বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

দেশে দেশে শরণার্থী সংকট

তানভীর আহমেদ

দেশে দেশে শরণার্থী সংকট

মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর, বর্বর হত্যাযজ্ঞ থেকে প্রাণ বাঁচাতে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ছবি : রোহেত রাজীব

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বর্তমান বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ শরণার্থী সংকটে ভুগছে। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে রাজনৈতিক, সামরিক, জাতিগত ও মতাদর্শের নানা সংকট মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে জাতি পরিচয়, বেঁচে থাকার অধিকার। ইতিমধ্যে ৬ কোটি ৫৬ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়েছে।

শরণার্থী হিসেবে জীবন কাটাচ্ছে ২ কোটি ২৫ লাখ মানুষ। এসব শরণার্থীর অর্ধেকেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। এখনো ১ কোটি মানুষের কোনো পরিচয় নেই। কোনো দেশই এদের নাগরিক অধিকার ও স্বীকৃতি দিচ্ছে না। তারা যেন এ গ্রহের কেউ নয়! জাতি পরিচয়হারা এই মানুষরা পায় না শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার।

আপনি যখন এ লেখা পড়ছেন তখন বিশ্বের কোথাও না কোথাও প্রতি মিনিটে অন্তত ২০ জন মানুষ ঘরবাড়ি, দেশ সব ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে অন্য কোথাও। বেছে নিচ্ছে অনিশ্চিত ও করুণ শরণার্থীর জীবন।

 

নজিরবিহীন রোহিঙ্গা শরণার্থী  সংকটে বাংলাদেশ

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে।  ২৫ আগস্ট থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭। জাতিসংঘের হিসাবমতে, এই সময়ের ব্যবধানে অন্তত ৪ লাখ ২১ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। প্রকৃত চিত্র বলছে এই সংখ্যা আরও বেশি। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১০ লাখ হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে উদ্বেগজনক শরণার্থী সমস্যা এটি। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বর্তমান চিত্র, দুর্দশা নিয়ে উৎকণ্ঠা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ-মিয়ানমার টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশকারী রোহিঙ্গারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারের রাখাইনে বসবাস করে আসছে। কিন্তু তাদের মিলত না কোনো নাগরিক অধিকার ও সেবা। সম্প্রতি কয়েকটি পুলিশ চৌকিতে কিছু দুর্বৃত্তের হামলার ঘটনার পর মিয়ানমার সামরিক জান্তা নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা করে, গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। জাতিগত এই নিধন ও অত্যাচার-নির্যাতন থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে। প্রতিদিনই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।

 

সিরিয়ার ৫৫ লাখ শরণার্থীর হাহাকার

নাটকীয়ভাবে সিরিয়া সংকটের শুরু হয়। ২০১১ সালে মার্চ থেকেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হলে সিরিয়ায় মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে। সে বছরই প্রায় ১০ লাখ মানুষ সিরিয়া ছেড়ে পালিয়ে যান পার্শ্ববর্তী দেশে। পরের ছয় মাসে আরও ১০ লাখ মানুষ শরণার্থীর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়। এরপর ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। সিরিয়া সংকটের সমাধান হয়নি। এরই মধ্যে সিরিয়া ছেড়েছে ৫৫ লাখ মানুষ। সিরিয়া শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে তুরস্ক। ইতিমধ্যে তুরস্কে ২৫ লাখ সিরিয়ান শরণার্থী আশ্রয় পেয়েছে। সিরিয়ান শরণার্থীরা সারা বিশ্বে আশ্রয় নিয়েছে। নিবন্ধনকৃত সিরিয়ান শরণার্থীরা তুরস্ক, লেবানন, জর্ডান, জার্মানি, সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত, ইজিপ্ট, সুইডেন, হাঙ্গেরী, কানাডা, ক্রোয়েশিয়া, গ্রিস, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, সার্বিয়া, সিঙ্গাপুরসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে আশ্রয় নিয়েছে। বিশ্বজুড়ে শরণার্থী ছড়িয়ে পড়ার এমন ঘটনা ইতিহাসে এত বড় পরিসরে আর ঘটেনি। এছাড়া প্রথম দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এত মানুষকে দেশ ছেড়ে শরণার্থীর জীবন বেছে নিতেও হয়নি। বর্তমান বিশ্বের শরণার্থীর সমস্যার সবচেয়ে দুঃখজনক চিত্র এটি। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ফলে এই শরণার্থীদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। উন্নত দেশগুলো যে  অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা করছে তা খুব সামান্য। যে কারণে সিরিয়ান শরণার্থীদের দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিকভাবেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে সিরিয়ান শরণার্থীরা। সিরিয়ার শরণার্থীদের শিশু ও নারীরা পড়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ সিরিয়া শরণার্থীদের জন্য মানবতার হাত বাড়িয়ে দিলেও আর্থিকভাবে সচ্ছল, উন্নত ও সামরিক শক্তিধর দেশগুলো সিরিয়া শরণার্থীদের ব্যাপারে নিয়েছে কৌশলী ভূমিকা। তাদের আশ্রয় দিতে চাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্রসহ মানবতার বুলি আওড়ানো বেশির ভাগ দেশের রাষ্ট্রনেতারা।

 

আফ্রিকায় ভয়াবহ শরণার্থী সমস্যা

আফ্রিকার লেক চাঁদ বেসিন অঞ্চল। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই কৃষক। কেউ কেউ মাছ ধরে। কাঠের কাজ করে। আধুনিক দুনিয়ার  রাজনীতি, সন্ত্রাসবাদের হুমকি এসব নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। কিন্তু এ সাধারণ, দরিদ্র মানুষগুলোকে বেছে নিতে হয়েছে শরণার্থীর করুণ জীবন। আফ্রিকার লেক চাঁদ বেসিন অঞ্চল থেকে প্রায় ২০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছে। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তা ২৬ লাখ ছুঁয়ে যায়। ক্যামেরুন, চাঁদ, নাইজার ও নাইজেরিয়ার এ শরণার্থীদের অবস্থা করুণ। খাদ্য ও চিকিৎসাসেবার সংকট এখানে মানবিক বিপর্যয় তৈরি করেছে। অর্ধ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছে। ৬০ লাখ মানুষ রয়েছে ভয়াবহ খাদ্য ঝুঁকিতে। বিশ্বের ধনী দেশগুলোর কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েও সমস্যা আশানুরূপ সমাধান ঘটেনি এ অঞ্চলে। বরং শরণার্থীদের সংকট দিন দিন বেড়েই চলেছে। উত্তর-পূর্ব নাইজেরিয়ায় সন্ত্রাসী সংগঠন বোকো হারামের হত্যাযজ্ঞ, লুটপাট প্রবল আকার ধারণ করে ২০০৯ সালে। তখন থেকেই আফ্রিকার লেক বেসিন অঞ্চলের মানুষ ঘর ও দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করে। জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়লেও খাদ্য ও পানি সংকটে পড়ে। বোকো হারাম এ অঞ্চলে শরণার্থীদের দেশ থেকে দেশে ছড়িয়ে দিতে বাধ্য করে। শুধু তাই নয়, অনেককেই তারা সন্ত্রাসী সংগঠনে যোগ দিতে বাধ্য করে। সাব-সাহারা আফ্রিকান অঞ্চলের যে পরিমাণ শরণার্থী রয়েছে তা গোটা বিশ্বের শরণার্থীদের ২৬ শতাংশ। ইউএনএইচসিআর-এর মতে এ অঞ্চলের অন্তত ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ শরণার্থী সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ সংকট অত্যন্ত প্রকট হচ্ছে। সেন্ট্রাল আফ্রিকা, নাইজেরিয়া এবং দক্ষিণ সুদানসহ আশেপাশের দেশগুলো এরই মধ্যে শরণার্থী সংকটে নাকাল হয়ে পড়েছে। বুরুন্দি ও ইয়েমেনে শরণার্থী সংকট দেখা দেওয়া, জাতি বিরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আফ্রিকায় শরণার্থী সমস্যা নতুন রূপ পেয়েছে।

 

দুনিয়া ভুলে গেছে দক্ষিণ সুদানকে!

১ লাখ মানুষ না খেয়ে আছে। আরও ৫০ লাখ মানুষ রয়েছে ভয়াবহ খাদ্য সংকটে। এই হলো দক্ষিণ সুদানের শরণার্থীদের চিত্র। তাদের দুর্দশা, কষ্ট দেখে অনেকেই বলেন, দুনিয়া হয়তো তাদের ভুলেই গেছে! গৃহযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বন্যা তাদের জীবনে যোগ করেছে চূড়ান্ত সংকট। তাদের স্যানিটেশন, চিকিৎসা, খাবার পানি, বাসস্থান কিছুই নেই। জাতিগত বিরোধ, দরিদ্রতা আর প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেন তাদের নিয়তি। আধুনিক বিশ্বের মানচিত্রে যেন তাদের ঠাঁই নেই। অমানবিক, দুর্দশায় নিমজ্জিত দক্ষিণ সুদানের এ শরণার্থীরা। এ মুহূর্তে দক্ষিণ সুদানের শরণার্থী সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে দক্ষিণ সুদান ছেড়ে আসে ৪০ লাখ মানুষ। তাদের এখন কোনো ঘর নেই, খাবার নেই। ২০ লাখ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। প্রাণে বেঁচে গেলেও চিকিৎসা ও খাদ্য সংকটে তারা মৃত্যুর প্রহর গুনছে।

 

২৫ লাখ আফগান শরণার্থীর দুর্দশা

১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর থেকেই আফগান অঞ্চলে মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করে। শরণার্থীর জীবন তখন থেকেই আফগানবাসীর। ১৯৮৯ এর পর যুদ্ধ থামলে, এ শরণার্থীরা গৃহহীন থেকে যায়। ১৯৯২ সালের পর আফগানিস্তানে ‘মুজাহিদীন’ গোষ্ঠী শহর দখল করা নিয়ে সংঘর্ষে জড়ালে সাধারণ মানুষ শরণার্থীর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়। ঘর ছেড়ে দেশ ছেড়ে পাকিস্তান ও ইরানে পাড়ি জমায় আফগান শরণার্থীরা। বছরের পর বছর বেকারত্ব, নিরাপত্তাহীনতা ও রাজনৈতিক সংঘাত সংকট থেকেই আফগানিস্তান অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। জঙ্গিগোষ্ঠী আফগানিস্তানে নিজেদের সুগঠিত করলে পশ্চিমা বিশ্বে তাদের নির্মূলে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে। যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার পরই মূলত এ অঞ্চলে মার্কিন আগ্রাসন নতুন রূপ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় আফগানিস্তানের জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। ইউএনের দাবি প্রতিদিন আফগানিস্তান ছাড়ছে ১ হাজার মানুষ। ইতিমধ্যে আফগানিস্তান ছেড়ে শরণার্থীর জীবন বেছে নেওয়া মানুষের সংখ্যা ২৫ লাখ পেরিয়ে গেছে। পাকিস্তান ও ইরান আফগানিস্তানের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে।

 

বিশ্বজুড়ে শরণার্থীদের বর্তমান চিত্র

 

শরণার্থীরা বিশ্বের যে অঞ্চলগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর