শূন্য থেকে শিখরে— কথাটি বলা সহজ কিন্তু দেখানো কঠিন। আর সেই কঠিন বাস্তবতাকে জয় করেছিলেন প্রয়াত ব্যবসায়ী সেখ আকিজ উদ্দিন। মাত্র ১৬ টাকা পুঁজি করে ঘর ছেড়েছিলেন এ মানুষটি। তিনি ছিলেন সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। হাজার কোটি টাকার মালিক। ‘মালিক হবে গরিব আর প্রতিষ্ঠান হবে ধনী’ নীতিতে বিশ্বাসী তিনি। এত সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও সারাটি জীবন কাজ করে গেছেন শ্রমিক, দিনমজুর আর অসহায় মানুষের কল্যাণে। গড়ে তুলেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ট্রাস্ট, হাসপাতালসহ অনেক সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান।
মাত্র ১৬ টাকা পুঁজি নিয়ে ফেরিওয়ালার শিল্পপতি হওয়ার গল্পটি রূপকথাতেই মানায়। বাস্তবে কখনো কি তা সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সেখ আকিজ উদ্দিন এমনই এক বাস্তব গল্পের নায়ক। তিনি খুলনার ফুলতলা থানার মধ্যডাঙ্গা গ্রামে ১৯২৯ সালে জন্ম নেন। বাবা খুদে ব্যবসায়ী সেখ মফিজউদ্দিন ও মায়ের নাম ছিল মতিনা বেগম। সাত-আট বছরের খুদে আকিজ বাবার ঘাড়ে ঝোলানো পণ্যবাহী বাঁকের এক ঝুড়িতে বসে থাকতেন। অপর ঝুড়িতে থাকত নানা পদের সবজি। ফেরিওয়ালা বাবার সঙ্গে পথে পথে ঘুরে তখনই সঞ্চয় করে নিয়েছিলেন ব্যবসায়িক স্পৃহা। কিন্তু বাবার একার যৎসামান্য আয়। তাদের ইচ্ছা থাকলেও দারিদ্র্যের কশাঘাতে আকিজের পড়ালেখায় মন বসল না। স্কুলেও যাওয়া হয় অনিয়মিত। এখানে ওখানে ঘুরেফিরে আর সঙ্গীদের সঙ্গে খেলা করে সময় কাটে বেশ কিছুদিন। কিন্তু না, স্কুলে আর ফিরে যাওয়া হয় না তার। তারপর মাত্র নয় বছর বয়সে মায়ের সহযোগিতায় চকোলেট, বাদামের ফেরিওয়ালা হয়ে গেলেন। সেই থেকেই শুরু। পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাকতেন একটি কুঁড়েঘরে। বাড়ির অদূরেই বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠ। এরপর ছিল খুলনার বেজেরডাঙ্গা রেলস্টেশন। সেখানেই ছোট্ট আকিজের ফেরি করে এটা-ওটা বিক্রির কাজ শুরু। যখন মোটামুটি একটু ব্যবসায়িক জ্ঞান চলে এলো তখনই নতুন চিন্তা মাথায় চেপে বসল। ১৯৪২ সালে বাবার কাছ থেকে মাত্র ১৬ টাকা নিয়ে বাড়ি ছাড়েন। গন্তব্য কলকাতা। সেখানে গিয়ে আশ্রয় হলো শিয়ালদহ রেলস্টেশনে। সারা দিন ঘোরাফেরা, কাজের সন্ধান করা আর রাত হলে স্টেশনের এক কোণে কাগজ বিছিয়ে শুয়ে পড়া। তার সারা দিনের খাবার ছিল ছয় পয়সার ছাতু। এদিকে দ্রুত টাকা ফুরিয়ে আসছে আবার উপযুক্ত কাজও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন অনেক ভেবে-চিন্তে কমলা লেবুর ব্যবসা শুরু করলেন। পাইকারি দরে কমলা কিনে হাওড়া ব্রিজের আশপাশে ফেরি করে খুচরা বিক্রি করা শুরু করেন। সেজন্য পুলিশকে দুই টাকা করে ঘুষও দিতে হতো তাকে। এরপর আরেকটি নতুন ব্যবসার পরিকল্পনা আসে তার মাথায়। ভ্রাম্যমাণ মুদির ব্যবসা। কিন্তু পুলিশি ঝামেলায় তিন দিনের কারাবাসে সে ব্যবসাও বাদ দিতে হয়। এর কিছুদিন পর এক পেশোয়ারি ব্যবসায়ীর সঙ্গে পাড়ি জমান পেশোয়ারে। ব্যবসার স্বার্থে তাকে পশতু ও হিন্দি ভাষা শিখতে হয়েছিল। এভাবেই কেটে গেল দুই বছর। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্রান্তিকাল চলছে। মোটামুটি ১০ হাজার টাকা পুঁজি হলে আকিজ উদ্দিন বাবা মায়ের কাছে ফিরে আসেন। কিন্তু সুখ বেশিদিন সইল না।
অল্পদিনের ব্যবধানে বাবা-মা দুজনেই মারা গেলেন। তখন আকিজ উদ্দিনের বয়স মাত্র ১৯। কী করবেন কিছু ভেবে পাচ্ছিলেন না। আকিজ উদ্দিন বিয়ে করে ঘরজামাই হলেন। শ্বশুরের কৃষিকাজে তিনি মন দিলেন না। এক বন্ধুর বাবা বিধুভূষণের বিড়ির ব্যবসা দেখে উৎসাহিত হন। সেই সুবাদে বিড়ি তৈরি করে বিক্রির ধারণাটি মাথায় আসে। ১৯৫২ সালে দুজন কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে নেমে পড়েন বিড়ির ব্যবসায়। অল্পদিনের মধ্যে লাভের মুখ দেখা যায়। তখন বেজেরডাঙ্গা রেলস্টেশনের পাশে একটি মুদির দোকান দেন। ১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে দোকানের বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৬০ হাজার টাকার মতো। হঠাৎ এক রাতে দোকানে আগুন লেগে যায়। দোকানের ভিতর থেকে কোনোমতে ঘুমন্ত আকিজ উদ্দিন বের হয়ে আসেন কিন্তু সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সব হারিয়ে এক মুহূর্তের জন্যও তিনি মনোবল হারাননি। দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে শূন্য থেকে আবার শুরু করেন। এরপর নতুন করে আপন লোকদের সহায়তায় দোকান শুরু করেন। এবার শুরু করলেন ধান, পাট, চাল, গুড় আর ডালের ব্যবসা। সবক্ষেত্রে তার মূলধন ছিল বিশ্বস্ততা। তাকে সবাই নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করত। ১৯৬০ সালে তিনি যশোরের সীমান্তবর্তী নাভারণ পুরাতন বাজারে চলে যান। সেখানেই তিনি নতুন করে বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। গড়ে তোলেন বিড়ি ফ্যাক্টরি। ধীরে ধীরে অন্যান্য ব্যবসাতেও মনোনিবেশ করেন। নাভারণের বিড়ি ফ্যাক্টরি চালু করতে গিয়েও গ্রাম্য কূটচালের শিকার হয়েছিলেন। এ ষড়যন্ত্রগুলোই তাকে সমাজে স্থান করে দিয়েছিল। কেননা তিনি ছিলেন মিষ্টভাষী-সদালাপী। তা ছাড়া নাভারণের দুস্থ নারী-পুরুষের কর্মস্থলের সুযোগ তৈরি করেছিলেন তিনি। এ মেহনতি জনতাই তাকে সমর্থন জুগিয়েছেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন সংগ্রামী। রেলের এক ছাদ থেকে অপর ছাদে লাফিয়ে তার জীবনের ভারবহন শুরু। ব্যবস্থাপক হিসেবে তিনি ছিলেন প্রশংসনীয়। ব্যবসা থেকে পরিবার কোথাও তার ব্যবস্থাপনা নীতির জুড়ি ছিল না। ব্যবসায় বিপণনকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রথম জীবনে তিনি নিজেই বিপণনের কাজ করতেন। এক্ষেত্রে তার বিশেষ কিছু কৌশল ছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দুর্গত এলাকায় কোম্পানির পণ্য পৌঁছাত না। কিন্তু তিনি কর্মকর্তাদের ডেকে বলতেন, সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। অতিরিক্ত খরচ হলেও সেখানে পণ্য পৌঁছাতে হবে। তাতে সামাজিক দায় মিটবে, একই সঙ্গে আকিজ ব্র্যান্ডের পরিচিতি বাড়বে। এমনকি এককভাবে বিপণন করা সম্ভব হবে। তিনিই প্রথম বাংলাদেশে রেডিওতে পণ্যের বিজ্ঞাপন ব্যবস্থা চালু করলেন। তার গাড়িতে আকিজ বিড়ির বিজ্ঞাপন সেঁটে দিয়েছিলেন। আশির দশকে ব্যবসা যশোরকেন্দ্রিক থাকাবস্থায় তিনি বিপণনে প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। তার আগে তিনি নিজে বিভিন্ন বাজারে বিপণন করেছেন। তার নীতি ছিল ‘মালিক হবে গরিব আর প্রতিষ্ঠান হবে ধনী’— এই নীতির ওপর ভিত্তি করে কোম্পানি থেকে তিনি বেতন নিয়েছেন। তার বেতনের চেয়ে অনেক কর্মকর্তার বেতন ছিল বেশি। তার ব্যবসায়িক মালিকানায় সন্তানদের অংশীদার করেছেন। আর নিজের অংশ রেখেছেন কম। তিনি ব্যবসায় সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনে যেমন ছিলেন উদ্ভাবনী গুণে অনন্য, তেমনি তিনজন স্ত্রীর সংসারে ছিলেন দৃঢ়চেতা। সন্তান লালন-পালনে ব্যবসায়িক ব্যস্ততা তার বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বিত্ত-বৈভবের মধ্যে থেকেও সন্তানরা লেখাপড়া শিখেছেন এবং সাদামাটা জীবন পার করেছেন। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে যে সন্তানকে যে জায়গায় উপযুক্ত মনে করেছেন সেখানে কাজে লাগিয়েছেন। ২০০৬ সালে মারা যাওয়ার পর আজও এ বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের কোনো অধঃপতন লক্ষ্য করা যায়নি। বরং সন্তানদের দক্ষ ভূমিকায় ব্যবসাটি নিয়মিত ধারায় এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে।
বিড়ি ব্যবসায়ের উত্থান
ফেরিওয়ালা থেকে আকিজ উদ্দিনের সংগ্রামী জীবন
বিড়ি থেকে শুরু করে ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, সিমেন্ট, টোব্যাকো, টেক্সটাইল, পার্টিকেল বোর্ডসহ ২৩টি ক্যাটাগরিতে সেখ আকিজ উদ্দিনের ব্যবসা। ব্যবসার প্রসার এক দিনে এভাবে বিস্তৃতি লাভ করেনি। তিল তিল করে গড়ে তুলতে হয়েছে বিশাল এ ব্যবসায় সাম্রাজ্য। মাঝে মাঝে হয়তো এমনভাবে হোঁচট খেয়েছেন, তাতে সর্বস্বান্তই বলা যায়। কিন্তু না, থেমে না থেকে উত্থান ঘটিয়েছেন সেখান থেকেই। আকিজ গ্রুপে যত নতুন ব্যবসায় যুক্ত হোক না কেন ভিত্তি ব্যবসা ছিল বিড়ির। যৎসামান্য পুঁজি নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই ব্যবসা বর্তমানে একটি গ্রুপ অব কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। প্রথমদিকে হয়তো আকিজ উদ্দিন নিজেও ভাবতে পারেননি, তার হাতের এই ছোট্ট প্রতিষ্ঠানটি দিন বদলের সঙ্গে নিজের অবস্থান এতটা শক্ত করতে পারবে। বর্তমানে ৩ লাখ ২ হাজার লোক এখানে কাজ করছেন। ফেরিওয়ালা থেকে সেখ আকিজের এ সংগ্রামী জীবন আজ শিল্পশক্তিতে পরিণত হয়েছে। আজ তিনি তুচ্ছতা আর নিন্দাকে ছাপিয়ে অপরের অনুকরণের ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষার পাট চুকাতে না পারলেও পৃথিবীর পাঠশালা থেকে তার অর্জিত জ্ঞান সমৃদ্ধির জন্য সহায়তা করেছে। তিনি নিজেই একটি বিশাল বিস্তৃতির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। ছাই স্পর্শ করে সোনা ফলিয়েছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার উদ্যোগের সুফল ভোগ করছে লাখো মানুষ। ব্রিটিশ, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি অর্থনীতির তিনটিই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। নানা চড়াই-উতরাইয়ের মাঝে ব্যবসাকে বয়ে নিয়ে শিখরে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। তবে সে কঠিন কাজও করেছেন সেখ আকিজ উদ্দিন। ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতির রূপকার সেখ আকিজ উদ্দিন অনেকের জন্য ছিলেন বৃক্ষের ছায়াস্বরূপ। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে সেখ আকিজ উদ্দিন আকিজ শিল্প গোষ্ঠী ৯৫০ কোটি টাকা শুল্ক কর সরকারকে প্রদান করে রেকর্ড সৃষ্টি করে।
সমাজসেবক
মানবসেবায় কয়েক জেলায় গড়েছেন হাসপাতাল
বাংলাদেশের কৃতী ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক সেখ আকিজ উদ্দিন। মাত্র ১৬ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেছিলেন তার ব্যবসা। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করেছেন, সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন আকিজ গ্রুপ অব কোম্পানি। অবদান রেখেছেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে। সেখ আকিজ উদ্দিন সমাজসেবায় নিজেকে যুক্ত করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মানব কল্যাণে তিনি যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়াসহ ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেছেন হাসপাতাল। এ ছাড়াও বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ডে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন দুই হাতে। ২০০০ সালে যশোরে ভয়াবহ বন্যার সময় ত্রাণ নিয়ে ঢাকা থেকে ছুটে আসেন শার্শা-ঝিকরগাছা এলাকায় আকিজ উদ্দিন। এ সময় তিনি প্রায় এক কোটি টাকার ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন অসহায় বন্যার্তদের মাঝে। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর মসজিদ নির্মাণ করেছেন। স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ গরিবের সন্তানদের লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। আকিজ উদ্দিনের অন্যতম সৃষ্টি হচ্ছে আদ্-দ্বীন ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ট্রাস্ট দক্ষিণাঞ্চলসহ আরও কিছু জেলায় মানব কল্যাণ, স্বাস্থ্যসেবা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া তিনি ১৯৮৯ সালে আদ্-দ্বীন ওয়েল ফেয়ার সেন্টার, ২০০৪ সালে আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশন, ১৯৮০ সালে আদ্-দ্বীন শিশু কিশোর নিকেতন, ১৯৮৫ সালে আদ্-দ্বীন নার্সিং ইনস্টিটিউট, আদ্-দ্বীন ফোরকানিয়া প্রজেক্ট, ১৯৯২ সালে আকিজ কলেজিয়েট স্কুল, ১৯৯৮ সালে সখিনা স্কুল ফর গার্লস প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন রকম সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। বেনাপোলের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সারথী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মতিয়ার রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, আকিজ সাহেবের সঙ্গে আমি ১৯৭৮ সাল থেকে ব্যবসা করছি। ২০০০ সালে বন্যায় তার অবদানের কথা আমরা কোনোদিন ভুলব না।
তার যত ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান
রেলস্টেশনে ঘুরে ঘুরে ছোট্ট আকিজ শুরু করেন চকোলেট, আচারের ব্যবসা। তার কিছুদিন বাদে ট্রেনে চেপে তেঁতুল, আচার কিংবা মাছ নিয়ে তিনি কলকাতা যেতেন। সেখান থেকে চকোলেট, বিস্কুটের ফেরি নিয়ে গ্রামে ফিরতেন। সেই ব্যবসা থেকে অর্জিত টাকায় বাবার পরামর্শে ডাবের ব্যবসা শুরু করেন। তারপর কলকাতায় গিয়ে ঘুরে ঘুরে লেবুর ব্যবসা করে বেশ লাভবান হন। এর কিছুদিন পর কলকাতাতেই ভ্রাম্যমাণ মুদির দোকানের ব্যবসা করেন। হরেক রকম জিনিস বিক্রি করে লাভও হচ্ছিল ভালো। তারপর পেশোয়ারে গিয়ে তিনি আবারও ফলের ব্যবসা করেন। এরপর বাবা-মায়ের কাছে ফিরে এসে নতুন কিছু করার পরিকল্পনা করেন। ১৯৫২ সালে আকিজ তার বন্ধুর বাবা ‘বিধু’ বিড়ির মালিক বিধুভূষণের অনুগ্রহ-সহায়তা-পরামর্শে বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। বেজেরডাঙ্গা রেলস্টেশনের পাশে করা দোকানটি আগুনে পুড়ে গেলে তিনি কিছুটা ভেঙে পড়েন। কিন্তু ধৈর্যশীল আকিজ আবার ঘুরে দাঁড়ান। তিনি স্থানীয় মহাজনদের সহায়তায় আবার দোকান নির্মাণ করেন। একই সঙ্গে শুরু করেন ধান, পাট, চাল, ডালের ব্যবসা। এরপর ১৯৬০ সালে আকিজ যশোরের নাভারণে এসে আকিজ বিড়ির প্রসার ঘটান। স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোজাহের বিশ্বাস আকিজকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। আকিজ আর পেছনে ফিরে তাকাননি। নাভারণ পুরাতন বাজারে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আজকের সবচেয়ে বড় বিড়ি তৈরির কারখানা আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরি। এরপর ১৯৬০ সালে অভয়নগরে অত্যাধুনিক চামড়ার কারখানা এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ১৯৬৬ সালে ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ, ১৯৭৪ সালে আকিজ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, ১৯৮০ সালে আকিজ ট্রান্সপোর্টিং এজেন্সি লিমিটেড গড়ে তোলেন। ১৯৮০ সালে তার অপর ব্যবসা নাভারণ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৬ সালে গড়ে তোলেন জেস ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড, ১৯৯২ সালে আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরি লিমিটেড, ১৯৯৪ সালে আকিজ জুট মিল লিমিটেড, ১৯৯৫ সালে আকিজ সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, একই বছর আকিজ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড তার ব্যবসায় যুক্ত হয়। আকিজ পার্টিক্যাল বোর্ড মিলস লিমিটেড আসে ১৯৯৬ সালে। ব্যবসার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হিসেবে দেখা যায় ১৯৯৭ সালে আকিজ হাউজিং লিমিটেড, ১৯৯৮ সালে সাভার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ২০০০ সালে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, একই বছর আকিজ অনলাইন লিমিটেড, নেবুলা ইনক লিমিটেডের সংযুক্তি। উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী ও ব্যবসায়ী দিকপাল আকিজ উদ্দিন জীবনের প্রায় শেষ দিকে এসেও নিজের কাজে ক্লান্ত হননি।
২০০১ সালে আকিজ করপোরেশন লিমিটেড, আকিজ কম্পিউটার লিমিটেড, আকিজ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড টেকনোলজি লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। এর বছর তিন পর ২০০৪ সালে আকিজ অ্যাগ্রো লিমিটেড এবং ২০০৫ সালে আকিজ পেপার মিলস্ প্রতিষ্ঠা করে তিনি বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে কিংবদন্তির নায়কে পরিণত হন। তিনি ব্যবসার পাশাপাশি সেবামূলক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আদ্-দ্বীন ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, ১৯৮৯ সালে আদ্-দ্বীন ওয়েলফেয়ার সেন্টার ও ২০০৪ সালে আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন।
এ ছাড়াও ১৯৮০ সালে আদ্-দ্বীন শিশু-কিশোর নিকেতন, ১৯৮৫ সালে আদ্-দ্বীন হাসপাতাল ও আদ্-দ্বীন ফোরকানিয়া প্রজেক্ট গড়ে তোলেন নিজের উদ্যোগে।
শিক্ষা বিস্তারেও তার ভূমিকা ছিল। সেবামূলক খাতের অধীনে তিনি ১৯৯৮ সালে আকিজ কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় আকিজ উদ্দিনের মৃত্যুর পরেও ২০১০ সালে গড়ে ওঠে আকিজ ফাউন্ডেশন স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবন
কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েও সেখ আকিজ উদ্দিন খুবই সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। পাশাপাশি নিজের জীবন অভিজ্ঞতার আলোয় তিনি তাদের আলোকিত করেছেন। আকিজ উদ্দিনের ১৫ সন্তান। ১০ ছেলে ৫ মেয়ে। বড় ছেলে ডা. সেখ মহিউদ্দিন আদ্-দ্বীনের নির্বাহী পরিচালক। এ ছাড়া সেখ মোমিন উদ্দিন, সেখ আফিল উদ্দিন, সেখ আমিন উদ্দিন, আজিজ উদ্দিন, নাসির উদ্দিন, বশির উদ্দিন, জামিল উদ্দিন আকিজ শিল্প গ্রুপের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করেন। সেখ আফিল উদ্দিন ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ছোট দুই ছেলে জসিম উদ্দিন ও শামিম উদ্দিন লন্ডনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। আকিজ উদ্দিনের ৫ মেয়ে সাফিনা, শাহিনা, আঁখি, নাজমা ও নাসিমা। একাধিক বিয়ে করেছিলেন সেখ আকিজ উদ্দিন। ১০ অক্টোবর ২০০৬ ইন্তেকাল করেন তিনি। তার দুরদর্শিতার কারণেই আজ আকিজ গ্রুপ দেশের অন্যতম শিল্প গ্রুপ হিসেবে দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছে। নিজে সাধারণ জীবন-যাপনের পাশাপাশি সন্তানদেরও প্রাচুর্যের মধ্যে না রেখে খুব সাধারণভাবে মানুষ করেছেন। সততা, নিজস্ব মেধা, সহনশীলতার কারণেই তিনি আকিজ গ্রুপকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গেছেন।
শত্রুকেও করেছেন পুনর্বাসন
উপকার করে প্রতিশোধ নিতেন সেখ আকিজ উদ্দিন। অর্থাৎ কোনো শত্রু তৈরি হলে তিনি তার কোনো ক্ষতি করতেন না। উল্টো উপকার করতেন। আকিজ উদ্দিনের বড় ছেলে ডা. সেখ মহিউদ্দিন আকিজ উদ্দিনের এ গুণের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘বাবা উপকার করে প্রতিশোধ নিতেন। একটি ঘটনার কথা আমার মনে আছে। নাভারণ পুরাতন বাজারের ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন আজিজ মিয়া। বিড়ি ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের নিয়ে একটি ঘটনায় আজিজ মিয়া বাবাকে বন্দুক দিয়ে গুলি করতে চান। আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। আমি বাবার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাবা অল্পতে রক্ষা পান। পরে বাবা আজিজ মিয়ার ছেলেদের চাকরি ও টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। কারও ক্ষতি করেননি। এভাবেই উপকার করে প্রতিশোধ নিয়েছেন।’ ডা. সেখ মহিউদ্দিন আরও বলেন, ‘বাবা আমাকে উপদেশ দিয়ে গেছেন, ‘কারও হক নষ্ট করবা না। কথা দিয়ে কথা ঠিক রাখবা। বাবার মুখের কথাই ছিল ব্যাংকের চেক। পাওনাদারকে তিনি যেদিনের কথা বলতেন সেদিনই টাকা দিতেন। শিক্ষার প্রতি তার অনুরাগ ছিল। আমাদের সব ভাইবোনকে তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেছি।’
আদ্-দ্বীন হাসপাতাল
মানসম্মত সেবা ও কম খরচের কারণে গর্ভবতী মায়েদের আস্থার জায়গায় পরিণত হয়েছে আকিজ উদ্দিন প্রতিষ্ঠিত আদ্-দ্বীন হাসপাতাল। হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে গর্ভবতী মায়েরা এখানে আসতে পছন্দ করেন এবং নির্ভরতা খুঁজে পান। হাসপাতাল কর্মীদের সেবাদানের মানসিকতায় তারা খুশি। এখানকার ডাক্তার, নার্স সবাই খুব আন্তরিক বলে জানান রোগীরা। তা ছাড়া খরচ অন্য হাসপাতালের তুলনায় অনেক কম। আদ্-দ্বীন হাসপাতাল অনেক আগে থেকেই নারী ও শিশুদের জন্য পরিচিত। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েরা এ হাসপাতালকে খুবই পছন্দ করেন। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, নারীবান্ধব একটা পরিবেশ। এখানে মহিলা চিকিৎসক ও নার্স দ্বারা পরীক্ষা করাসহ বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত সবকিছু মহিলাদের দ্বারাই পরিচালিত। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয়, এখানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০০ গর্ভবতী মা চেকআপে আসেন।
তাদের হাসপাতালে নিয়োজিত একদল দক্ষ কর্মী দ্বারা সেবা দেওয়া হয়। এখানে ২৪ ঘণ্টা কনসালটেন্ট চিকিৎসক রয়েছেন। ডেলিভারি যে ইউনিট রয়েছে তাও দক্ষ কর্মীদের দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।