমন ধাক্কায় গোটা পরিবার তছনছ হয়ে যায়। বাবা কৃষি কাজের পাশাপাশি ছোট্ট একটি দোকান চালিয়ে হাল ধরেন। এমন পরিবারের সবচেয়ে ছোট্ট ছেলেটিই হয়ে ওঠে ভারতের ১৪তম রাষ্ট্রপতি।

জন্ম ১৯৪৫ সালের ১ অক্টোবর উত্তর প্রদেশের কানপুরের পরৌখ গ্রামে। প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেওয়া সাদামাটা রামনাথ ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী। রামনাথের গ্রামের পঞ্চম শ্রেণি পার করে অনেক সহপাঠী আর স্কুলের মুখ দেখেনি। গ্রামে তেমন সুবিধাই ছিল না। রামনাথ কিন্তু হাল ছাড়েননি। ভর্তি হলেন বাড়ি থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে খানপুর-প্রয়াগপুরের এক স্কুলে। সে সময় বাড়িতে সাইকেল রাখাও এক প্রকার বিলাসিতা। এত বড় পরিবারে যেখানে খাবার জোটাই দায়! সেখানে এই বিলাসিতা ছিল রামনাথের জন্য আকাশ কুসুম স্বপ্ন। তাই তো প্রতিদিন ৬ কিলোমিটার হেঁটে যেতেন, স্কুল শেষে আবার হেঁটেই ফিরতেন। যখন রামনাথের ১৫ বছর চলছিল তখন তিনি বুঝলেন উচ্চশিক্ষা আর গ্রামে সম্ভব নয়। পাড়ি দিলেন শহরে। কানপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই কমার্সে গ্র্যাজুয়েট হলেন, আইন পাস করলেন। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাননি। সোজা দিল্লি এসে আইনজীবী হিসেবে হাত পাকাতে থাকেন। সুপ্রিম কোর্টে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড-ও হলেন। আইনজীবী হিসেবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন রামনাথ।  রামনাথ পেশায় আইনজীবী। রামনাথ ১৯৭১ সালে দিল্লির বার কাউন্সিলে নথিভুক্ত হন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি দিল্লি হাই কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারের আইনজীবী ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারের স্ট্যান্ডিং কাউন্সিলের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সালের আগ পর্যন্ত তিনি দিল্লি হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে ওকালতি করেন। প্রায় ১৬ বছর আইনি পেশার পর যোগ দিলেন রাজনীতিতে। সেটা ১৯৯০ সাল। হাই কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট দাপিয়ে বেড়ানো মানুষটি ওকালতির পাশাপাশি সমাজ সেবাও নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। বিজেপি তখন সবে পায়ের তলায় জমি শক্ত করছে। ভোটেও দাঁড়ালেন দুবার। প্রথমবার লোকসভা, দ্বিতীয়বার বিধানসভা। কিন্তু জয় পাননি। তবুও দলীয় নেতাদের গুডলিস্টে থেকে গেলেন। ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে এই দলিত নেতা উত্তর প্রদেশ থেকে রাজ্যসভার সদস্য হন এবং পর পর দুবার সাংসদ নির্বাচিত হন। রামনাথ দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করা বিজেপির ইউনিট ‘বিজেপি দলিত মোর্চা’র সাবেক প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি ওই পদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।  এ ছাড়া তিনি অল ইন্ডিয়া সমাজের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। সিভিল সার্ভিসের জন্যও তোড়জোড় শুরু করলেন। অচিরেই তার গুণ নজর কাড়ল ক্ষমতায় আসীনদের। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের অফিসার অন স্পেশাল ডিউটিও (ওএসডি) হয়ে গেলেন। এখানেই শেষ নয় সাদামাটা মানুষটির পথচলা। এরপর রামনাথ লক্ষেৗয়ের আমবেদকার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতার অল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের বোর্ড সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জাতিসংঘে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্বও করেন। একবার তো জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণও দেন। সময়টা ছিল ২০০২ সাল। কিন্তু এত সত্ত্বেও এই মানুষটি সব সময়ই থাকতে চেয়েছেন পর্দার পিছনেই। তিনি সংবাদ সম্মেলন করতে চাইতেন না। কখনো কখনো পাঠালেও তা এড়ানোর চেষ্টা করতেন। বিজেপির সদর দফতরে তাকে পেলেও সাংবাদিকরা খুব একটা কাছে ঘেঁষতেন না। কারণ, রাজনীতির সাত-পাঁচে থাকতেনই না তিনি। নীরবে কাজ করে যেতেন। আর সেটাই সাফল্যের চাবিকাঠি। অত্যন্ত সাদামাটা, মৃদুভাষী, গ্রামমুখী এই ব্যক্তিকে তাই বোধহয় রাষ্ট্রপতি পদে বেছে নিতে খুব বেশি ভাবতে হয়নি নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহকে। হ্যাঁ, দলিত-তাস তো ছিলই। রামনাথের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের ভাষায়, ‘আসলে বিতর্ককে খুব বেশি ধারে কাছে ঘেঁষতে দেননি রামনাথ। প্রত্যাশাও রাখেননি। নেতারা এমন ব্যক্তিকে পছন্দ করেন। রাষ্ট্রপতি পদে তার নাম ঘোষণার পর বিরোধীরা কম চেষ্টা করেননি রামনাথের বিতর্কে জড়াতে। কিন্তু ভালো কাজ জীবিত থাকে সর্বদা তারই প্রমাণ স্বয়ং রামনাথ কোবিন্দ। তা না হলে এত যোগ্য নেতার ভিড়েও রাষ্ট্রপতি পদে তার অভিষেক নিঃসন্দেহে ভাগ্যের বিষয়। আর পরৌখ গ্রামে সবার পছন্দের বাবা পৌঁছে যান রাষ্ট্রপতি ভবন রাইসিনা হিলে।

 

যত গৌরবময় অর্জন

আইনজীবী

ক্যারিয়ারের শুরুতে রামনাথ কোবিন্দ ছিলেন আইনজীবী। কানপুর কলেজ থেকে আইন বিষয়ে পাস করার পর রামনাথ দিল্লি চলে যান। সেখানে  সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতিও নেন ভালোভাবে। কিন্তু রামনাথ কোবিন্দের বিধি বাম, পরপর দুবার পরীক্ষা দিয়ে ব্যর্থ হন। কিন্তু হাল ছেড়ে দেননি তখনো। তৃতীয়বার চেষ্টায় তিনি সফল হন। তবে যে চাকরি হয় তাতে তিনি মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারেন না। তাই চাকরির আশা ছেড়ে ওকালতি প্র্যাকটিস শুরু করেন। ১৯৭১ সালে দিল্লির বার কাউন্সিলে তিনি আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের আইনজীবী হিসেবে দিল্লি হাই কোর্টে তিনি কাজ করেন ১৯৭৭-১৯৭৯ সাল পর্যন্ত। এই সময়কালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের ব্যক্তিগত অ্যাসিস্ট্যান্স হিসেবে কাজ করেন। এরই মধ্যে ১৯৭৮ সালে রামনাথ কোবিন্দ ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৯৩ দীর্ঘ ১৩ বছর তিনি দিল্লি সুপ্রিম কোর্টে ওকালতি করার মতো দক্ষতা প্রদর্শন করেন। শুধু তাই নয়, এ সময় সরকারের উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী করেন। এসব করতে গিয়ে তিনি গরিব অসহায়দের ভুলে যাননি। নিজের কাজের সঙ্গে রামনাথ তার সমাজসেবামূলক কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। নারী এবং গরিব দুস্থদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রদান করায় চারদিকে তার সুখ্যাতি ছিল।

 

বিজেপি সদস্য

নিজের অবস্থানকে একটু একটু করে শক্ত করে তোলেন রামনাথ কোবিন্দ। দলের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সালে তিনি ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্য হন। ১৯৯৮-২০০২ সময়কালে তিনি বিজেপি দলিত মোর্চার ও সর্বভারতীয় কোলি সমাজের সভাপতি পদে নিযুক্ত থাকেন। একই সময়ে তিনি দলটির জাতীয় মুখপাত্র হিসেবেও কাজ করেন। উদার রাজনীতিতে বিশ্বাসী থাকায় দেরাপুরে তার পৈতৃক ভিটেবাড়ি পর্যন্ত দান করে দেন দলকে। বিজেপিতে যোগদান করার কিছুদিন পরেই তিনি গৌতমপুর বিধানসভা কেন্দ্রের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

 

রাজ্যসভা

১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে রামনাথ কোবিন্দ রাজ্যসভার এমপি নির্বাচিত হন। মার্চ ২০০৬ পর্যন্ত টানা ১২ বছর একনিষ্ঠভাবে তিনি দলিত সম্প্রদায়ের জন্য উন্নয়নমূলক কাজে তিনি নিযুক্ত থাকেন। হোম অ্যাফেয়ার্স, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস, সামাজিক ন্যায় বিচার- প্রভৃতি ক্ষেত্রে তিনি দৃষ্টান্ত মূলক কাজ করেছেন। লোকাল এরিয়া ডেভেলপমেন্ট স্কিমের এমপি থাকা অবস্থায় উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরখন্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লেখাপড়ার মানোন্নয়ন এবং একাধিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের কাজ করেছেন। পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে তিনি থাইল্যান্ড, নেপাল, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে ভ্রমণ করেছেন।

