বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিল গেটসকে ছাড়িয়ে গেলেন যিনি

তানভীর আহমেদ

বিল গেটসকে ছাড়িয়ে গেলেন যিনি

কোনো দোকান নেই। অনলাইনের একটি ওয়েবসাইট অ্যামাজন ডটকম। এমন কোনো পণ্য নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। সুই-সুতা থেকে শুরু করে লিপস্টিক, মোবাইল ফোন কি গানের সিডি— সব পাবেন এখানে। প্রতি সেকেন্ডে ৩০৬টি পণ্য বিক্রির রেকর্ড রয়েছে তাদের। প্রতিদিন ৩১ কোটি মানুষ কেনাবেচার জন্য বেছে নেন অ্যামাজন ডটকমকে। এই বিশাল বাজার ইন্টারনেটে বসিয়েছেন জেফ বেজোস। স্ত্রীর বই পড়ার বাতিক দেখে ঠিক করলেন অনলাইনে বই বিক্রি করবেন। এই আইডিয়া থেকে অ্যামাজনের অফিস খোলেন বাড়ির পরিত্যক্ত গ্যারেজে। দিনে দিনে সেই অ্যামাজনের কল্যাণে ধনকুবের বনে গেছেন জেফ বেজোস। এতদিন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী বলতে বিল গেটসকেই চিনত সবাই।  সেই বিল গেটসকে টপকে বিশ্বের শীর্ষ ধনী এখন ‘অনলাইনের দোকানদার’ জেফ বেজোস

 

অ্যামাজনের বাদশাহ

মা জ্যাকলিন বিয়ে বিচ্ছেদের পর বিয়ে করেন মাইক বেজোসকে। আইনগত পিতা হওয়ায় মাইক বেজোসের সন্তান জেফের নাম বদলে দাঁড়ায় জেফ বেজোস। জেফের বয়স তখন চার বছর। বাবা-মায়ের সঙ্গে তিনি চলে আসে হিউস্টন, টেক্সাসে। এখানে মাইক বেজোস ইক্সোনের প্রকৌশলী হিসেবে কাজ নেন। জেফ বেজোস ভর্তি হন রিভার ওকস অ্যালিমেন্টারি স্কুলে। দক্ষিণ টেক্সাসে দাদার জমিদারি ছিল। সেখানে ফার্মে কাজ করতেন জেফ। গবাদিপশু চরাতে নিয়ে যেতেন খেত-খামারে। ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তি পণ্য, ইলেকট্রিক্যাল বিষয়াদি নিয়ে তার আগ্রহ ছিল। পরবর্তীতে তিনি ফ্লোরিডায় চলে আসেন। ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটি থেকে স্টুডেন্ট সায়েন্স ট্রেইনিংয়ে সিলভার নাইট পুরস্কারও পান। ভালো রেজাল্ট করার কারণে জাতীয় মেধা তালিকাতেও তার জায়গা হয়। এরপর প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে তিনি উচ্চ শিক্ষা শেষ করেন। পড়াশোনা শেষ করে কাজ নেন ওয়াল স্ট্রিটে। ফিটেল কোম্পানিতে প্রযুক্তিবিষয়ক কাজ বেছে নেন তিনি। সেখান থেকে যান ব্যাংকার্স ট্রাস্টে। এরপর কাজ নেন ইন্টারনেটে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে। হেজ ফান্ড কোম্পানি ভালো আয় করলেও নিজেই কিছু করতে চাইলেন জেফ। মালিকের অনুরোধ থাকলেও তিনি অনেকটা জোর করেই চাকরি ছেড়ে সিয়াটলে চলে আসেন। সিয়াটলের প্রায় ধংসস্তূপ হয়ে যাওয়া গাড়ির গ্যারেজে খোলেন অ্যামাজন। অ্যামাজন ডটকম। ওয়েবসাইটে বই বিক্রি শুরু করেন। প্রথম মাসেই অভাবনীয় সাড়া পান তিনি। পরবর্তীতে আরও নানা ধরনের নিত্যপণ্য বিক্রি শুরু করেন। অনলাইনে অর্ডার করেন ক্রেতারা। তিনি ঠিকানা মতো পণ্য পাঠান। বিক্রেতারা অ্যামাজনে তাদের পণ্য বিক্রির আগ্রহ দেখাতে শুরু করলে খুচরা পণ্য বেচাকেনার বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন জেফ। কয়েক বছরের মাথায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের পণ্য বেচাকেনা হতে থাকে অ্যামাজনের মাধ্যমে। ওয়েবসাইটের বিজ্ঞাপন আর কেনাবেচার অর্থের নির্দিষ্ট লভ্যাংশ তুলে রেখে জেফ ধনকুবের বনে যান। এখন বিশ্বের প্রতিটি দেশেই অ্যামাজন থেকে পণ্য কেনাবেচা হয়ে থাকে। অ্যামাজনে কাজ করেন ৩ লাখ ৪১ হাজারেরও বেশি কর্মী। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ৪৮ কোটির বেশি পণ্য বিক্রি করে অ্যামাজন। ৪ লাখ ৮৫ হাজারেরও বেশি ধরনের পণ্য বিক্রি হয় এখানে। এক দিনে ২ কোটি ৬৫ লাখ পণ্য বিক্রির রেকর্ডও রয়েছে অ্যামাজনের। রেকর্ডবুক বলছে, প্রতি সেকেন্ডে ৩০৬টি পণ্য বিক্রি হয় অ্যামাজনের মাধ্যমে। প্রতিদিন ৩১ কোটি মানুষ এখানে কেনাকাটা করেন। ২০১৬ সালে ১৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকার পণ্য কেনাবেচা হয় অ্যামাজনের মাধ্যমে। ইন্টারনেটে দোকান বসিয়ে যে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন জেফ বেজোস তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য।  সে সাম্রাজ্যের বাদশাহ জেফ বেজোস বিল গেটসকে টপকে এখন বিশ্বের শীর্ষ ধনী।

 

কার কত সম্পদ

 

বিল গেটসকে টপকালেন যেভাবে

২৭ অক্টোবর ২০১৭। শুক্রবার সকাল। তখনো বিশ্বসেরা ধনী মাইক্রোসফটের বিল গেটস। তালিকায় দুই নম্বরে রয়েছে অ্যামাজনের মালিক জেফ বেজোস।

শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হলো। শুরুতেই দাম বাড়ল অ্যামাজনের শেয়ারের। কয়েক ঘণ্টা এগোতেই দৃশ্যপট বলে দিল, নতুন কিছু হতে যাচ্ছে আজ। হলোও তাই। অ্যামাজনের শেয়ার ৭ শতাংশ থেকে ৮-এ বেড়ে গেল। ৮ শতাংশ বাড়তেই জেফ বেজোসের পকেটে ঢুকে গেল ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তখন বিল গেটসের মোট সম্পদ ৯০.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জেফ বেজোসের চেয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচশ মিলিয়ন ডলার বেশি। কিন্তু ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্যের চাকাও দৌড়াতে থাকল বেজোসের। শেয়ারের দাম বাড়ার গতি এক মিনিটের জন্যও থামেনি। ধীরস্থিরভাবে একপর্যায়ে শেয়ারের দাম ১৩ শতাংশ বেড়ে গেল। দিনশেষে সবাইকে চমকে দিয়ে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছাড়িয়ে গেল বিল গেটসকে। ‘বিশ্বসেরা ধনী’ তকমাটি তাই জেফ বেজোসের নামের সঙ্গেই উচ্চারিত হলো। নয়শ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যোগ হতেই তিনি বিল গেটসকে টপকে বনে গেলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি। দিন শেষে বেজোসের মোট সম্পত্তির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৯৩ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিল গেটসের চেয়ে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার বেশি। একদিনেই বেজোসের আয় ছিল ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ওইদিন পুঁজিবাজারে বিপুল অংকের মুনাফা অর্জন করে অ্যামাজন। হিসাব বলছে, ওইদিন অ্যামাজনের অর্জিত মুনাফার পরিমাণ ৪২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। তবে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর জায়গাটা একেবারেই নতুন নয় জেফ বেজোসের জন্য।  তিন মাস আগে প্রথমে কয়েক ঘণ্টার জন্য। পরে প্রায় একদিনের জন্য জেফ বেজোস  প্রথমবারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির আসনে বসেছিলেন।

 

বাবা জানেনই না ছেলে এখন বিশ্বের শীর্ষ ধনী!

জেফ বেজোসের মা জ্যাকলিন গিস। তখন জ্যাকলিনের বয়স মাত্র ১৭ বছর। হাইস্কুল পড়েন তিনি। কিশোরী জ্যাকলিন প্রণয়ে জড়ান আরেক হাইস্কুল পড়ুয়া কিশোর টেড জার্গেনসনের সঙ্গে। টেডের বয়স ১৮ বছর। প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া এই কিশোর-কিশোরী হুট করেই বিয়ে করে বসেন। তাদের সংসারেই জন্ম নেন জেফ। কিন্তু সন্তান জন্ম নেওয়ার পরও সংসারি হতে পারেননি টেড। স্ত্রীকে ঘরে রেখে ফিরতেন অনেক রাত করে। তার মাতলামি ছিল লাগামছাড়া। শিশু সন্তানের জন্যও তাকে আবেগি হতে দেখেননি মা জ্যাকলিন। এই টানাপড়েনে সংসার ভাঙেন তারা। বিয়ের ১৭ মাসের মাথায় বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে আলাদা হয়ে যান দুজন। জেফ থেকে যান মায়ের সঙ্গেই। জ্যাকলিন তার বাবা-মায়ের কাছেই সন্তানসমেত থাকতে থাকেন। তিন বছর পর তিনি মাইক বেজোসকে বিয়ে করেন। এখন জেফের নতুন বাবা মিগুয়েল বেজোস। কিউবা থেকে আসা শরণার্থীর জীবন ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরু করেন তিনি। মিগুয়েল জেফের পিতৃত্ব দায়ভার আইনগতভাবে নিয়ে নিলে জেফের আসল বাবা টেড জার্গেনসন সন্তানের ওপর সব ধরনের আইনি অধিকার হারান। ‘বায়োলজিক্যাল ফাদার’ হয়েই থাকতে হয় তাকে। এই ‘বায়োলজিক্যাল ফাদার’ টেড জার্গেনসন তার স্ত্রী জ্যাকলিন ও সন্তান জেফের আর কোনো খোঁজ রাখেননি। ২০১৩ সালে জেফকে তার বায়োলজিক্যাল ফাদার বা আসল পিতার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘তিন বছর বয়সে একবার বাবাকে দেখেছি— এরপর আর দেখিনি।’ টেড জার্গেনসনের ক্ষেত্রেও তাই।  ৪৭ বছর পর তাকে সেই সন্তানের কথা জানাতে যখন সাংবাদিক পৌঁছালেন তখনো টেড জার্গেনসন জানেনই না অ্যামাজনের মালিক জেফ বেজোসই তার সেই সন্তান! যে কিনা এখন বিশ্বের শীর্ষ ধনী!

কোন ব্যবসায় কত টাকা

অ্যামাজনে বেচা-বিক্রির আগে কেউ কল্পনাও করতে পারেননি বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে নাড়া পড়ে যাবে। ৩১ কোটিরও বেশি মানুষ এখন অ্যামাজনে কেনাকাটা করেন। এই ব্যবসা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করেন জেফ বেজোস। সেই আয়  থেকে ব্যবসা ছড়িয়েছেন তিনি। বিশ্বের অন্যতম বিনিয়োগকারী হিসেবে জেফ বরাবরই আলোচনায় রয়েছেন। অ্যামাজনেরই রয়েছে ১৪টি সেবা। অ্যামাজন ফ্রেস বিক্রি করছে খাদ্যপণ্য। কিণ্ডল দিচ্ছে ইবুক। স্মার্ট স্পিকার ইকো অ্যামাজনের অন্যতম জনপ্রিয় পণ্য। আছে স্টুডিও, ফায়ার টিভি, গানের বাজার, ক্লাউড স্টোরেজ, অ্যালেক্সা ওয়েবসাইট, মনিটরিং ওয়েবসাইট ছাড়াও নানা কিছু। আছে কমিক্সোলজি কমিক ডাউনলোড সাইট। এসব তো রয়েছেই, সঙ্গে নানা গবেষণা কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছে তারা। এয়ারবিএনবিতে রয়েছে ঘর ভাড়া নেওয়ার সুবিধা।  মহাকাশ ভ্রমণের জন্য ব্লু অরিজিন। বিজনেস ইনসাইডার ও ওয়াশিংটন পোস্ট রয়েছে মিডিয়া প্রকাশনায়। সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ডোমো, বেসক্যাম্প, ওয়ার্কডে, জকডোক সবই  জেফ বেজোসের। ডি ওয়েব সিস্টেমার্স রয়েছে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং সিস্টেম তৈরিতে। ক্যান্সার চিকিৎসাসেবায় রয়েছে গ্ল্যাসিবেবি। জুনোথোরপিউটিকসের মত গবেষণা কার্যক্রমেও টাকা বিনিয়োগ করেছেন। গুগল সার্চ ইঞ্জিন, স্যোসাল মিডিয়া টুইটার সবখানেই শেয়ার কিনেছেন। রিদনিক রোবোটিক— রোবট গবেষণা, স্যাফেয়ার এনার্জি— শক্তি উন্নয়ন ও পরিষেবা, ভিকারাস— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নয়নের মতো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায়, গবেষণায় তিনি অঢেল অর্থ ঢেলেছেন। পরিবহনে উবার, অনলাইন গেমিং, স্বাস্থ্যসেবা সবখানেই রয়েছে তার ব্যবসায়িক বিনিয়োগ।  প্রথম সারির সব ব্যবসাতেই তিনি জড়িয়েছেন।

 

মহাকাশ দখলের স্বপ্ন

মহাকাশ দখলের স্বপ্ন রয়েছে জেফ বেজোসের। ছোটবেলা থেকে হলিউড সিনেমায় মহাকাশের গল্প দেখে মহাকাশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। হলিউড কাঁপানো ‘স্টারট্রেক’ সিনেমার দারুণ ভক্ত তিনি। স্কুলে থাকতেও তিনি শিক্ষককে বলেছিলেন, মানুষের ভবিষ্যৎ এই পৃথিবীতে নয়। ১৮ বছর বয়সেও বলেছেন সেই কল্পকথা সত্যিই তিনি বিশ্বাস করেন। তাই টাকা ঢালছেন তার সব ড্রিম প্রজেক্টে। প্রায় ৩৪টি গবেষণা কার্যক্রমে বিনিয়োগকারী জেফের অ্যামাজন ছাড়া সবচেয়ে আলোচিত প্রজেক্ট হলো ‘ব্লু অরিজিন’। ২০০০ সালে এ প্রজেক্টের যাত্রা করেন জেফ। তার স্বপ্নযাত্রার চিত্র বলছে, তিনি মহাকাশে গড়ে তুলতে চান হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বিনোদন পার্ক। মহাকাশে রকেটে করে মানুষজন যাবে ঘুরতে। সেখানে তাদের জন্য থাকবে সব বিনোদনমূলক আয়োজন। সেখানে ঘরবাড়িও বানানোর ইচ্ছা রয়েছে তার। মহাকাশে ছোট একটি শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা এখন আর অজানা নেই কারও। জেফ বরাবরই বলে এসেছেন, তিনি মহাকাশ যাত্রা সাধারণ মানুষের কাছে সহজ করতে চান। মানুষ চাইলেই টিকিট কেটে যেন মহাকাশে ভ্রমণ করতে পারে, সে ব্যবস্থা করবেন। ২০ থেকে ৩০ লাখ মানুষ যেন মহাকাশে জীবনযাপন করতে পারে এমন একটি শহরও গড়ে তুলবেন তিনি। এসব শুধু কথার কথা নয়। ব্লু অরিজিন নিয়ে বেশ কর্মচাঞ্চল্য রয়েছে। মানুষবাহী রকেটের পরীক্ষা চালিয়েছেন ২০০৬ সালে। ২০১৩ সালে আরও কয়েকজন শীর্ষ উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার আলাপচারিতায় জানা যায়, তিনি মনুষ্যবাহী মহাকাশ যান তৈরি ও ব্যবসায় কাজ করছেন। ২০১৫ সালে তিনি বলেছেন, ‘আমরা কোনো নির্দিষ্ট গ্রহে থাকার পরিকল্পনা করছি না। আমি চাই, মানুষ মহাকাশে যেখানে খুশি সেখানে বেড়াতে যাবে। এই মহাকাশ ভ্রমণের খরচ কীভাবে কমানো যায় সে চেষ্টাই করছি।’ ২০১৬ সালে তার এ গবেষণা কার্যক্রমের কথা আবারও আলোচনায় আসে। সে বছর তিনি জানান, অ্যামাজন ডটকমের শেয়ার থেকে প্রায় ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তিনি এই গবেষণা প্রজেক্টে কাজে লাগিয়েছেন। স্বপ্নচারী জেফ বেজোসের এ গবেষণা কার্যক্রম মহাকাশে মানুষের যাত্রা আরও সহজ ও বাস্তব করে তুলবে— তা-ই প্রত্যাশা করেন বিশেষজ্ঞরা।

দোকান নেই তবু বিশ্বের সবচেয়ে বড় খুচরা পণ্য বিক্রেতা

অনেক ধরনের কাজ করেছেন জেফ বেজোস। গবাদিপশু মাঠে যেমন চরিয়েছেন তেমনি কাজ করেছেন সফটওয়্যার কোম্পানিতে। প্রিন্সটন থেকে গ্রাজুয়েট করে ওয়াল স্ট্রিটে আসেন। কম্পিউটার সায়েন্সে দক্ষ হওয়ায় কাজ নেন ফিটেলে। এরপর অন্য কাজে জড়ালেও তিনি মনস্থির করতে পারেননি। নিউ ইয়র্ক থেকে সিয়াটলে চলে আসেন। ১৯৯৪ সালে তিনি খেয়াল করলেন এক বছরে নতুন করে প্রায় ২,৩০০ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারে জড়িয়েছেন। মানুষজন ক্রমেই ইন্টারনেটে বুঁদ হচ্ছে দেখে তিনি ভিন্ন কিছু করার পরিকল্পনা নিতে থাকেন। তখন জেফের বস ছিলেন ডেভিস স্য। মাইনেও ভালো দিতেন। অবশ্য সে চাকরি ছেড়ে নিজেই কিছু করতে চাইলেন জেফ। স্ত্রী ম্যাকেনজিকে সে কথা বলতে তিনিও সায় দিলেন। টেক্সাসে উড়ে এলেন দুজনে। বাবাকে বললেন, ‘বাবা, তোমার গাড়িটা ধার দাও। সিয়াটল যাব।’ বাবার গাড়ি চালিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে সিয়াটলে পৌঁছলেন জেফ। তার বউয়ের বই পড়ার খুব শখ। লেখালেখিও করেন প্রচুর। খেয়াল করলেন তার স্ত্রীর মতো অনেকেই বই কিনতে লাইব্রেরিতে যান। তিনি ভাবলেন, এমন একটি ওয়েবসাইট তৈরি করি যেখানে গ্রাহকরা ইন্টারনেটেই বই অর্ডার করতে পারবেন। ১৯৯৪ সালে সিয়াটলে বাড়ির গ্যারেজ পরিষ্কার করে অ্যামাজনের অফিস খোলেন। অ্যামাজনের যাত্রা শুরু। ইন্টারনেটের মাধ্যমে অর্ডার নিয়ে গ্রাহকের বাড়ি পৌঁছে দেবেন সেই বই। সেটাই হলো। শুরুর দিকে কেউ বই কিনতে চাইলে গ্যারেজের কাছেই থাকা বেল বাজাতেন জেফ। আশেপাশে তার প্রতিবেশীরা ছুটে এসে কম্পিউটারের পর্দায় দেখতেন এই ক্রেতা, তার ঠিকানা কেউ চেনেন কিনা। বই তো পৌঁছে দিতে হবে!  প্রথম মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি স্টেট থেকে বইয়ের অর্ডার এলো। শুধু কি তাই? বিশ্বের আরও ৪৫টি দেশ থেকে তার ওয়েবসাইট অ্যামাজন থেকে বই কিনতে আগ্রহ দেখালেন ক্রেতারা। অর্ডার পেয়ে আর দেরি করেননি— সবার কাছেই পৌঁছে দিলেন পছন্দের বই। বই বিক্রির এই ঊর্ধ্বগতি দেখে আরও ২০টি পণ্য ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিক্রির পরিকল্পনা নেন জেফ। ১৯৯৭ সালে অ্যামাজন ‘পাবলিক’ ঘোষণা করে শেয়ারবাজারে নামেন। অ্যামাজনে ক্রেতার ভিড় রীতিমতো ইন্টারনেট জগেক কাঁপিয়ে দেয়। মানুষজন যখন কেনাকাটার জন্য অ্যামাজনে ভিড় বাড়াতে থাকল জেফও নানা ধরনের পণ্যের সংগ্রহশালা খুলে বসলেন তার ওয়েবসাইটে। ভিডিও গেম, কসমেটিকস, পোশাক, টিভি-ফ্রিজ... কত কি। একপর্যায়ে দেখা গেল— এমন কিছু নেই যা অ্যামাজনে বিক্রি হচ্ছে না। বিক্রেতারাও অনলাইনের মাধ্যমে তাদের পণ্য বিক্রির জন্য অ্যামাজনের ওপর নির্ভরতা বাড়াল। অবস্থা এমন গিয়ে ঠেকল, অ্যামাজনে পাওয়া যায় না এমন কোনো পণ্য বুঝি দুনিয়ায় নেই! নিজের কিডনি, সতীত্ব বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথাও বেশ কয়েকবার শোনা গেছে; যদিও অ্যামাজন সেসব বিজ্ঞাপন সতর্কভাবে সরিয়ে নিয়েছে বরবার। ‘আপনি যা কিনতে চান, অ্যামাজনে যান’। অ্যামাজন সাফল্যে, জেফ বেজোসের কাছে টাকার স্রোত সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে থাকে। ২০০৮ সালে তিনি গুগলে আড়াই লাখ ডলার বিনিয়োগ করেন।  ২০১৩ সালে কিনে নেন প্রভাবশালী ওয়াশিংটন পোস্ট। ৩০টির বেশি গবেষণা কার্যক্রমে বিনিয়োগ করেছেন।  খোদ অ্যামাজনেরই সহায়ক সেবা প্রতিষ্ঠান প্রায় ১৪টি।

জেফ বেজোসের দিনকাল

দুটি পিৎজা খেয়ে শেষ করতে না পারলে মিটিং ক্যানসেল

আলসেমি একদম পছন্দ করেন না জেফ বেজোস। সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠেন। এ জন্য তার কোনো অ্যালার্ম ঘড়ির দরকার হয় না। দিনের শুরুটা হয় পরিবারের সঙ্গে সকালের নাস্তা খেয়ে। খাবার টেবিলে অবশ্যই থাকা চাই তার স্ত্রী ঔপন্যাসিক ম্যাককেনজিকে। তাদের চার সন্তান রয়েছে। সবাইকে নিয়ে খেলায় মেতে ওঠেন। পরিবার ও সন্তানদের সময় দিতেই সকালে কখনো বেজোস কারও সঙ্গে দেখা করেন না। যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক, কোনো অফিসিয়াল মিটিংও করেন না। জেফ অফিসিয়াল মিটিং বিষয়টাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন, এমনও না। বেজোস পরিবারের সূত্র ধরে বিজনেস ইনসাইডার জানায়, অ্যামাজনের প্রধান বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে তাদের বছরে ৬ ঘণ্টার বেশি কখনই সময় কাটাতে দেখা যায়নি। অ্যামাজনের মিটিং ডাকলে জেফ বেছে নেন মজার একটি রীতি। রীতি না বলে আইনও বলা যেতে পারে। এই আইন মতে, মিটিংয়ে যদি উপস্থিত কর্তাব্যক্তিরা মিলে অন্তত দুটি পিত্জা খেয়ে শেষ করতে না পারেন তাহলে মিটিং বাতিল। মিটিংয়ে উপস্থিত সবাই মিলে দুটি পিত্জা শেষ করতেই হবে। অফিসের মিটিংয়ে তাকে মজার মানুষ মনে হলেও বিভিন্ন সময় তিনি কঠোর, রাগী বস হিসেবেই সমালোচিত হয়েছেন। তিনি ভালো বস নন— এ অভিযোগ ছাড়াও  কথায় কথায় কর্মীদের চাকরি খেয়ে ফেলেন বলে সমালোচিত হয়েছেন জেফ।  এ অভিযোগ স্বীকার না করলেও পরে জানা যায়, জেফ বেজোস একজন ‘এক্সিকিউটিভ কোচ’ রেখেছেন যিনি তাকে বসগিরি মানে কীভাবে অধীনস্থদের অফিসের কাজে লাগাতে হবে সেসব শেখান। তবে কর্মীদের প্রতি তার সহনীয় আচরণের কথাও জানা যায়। মাঝেমধ্যেই অফিসের কর্মীদের দুপুরের খাবারের দাওয়াত দিয়ে বসেন তিনি। খাবার নিয়ে তিনি বেশ শৌখিন। একবার রিটেইল কোম্পানি ‘উট’-এর প্রতিষ্ঠাতা ম্যাটের সঙ্গে খেতে বসে জেফ আলু দিয়ে অক্টোপাস অর্ডার করে বসেন। সঙ্গে ডিমও অর্ডার করেন। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে জেফ বলেন, ‘এই রেস্টুরেন্টের অর্ডার মেন্যুর কিছুই আমি বুঝিনি। তাই এটা অর্ডার করলাম।’ অ্যামাজনের অফিসের ভিতরও রয়েছে ‘ফুড ট্রাক’। বিজনেস ইনসাইডার জেফের সাক্ষাৎকার নিতে ভিতরে প্রবেশ করে এই ফুড ট্রাকের দেখা পান। তিনি এই ট্রাকের কথা জানতে চাইলে জেফ বলেন, ‘এটা অনেক জনপ্রিয় খাবারের ট্রাক। ট্রাকে করে যখন খাবার আসে তখন এর নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন।’ জেফের ছিপছিপে শরীরের গড়ন দেখে অনেকে মনে করেন, তিনি হয়তো জিমে শরীর চর্চা করেন। তবে এ নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানা যায়নি। বরাবরই মিডিয়াকে এড়িয়ে চলেন তিনি।  বিশ্বের শীর্ষ ধনী জেফের বয়স এখন ৫৩ বছর।

সর্বশেষ খবর