বুধবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সিআইএ রহস্য

তানভীর আহমেদ

সিআইএ রহস্য

বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ (সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্স এজেন্সি) বিশ্বজুড়েই আলোচিত ও সমালোচিত। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সারা বিশ্বে তারা গোয়েন্দা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। তাদের নজরদারির হাত থেকে কেউই মুক্ত নন। শুধু গোয়েন্দা তথ্য হাতিয়ে নেওয়া নয়, সিআইএ বহু দেশে চালিয়েছে গোপন অভিযান। কিলিং মিশন চালানো, বন্দী নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। সিআইএর কার্যক্রম এতটাই গোপন যে, তাদের নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য কেউই উপস্থাপন করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও অন্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সিআইএকে নিয়ে যেসব ধারণা পোষণ করে তারই আলোকে আজকের রকমারি—

 

বিশ্বব্যাপী গোপন নজরদারি

সরকার, প্রশাসন, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠন-সংস্থা— সর্বত্রই সিআইএর চোখ। তাদের গোপন নজরদারি চলে দেশে দেশে। যুক্তরাষ্ট্রের এই শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার দুর্নাম আর সুনাম দুটোই এ কারণে। কেউ তাদের নজরদারির বাইরে নয়। সিআইএ এজেন্ট সোর্স সব দেশেই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে সক্রিয় রয়েছে বলে মেনে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা বিশ্লেষকরা। তবে শুধু সিআইএ নয়। একই চিত্র বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থারও। দেশে দেশে রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। দেশের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্যই এ ধরনের গোয়েন্দা কার্যক্রম জরুরি। বিশ্বের প্রথম সারির গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে বিবেচিত সিআইএ। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৪৭ সালে। তবে এর আগে থেকেই এটি কাজ করে আসছিল বলে মনে করা হয়। অত্যন্ত গোপনীয়তার কারণে কখনো সুনির্দিষ্টভাবে এই গোয়েন্দা সংস্থার অভিযান, কর্মসংখ্যা, বাজেট জানা যায়নি। বিভিন্ন সময় বিশেষজ্ঞদের মতামত ও অন্য দেশগুলো গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র পরিধি ও পরিকাঠামো নিয়ে নানা মতামত দিয়েছে। ধারণা করা হয়, সিআইএ’র কর্মী প্রায় ২০ হাজার। এদের মধ্যে রয়েছে স্পেশাল সিক্রেট এজেন্ট। বিভিন্ন স্কোয়াড থাকতে পারে বলেও মত দিয়েছেন তারা। সিআইএ সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায় তাতে বলা হচ্ছে, বিশ্বের প্রতিটি দেশেই সিআইএর এজেন্ট রয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সামরিক কর্মকর্তা, মিডিয়াকর্মী, সব ধরনের পেশাজীবীই তাদের সোর্স হিসেবে কাজ করে থাকে। বিশ্বব্যাপী গোপন নেটওয়ার্ক ও সোর্স এজেন্টের কারণেই সিআইএ এতটা শক্তিশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। উইকিলিকস সিআইএ’র সাম্প্রতিক বছরগুলোর গোয়েন্দা নজরদারির কথা ফাঁস করে চমকে দিয়েছে। তাদের ফাঁস করা নথিগুলো প্রমাণ করে স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, স্মার্টটিভি পর্যন্ত তারা হ্যাক করে নিয়েছে। ঘরের ভিতরের কথাবার্তা শুনতে বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডের স্মার্টটিভি হ্যাক করার চেষ্টা চালিয়েছে তারা। এ ছাড়া স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটে আদান-প্রদানকৃত তথ্যও হাতিয়ে নেওয়ার কথা এই নথিগুলোতে রয়েছে। সিআইএ’র এই গোপন নজরদারির কথা নতুন নয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তারা বিভিন্ন উপায়ে মানুষের ওপর নজরদারি চালিয়ে আসছে। রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য হাতিয়ে নিতে তাদের তুলনা নেই। তথ্য সংগ্রহের জন্য তারা যে কোনো উপায় বেছে নিতে সিদ্ধহস্ত। যে কারণে সিআইএ’কে বিভিন্ন সময় নিষ্ঠুর বলেও সমালোচিত হতে হয়েছে। সিআইএ দেশে দেশে চালিয়ে এসেছে গোপন অভিযান। তারা হিটলিস্ট করে হত্যার চেষ্টা করেছে রাষ্ট্রনেতা, রাজনীতিবিদ। নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড পরিচালনায় তাদের গোপন কিলিং স্কোয়াড যে কারও জন্য আতঙ্কের। বিশ্বের প্রতিটি কোনায় তাদের চোখ রয়েছে। আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার সর্বোচ্চ প্রতিশোধও নিয়েছে সিআইএ। হত্যাকাণ্ড ছাড়া গোপন কারাগারে বন্দী নির্যাতনের জন্য তারা সমালোচিত। এ ছাড়া বন্দীদের মুখ থেকে তথ্য আদায়ে নির্মমতম পন্থা বেছে নিতেও সিআইএ পিছিয়ে নেই। শক্তিশালী এই গোয়েন্দা সংস্থা বরাবরই যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ফ্যাক্টর। তার একটি নমুনা বলা যাক, ১৫ বছর আগে পৃথিবীর বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল সিআইএ। যার কিছু মিলেছে। কিছু ঘটেছে পুরোপুরি ভিন্ন। বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে ২০০১ সালে ৯/১১-এ যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার মধ্য দিয়ে। এর মাত্র এক বছর আগে ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের কাছে ২০১৫ সালের পৃথিবী সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে একটি প্রতিবেদন জমা দেয় সিআইএ। ওই প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে মত দেওয়া হয়। ৭০ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে সন্ত্রাসবাদ, মারণাস্ত্র ও বিশ্বের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে।

 

যেভাবে চলে গোয়েন্দাগিরি

সিআইএর মতো শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা পৃথিবীতে কমই আছে। সাধারণ মানুষের মনে কৌতূহল জাগে, আমেরিকা কীভাবে সারা বিশ্বে গোয়েন্দাবৃত্তি চালায়? উত্তরটা খুব কঠিন নয়। তবে অনেকেই জেনে অবাক হবেন, গুপ্তচররাই তাদের আসল সোর্স হিসেবে কাজ করছে। প্রায় প্রতিটি দেশে তাদের সরাসরি এজেন্ট রয়েছে। এ ছাড়া তাদের হাতে রয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, স্মার্টটিভি, টেলিফোন, ই-মেইল— এসব প্রযুক্তিতে তথ্য আদান-প্রদানের সময় নজরদারি চালিয়ে থাকে। উইকিলিকসের ফাঁস করা নথিতে সিআইএ’র এ ধরনের নজরদারির কথা বিশ্বব্যাপী ইতিমধ্যে জেনেছে। তা ছাড়া তথ্য আউটসোর্সিংয়ে বিশাল অংকের টাকা ব্যয় করে তারা। নিজ দেশের লোকই টাকার লোভে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাদের কাছে বিক্রি করে থাকে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও নীতিনির্ধারক লোকদের অর্থবিত্তের মাধ্যমে কিনে নেয়। সিআইএ তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন বেসরকারি এনজিওকেও বিভিন্ন দেশে ভালোভাবেই ব্যবহার করেছে। নানামুখী সেবা, কর্মসংস্থান সৃষ্টির আড়ালে তারা সূচারুভাবে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে বিশ্বজুড়ে। বলা হয়, সিআইএ’র অন্যতম প্রধান গোয়েন্দা তথ্য প্রাপ্তির মাধ্যম হচ্ছে মিডিয়াগুলো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পত্র-পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, সরকারি প্রকাশনা, পরিসংখ্যান, সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে তারা তথ্য সংগ্রহ করে। নানাভাবে বিশ্বজুড়ে ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে কাজে লাগায় তারা।

বড় বড় সেনা কর্মকর্তাকে অস্ত্র ব্যবসার ফাঁদে ফেলে তাকে কাজে লাগিয়ে তথ্য উদ্ধার করার কথাও বলেছেন অনেকে। আর সমমনা রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়েও তারা গোপন তথ্য হাতিয়ে নেয়।

 

ছাড় নেই মার্কিন প্রেসিডেন্টেরও

সিআইএর নজরদারির বাইরে নয় খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট। হোয়াইট হাউসের ভিতরের খবরও ভালোমতোই রাখে তারা। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের ওপর তাদের নজরদারি মোটেই অবাস্তব নয়। মার্কিন রাজনীতি ও ক্ষমতার পালাবদলে সিআইএ’র ভূমিকা ও প্রভাবের অভিযোগ বহু বছর ধরেই রয়েছে। সর্বশেষ মার্কিন নির্বাচনেও সিআইএ ও এফবিআইয়ের প্রভাবের অভিযোগ উঠেছে। তবে এই ইতিহাস নতুন নয়। যাত্রা শুরুর পর থেকেই সিআইএ’র গোপন নজরদারির সীমানা নিয়ে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। সেই বিস্ময় থেকেই আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোকটিই যে সিআইএ’র হয়ে কাজ করছে, তা আপনার ধারণারও বাইরে! সে কথা খাটে হোয়াইট হাউসের ক্ষেত্রেও। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তো বটেই, বিশ্বের নানা দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীসহ শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের ওপর গোপন নজরদারির অভিযোগ সিআইএ’র কাছে পুরোনো। মজার ব্যপার হচ্ছে, কখনই এসব অভিযোগে নাকাল হয়নি সিআইএ। তাদের গোপনীয়তা সব সময়ই একধাপ এগিয়ে। যে কারণে তথ্য-প্রমাণের অভাবে ‘দায় স্বীকার’ না করেই পার পেয়ে গেছে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এই গোয়েন্দ বাহিনী।

 

সিআইএর তিন ধরনের নজরদারি

১. ডিজিটাল খবরদারি বা আড়িপাতা (ডিজিটাল সারভেইলেন্স)

২. ড্রোন (পাইলটবিহীন উড়োজাহাজ)

৩. হস্তরেখা শনাক্তকরণ (বায়োমেট্রিক আইডেন্টিফিকেশন)

সিআইএর গোপন নজরদারির আংশিক তথ্য এডওয়ার্ড স্নোডেন ২০১৩ সালে প্রথমে ফাঁস করেন। সেই তথ্যমতে এই গোয়েন্দা সংস্থার একটি চিত্র পাওয়া যায়। সিআইএ প্রকাশ্যে আট লাখ ৫৪ হাজার অফিসার, ২৬৩টি সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠান এবং তিন হাজারের অধিক গোয়েন্দা সংস্থা নিয়োগ করেছে। এরা প্রতি বছর ৫০ হাজারের বেশি বিশেষ রিপোর্ট তৈরি করে। সিআইএ নিয়ে কাজ করা ড. ম্যাককয় তার বইয়ে লিখেছেন, ‘আকাশে ড্রোন এবং সারা বিশ্বের সমুদ্রতলে তারের মধ্য দিয়ে চলাচল করা তথ্য— প্রতি মুহূর্ত এ সংস্থাটি পর্যবেক্ষণ করছে। ফলে বিশ্বের নেতৃবৃন্দসহ সবার কথাবার্তার ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখে সিআইএ’।

 

সিআইএর হিটলিস্ট!

তথ্য-প্রমাণ না থাকলেও সিআইএর হিটলিস্টের কথা অজানা নেই কারও। নিষ্ঠুর সিআইএ প্রয়োজনে স্বার্থসিদ্ধির জন্য হিটলিস্ট ধরে চালিয়েছে অভিযান। এই হিটলিস্টে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা থাকেন। হিটলিস্ট ধরে ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য অনেককেই ফাঁসিয়ে দিয়ে সফলও হয়েছে সিআইএ। দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারি তাদের স্বার্থসিদ্ধির সবচেয়ে সফল পন্থা। এসব ষড়যন্ত্রের বাইরে, সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকা করারও অভিযোগ রয়েছে সিআইএর বিরুদ্ধে।

এর মানে হত্যা, আততায়ীর হামলা। যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি হত্যা প্রচেষ্টা চালিয়েছিল ফিদেল কাস্ত্রোর বিরুদ্ধে। কিউবার এই বিপ্লবী নেতার চুরুটে বিস্ফোরক গুঁজে দেওয়া, স্কুবা ডাইভিং স্যুটে বিষ মাখিয়ে দেওয়ার মতো চমত্কৃত পন্থা। যুক্তরাষ্ট্র তাকে ৮ বার হত্যা চেষ্টার কথা স্বীকার করে। তবে কিউবার দাবি কাস্ত্রোকে ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করে সিআইএ! কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা বেশির ভাগই হয় ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে। ১৯৪৫ সাল থেকে বেশ কয়েকজন বিশ্বনেতাকে হত্যায় ও উচ্ছেদে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সফল হয়। কখনো এই তত্পরতা সরাসরি আবার অধিকাংশ সময়ই তা পরিচালিত হয় স্থানীয় সেনা, স্থানীয় ভাড়াটে অপরাধী বা বিদ্রোহীদের দ্বারা। ১৯৮৬ সালে মার্কিন বিমান হামলার শিকার হয়েছিলেন লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি, ১৯৯৯ এ সার্বিয়ার স্লোবোদান মিলোসেভিক এবং ২০০৩ সালে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিক লুমুম্বাকে হত্যার জন্য প্রাণঘাতী ভাইরাসসহ একজন বিজ্ঞানী পাঠানোর অভিযোগও রয়েছে।

 

দেশে দেশে সিআইএর অভিযান

মিডনাইট ক্লাইমেক্স

গবেষণায় বেরিয়ে আসে, এলএসডির মতো উত্তেজক ড্রাগস দিয়ে ইচ্ছা করলেই মানুষের মাথার নিয়ন্ত্রণ সাময়িকভাবে নেওয়া সম্ভব। এমনকি সেক্সচুয়াল ব্ল্যাকমেইলিং করার জন্য সিআইএ’র গবেষণাগারে সফলতা পেতে গোয়েন্দা কাজে এলএসডি ড্রাগস হয়ে উঠে সংস্থাটির তুরুপের তাস। যে এলএসডি ড্রাগসটি নিয়ে সিআইএ কাজ করছিল সেটি এমনিতেই যথেষ্ট উত্তেজক ড্রাগস ছিল। সেটার প্রভাব পরবর্তীতে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটা বিবেচনা না করেই সিআইএ তার গবেষণা চালিয়ে যায়। ১৯৬৩ সালে অপারেশন মিডনাইটের মতোই এলএসডি ড্রাগস দিয়ে মানুষের মাথার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার একটা গবেষণা হয়েছিল এবং তার ফলাফল খুব একটা আশাব্যঞ্জক ছিল না। সিআইএ জেনারেল আবারও গবেষণা চালিয়ে যেতে বললে শিগগিরই এলএসডি উত্তেজক ড্রাগস দিয়ে মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণের একটি ত্রুটি ধরা পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে এলএসডি দিয়ে মোহগ্রস্ত সাবজেক্ট শত্রুপক্ষকে হামলার পরিবর্তে উল্টো প্রশিক্ষণ কর্মীদের হামলা করে বসে। মাথার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হয়ে সিআইএ অপারেশন মিডনাইট বন্ধ করে দেয়।

 

প্রজেক্ট পেপারক্লিপ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স জার্মানির বৈজ্ঞানিক সামর্থ্য জানতে বিভিন্নভাবে সার্চ টিম পাঠিয়ে তথ্য-উপাত্ত হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। মূলত জার্মানির প্রযুক্তিগত শক্তিমত্তা জানতে ভীষণ তত্পর হয়ে উঠে সিআইএ। যদিও কাগজে-কলমে এটুকুই ছিল সিআইএর গোয়েন্দা তত্পরতার মূল বিষয়, কিন্তু তাদের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। নজর রাখছিল জার্মানিতে থাকা বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার এবং সে দেশের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের ওপর। ‘অপারেশন ওভারকাস্ট’ ছিল এই গোপন গোয়েন্দা তত্পরতার আসল নাম, যা বাইরে থেকে প্রজেক্ট পেপারক্লিপ বলে প্রচার হয়েছিল। অপারেশন ওভারকাস্টের মূল ফোকাস ছিল সেরা মেধাবীদের বুঝিয়ে, ব্রেনওয়াশ করে আমেরিকার পক্ষে কাজ করানোর। এত বড় একটি প্রজেক্টেও সিআইএ অত্যন্ত গোপনে কোনো ভিসা ছাড়াই প্রায় এক হাজার ৬০০ বিজ্ঞানীকে তাদের পরিবারসহ জার্মানি থেকে আমেরিকায় সরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এদের দিয়ে পরবর্তী সময়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মিসাইল ও ব্যালাস্টিক মিসাইলের নকশা প্রণয়ন করে সিআইএ।

 

পিগস ইনভেশন

সিআইএ অপারেশন দ্য বে অব পিগস ইনভেশন। ১৯৬১ সালে কিউবায় প্রায় এক হাজার ৫০০ অত্যন্ত দক্ষ সিআইএ সেনা এই অপারেশনে অংশ নিয়েছিল। পিগস ইনভেশন নামটি দেওয়া হয় গোয়েন্দা হামলার মারাত্মক ব্যর্থতার জন্য। এই অপারেশনে সংগঠনটির কয়েক হাজার সেনা কিউবার সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং তাদের নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করা হয়। ফিদেল কাস্ত্রোকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সিআইএ এই গোয়েন্দা হামলার নীলনকশা করেছিল। বাইরে থেকে পরিকল্পনার সব ঠিক দেখালেও কিউবায় হামলা করতে নেমে পরিস্থিতি একেবারেই সিআইএ’র প্রতিকূলে চলে যায়। একে তো কাস্ত্রোর ব্রিগেড সিআইএ’র হামলা সম্পর্কে আগেই জেনে ফেলেছিল এবং কাস্ত্রোর সেনা ব্রিগেডের বিছানো ফাঁদেই সিআইএ পা ফেলেছিল। সব মিলিয়ে সিআইএ’র অপারেশন জ্যাপাট ছিল একটা লম্বা দুঃস্বপ্ন। বোদ্ধারা বলেন, সেই অপারেশনের ক্ষয়ক্ষতি আজও পুষিয়ে উঠতে পারেনি তারা। এক হাজার ৫০০ জনের সিআইএ’র প্রশিক্ষিত বাহিনী কিউবার উপকূলে নামমাত্র হামলা করতে পেরেছিল।

 

চীনে উধাও সিআইএ সোর্স!

সব দেশেই সিআইএর বাড়াবাড়ি রকমের তত্পরতায় মার্কিন প্রশাসন যখন স্বস্তিতে দিন কাটাচ্ছে তখন দুঃসংবাদ মিলেছে চীন থেকে। চীনে গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে রীতিমতো নাকানিচুবানি খেয়েছে সিআইএ। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার গোপন সোর্সের অন্তত ২০ জন স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। চীনে গোপন গোয়েন্দাগিরি করতে এসে মাত্র দুই বছরে ২০ জন সোর্স গায়েব হয়ে যাওয়ার এই ঘটনা সিআইএ’র ইতিহাসে এর আগে কখনোই ঘটেনি। চীনে নজিরবিহীন সংকটে পড়ে সিআইএ’র এই করুণ দশা বেশ ফলাও করে প্রচার করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। সে সব খবর থেকে জানা যায়, চীনে মার্কিন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ২০ জনের বেশি সোর্স বা তথ্য প্রদানকারী নিহত অথবা কারান্তরীণ হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে এসব ঘটনা ঘটে। সিআইএর তথ্য সংগ্রহ  প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করতেই তথ্য সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে চীন। নিউইয়র্ক টাইমসের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার এই গোপন সোর্সদের বিষয়ে চীনা সরকার কীভাবে তথ্য পেল, তা নিশ্চিত নয় সিআইএ। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, চীন সিআইএ’র ওয়েবসাইট হ্যাকের মাধ্যমে এসব গোপন তথ্য পেয়েছে বা সিআইএ’র ভিতরের কেউ চীনকে এসব তথ্য পেতে সাহায্য করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা আরও জানান, নিহত তথ্য সরবরাহকারীদের মধ্যে অন্তত একজনকে চীনের একটি সরকারি কার্যালয় চত্বরেই গুলি করা হয়, যাতে অন্যরা সিআইএ’কে তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে সাবধান হয়।  ২০১০ সালের মাঝামাঝি থেকে চীনা সরকারি আমলাতন্ত্র থেকে তথ্য আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং ২০১১ সালের শুরুর দিক থেকে গোয়েন্দা সোর্সগুলো হারিয়ে যেতে শুরু করে। সিআইএ এবং এফবিআই যৌথভাবে এসব ঘটনার তদন্তে নামে, যার কোড নাম ছিল ‘হানি ব্যাজার’।

 

নিষ্ঠুরতার অভিযোগ

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গোয়েন্দাবৃত্তির পাশাপাশি কিলিং মিশন, সিক্রেট অপারেশন চালিয়ে আসছে তারা— এই অভিযোগগুলো ওপেন সিক্রেট। আন্তর্জাতিক মিডিয়া, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতা ও বিশ্বের প্রথম সারির গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বরাবরই সিআইএ’র বর্বরতার কথা জানিয়ে আসছে। বিভিন্ন সময় অবসর নেওয়া কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন সে সব। সিআইএ’র নিষ্ঠুরতার কথা বলতে গেলে তাদের হিটলিস্টের কথা শুরুতেই আসে। এ তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের যে কোনো উপায়ে হত্যা করে সিআইএ’র সিক্রেট এজেন্টরা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর সিআইএ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি সিআইএ’র হন্তারক শাখাকে (কিলিং স্কোয়াড) তখন সক্রিয় করেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সন্দেহভাজনদের ধরে হত্যার নির্দেশ দেন। ৯/১১-এ যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর আল কায়েদার নেতাদের শনাক্ত করে হত্যার তালিকা করে সংস্থাটি। এর আগে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোকে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে অসংখ্যবার হত্যার চেষ্টা করে সিআইএ। সর্বাধুনিক রাইফেল থেকে শুরু করে বিষের বড়ি দিয়ে, বিষাক্ত কলম ছুড়ে, ভয়ঙ্কর ব্যাকটেরিয়া পাউডার দিয়ে ফিদেলকে হত্যার চেষ্টা করে সিআইএ। কিন্তু তাদের সব অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৬০ সালে কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বাকে মার্কিনীদের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেন প্রেসিডেন্ট আইজেন আওয়ার। তিনি লুমুম্বাকে গোপনে ভয়ঙ্কর ভাইরাস দিয়ে হত্যার জন্য সিআইএ’র এক গোয়েন্দাকে নিয়োজিত করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন।

এ তো গেল হিটলিস্টে নাম লিখে বিশ্বজুড়ে চলা তাদের কিলিং মিশনের কথা। কিলিং মিশন ছাড়াও বন্দী নির্যাতনেও অভিযুক্ত সিআইএ। কিউবার কুখ্যাত গুয়ান্তানামো বে ও বাগদাদের আবু গারিব কারাগারে বন্দী নির্যাতনের কথা কে না জানে? সিআইএ’র ভয়ঙ্কর রূপ সবার সামনে এলে বেকায়দায় পড়ে মার্কিন প্রশাসন। ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহু কারাগার স্থাপন করেছে সিআইএ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আফগানিস্তানের বাগরাম বিমান ঘাঁটি, ভারত মহাসাগরের দিয়েগো গার্সিয়ার নৌঘাঁটি। সিআইএ’র নির্মিত গোপন কারাগারগুলো এমনভাবে তৈরি করা, যেখানে নির্যাতন করলেও সে শব্দ বাইরে আসবে না। ছোট ছোট এসব কক্ষে একজনের বেশি বন্দী রাখা হয় না। এভাবে বন্দীদের দিনে মাত্র এক ঘণ্টার জন্য সূর্যের আলোতে বের করা হয়। তাও আবার কালো কাপড়ে মাথা ঢেকে। জিজ্ঞাসাবাদে ব্যবহার করা হয় শাস্তির অভিনব সব কৌশল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সিআইএ তাদের এসব গোপন বন্দীশালায় বন্দী নির্যাতনের যে মিশন চালিয়ে আসছে তা বন্ধ হয়নি কখনো।

 

সিআইএ এজেন্টের যত গুণ

 

লক্ষ্য স্থির

সিআইএ আমেরিকার গোয়েন্দা বাহিনী। নানা কারণে আলোচনা-সমালোচনায় রয়েছে তারা। সিআইএ চাকরি পেতে হলে প্রথমেই লক্ষ্য স্থির গুণ থাকতে হবে। যে কোনো মিশনে গোল অর্জন করার জন্য সিআইএ গোয়েন্দাদের এই গুণটি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়।

 

 গোপনীয়তা

শুধু সিআইএ নয়, যে কোনো গোয়েন্দা বাহিনীতে চাকরি পাওয়ার আগে গোপনীয়তা রক্ষার সর্বোচ্চ গুণ রয়েছে কিনা ক্ষতিয়ে দেখা হয়। সর্বোচ্চ মাত্রার  গোপনীয়তা ও মিশনের মর্যাদা ধরে রাখতে পারলে সিআইএয়ের গোয়েন্দা হিসেবে চাকরি পাওয়া সহজ হয়ে যায়।

 

মেধা

প্রত্যেক সিআইএ গোয়েন্দাকে খুব ভালো শিক্ষার্থী হওয়া জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই গোয়েন্দা হিসেবে সুযোগ পেয়ে থাকে। তবে এই প্রক্রিয়াটি খুবই গোপনীয়তা রক্ষা করে করা হয়। শিক্ষাজীবনে বিভিন্ন পরীক্ষায় ঈর্ষণীয় ফলাফল ও কর্তব্যরত পেশায় অসাধারণ দক্ষতা থাকা চাই।

 

বিশ্লেষণ দক্ষতা

শুধু একজন গোয়েন্দা হিসেবে নয়, যে কোনো কাজে বিশ্লেষণ দক্ষতা আগ্রহী প্রার্থী অগ্রাধিকার পায়। মারাত্মক মানসিক চাপ সামলে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করার দক্ষতা সিআইএ গোয়েন্দার থাকা চাই।  

 

গণিত ও কম্পিউটার জ্ঞান

গোয়েন্দার কাজ সহজ নয়। বিভিন্ন পেশাভিত্তিক দক্ষতা গোয়েন্দাদের অর্জন করতে হয়। এই ধরনের কাজে সফলতার দেখা মিলতে প্রায়শই জটিল বিশ্লেষক ও গণনাভিত্তিক কাজ সামলাতে হয় সিআইএ গোয়েন্দাদের। এছাড়া কম্পিউটার চালনা ও প্রযুক্তি জ্ঞান তাদের নিত্যদিনের কাজে প্রয়োজন হয়।

 

 

মিলিটারি প্লাটফর্ম

সিআইএ গোয়েন্দাদের সেনাবাহিনীতে কাজ করার অভিজ্ঞতা বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্পেশাল ফোর্স ও সেনাবাহিনীতে কর্মরতদের মাঝখান থেকে সবচেয়ে মেধাবী ও নির্ভরযোগ্য সেনা কর্মকর্তাদের এখানে কাজের সুযোগ মেলে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর