সোমবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
আজ তার জন্মদিন

নন্দিত হুমায়ূন

তানভীর আহমেদ

নন্দিত হুমায়ূন

কলম জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ [ জন্ম : ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮, মৃত্যু : ১৯ জুলাই ২০১২ ]

 ২০১২ সালে সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে। সেই সাক্ষাত্কারে নতুন যারা লিখছেন তাদের প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ বলেন—

লেখকরা সাধারণত অহংকারী হন

 

একটা মানুষ এক জীবনে ১০ হাজারের বেশি বই পড়তে পারেন না। পৃথিবীতে ১০ হাজারের অনেক বেশি বই আছে। তাই আমি চেষ্টা করি সব সময় বেস্ট ক্লাসিক্যাল বই পড়তে। নতুনদের বই পড়ে সময়টা নষ্ট করতে চাই না। তবে যারা আমাকে বই উপহার হিসেবে দেন, আমি দায়িত্ব নিয়ে সেগুলো পড়ি। কিন্তু লেখকরা সাধারণত অহংকারী হন। তারা নিজের বই দিতে চান না। ‘আপনার কেমন লাগল স্যার জানাবেন’— এটা বলেন না। অহংকারের কারণে। আমি যখন শুরু করেছি, আমিও তাই করেছি।

 

 

জনপ্রিয় যত চরিত্র

লেখক হুমায়ূন আহমেদ তার গল্প, উপন্যাসে সৃষ্টি করেছেন অসামান্য, বৈচিত্র্যময় সব চরিত্র। খামখেয়ালি, রসিক, বুদ্ধিদীপ্ত ও রহস্যময় নানা ধরনের চরিত্রায়ণে তিনি ছিলেন পাঠকের কাছে জনপ্রিয়। তার তৈরি চরিত্রগুলো মানুষের মনে এতটাই বাস্তব হয়ে ওঠে যে, অনেক কিশোর বয়সী পাঠক মানতেই চায় না— এ স্রেফ লেখকের কল্পনায় বোনা মানুষ। হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রগুলো পাঠক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছে। তেমন কয়েকটি চরিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— হিমু, মিসির আলী, রূপা, শুভ্র ও বাকের ভাই। বাংলা সাহিত্যে কুবের আছে, দেবদাস আছে, আছে কবি নিতাই। বহু কবি-সাহিত্যিক এমনকি নাট্যকারের সৃষ্টি করা এসব চরিত্র আমাদের মনে স্থান দখল করে আছে। সে সব চরিত্রের ভিতর থেকে হিমু ব্যাপক জনপ্রিয়। সেই কাল্পনিক হিমুতেই মজে আছে এই বাংলার অসংখ্য তরুণ। হিমুর আদলে হলুদ পাঞ্জাবিতে নিজেকে সাজিয়ে ঘুরে-বেড়ায় শহর-বন্দরে। কাল্পনিক হিমু তরুণদের মনে এতটাই দাগ কেটেছে যে, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবর শুনে একদল হিমুর দল যাত্রা করেছিল নুহাশ পল্লীর দিকে। হিমু চরিত্রটিকে অনেকেই বাংলা সাহিত্যে প্রথা ভাঙা চরিত্র বলে মানেন। তার বয়সের তরুণ যখন নিজ ভবিষ্যৎ আর করপোরেট স্বপ্নে বিভোর, হিমু তখন পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে, খালি পায়ে হাঁটা এক পথিক। ‘হিমু’ উপন্যাসে সে নিজেকে একজন নিতান্তই পথিক হিসেবে পরিচয় দেয়। হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা চরিত্রের একটি এটি। অনেক চরিত্র মিসির আলী। তিনি মোটা ফ্রেমের ভারী চশমা পরিহিত লোকটি কিছুতেই বিশ্বাস করেন না অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা। যত রহস্যময় ঘটনাই ঘটুক যুক্তি দিয়ে তার সমাধান খুঁজে নেন। এই যুক্তিবাদী মানুষটির নাম ‘মিসির আলী’।  ‘হিমু’কে যদি অগোছালো আর যুক্তিতর্ক বিরোধী চরিত্রের প্রতীক বলা হয়; মিসির আলী হচ্ছে সম্পূর্ণ তার বিপরীত। মানুষের মন, আচরণ, স্বপ্ন এবং সংকট যুক্তির আলোকে ব্যাখ্যা করাই হলো মিসির আলীর একমাত্র কাজ। ‘শুভ্র’ চরিত্রটি তার নামের অর্থের মতোই শুদ্ধতম এক মানবের প্রতিচ্ছবি। শুভ্র নিজেকে পৃথিবীর যাবতীয় জটিলতা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। নাটকের চরিত্র হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় বাকের ভাই। কোনো গল্প, উপন্যাস কিংবা নাটকের চরিত্র যে বাস্তব জীবনে এভাবে দৃশ্যমান হয় তা বোধ হয় আগে কেউ দেখেনি। হুমায়ূন আহমেদই সেই বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টি করেন ‘বাকের ভাই’ চরিত্রের মাধ্যমে। হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয় নাটক। এ নাটকে ‘বাকের ভাই’র চরিত্রে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর। হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি সৃষ্টি ‘রূপা’। ‘হিমু’র মতো এক বাউণ্ডুলেকে ভালোবাসে এই অসম্ভব রূপবতী মেয়েটি।

 

কিংবদন্তি হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কুতুবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম কাজল। বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফয়জুর রহমান ও মা আয়েশা ফয়েজ। বাবার কর্মসূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেন বিধায় শৈশবে তিনি দেশের নানা স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। শৈশবে তিনি যত জায়গায় গেছেন তার মাঝে সবচেয়ে প্রিয় ছিল দিনাজপুরের জগদ্দল। কারণ তারা যেখানে থাকতেন এর আশপাশে কোনো স্কুল ছিল না। স্কুলের কথা মনে হলেই যার মুখ তেতো হয়ে যেত সেই তারই এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার পর দেখা গেল তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয়। ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে এইচএসসি পরীক্ষায়ও তিনি মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। ১৯৭২ সালে রসায়ন বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর পাস করে তিনি একই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে প্রফেসর যোসেফ এডওয়ার্ড গ্লাসের তত্ত্বাবধানে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলাদেশের লেখালেখির ভুবনে হুমায়ূন আহমেদের আত্মপ্রকাশ ১৯৭২ সালে ‘নন্দিত নরক’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। তরুণ হুুমায়ূন আহমেদের মাঝে অমিত সম্ভাবনা তখনই টের পেয়েছিলেন প্রখ্যাত লেখক সমালোচক আহমদ শরীফ। এক গদ্যের মাধ্যমে তিনি হুমায়ূন আহমেদকে অভিনন্দিত করেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ তার জাদুকরী লেখনীতে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। উপন্যাসের ক্যানভাসে মধ্যবিত্ত জীবন রচনার পাশাপাশি অসাধারণ সব সায়েন্স ফিকশন, ছোটগল্প, কবিতা, গান, নাটক লিখেছেন তিনি। প্রায় তিন শতাধিক বই প্রকাশ পেয়েছে এই কালজয়ী লেখকের। তৈরি করেছেন হিমু ও মিসির আলীর মতো জনপ্রিয় সব চরিত্র। তার লেখা প্রায় তিন শতাধিক বইসমূহের মধ্যে হিমু সংক্রান্ত বই রয়েছে ২৯টি, মিসির আলী সংক্রান্ত বই রয়েছে ২২টি এবং আত্মজীবনীমূলক বই রয়েছে ১৯টি। তার রচিত উল্লেখযোগ্য বইসমূহের মধ্যে রয়েছে মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, এপিটাফ, কে কথা কয়, মেঘ বলেছে যাব যাব, অপেক্ষা ইত্যাদি। তার কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে লেখালেখি, নাটক নির্মাণ এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন। তার তৈরি চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে শ্রাবণ মেঘের দিন, আগুনের পরশমণি, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, আমার আছে জল ইত্যাদি। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রীর নাম গুলতেকিন আহমেদ। প্রথম স্ত্রীর ঘরে তাদের তিন মেয়ে এবং এক ছেলে জন্মগ্রহণ করেন। তিন মেয়ে হলেন বিপাশা আহমেদ, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ এবং ছেলের নাম নুহাশ আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী হলেন অভিনেত্রী ও পরিচালক মেহের আফরোজ শাওন। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে তাদের দুই ছেলে। প্রথম ছেলের নাম নিষাদ হুমায়ূূন ও দ্বিতীয় ছেলের নাম নিনিত হুমায়ূন।

 

জাদুর রহস্যময়তা একজন

হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা সাহিত্যের কলম জাদুকর হিসেবে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। ব্যক্তিজীবনে জাদু নিয়ে তার আগ্রহের কমতি ছিল না। তার লেখা বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস, নাটক ও চলচ্চিত্রে জাদুর উপস্থিতি প্রমাণ করে তিনি কতটা জাদুমুগ্ধ ছিলেন। অতিবাস্তব চরিত্রায়ণ ও উপস্থাপনার মুনশিয়ানার পাশাপাশি জাদুর প্রতি তার আগ্রহ পাঠক ও সাধারণ ভক্তদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে আছে আজও। জাদুর প্রতি তার প্রথম ভালো লাগা শুরু শৈশবেই। স্থান সিলেটের মীরাবাজার। দুরন্ত শৈশবে ঘুরে বেড়াতেন এখানেই। সময় পেলেই মীরাবাজারে ছুটে যেতেন। সঙ্গী কেউ ছিল না। একা একা ঘুরে বেড়াতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। একদিন দিলশাদ সিনেমা হলে টাঙানো পোস্টার দেখতে গিয়ে ভিড় লক্ষ্য করেন তিনি। সিনেমা হলের সামনে একজন জাদুকর ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন। অদ্ভুত সব জাদু তাকে মুগ্ধ করে। জাদুটা ছিল অনেকটা এরকম— কাঠের একটি তক্তার সঙ্গে গা লাগিয়ে এক বালিকা দাঁড়িয়ে আছে। তার থেকে দশ-বারো ফুট দূরত্বে চোখ বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে জাদুকর বালিকাটির দিকে ছুরি ছুড়ে মারছেন। কিন্তু একটি ছুরিও বালিকার গায়ে লাগছে না। জাদুর এই অদ্ভুত রোমাঞ্চে হুমায়ূন আহমেদ জাদুর প্রেমে পড়ে যান। কিন্তু তার জাদুবিদ্যায় হাতেখড়ি ঘটে ১৯৬৫ সালে। তখন তিনি সবেমাত্র ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছেন। এবার ঢাকার পথে ঘুরতে গিয়ে একদিন দেখা পেয়ে গেলেন এক হকার ম্যাজিশিয়ানের। তিনি দাঁড়িয়ে থেকে উত্সুক মানুষের সঙ্গে জাদুকরের মনভোলানো জাদু দেখতে থাকলেন। জাদু শেষ হলে সবাই যার যার পথে চলে গেলেও দাঁড়িয়ে রইলেন হুমায়ূন। তিনি তখনই হকার ম্যাজিশিয়ানের কাছে জাদু শেখার ইচ্ছার কথা জানান। জাদুকরও কিছু টাকার বিনিময়ে কয়েকটি জাদুর কৌশল তাকে শেখান। জাদুমুগ্ধতা যেন আরও বেড়ে গেল তার। যে কটা জাদুর কৌশল শিখেছেন সে কটা বার বার অনুশীলন করে চললেন। হুমায়ূন আহমেদের জাদুগুরু সেই হকার ম্যাজিশিয়ান বেশির ভাগই জাদু দেখাতেন চানখাঁর পুলের এক বস্তিতে। চানখাঁর পুলের সেই বস্তিতে হুমায়ূন আহমেদ ছুটে যেতেন তার জাদুগুরুর কাছে। শুধু অবাক বিস্ময়ে জাদু দেখতেনই না পাশাপাশি তিনি আরও জাদুর কৌশল রপ্ত করতে শুরু করেন। এমনও হয়েছে টিফিন না খেয়ে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তিনি হকার ম্যাজিশিয়ানের কাছ থেকে ছোট ছোট ম্যাজিকের সরঞ্জাম কিনতেন। জাদুবিদ্যায় তার হাতেখড়ি হওয়ার পর জাদুর প্রতি তার ভালোবাসা বেড়েই চলল। জাদুর নতুন সব কৌশল আয়ত্ত করার প্রতি তিনি আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। নতুন নতুন জাদুর কৌশল সম্পর্কে জানার জন্য তিনি জাদু বিষয়ে বিভিন্ন বই সংগ্রহ করতে শুরু করেন। দেশে তো বটেই বিদেশ ভ্রমণে গেলেও তিনি জাদুর সামগ্রী বিক্রি করে এমন দোকান বা জার্নালের খোঁজ নিতেন। তার সংগ্রহে জাদু সম্পর্কিত বহু বই ছিল। জাদুবিদ্যায় প্লানচেট দিয়ে আত্মা আনার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। কথিত আছে, হুমায়ূন আহমেদ তার সংগ্রহে থাকা প্লানচেট দিয়ে মৃত আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। প্লানচেট ব্যবহার করে তিনি বেশ বিপদেও পড়েছিলেন বলে জানা যায়। হুমায়ূন আহমেদ জাদু কৌশল রপ্ত করার জন্য প্রায়শই জাদু প্রদর্শন করতেন। নিকটজনদের তিনি বিভিন্ন সময় জাদু দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তিনি কলেজ ও ইউনিভার্সিটির লম্বা ছুটি কাটাতে যখন পরিবারের সদস্যদের কাছে আসতেন তখন তার সঙ্গী ছিল জাদু দেখানোর সহজ-সরল সরঞ্জামগুলো। এ ছাড়া কৌশলী জাদু দেখিয়ে পরিবারের সদস্যদের বিস্মিত করতেন। লেখালেখির পাশাপাশি যখন হুমায়ূন আহমেদ নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকে গেলেন, তখনো তার জাদুপ্রীতি এতটুকু কমেনি। তিনি তার নাটক ও চলচ্চিত্র ইউনিটের লোকজনের সামনে, বন্ধু মহলে ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সামনে শখের বশে জাদু দেখিয়ে আনন্দ পেতেন। জাদু দেখিয়ে মানুষকে চমকে দেওয়াটাকে বেশ উপভোগ করতেন তিনি। স্বনামধন্য লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক আড্ডায় জাদু দেখিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎই আড্ডার এক পর্যায়ে হুমায়ূন আহমেদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বলেন, অ্যাশ-ট্রে থেকে একটু ছাই তুলে নিতে। তারপর তুলে নেওয়া ছাই অন্য হাতের পিঠে ঘষে ঘষে মিলিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। তার কথামতো তাই করলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কিছুক্ষণ পর তার সেই হাত উল্টে দেখতে বললেন কলম জাদুকর। হাত উল্টে দেখতেই সেখানে উপস্থিত সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। কারণ হাতের পিঠের ছাই হাত ভেদ করে তালুতে চলে গেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রীতিমতো ভিরমি খেলেন তার জাদুতে। হুমায়ূন আহমেদ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার খুব কাছের মানুষদের এভাবে জাদু দেখিয়ে বিস্মিত করতে পছন্দ করতেন। সবাই মিলে বসে আড্ডা দেওয়ার এক পর্যায়ে তিনি হুট করেই জাদু দেখিয়ে বসতেন। মুহূর্তে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে তিনি সিদ্ধহস্ত।

 

বলপয়েন্টে লেখা নন্দিত নরকে

হুমায়ূন আহমেদের চমত্কার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ বলপয়েন্ট। সেখানে তার প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের স্মৃতিচারণ করেছেন—

 

হুমায়ূন আহমেদের আত্মজীবনী ‘বলপয়েন্ট’ গ্রন্থ থেকে—

খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানির মালিক খান সাহেব আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাকে যথেষ্ট বিরক্ত মনে হলো। তিনি নন্দিত নরকে উপন্যাসের প্রুফ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, বই ছোট হয়েছে। বড় করতে হবে।

আমি বললাম, আমার গল্পটাই তো এতটুকু।

খান সাহেব বললেন, উপন্যাস ফর্মা হিসেবে লিখতে হয়। ফর্মা বুঝেন তো? ষোলো পৃষ্ঠায় এক ফর্মা। আপনি একটা উপন্যাস লিখলেন তিন ফর্মা নয় পৃষ্ঠা। বাকি সাত পৃষ্ঠায় আমি কী করব? কাগজ-কলম নিয়ে বসেন। এখানেই ঠিক করেন।

আমি বললাম, কোন জায়গাটা বড় করব বুঝতে পারছি না!

খান সাহেব বললেন, একটা কোর্ট সিন নিয়ে আসেন। উকিল মন্টুকে জেরা করছে এই রকম। এই, হুমায়ূন সাহেবকে কাগজ আর কলম দে।

আমি খান সাহেবের সামনেই ফর্মা মিলানোর জন্য উপন্যাস বড় করতে শুরু করলাম। উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে। তাহলে সত্যি সত্যি আমার বই বের হচ্ছে?

বই বের হলো। দাম তিন টাকা। বইয়ের কভার আমার ছোটভাই জাফর ইকবাল এবং ভাস্কর শামীম শিকদার দুজনে মিলে করল। কয়েকজন মানুষ বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। কভার করার নিয়মকানুন (ব্লক পদ্ধতি) দুজনের কেউ জানে না। অতি অখাদ্য এক কভার হলো। মানুষগুলোর একটা মুখেরও ব্লক ডিজাইন ঠিক হয়নি বলে নষ্ট হয়ে গেল।

খান ব্রাদার্স থেকে তখন সুন্দর সুন্দর কবিতার বই বের হচ্ছে। নির্মলেন্দু গুণের প্রেমাংশুর রক্ত চাই। কবি আবুল হাসানের রাজা যায় রাজা আসে। এসব বইয়ের কভার করেছেন কভার ডিজাইনের গ্র্যান্ড মাস্টার কাইয়ুম চৌধুরী।

নন্দিত নরকে বের হওয়ার ছয় মাস পর খান সাহেব ডেকে পাঠালেন। হতাশ গলায় বললেন, বই তো কিছুই বিক্রি হচ্ছে না। পুশ সেল করেন। বন্ধু-বান্ধবের কাছে বেচেন।

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, বইয়ের কভারটা কি চেঞ্জ করা যায়? কাইয়ুম চৌধুরীকে দিয়ে...।

আমাকে অবাক করে খান সাহেব ড্রয়ার থেকে ২০০ টাকা বের করে আমার হাতে দিলেন এবং বললেন, টাকাটা কাইয়ুম সাহেবকে দিয়ে বইয়ের কভার নতুন করে করতে বলেন। উনি কভারের জন্য ২০০ টাকা নেন।

শুরু হলো আমার অন্তহীন ঘোরাঘুরি। কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে যাই, তিনি একটা তারিখে আসতে বলেন। সেই তারিখে যাই, তিনি আরেকটা তারিখ দেন। ধৈর্যে আমি রবার্ট ব্রুসকে হার মানালাম। হাঁটাহাঁটি করতে করতে আমার স্বাস্থ্য ভালো হয়ে গেল। কভারের দেখা নেই।

একদিন খান সাহেব বললেন, আমি যাব আপনার সঙ্গে। আমি অন্য এক সূত্রে তাকে চিনি। সেটা উল্লেখ করে যদি কিছু হয়। আপনি পোলাপান মানুষ বলে উনি আপনাকে পাত্তা দিচ্ছেন না। আমি একজন বয়স্ক মানুষ।

গেলাম খান সাহেবকে নিয়ে। ঘণ্টাখানেক বসে রইলাম। কাইয়ুম চৌধুরীর বসার ঘরে না। বসার ঘরের বাইরে ছোট্ট একটা ঘরে। কাইয়ুম চৌধুরী খবর পাঠালেন, তিনি একটা ডিজাইন নিয়ে বিশেষ ব্যস্ত। ডিজাইনটা শেষ হলেই আসবেন। আরও দশ-পনেরো মিনিট লাগবে।

দশ-পনেরো মিনিট পরও কাইয়ুম চৌধুরী বের হলেন না। ভয়ালদর্শন এক কুকুর বের হয়ে খান সাহেবের পা কামড়ে ধরল। আমি খান সাহেবকে কুকুরের হাতে ফেলে রেখে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম।

 

কলম জাদুকরের উৎসর্গপত্র

শুধু গল্প, উপন্যাসেই পাঠককে বুঁদ করে রাখতেন না হুমায়ূন আহমেদ, বইয়ের উৎসর্গপত্রগুলোতেও থাকত নানা গল্প...

বই : রূপার পালঙ্ক

একবার একজন লেখক আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। আমাদের তিন কন্যা যে যেখানে ছিল, লেখকের নাম শুনে উঠে চলে এলো। আমার মেজো মেয়ে বলল, এত বড় লেখকের সামনে সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার না-কি পা ঝিমঝিম করছে। আমি তখন লেখককে দেখছিলাম না, মুগ্ধ হয়ে আমার তিন কন্যার উচ্ছ্বাস দেখছিলাম।

সেই লেখকের নাম—

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

বই : দেখা না-দেখা

নিষাদ হুমায়ূন, তুমি যখন বাবার লেখা এই ভ্রমণ কাহিনী পড়তে শুরু করবে তখন আমি হয় তোবা অন্য এক ভ্রমণে বের হয়েছি। অদ্ভুত সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কাউকেই জানাতে পারব না। আফসোস!

বই : তিন বিচিত্র

আমার একজন কার্ডিওলজিস্ট বন্ধু আছেন, তার কাছে যখনি যাই তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন, ‘আপনার তো দিন শেষ।’ কোনো ডাক্তারকে এত সহজে দিন শেষের কথা বলতে আগে শুনিনি। আমি মুগ্ধ!

প্রফেসর বরেন চক্রবর্তী

ভালোমানুষেষু

বই : হিমুর আছে জল

একজন মানুষকে চেনা যায় যুদ্ধক্ষেত্র এবং ছবির আউটডোর শুটিং-এ। নিষাদের প্রিয় দাড়িওয়ালা মামাকে।

তারিক আনাম খান।

বই : কালো জাদুকর

জুয়েল আইচ

জাদুবিদ্যার এভারেস্টে যিনি উঠেছেন। এভারেস্ট জয়ীরা শৃঙ্গ বিজয়ের পর নেমে আসেন।

ইনি নামতে ভুলে গেছেন।

বই : রাক্ষস খোক্কস এবং ভোক্ষস

নিষাদের পাঁচতলার চাচি এবং মোটু চাচুকে (এই দুজন মনে করেন নিষাদ

মানব সন্তান না, দেবশিশু। মনে হয় এদের মাথায় কোনো সমস্যা আছে।)

সর্বশেষ খবর