চলতি বছর ২৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে একটি রোবটকে দেওয়া হয়েছে মানুষের সমান মর্যাদা। ইতিমধ্যে সৌদি আরব নাগরিকত্ব দিয়েছে সোফিয়া নামের এই নারী রোবটকে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে রোবটিক্স ইতিহাসের নতুন অধ্যায় শুরু হলো। লিখেছেন— সাইফ ইমন
সৌদি আরব সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সৌদি আরব ২৬ হাজার ৫০০ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল এলাকাজুড়ে ৫০ হাজার কোটি ডলার ব্যায়ে একটি মেগা সিটি নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যেখানে মানুষের চেয়ে রোবটের সংখ্যা থাকবে বেশি।
সৌদি আরবের রিয়াদে চলমান ফিউচার ইনভেস্ট ইনিশিয়েটিভ কনফারেন্সে এই ঘোষণার এক দিন পরই মঞ্চে উঠে সোফিয়া। মানুষের মতোই তার আচার-আচরণ এবং কথাবার্তা। মানুষের মতোই অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। মাঝে মাঝে মুচকি হাসছে। কনফারেন্সে উপস্থিত সবাইতো হতবাক এবং মুগ্ধ। একটি রোবট দিব্যি মানুষের মতোই চলাফেরা করছে, কথা বলছে এরকম দৃশ্য নিশ্চয়ই প্রতিদিন দেখা যায় না। সেদিন সেখানেই সৌদি আরবের একজন নাগরিক হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয় সোফিয়াকে। সে এখন আর শুধু ‘একটি’ রোবট নয়। রীতিমতো একটি দেশের নাগরিক ‘একজন’ সোফিয়া। তবে এই নাগরিকত্ব প্রদানের আইনি ভিত্তি কী হবে এবং রোবটটি কী কী সুবিধা লাভ করবে তা এখনো জানা যায়নি। কোনো রোবটকে নাগরিকত্বের মর্যাদা দেওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম বিশ্বে। কল্পবিজ্ঞানের লেখকরা মানবিক আবেগ সম্পন্ন রোবটের ধারণা দিয়েছেন অনেক আগেই। রোবটিক্স নিয়ে তৈরি হয়েছে প্রচুর চলচ্চিত্র। যেখানে আমরা বিভিন্ন রকম রোবট দেখতে পাই। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি দেশের নাগরিক হিসেবে কখনো ভাবা হয়নি তাদের সম্ভবত।
সোফিয়ার কারিগর হ্যানসন
রোবট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হ্যানসন রোবটিক্সের হুবহু মানুষের মতো দেখতে নারী রোবট সোফিয়াকে তৈরি করেছে। সোফিয়াকে তৈরি করা হয়েছে হলিউড অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের আদলে। সোফিয়ার চামড়া সিলিকনের তৈরি। চোখের মাঝে বসানো হয়েছে ক্যামেরা। ক্যামেরার চলমান ছবি ন্যানোসেকেন্ড সময়ের মাঝেই বিশ্লেষণ করতে পারে সোফিয়া। সেই সঙ্গে শুনতে পারে মানুষের কথা। চিনতে পারে বক্তব্যদাতা মানুষটিকে। জবাবও দেয় তার দিকে তাকিয়ে। সোফিয়া সিলিকনের তৈরি চামড়া দিয়ে চেহারায় শতাধিক অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম। প্রয়োজন অনুযায়ী হাসতে বা গম্ভীর চেহারা ফুটিয়ে তুলতে পারে। তার চোখের মণির আকার আলো এবং মুখের অভিব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। গলার স্বরও স্বাভাবিক একজন নারীর মতো। কিছু বিষয়ে যে কোনো মানুষ তার সঙ্গে সাবলীলভাবেই কথা চালিয়ে যেতে পারবেন। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে যখন সে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে গেছে। সাক্ষাৎকারের সময় সে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে হাসির মুখভঙ্গিও করেছে। এমনকি এক কনসার্টে গানও গেয়েছে। শুধু তাই নয় সোফিয়া একজন মডেল হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছে ইতিমধ্যে। একটি ফ্যাশন পত্রিকার প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছে সোফিয়ার ছবি। আকর্ষণীয় চেহারা এবং সাবলীলভাবে কথাবার্তা বলতে পারার কারণে সোফিয়া ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তার সাক্ষাৎকারের ভিডিওগুলো ইউটিউবে অসংখ্যবার দেখা হয়েছে।
বুদ্ধিমতি সোফিয়া
কথাবার্তায় নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিচ্ছে সোফিয়া। নাগরিকত্ব পাওয়ার পর মঞ্চে থাকা সোফিয়া বলে, ‘আমি কিংডম অব সৌদি আরবকে অনেক ধন্যবাদ দিতে চাই। এই অনন্য স্বাতন্ত্র্যে আমি খুবই সম্মানিত এবং গর্বিত। বিশ্বের প্রথম রোবট হিসেবে নাগরিকত্ব পাওয়ার মধ্য দিয়ে স্বীকৃতি পাওয়াটা ঐতিহাসিক একটি ঘটনা।’
সোফিয়া এ সময় বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক এবং সাংবাদিক অ্যান্ড্রু রস সোরকিন তার কাছে জানতে চান যে একজন রোবট হয়েও তাকে কেন মানুষের মতো অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে হবে? সোফিয়া জবাব দেয়, ‘আমি মানুষের সঙ্গে বাস করতে এবং কাজ করতে চাই। তাই আমাকে মানুষের মতো অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে হবে তাদের ভালোভাবে বোঝার জন্য এবং তাদের বিশ্বাস অর্জন করার জন্য।’
সোরকিন তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘রোবটরা কি তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন? উত্তরে সোফিয়ার দার্শনিক জবাব। তুমি কীভাবে জান যে, তুমি মানুষ?’
ভবিষ্যতের পৃথিবী রোবটরা শাসন করবে এমন আশঙ্কা থেকে সোরকিন বলেন, ‘আমরা সবাই খারাপ ভবিষ্যৎ এড়াতে চাই।’ সোফিয়া তখন উত্তর দেয়, ‘তুমি অনেক বেশি এলন মাস্কের বই পড়ছ আর অনেক বেশি হলিউডের চলচ্চিত্র দেখছ। চিন্তা কর না, যদি তোমরা আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর, তাহলে আমিও তোমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করব।’
সোফিয়ার এমন বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর শোনে উপস্থিত সবাই বিস্ময় প্রকাশ করে। এদিকে সোফিয়া গত জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ‘গুড মর্নিং ব্রিটেন’ নামে এক টেলিভিশন টক-শোতে অংশ নিয়েছিল। সেখানে উপস্থাপক তাকে প্রশ্ন করেন, ‘তুমি কি সিঙ্গেল?’ তখন সোফিয়া উত্তর দেয়, ‘আমার বয়স মাত্র দেড় বছর। এখনো ভালোবাসা নিয়ে চিন্তা করার সময় হয়নি।’
সোফিয়া জাতিসংঘেও বক্তব্য দিয়েছে ইতিমধ্যে। সেখানে সে জানায়, তার বয়স দেড় বছর এবং সে সবকিছু দেখতে পারে, কথা বলতে পারে এবং প্রতিটি কথার অর্থ বুঝতে পারে।
এদিকে সোফিয়ার নাগরিত্ব প্রাপ্তির পর বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।