শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

অভিশপ্ত কোহিনুর হীরা

তানভীর আহমেদ

অভিশপ্ত কোহিনুর হীরা

ইতিহাস সমৃদ্ধ এক রত্ন। হীরা। তার নাম কোহিনুর। এটি ডিম্বাকৃতির  শ্বেত হীরা। বর্তমান ওজন ১০৫ ক্যারেট (২১.৬ গ্রাম) বা ৩১৯ রতি। প্রাথমিকভাবে ওজন ছিল ৭৫৬ ক্যারেট। শাহজাহানের রাজদরবারে  কোহিনুরের ওজন পরীক্ষা করা হয়। ফরাসি রত্ন ব্যবসায়ী তাভারনিয়ার যাচাই করে দেখেন, তার ওজন ২৬৮ ক্যারেটের সামান্য বেশি। ভেনিসের হীরক কর্তনকারী হরটেনসিও জর্জিস প্রথম অদক্ষ হাতে এ হীরা কেটে ফেলেন। এত বড় সর্বনাশ করায় সম্রাট শাহজাহান তাকে ১০ হাজার রুপি জরিমানা করেন। কোহিনুর কখনো ক্রয়-বিক্রয় করা হয়নি। এতে ৩৩টি পার্শ্ব রয়েছে। বিভিন্ন সময় হীরাটি হিন্দু, পারসি,  মুঘল, তুর্কি, আফগান, শিখ এবং ব্রিটিশ শাসকদের অধিকারে ছিল। স্যার ওলফের মতে, কোহিনুর মুঘলদের অধিকারে ছিল ২১৩ বছর, আফগানদের অধিকারে ছিল ৬৬ বছর এবং ২০১১ সাল নাগাদ ব্রিটেনের অধিকারে ১২৭ বছর। এ হীরা দ্বাদশ শতাব্দীতে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টার জেলার হিন্দু অধ্যুষিত সন্তোষনগর অঞ্চলে কল্লর গ্রামে কল্লর খনি থেকে উত্তোলন করা হয়। একইসঙ্গে কোহিনুরের যমজ দরিয়া-ই-নূর-ও উত্তোলন করা হয়। হিন্দুরা বিশ্বাস করে, অর্জুনের বাহুতে এ হীরাটি শোভা  পেত। তবে অন্যরা ঐতিহাসিক ভাষ্যকে সত্য বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে। অন্ধ্রপ্রদেশের কর্নুল ও অনন্তপুর  জেলা হীরক খনির জন্য খ্যাতি লাভ করায়  সেখানে এ ধরনের হীরা প্রাপ্তি অসম্ভব কিছু ছিল না।

পরবর্তীতে মালবের রাজপরিবারের কাছে কয়েক প্রজন্ম হীরাটি সংরক্ষিত ছিল। তবে কোহিনুর হীরা নিয়ে সবেচেয়ে বেশি আলোচিত মুঘল সাম্রাজ্য। মুঘল সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য হিসেবে এটা উপমহাদেশের মানুষের কাছে একটি পরিচিত নাম। কোহিনুর শব্দটি মূলত ফারসি শব্দ  কোহ-ই-নুর থেকে এসেছে। যার অর্থ পর্বতের আলো। অনেকে বলেন,  কোহিনুর, কাকাতিয়া রাজবংশের অধিষ্ঠিত দেবীমন্দিরে দেবীর চোখ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। যখন যে হীরাটির মালিকের ওপর জয়ী হয়েছে, হীরা তার দখলে চলে গেছে। বর্তমানে হীরাটি ব্রিটিশ রাজসম্পত্তির একটি অংশ হিসেবে গণ্য। এর পূর্বে মুঘল সম্রাটদের গৌরবের বিষয় ছিল কোহিনুর। মুঘলরাই এর নামকরণ কোহিনুর করে। ১৪ শতকের প্রথম দিকে তুর্কি রাজবংশের সেনারা অপহরণ ও লুটতরাজের জন্য দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে। ১৩১০ সালে আলাউদ্দিন খিলজির সেনাপতি মালিক কফুর, ওয়ারঙ্গলে একটি সফল অভিযান পরিচালনা করেন। কাকাতিয়া রাজ্য ও অন্যান্য দক্ষিণ ভারতীয় রাজপ্রাসাদ ও মন্দিরগুলো লুট করা হয়। যার মধ্যে কোহিনুরও ছিল। এরপর হীরাটি তুর্কি রাজবংশের কাছেই ছিল। এরপর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হতে হতে এটা দিল্লির সুলতানদের অধিকারে আসে। কিন্তু ১৫২৬ সালে তুর্কি-মুঘল যুদ্ধে তুর্কিরা পরাজিত হয়। জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় হীরাটি বাবরের দখলে চলে আসে। বাবর ও তার ছেলে সম্রাট হুমায়ুন দুজনেই এটিকে ‘বাবরের হীরা’ বলে পরিচিত করিয়েছেন। পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাহজাহানের হাতে আসার আগ পর্যন্ত হীরাটি মুঘল তোষাখানায় পড়ে ছিল। সম্রাট শাহজাহান, তার সুসজ্জিত ময়ূর সিংহাসনে হীরাটি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমগ্র ভারতবর্ষ দখল করে নিলে  কোহিনুরসহ ময়ূর সিংহাসন তাদের দখলে চলে যায়। কোম্পানি হীরাটি রানীকে ভেট হিসেবে প্রদান করে।

