১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন এক সময় বিশ্ব রাজনীতিতেও বিশাল প্রভাব ফেলে। বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো নিজ নিজ ভাবমূর্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঘটনার মূল্যায়ন করে থাকে। তাদের প্রতিক্রিয়া নির্ধারিত হয় ঘটনার গুরুত্ব বুঝে। এর মধ্যেই অনেক দেশ সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করে। কেউ কেউ আবার নীতিগত সমর্থন জানায়। যুদ্ধের মাঠ ও মাঠের বাইরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো দেশগুলো নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
যুদ্ধমঞ্চে বন্ধু ভারত
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে অনেকেই বলে থাকেন ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না থাকলে ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে— এটি অস্বীকারের উপায় নেই। বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের দেশে আশ্রয় দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধে সেনা সহায়তা দেওয়াসহ সব ধরনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহায়তা দিয়েছিল ভারত। ভারতের সামরিক বাহিনীর সহায়তায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে স্পষ্টভাবে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। আর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের পরই বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে ভারত রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও মতাদর্শগত কারণেই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তা করে। ভুটানের পর দ্বিতীয় বিদেশি রাষ্ট্র হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। উপমহাদেশের অন্যতম পরাশক্তি ভারতের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়ে দারুণ ভূমিকা রেখেছিল। তবে পূর্ণ বিজয় অর্জনের ১০ দিন আগেই ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল বাংলাদেশকে।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ওই দিন একটি চিঠি দিয়েছিলেন মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে। চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ভারত সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানান এবং ভারতের পার্লামেন্টে ওই দিন সকালে এ বিষয়ে তার বিবৃতির কথাও উল্লেখ করেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে লেখা ইন্দিরা গান্ধীর সেই চিঠি স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষের দিনগুলোয় মুজিবনগর সরকারকে তাৎপর্যপূর্ণ প্রেরণা জুগিয়েছিল। এর বাইরেও ভারতের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দান বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের ছিল। মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের শেষ দিক পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামরিক ব্যক্তিকে আশ্রয়দানের সুযোগ দেয়। কলকাতায় একটি প্রবাসী সরকার গঠনের ব্যবস্থা করে। এ ছাড়া পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য স্বল্প পরিমাণে সামরিক সহায়তা দিতে থাকে এবং মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার জন্য ভারত কূটনৈতিক প্রচারণা অব্যাহত রাখে।
মে মাসের শুরু থেকে জুনের শেষ পর্যন্ত এ সময়ে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করে। যার কারণে ভারতীয় সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি আন্দোলন নিয়ে ব্যাপকভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এ সময় ভারত পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সমর্থন দিতে থাকে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এ সময়ে ভারত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার প্রত্যাশিত সমাধানের জন্য কূটনৈতিক ও সামরিক প্রচেষ্টা জোরদার করে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েন করা হয়। ভারত কর্তৃক প্রেরিত তিনটি সৈন্য বহরের দুটি ছিল সপ্তম পদাতিক, একটি ছিল নবম পদাতিক যাদের ভারত পূর্ব বাংলার সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করে। এ সময় ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সব ধরনের সমর্থন দানে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে কার্যকর কূটনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন পায়।
৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বর এ সময় ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এই সহায়ক অংশগ্রহণের ফলশ্রুতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ার সমর্থন
ভারতের পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় মিত্রশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েতের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে তার প্রতিপক্ষ আমেরিকা ও চীনকে হীনবল করা সম্ভব হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে আশ্বাস দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র বা চীন যুদ্ধে সম্পৃক্ত হলে তারা এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়া সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাইন ও ধ্বংসাবশেষ অপসারণে রাশিয়ার অনেককে জীবন দিতে হয়েছে। কেবল আমাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধেই নয়, বাংলাদেশের পুনর্বাসন কাজেও সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আট দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৭১-এর ৩ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে লেখা সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোনির চিঠিটি দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। সে চিঠিতে শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের খবরে উদ্বেগ, শক্তি ব্যবহার না করে রাজনৈতিক পথেই সংকট মোকাবিলার পরামর্শ ও মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার কথা রয়েছে।
২৫ মার্চ গণহত্যার পর প্রথম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল ভারত। দ্বিতীয়টি সোভিয়েত ইউনিয়ন। এ অধ্যায়েই গণহত্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ারও উল্লেখ আছে। ইয়াহিয়ার কাছে পদগোনির চিঠি এবং ৬ এপ্রিল মার্কিন নীতি নিয়ে ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেট থেকে আর্চার ব্লাড ও তার অধস্তন ২০ সহকর্মীর পাঠানো প্রতিবাদপত্র হোয়াইট হাউসকে বিব্রত করে তুলেছিল। ব্লাড লিখেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন যেখানে গণতন্ত্র সুরক্ষা ও রক্তপাত বন্ধের আবেদন করেছে, সেখানে ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র তার নৈতিক প্রতিবাদটুকুও জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। একটি পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরোপে তার প্রভাব বলয়ের মতো এশিয়ায়ও প্রভাব বৃদ্ধি করতে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সামষ্টিক নিরাপত্তার ধারণাও এক্ষেত্রে কাজ করেছে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তান চীনের সহযোগিতা পাওয়াও তারা মেনে নিতে পারেনি। ১৯৬৭-৬৮ সালে পাকিস্তান, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একত্রিত হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি সাধারণ শত্রুতে পরিণত হয়। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের দুই প্রতিবেশী প্রতিপক্ষ চীন ও পাকিস্তান যাতে বাংলাদেশের যুদ্ধের মাধ্যমে কোনো ধরনের সুবিধা নিতে না পারে এ জন্য বাংলাদেশের যুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করে।
পাশে ছিল ভুটান ও নেপাল
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশটি ছিল একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ভুটান। ভুটান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। সরকার ছাড়াও তৎকালীন ভুটানের জনগণও বাংলাদেশের প্রতি তাদের নৈতিক সমর্থন জানায়। ১৯৭১ সালে একজন সমাজকর্মী হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন উগিয়েন তেসারিং যিনি বিদেশি বন্ধু হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা লাভ করেন। তিনি ছাড়াও ভুটানের আরও বেশ কিছু সমাজকর্মী এবং সংবাদমাধ্যম নৈতিকভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন জানিয়েছিল। ভুটানের এই স্বীকৃতি পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দারুণ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
ছোট রাষ্ট্র নেপালও এই সময় চুপচাপ ছিল না। তাদের জনগণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারিভাবে অংশগ্রহণ করে।
প্রথমত, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি অংশ গুর্খা রেজিমেন্ট। গুর্খারা মূলত নেপালি। এরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর হয়ে আমাদের যুদ্ধে অংশ নেয়। সেসব সৈন্যের এখনো অনেকে জীবিত আছেন এবং নেপালে বসবাস করছেন। অন্যদিকে ভারতে নির্বাসিত নেপালের কৈরালা পরিবার যুদ্ধে অংশ নেয়। তারা কিছু অস্ত্রও জোগাড় করেছিলেন। কিন্তু তারা পরে ভারতীয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণের অনুরোধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সেগুলো দিয়ে সাহায্য করেন।
যুক্তরাজ্যের ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বন্ধুর ভূমিকা পালন করে যুক্তরাজ্য। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যরা জোরালোভাবে বাঙালির স্বাধীনতার লড়াইকে সমর্থন জানান। শরণার্থীদের জন্য অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা দেয়। একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানাতে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রবাসী বাঙালিদের বড় একটি অংশ যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে। লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বাঙালিদের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট নাগরিকদের সমাবেশ হয় ১ আগস্ট ১৯৭১। ২৫ মার্চ রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত ঘটনার পর ব্রিটেন সরকার, গণমাধ্যম ও সে দেশের জনগণ চুপচাপ ছিল না। গণহত্যার কয়েক দিনের মধ্যেই হাউস অব কমন্স সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ২৯ মার্চ হাউস অব কমন্স সভায় ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ-বিষয়ক সচিব স্যার অ্যালেস ডগলাস হিউম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোয় দুঃখ প্রকাশ করেন এবং পাকিস্তানকে তাদের সামরিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করার আহ্বান জানান। এ ছাড়া ওই দিন হাউস অব কমন্স সভার আলোচনায় তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের নিরাপত্তার কথাও উত্থাপন করেছিলেন। ৫ এপ্রিল ১৯৭১ হাউস অব কমন্স সভার আলোচনায় ডগলাস হিউম ও অন্য সদস্যরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি প্রয়োগের তীব্র সমালোচনা করেন। হাউস অব কমন্স সভার সদস্যরা পাকিস্তান সরকারকে উদ্ভূত পরিস্থিতি মীমাংসায় রাজনৈতিক সমঝোতাকে বেছে নিতে অনুরোধ করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ও মানবেতর অবস্থার সংবাদ পেয়ে ব্রিটিশ কিছু এমপি নিজেদের উদ্যোগে পশ্চিম বাংলায় শরণার্থী শিবির ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মী ও সমব্যথী ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন রাসেল জন স্টোনহাউস। তিনি বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। হাউস অব কমন্স সভায় তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করবেই। স্বাধীনতা লাভ করতে তাদের অনেক মাস লাগতে পারে অথবা কয়েক বছর লাগতে পারে, কিন্তু আমার কাছে এটা অসম্ভব মনে হয় যে এক হাজার মাইল দূরের ৭৫ মিলিয়ন মানুষের একটি দেশে পাকিস্তান শাসন ধরে রাখতে পারবে, বিশেষ করে সেখানকার মানুষ যখন তা চাইছে না।’ এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবেও স্টোনহাউস বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী শিবিরে দুর্গত বাঙালিদের ত্রাণ দিয়ে সহায়তা করেছিল। ১৯৭১ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত শরণার্থীদের জন্য ব্রিটিশ সরকারের সহায়তার পরিমাণ ছিল এক কোটি ৪৭ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড। এ ছাড়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও ব্রিটিশ সরকার দুই মিলিয়ন পাউন্ড অর্থের ত্রাণ সহযোগিতা পাঠিয়েছিল।
ব্রিটিশ সরকার ছাড়াও বেসরকারিভাবে ব্রিটিশ জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিল। বাংলাদেশে নির্যাতন বন্ধে লর্ড সভার সদস্য লর্ড ফ্রেনার জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটিশ গণমাধ্যমের ভূমিকাও বেশ জোরালো ছিল। ব্রিটেনের ডেইলি টেলিগ্রাফ, গার্ডিয়ান, নিউ স্টেটসম্যান, টাইমস, ইকোনমিস্ট, সানডে টাইমস, অবজারভার, বিবিসিসহ বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য গণমাধ্যম মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যা, নির্যাতন ও বাঙালিদের দুর্দশা বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরে।
এগিয়ে এসেছিল জাপান
বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি জাপানি জনগণ ও সরকারের সমর্থন ছিল। এটি সম্প্রসারণের নেপথ্যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন জাপানের ডায়েটের প্রভাবশালী সদস্য হায়াকাওয়া। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, সে ব্যাপারে জাপান সরকারের উদ্বেগ প্রকাশ এবং বিশেষ করে জাপানি জনগণের প্রতিবাদ জানানোর প্রেক্ষাপট তৈরিতে সাংগঠনিক উদ্যোগ নেন হায়াকাওয়া। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাপানি মিডিয়ায় বিশেষ গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জাপানিদের সমর্থনের লক্ষ্যে জাপানের বুদ্ধিজীবী, শিল্প মালিক, শ্রমিক, ছাত্রসমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। সে সময়ে জাপান প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তানিদের সঙ্গেও একাত্ম হয়েছিলেন হায়াকাওয়া। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ টোকিওতে গঠিত প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন-জাপান, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জাপানি জনমত ও সমর্থন আদায়ে ভূমিকা রাখে। পরবর্তীতে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটে। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জাপানিদের সমর্থন জানাতে জাপানের বুদ্ধিজীবী, শিল্প মালিক, শ্রমিক, ছাত্রসমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে জাপান তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়। স্বীকৃতিদানের এক মাসের মধ্যে ঢাকায় জাপানি দূতাবাসের কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১৩-১৪ মার্চ হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের জাপানি সংসদীয় প্রতিনিধি দল প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসে। দেশে ফিরে ২৪ মার্চ প্রধানমন্ত্রী সাতোর কাছে প্রতিনিধি দল দুটি প্রস্তাব পেশ করে— বাংলাদেশকে ১০ মিলিয়ন ডলারের জরুরি অনুদান অবিলম্বে প্রদান এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের হিস্যা আদায়ে জাপানের মধ্যস্থতা। এই সুপারিশ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সাতোর নির্দেশে ২৮ মার্চ ১৯৭২ জাপান বাংলাদেশে প্রথম অর্থনৈতিক সার্ভে মিশন পাঠায়। ওই বছর ৬ জুন জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন এবং পরবর্তীতে জাপান-বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হলে হায়াকাওয়া তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়ে আমৃত্যু এর নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।
মিসর ও ইরাকের সমর্থন
মুসলিম এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মিসর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে। এর বাইরে ইরাকও বাংলাদেশকে সমর্থন করে।
বাংলাদেশের পক্ষে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের শরিক ভারতের অবস্থানকেই সমর্থন করেছে তারা।
সেই সূত্রেই গণহত্যার বিপরীতে অবস্থান ছিল মিসরের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী প্রথমদিকের রাষ্ট্রগুলোর একটি মিসর।
মিসরের মিডিয়ায়ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে লিখেছেন অনেকে।
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে কায়রোর আধা সরকারি সংবাদপত্র আল আহরামে সম্পাদক ড. ক্লোভিস মাসুদ ভারত থেকে শরণার্থীদের নিরাপদ এবং নিঃশঙ্কাভাবে দেশে ফেরার একটি ব্যবস্থা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাগিদ দেন। এর পাশাপাশি একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের কথাও বলেন।
আরও যত বন্ধু
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের অবদানও অনস্বীকার্য। বাংলাদেশে তখন পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞে বিশ্বনেতারাও নীরব ছিলেন না।
বিশ্বের আরও বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান যেমন- কিউবা, যুগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানি প্রভৃতি তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন এবং যুদ্ধকে সমর্থন করে। নানা রকম কর্মসূচি পালন করেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে।
লন্ডনে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত সংগীতশিল্পী জর্জ হ্যারিসন মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিশ্বজনমত সৃষ্টি ও দান সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে ৪০ হাজার লোকের সমাগমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডভিত্তিক গান পরিবেশন করেন।
অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান ও কানাডার প্রচার মাধ্যমগুলো পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে সাহায্য করে। তাদের একাত্ম ভূমিকা আমাদের যুদ্ধজয়ে অনুপ্রেরণা ও শক্তির অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করে।
মুক্তিযুদ্ধে ইরাক বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছিল, তবে বিশ্বের কোনো কোনো দেশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।