 

শিক্ষাঙ্গনে ভূমিকা

রামনাথ কোবিন্দ শিক্ষা বিস্তারে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। তিনি লক্ষেৗর  ড. বি আর আম্বেদকার ইউনিভার্সিটি ও আইআইএম কলকাতার পরিচালন বোর্ডের সদস্য ছিলেন। শিক্ষা বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালনে এই পদে তিনি ছিলেন অক্টোবর ২০০২ সাল পর্যন্ত।

 

গভর্নর

২০১৫ সালের ৮ আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা দেবীসিংহ পাটিল রামনাথ কোবিন্দকে বিহারের রাজ্যপাল হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১৬ আগস্ট ২০১৫-তে পাটনা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইকবাল আহমেদ আনসারী তাকে রাজ্যপালের শপথ বাক্য পাঠ করান। শপথ অনুষ্ঠান পাটনার রাজ ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। কোবিন্দ গভর্নর থাকাকালীন সাংবিধানিক এবং অনুসন্ধানমূলক কাজে জুডিশিয়াল কমিশন দারুণভাবে প্রশংসিত হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকদের আটকে থাকা পদোন্নতি, সেবামূলক ফান্ডের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ কার্যক্রমে দুর্নীতি দূরসহ বিভিন্ন বিষয়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হন রামনাথ কোবিন্দ। ২০১৭ সালের জুনে যখন রামনাথ কোবিন্দ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পদপ্রার্থী হন তখন অপর এক প্রতিদ্বন্দ্বী নিতিশ কুমার নিজের অবস্থান থেকে ফিরে যান। রামনাথ কোবিন্দের উজ্জ্বল কর্মময় অবদানের জন্য তাকে প্রশংসা করে তার পাশে থাকার আশ্বাসও দেন।

 

প্রেসিডেন্ট হলেন অবশেষে

ভারতের ১৪তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার পর কোবিন্দ বিহারের গর্ভনরের পদ থেকে সরে আসেন। অপরদিকে ২০ জুন ২০১৭ পদত্যাগ করেন প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি। গত ২০ জুলাই বিপুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝে সম্পন্ন হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সেখানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে রামনাথ কোবিন্দ নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে ফলাফলে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের (এনডিএ) প্রার্থী রামনাথ পেয়েছেন ৬৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্সের প্রার্থী মীরা কুমার পেয়েছেন ৩৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ ভোট। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সংসদ সদস্যরা ভোট প্রদান করেন। ওই নির্বাচনে ভোটদাতার সংখ্যা মোট চার হাজার ৮৯৬ জন। এর মধ্যে আছেন রাজ্যসভার ২৩৩ জন, লোকসভার ৫৪৩ জন, বিধানসভার চার হাজার ১২০ জন। মোট ভোটারের সংখ্যা চার হাজার ৮৯৬ জন। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় রামনাথের থলিতে ভোট জমা পড়ে দুই হাজার ৯৩০টি। অন্যদিকে এক হাজার ৮৪৪ ভোট পেয়েছেন মীরা কুমার। ২৫ জুলাই ভারতের লোকসভার সেন্ট্রাল হলে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের শপথ অনুষ্ঠান হয়। তাকে শপথবাক্য পাঠ করান ভারতের শীর্ষ আদালত সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জে এস খেহর। শপথ বাক্য পাঠ করার পর ভাষণ দেন রামনাথ কোবিন্দ। তিনি বলেন, ‘বৈচিত্র্যের সম্মিলনই ভারতের সাফল্যের চাবিকাঠি’।

এদিন ভারতের ১৩তম সদ্য প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেন্ট্রাল হলে আসেন নতুন রাষ্ট্রপতি। তারপর প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে হয় তার আসন বিনিময়। নতুন রাষ্ট্রপতির সম্মানে একুশ বার তপোধ্বনি হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভারতের উপ রাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও লোকসভা অধ্যক্ষ সুমিত্রা মহাজন। এ ছাড়াও ছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা, বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্যপালরা, মুখ্যমন্ত্রীরা ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকরা। নতুন রাষ্ট্রপতির পরিবারের আট সদস্যও ছিলেন শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে নতুন রাষ্ট্রপতি যাত্রা করেন রাষ্ট্রপতি ভবনের উদ্দেশে। সেখানে তাকে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার।

 

 

গ্রামে তিনি সবার ‘বাবা’

ভারতের নতুন রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র রাজনৈতিক জীবনেই নয়, ব্যক্তিজীবনেও সবার প্রিয় পাত্র। গ্রামের মানুষ তাকে গরিবের ত্রাণকর্তা হিসেবেই জানেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নেওয়া রামনাথ কোবিন্দ ছোট থেকেই দেখেছেন গ্রামের মানুষের অসহায়ত্ব। নিজেও পার করেছেন অসহনীয় অভাবের দিন। তাই তো গ্রামের অসহায় মানুষের কষ্ট বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি মোটেও। এতকিছুর পর জীবনে আলোর মুখ চোখে দেখা শুরু করলেও ভুলে যাননি গ্রামের মানুষদের। তাদের পাশে ছিলেন সব সময়। গ্রামে তাকে সবাই ‘বাবা’ বলেই ডাকেন। সেই নামেই রামনাথকে চেনেন সবাই। তার কারণও আছে। বছর কয়েক আগে তিনি গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলেন। গ্রামবাসীরা তাদের এই মধ্যমণিকে সোনা-রুপোয় বাঁধানো মুকুট পরিয়ে দেয়। সেই মুকুট তিনি গ্রহণ করেননি। খুলে তুলে দিয়েছিলেন গ্রামবাসীদের হাতেই। তখন গ্রামবাসীর সামনে তিনি বলেছিলেন, ‘এই টাকায় গরিব মেয়েদের বিয়ে দিন।’ তার ত্যাগ এখানেই থেমে থাকেনি, নিজের জন্মভিটেটাও দান করেছেন। সেখানে গড়ে দিয়েছেন ‘মিলন কেন্দ্র’। যে কোনো অনুষ্ঠানের জন্য এখন সব গ্রামবাসীরই হক সেই কেন্দ্রে। রাজ্যসভার সাংসদ হয়ে সাংসদ তহবিলের টাকায় সেই গ্রামের রাস্তা থেকে হ্যান্ডপাম্প, ব্যাংক থেকে স্কুলসহ অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন রামনাথ কোবিন্দ।

 

ব্যক্তিজীবন

বাবা মাইকুলাল ছিলেন একজন ভূমিহীন চাষি। ছোট্ট দোকানের আয়ের ওপর নির্ভর ছিল সাত সন্তানসহ মাইকুলাল কোবিন্দের সংসার। প্রতিদিন ৬ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে খানপুর গ্রামে জুনিয়র স্কুলে পড়তে যেতেন রামনাথ কোবিন্দ। অদম্য প্রচেষ্টা ও মনোবলকে পাথেয় করে তিনি কানপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনস্ত ডক্টর অমিত কুমার শ্রীবাস্তব কলেজ থেকে কমার্স নিয়ে বিএ ও আইন পাস করেন। ৪৪ বছর বয়সে এই রাজনীতিবিদ বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। সময়টা ছিল ১৯৭৪ সালের ৩০ মে। রামনাথ কোবিন্দ ও সবিতা কোবিন্দ দম্পতির সংসারে দুই সন্তান। মেয়ে স্বাতী ও ছেলে প্রশান্ত কুমার।

 

এক নজরে

♦ একটি দলিত কোলি পরিবারে জন্ম নেন রামনাথ কোবিন্দ। বর্তমানে তার পৈতৃক ভিটেবাড়িটি গ্রামবাসীর বিয়েবাড়ি বা বরযাত্রীদের রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করে।

♦  ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশ থেকে নয়জন প্রধানমন্ত্রী আসলেও তিনিই প্রথম রাষ্ট্রপতি।

♦  বিজেপি-তে যোগদান করার আগে তিনি ১৯৭৭ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন।

♦  গত মে মাসে বিহারের রাজ্যপাল থাকাকালীন সপরিবারে হিমাচল প্রদেশে বেড়াতে গিয়ে কোবিন্দ সিমলার কাছে রাষ্ট্রপতির সামার রিট্রিটে ঢুকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ভবনের অনুমতি নেই, এই যুক্তিতে রক্ষীরা তাকে গেট থেকে ফিরিয়ে দেয়।

♦  বিজেপিতে যোগদান করার পর ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি দলিত শ্রেণির নেতার দায়িত্ব পালন করেন।

♦  লোকসভার ভোটে না জিতেও রামনাথ কোবিন্দ দুবার ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভার সদস্য হয়েছেন। ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত টানা বারো বছর তিনি রাজ্যসভার এমপি ছিলেন।

♦  ২০০২ সালে রামনাথ কোবিন্দ নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে ভাষণও দেন।

♦  ২০১৫ সালের ৮ আগস্ট তাকে বিহারের রাজ্যপাল পদে নিয়োগ করা হয়।

সর্বশেষ খবর