 

ব্রিটিশরা যেভাবে কোহিনুর চুরি করেছিল

রত্নালঙ্কার চুরি নতুন নয়। তবে কোহিনুর হীরা ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। অতিকায় এই হীরার দিকে নজর ছিল শাসকদের। তাই যুদ্ধজয় বা সিংহাসন পরিবর্তনের সঙ্গে কোহিনূরের মালিকানা পরিবর্তন ছিল উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে চুরি হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে দামি  কোহিনুর হীরা এখন ব্রিটিশ রাজপরিবারের অলঙ্কার ভাণ্ডারের অংশ। এই কোহিনুরের দাম প্রায় ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১,২০০ কোটি টাকা। সম্রাট শাহজাহানের আমলে এটি ছিল তার ময়ূর সিংহাসনে। ময়ূর সিংহাসনে খচিত থাকা কোহিনূর হীরাটি ব্রিটিশরা চুরি করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষ দখল করে নেওয়ার পর সরিয়ে ফেলে কোহিনুর। ময়ূর সিংহাসন থেকে  এটি চুরি করে ব্রিটিশরা। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ থেকে কোহিনুর চুরি করেছে এ নিয়ে বহু বছর ধরেই অভিযোগ রয়েছে। এই হীরার আসল মালিকানা শুধু ভারত নয়, আফগানিস্তান, ইরানও দাবি করেছে। ব্রিটিশদের চুরি করে নিয়ে যাওয়া সেই কোহিনুর ভারতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বারবার। তবে সববারেই তা ব্যর্থ হয়েছে। কোহিনুর  শোভিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ‘হীরার মুকুট’ ফিরিয়ে আনতে ‘মাউন্টেন অব লাইট’ নামক একটি দল ইতিমধ্যেই লন্ডন হাই কোর্টে মামলা দায়েরের জন্য আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছিল। মাউন্টেন অব লাইটের পক্ষের আইনজীবী দলটির দাবি, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ১০৫ ক্যারেট হীরার ওই  কোহিনুরটি চুরি করে নিয়ে যায় ব্রিটিশ শাসকরা। এ কারণে তারা যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে ওই  কোহিনুরটি ফেরত দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। তবে সেই দাবি ধোপে টেকেনি। যুক্তরাজ্য কোহিনুর হীরা ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়নি।

 

হীরার অভিশাপ

হীরার অভিশাপ নিয়ে মিথ রয়েছে বহু বছর ধরে। কোহিনুর ছাড়াও হোপ ডায়মন্ড নিয়েও অভিশাপের গল্প প্রচলিত রয়েছে। হীরার অভিশাপগুলোর মূলে রয়েছে ইতিহাস। যে এই হীরা পেয়েছে সেই হারিয়েছে জীবন, সাম্রাজ্য। কোহিনুর হীরা নিয়ে কথিত আছে, এটিও কোনো হিন্দু দেবীর মন্দিরে খচিত ছিল। সম্রাট বাবরের স্বত্বাধিকারী ছিলেন। সিংহাসন থেকে বারংবার বিচ্যুত হয়েছেন তিনি। এরপর ছিল সম্রাট শাহজাহানের কাছে। ময়ূর সিংহাসনে বসিয়েছিলেন তিনি হীরাটি। ছেলে আওরঙ্গজেবের হাতে সিংহাসনচ্যুত হন তিনি। ভিয়েতনামে হীরাটি কেটে ছোট করা হয়।

এরপর অনেক শাসকের কাছে যায় হীরাটি এবং প্রত্যেকেরই পরিণতি হয় করুণ। সিংহাসন নিয়ে রক্তারক্তি, খুন হয় প্রায় সব রাজ পরিবারেই। ১৮৫০ সালে হীরাটি ইন্ডিয়া থেকে চুরি করে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্রিটেনের রাজ পরিবারকে উপহার  দেয় এটি। হীরাটির অদ্ভুত বিষয়  খেয়াল করা হয় তখন। তা হলো এটির অভিশাপ শুধু পুরুষদের  বেলায় কাজ করে! ব্রিটিশ যে রাজাই এটা পরেছেন তারা সবাই তাদের ক্ষমতা হারিয়েছেন। তাই অবশেষে এর স্থান হয় রানী এলিজাবেথের মুকুটে। ১৮৬ ক্যারেটের হীরাটি এখন মুকুটের অংশ হিসেবে লন্ডন টাওয়ারে প্রদর্শিত হচ্ছে নিয়মিত। এই অভিশাপের ঘটনা তারপর থেকেই বাজারে ছড়িয়ে পড়ে এবং থিতু হয়। সামান্য রত্ন পাথর বলে একে এড়িয়ে যাওয়া হয় না। হীরার মতো মহামূল্যবান রত্ন পাথরের বেলাতেও সেই অভিশাপের কথা খাটে। ইতিহাস তাই বলে, কোহিনুর হীরার অভিশাপ পুরুষ শাসকদের জন্যই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর