বৃহস্পতিবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

মালয়েশিয়ায় আবার মাহাথির

রণক ইকরাম

মালয়েশিয়ায় আবার মাহাথির

৯২ বছর বয়সে মাহাথির

মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে নতুন করে মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন দেশটির কিংবদন্তি নেতা মাহাথির মোহাম্মদ। আগস্টে দেশটির আসন্ন নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর পদে তার প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছে বিরোধী দলগুলোর জোট। আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ৯২ বছর বয়সী মাহাথির শুধু নির্বাচনেই আসছেন না, জোট বেঁধেছেন রাজনৈতিক শত্রু হিসেবে পরিচিত আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে। ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা মাহাথির এবারও নির্বাচিত হলে বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণ প্রধানমন্ত্রী হবেন তিনি। মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিম একসময় পরস্পরের ঘোর বিরোধী ছিলেন। সে হিসেবে শত্রুও বলা যেতে পারে। একজন আরেকজনের নাম পর্যন্ত শুনতে পারতেন না। ইব্রাহিমকে দেখা হতো মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে এক উদীয়মান তারকা হিসেবে। কিন্তু তাদের মধ্যকার এই বিরোধে গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে আনোয়ার ইব্রাহিমকে উপপ্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর বলাৎকার ও ঘুষ গ্রহণের মতো জঘন্য অভিযোগে তাকে জেলে পাঠানো হয়। তারপর বিরোধী রাজনৈতিক একটি জোটের নেতৃত্ব দেন ইব্রাহিম। ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিস্ময়কর বিজয় পান এই আনোয়ার ইব্রাহিম। ওই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হন নাজিব রাজাক। পরে ২০১৪ সালে বলাৎকারের অভিযোগে অভিযুক্ত করে জেলে পাঠানো হয় আনোয়ার ইব্রাহিমকে। তার বিরুদ্ধে বলাৎকারের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় রাজনৈতিক পদ ব্যবহারের অযোগ্য ঘোষণা করা হয় তাকে। একইসঙ্গে অযোগ্য ঘোষণা করা হয় পরবর্তী নির্বাচনেও। কিন্তু ২০১৫ সালের জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ তহবিল ওয়ান মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বারহাদের (ওয়ানএমডিবি) অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। এর জেরে নাজিবের পদত্যাগের দাবিতে বিরোধীদের আন্দোলনে শরিক হন মাহাথির মোহাম্মদ। গঠন করেন পারতি প্রিবুমি বারসাতু মালয়েশিয়া (পিপিবিএম)। ক্ষমতাসীন বারিসান ন্যাশনাল পার্টিকে পরাজিত করতে পরে গত বছর বিরোধীদের সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক জোটে যোগ দেন। এতে করে সবার ভরসার জায়গা হিসেবে আবারও পরিগণিত হন তিনি। এখন সেই জোটের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে মাহাথির মোহাম্মদের নাম ঘোষণা করা হলো। এর মধ্য দিয়ে তাদের জোট চায় নির্বাচনে বিজয় অর্জন করতে। যদি সেটা করা যায় তাহলে আনোয়ার ইব্রাহিমের ক্ষমতায় ফেরা এবং পরে কোনো একসময় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ তৈরি হবে। যদি নির্বাচনে বিরোধীরা বিজয়ী হয় তাহলে তারা সময় ক্ষেপণ না করে আনোয়ার ইব্রাহিমকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় রাজকীয় ডিক্রি আদায়ের চেষ্টা করবে। এমন ডিক্রি জারি হলে আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে আর কোনো বাধা থাকবে না। বিরোধীদলীয় জোটের এক সম্মেলনে সেক্রেটারি হিসেবে জেনারেল সাইফুদ্দিন আবদুল্লাহর নাম ঘোষণা হয়। বিরোধীদলীয় জোটের উপপ্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হবেন আনোয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী ওয়ান আজিজা ওয়ান ইসমাইল।

 

 

দারিদ্র্যের স্বর্গরাজ্য

যে গল্পের হিরো ডা. মাহাথির মোহাম্মদ, সেই গল্পের শুরুটা কিন্তু অন্য আট-দশটি দুনিয়া পাল্টানো গল্পের মতোই সাদামাটা। বদলে ফেলার জন্য চাই জীর্ণশীর্ণ একটা অবয়ব। সেই অবয়বকে আমূল পাল্টে ফেলাটাই একজন শিল্পী কিংবা স্বপ্নদ্রষ্টার কাজ। মাহাথির সেই স্বপ্নদ্রষ্টা। আর মাহাথিরের স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু আজকের আধুনিক মালয়েশিয়া। কিন্তু আলো ঝলমলে যে আধুনিক মালয়েশিয়া আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে, সেই চোখ ধাঁধানো কী আগে থেকেই ছিল? ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। এই মালয়েশিয়া আসলে রূপকথার সফল বাস্তবায়নেরই প্রতিচ্ছবি।

একসময়ের মালয়েশিয়া ছিল দারিদ্র্যপীড়িত একটি অগোছালো রাষ্ট্র। শুধু কি দরিদ্রতা? দরিদ্রতার পাশাপাশি নিরক্ষরতা আর পশ্চাদমুখিতার কারণে অর্থনীতির ভঙ্গুর দশা কাটানোর কোনো উপায়ই বলতে গেলে ছিল না। এরপর পাল্টানোর গল্পটাও কিন্তু একদিনের নয়।

টেংকু আবদুর রহমান প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহুধাবিভক্ত দেশটিতে রোপণ করেন ঐক্যের বীজ। ঐক্যের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করে দেশ পরিবর্তনের যে ধারার সূচনা তিনি করেছিলেন তা তার উত্তরসূরি আবদুল রাজ্জাক, টোয়াংকু ইসমাইল এবং ডা. মাহাথির বিন মোহাম্মদ ধরে রেখেছিলেন। এর মধ্যে শেষোক্তজন কেবল ধারা বজায় রেখেই ক্ষান্ত হননি। তার নীতি আদর্শ আর দেশ পরিচালনার জাদুস্পর্শে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন অন্য সবাইকে। তিনি আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ও রূপকার হিসেবে পৃথিবীতে নন্দিত হয়েছেন। মূলত মাহাথির মোহাম্মদের হাত ধরেই দারিদ্র্যপীড়িত মালয়েশিয়া পৌঁছে যায় স্বপ্নিল সাফল্যের বিশ্বে। স্বাধীনতার সময় যে মালয়েশিয়ার অধিকাংশ জনসমষ্টি ছিল বেকার অথবা অর্ধবেকার, মাত্র দুই দশকে নিজের দেশের বেকারত্ব ঘুচিয়ে সেই মালয়েশিয়ায় কর্মরত রয়েছেন বিদেশের লাখ লাখ কর্মী। স্বাধীনতার সময় এমনকি পরবর্তী সময়েও যে মালয়েশিয়া প্রায় প্রকম্পিত হয়েছে নিম্নস্তরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়, সেই মালয়েশিয়া আজ রূপান্তরিত হয়েছে একটি সুস্থ, নিরাপদ, উদার, কল্যাণমুখী জনপদে।

কিন্তু মাহাথির মোহাম্মদ এবং পূর্বসূরিদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। মাহাথির অতীতকে স্মরণে রেখে বর্তমানকে সাজিয়েছেন এবং বর্তমানকে সাজানোর সময় ভবিষ্যেক সুস্পষ্টভাবে মনে রেখেছেন।

 

নিম্নমধ্যবিত্তের একজন

ডা. মাহাথির মোহাম্মদের জন্ম ১৯২৫ সালের ১০ জুলাই মালয়েশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর অ্যালোর সেটরে। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সেখানকারই একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে। পিতা মোহাম্মদ ইস্কান্দারের নয় সন্তানের মধ্যে মাহাথির ছিলেন সবার ছোট। মাহাথিরের পিতা প্রথম জীবনে একজন সাধারণ স্কুলশিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি একজন সরকারি অডিটর হিসেবে কাজ করেছেন।

তার পিতা ছিলেন অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ একজন মানুষ। শৃঙ্খলা এবং গুছিয়ে চলার যে সহজাত গুণ মাহাথিরের পরবর্তী জীবনে খুঁজে পাওয়া যায়, সেটি তিনি তার পিতার কাছ থেকে পেয়েছেন বলেই ধারণা করা হয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে মাহাথির ছোটবেলা থেকেই দারুণ সুশৃঙ্খল জীবন পালন করেছেন। মাহাথিরের মা সাধারণ গৃহিণী হলেও তিনি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। ছোটকাল থেকেই তিনি মাহাথিরকে বাসায় পবিত্র কোরআন শিক্ষা দিতেন।  মাহাথিরের সাধারণ জীবন দেখে বোঝার উপায় ছিল না এই ছেলে একদিন বিশ্ব কাঁপাবে। তবে ছোটবেলা থেকেই তিনি মেধাবী ছিলেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

 

চট্টগ্রামের মাহাথির!

মাহাথির সম্পর্কে লিখতে গেলে প্রসঙ্গের শেষ নেই। কিন্তু বাংলাদেশি হিসেবে লিখতে গেলে তার সম্পর্কে মজার একটি বিষয় না লিখলেই নয়। এ তথ্যটি হয়তো অনেকেরই অজানা। চট্টগ্রাম জেলার উত্তরাংশে রাঙ্গুনিয়া উপজেলাধীন চন্দ্রঘোনা ও কাপ্তাইগামী সড়কের সামান্য পূর্বে কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম মরিয়মনগর। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এ গ্রামের এক যুবক ব্রিটিশ শাসিত মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান।

তিনি ছিলেন জাহাজের নাবিক। মালয়েশিয়ায় অ্যালোর সেটর গিয়ে এক মালয় রমণীর সঙ্গে সম্পর্কে আবদ্ধ হন। তাদের ঘরেই জন্ম নেয় মোহাম্মদ ইস্কান্দার। আর এই মোহাম্মদ ইস্কান্দারের ছেলে সন্তান হিসেবে জন্ম নেন মাহাথির।  সে হিসেবে চট্টগ্রাম হচ্ছে মাহাথিরের পূর্বপুরুষের দেশ।

 

শিক্ষা জীবনের শুরুতে

মাহাথির তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন সেবেরাং পেরাক মালয় স্কুলে। কিন্তু তিনি চাইতেন ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করতে। সমস্যা হলো, ইংরেজরা মালয় ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে সহজে সুযোগ দিত না। ভর্তি পরীক্ষা হতো খুবই কঠিন। তাই মালয় ছেলেমেয়েদের জন্য সুযোগ পাওয়া ছিল দুঃসাধ্য। সেই ছোটবেলাতেই তিনি এ বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথমদিকে স্থান করে নেন। আলোর সেতারের গভর্নমেন্ট ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন মাহাথির।

বাসায় তাদের একজন ধর্ম শিক্ষক ছিলেন যিনি প্রতিদিন বাড়িতে এসে পবিত্র কোরআন, ইসলাম ধর্মের ওপর বিশ্বাস এবং ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান শেখাতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালে জাপান মালয়েশিয়া আক্রমণ করে। তখন সেখানকার ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে একটি জাপানি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। মাহাথিরের বয়স তখন মাত্র ১৬। প্রথমে তিনি জাপানি স্কুলে যেতে চাননি। ওই সময় মাহাথির একটি স্থানীয় ছোট বাজারে কলা বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু পিতার চাপে তিনি পরবর্তীতে ওই জাপানি স্কুলে ভর্তি হন।  মালয়েশিয়ায় জাপানি শাসন প্রায় তিন বছর স্থায়ী ছিল। ১৯৪৭ সালে তিনি সিঙ্গাপুরের কিং এডওয়ার্ড মেডিসিন কলেজে ভর্তি হন এবং চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া ফিরে আসেন।

 

রাজনীতির বীজ কৈশোরেই

অন্য আট-দশজন মেধাবী যেখানে রাজনীতি আর রাষ্ট্রীয় ঝুট-ঝামেলা থেকে বিরত থাকতে চান, সেখানে ব্যতিক্রম ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। তার রাজনৈতিক আগ্রহের পরিচয় মিলেছিল সেই কিশোর বয়সেই। মাহাথিরের বয়স যখন ২০ বছর তখনই রাজনীতির সিংহ দরজায় কড়া নেড়ে ওঠেন তিনি। সমমতো আর একই আদর্শের অনুসারী সহপাঠীদের একত্র করে তিনি গোপনে ‘মালয়ান ইউনিয়ন’ প্রস্তাবের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জাপানিরা চলে যাওয়ার আগে তৎকালীন মালয়েশিয়াকে তারা থাই সরকারের শাসনাধীনে হস্তান্তর করে। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা আবার ফিরে আসে এবং ‘মালয়ান ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠা করে। মালয়ান ইউনিয়ন সত্যিকার অর্থে সম্পূর্ণ উপনিবেশ ছিল। আর এটারই প্রতিবাদে মাঠে নামেন মাহাথির ও তার বন্ধুরা। তারা তখন রাতের অন্ধকারে সারা শহরে রাজনৈতিক বাণী সংবলিত পোস্টার লাগাতেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সীমিত, ‘মালয়ান ইউনিয়ন’ প্রস্তাবের সমাপ্তি এবং প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা ফিরে পাওয়া। সাইকেল চালিয়ে তারা সমগ্র প্রদেশ ঘুরে ঘুরে জনগণকে ব্রিটিশবিরোধী হিসেবে সংগঠিত ও সক্রিয় করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। সংগঠনে মাহাথির সাধারণত সম্পাদক বা দ্বিতীয় অবস্থানটা বেছে নিতেন, কারণ দ্বিতীয় ব্যক্তিকেই বেশি সাংগঠনিক কাজ করতে হয় ও অন্য দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়।  মাহাথির প্রথম কেদাহ মালয় যুব ইউনিয়ন এবং পরে কেদাহ মালয় ইউনিয়ন নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যা পরবর্তীতে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন বা ইউএমএনও হিসেবে পরিচিত হয়।

 

সিঙ্গাপুরে ছাত্রনেতা

মাহাথিরের সিঙ্গাপুর জীবন খুব বেশি বর্ণিল ছিল না। কিন্তু সেখানে রাজনীতি না হলেও সাংগঠনিক নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন ঠিকই। সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন মাহাথির সেখানের কলেজের মালয় ছাত্রদের নিয়ে ‘মালয় ছাত্র সংগঠন’ গঠন করেন। তবে এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের শিক্ষার মান ও ফলাফল উন্নয়ন করা। এর কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না।

 

মেধার স্বাক্ষর

মেধাবী ছাত্র হিসেবে মাহাথিরের পছন্দের বিষয় ছিল আইনবিদ্যা; কিন্তু সরকার তাকে পরামর্শ দেয় ডাক্তার হওয়ার। তাই তিনি সিঙ্গাপুরের কিং এডওয়ার্ড সেভেন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। স্কুলে এবং মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় তিনি একটি ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন এবং পত্রিকায় লিখতেন। উল্লেখ্য, মেধাবী ছাত্র মাহাথির খুব সহজেই বৃত্তি পেয়ে যান। এখানে উল্লেখ করার মতো আরও একটি বিষয় রয়েছে। সেটি হচ্ছে ১৯৪৭ সালে সিঙ্গাপুরের মেডিকেল কলেজে মাহাথিরসহ মাত্র সাতজন মালয় শিক্ষার্থী ছিলেন। পরবর্তীতে এক সময় মেধাবী মাহাথির পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসেন নিজ দেশ মালয়েশিয়ায়। ফিরে আসার পরই আসলে নিজের জীবনের বাঁক পরিবর্তন করেন তিনি। 

 

বর্ণিল কর্মজীবন এবং রাজনীতি

মাহাথির সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আসেন ১৯৫৩ সালে। সেখান থেকে ফিরে তিনি একজন চিকিৎসক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার ঠিক আগে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। তবে চিকিৎসা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঠিকই। তখন তিনি তার নিজের নিজ শহর অ্যালোর সেটরে মাহা-ক্লিনিক নামে একটি প্রাইভেট ক্লিনিক শুরু করেন। শহরের পাঁচটি প্রাইভেট ক্লিনিকের মধ্যে এটি একমাত্র মালয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্লিনিক ছিল। তিনি রোগীদের বাড়িতে যেতেন এবং মাঝে মাঝে ছোটখাটো অস্ত্রোপচার করতেন। একজন ডাক্তার রোগীকে পর্যবেক্ষণ করেন, স্বাস্থ্যগত ইতিহাস রেকর্ড করেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন, ল্যাব পরীক্ষা করেন এবং চূড়ান্তভাবে রোগ নির্ণয় করেন। এ প্রক্রিয়াটি রাজনীতির মতোই।’ ১৯৭৪ সালে মন্ত্রী হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি চিকিৎসা পেশা অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি ১৯৬৪ সালে কোটা সেটর দক্ষিণ এলাকা থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হলে কী হবে? তিনি তার দলের অনেক নীতির সঙ্গে একমত হতে পারেননি। ১৯৬৯ সালে তিনি একটি বই লেখেন, যার নাম The maloy dilima বা মালয়ীদের উভয় সংকট। বইটি নিষিদ্ধ করা হয়।

১৯৬৯ সালের ৩০ মে কুয়ালালামপুরে চীনা ও মালয় জাতির মধ্যে তুমুল দাঙ্গার জন্য মাহাথির ইউএমএনও নেতৃত্বকে দোষারোপ করে প্রধানমন্ত্রী টেংকু টুংকু আবদুর রহমানকে খুব কঠিন ভাষায় একটি চিঠি লেখেন ও তাকে পদত্যাগের পরামর্শ দেন। এ সমালোচনায় পার্টি নেতৃবৃন্দের দলীয় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মাহাথিরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি তখন আবার তার পেশায় ফিরে গেলেও অনেক ঘটনার পর ১৯৭২ সালের ৭ মার্চ পার্টিতে আবার ফিরে আসেন। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালের নির্বাচনে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়ে শিক্ষামন্ত্রী হন। শিক্ষামন্ত্রী হয়ে তিনি ঘোষণা দেন তার নামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা যাবে না। এই ধারা তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েও অব্যাহত রাখেন। তার কোনো ছবি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা সরকারি অফিসে টাঙানো যাবে না বলেও তিনি নির্দেশ দেন। মালয়েশিয়াকে বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা সংস্কার হচ্ছে মাহাথিরের প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। ১৯৭৫ সালে মাহাথির পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তুন হোসেন ওই দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে তিনি দেশের উপ-প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথকেও সুগম করেন। ১৯৮১ সালের ১৬ জুলাই ৫৫ বছর বয়সে ডা. মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একটানা ২২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ৭৭ বছর বয়সে ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ও রাজনীতি থেকে বিদায় নেন। ৯২ বছর বয়সে তিনি ফের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামছেন।

সবচেয়ে ব্যতিক্রমী প্রধানমন্ত্রী

ডা. মাহাথির মোহাম্মদকে কেবল সফল বললেই চলবে না। তিনি নীতি ও আদর্শে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী প্রধানমন্ত্রী বলতেই হবে। মাহাথির নিজের নাম লেখা ব্যাজ পরতেন। আধুনিক মালয়েশিয়ার বাস্তবায়নে দেশেই গাড়ি তৈরি ও বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে নিউ ইকোনমিক পলিসি সফলভাবে বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন। এনইপির উদ্দেশ্য ছিল জাতি নির্বিশেষে দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নতুন সম্পদ সৃষ্টি করা। ২০ বছর মেয়াদি এনইপি শেষ হওয়ার পর ১০ বছর মেয়াদি ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তার আমলে নিজের নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের নামকরণ একদমই নিষিদ্ধ ছিল।

 

 

মালয়েশিয়ার কাণ্ডারি

মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দল পর পর পাঁচবার সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। তিনি এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এক সময়ের অনুন্নত মালয়েশিয়াকে উন্নত বিশ্বের তালিকায় এনেছেন মাহাথির মোহাম্মদ। এশিয়ার এই নন্দিত নেতা বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন। এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের গণতান্ত্রিক এ প্রধানমন্ত্রী ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন। ততদিনে মালয়েশিয়ার চেহারাও পাল্টে যায়। কোন ম্যাজিকে এটা সম্ভব জানতে চাইলে সাক্ষাৎকারে মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, কোনো ম্যাজিক বা ফর্মুলা নয়, মালয়েশিয়ার মানুষের সমন্বিত চেষ্টায় আজ এ অবস্থান সম্ভব হয়েছে।

রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর মাহাথিরের আগ্রহ ছিল সুগভীর। তাই একটি জাতির উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। সরকারি নীতি এবং বেসরকারি বিনিয়োগের মাঝে তিনি একটি সমঝোতা এবং সখ্য গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর বেসরকারিকরণ মালয়েশিয়ার দ্রুত শিল্পায়নে সহায়ক হয়েছে। তিনি সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ আর সহযোগিতায় বেসরকারি খাতকে লাভজনক করতে মালয়েশিয়ান বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মাহাথির সব বিষয় পুনঃপরীক্ষা করেন। সব নীতি, পদ্ধতি, সরকার চালাতে প্রাত্যহিক সব কাজ, আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়। তার সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ওয়ার্ক-ফ্লো চার্ট আর অফিস ম্যানুয়েল প্রবর্তন করেন। মাহাথির ও তার সরকার দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি তৈরি করেন যার মাধ্যমে প্রত্যেকে তার নিজ নিজ ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়। ব্যবসা এবং রাজনীতিতে ফুটপাথের লোক থেকে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পর্যন্ত দেশের জন্য নিজের জন্য কাজ করবে। ২২ বছরের শাসনকালে মালয়েশিয়াকে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য পুরোদস্তুর তৈরি করে ভিশন-২০২০ এর দ্বারপ্রান্তে দেশকে রেখে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছিলেন। জাতির উন্নয়ন প্রতীক হয়ে তিনি মালয়ীদের মনে স্বপ্ন সমৃদ্ধির বীজ বুনে দিলেন। চোখে দিলেন ভবিষ্যৎ মালয়েশিয়ার ছবি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর