শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

মুঘল ই আজম (পর্ব ২)

রণক ইকরাম

মুঘল ই আজম (পর্ব ২)

বাবর পর্ব [খ]

ভারতবর্ষের সবচেয়ে ঐশ্বর্যমণ্ডিত সময় মনে করা হয় মুঘল সম্রাটদের শাসনামলকে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের পতনকে অনেকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন বললেও প্রকৃত অর্থে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। এর আগ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ বছরের বেশি সময় ভারতবর্ষ শাসন করেছেন মুঘলরা। যার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন ফারগানা ও সমরখন্দের অধিপতি বাবর। স্থাপত্যকলা, সমাজ সংস্কার, ঐশ্বর্যমণ্ডিত শাসন আর নানা কারণে মুঘল সম্রাটরা বরাবরই মানুষের কৌতূহলের শীর্ষে থেকেছেন। সেই মুঘল সম্রাটদের নিয়ে রকমারির শনিবারের বিশেষ ধারাবাহিক মুঘল ই আজম। প্রথম পর্বে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের উত্থান পর্ব জেনেছি। আজ ছাপা হলো এর পরবর্তী অংশ।

 

ব্যক্তি বাবর

ব্যক্তিজীবনে বাবরের দৃঢ়চিত্তের মানসিকতার কথা আগেই বলা হয়েছে। আবার বাবরের আত্মজীবনী বাবরনামায় তার আবেগী মানসিকতারও নান্দনিক উল্লেখ রয়েছে। বাবরের প্রথম স্ত্রী সালতান বেগমের কাছে অনেকটাই লাজুক ছিলেন বাবর। পরে অবশ্য এই স্ত্রীর প্রতি তার আগ্রহে ভাটা পড়েছিল। বিশ্বজুড়ে ইসলামী শাসক হিসেবে বাবর আলাদাভাবে পরিচিত। তিনি ব্যক্তিজীবনে একজন গোঁড়া সুন্নি মুসলিম ছিলেন। শিয়া মুসলমানদের বাবর খুব একটা পছন্দ করতেন না। শিয়াদের বাবর কখনো কখনো ‘তাদের বিচ্যুতি’ বলে অভিহিত করতেন।

বিজয়ী এবং শাসক হিসেবে বাবর সমকালীন অনেক শাসকের চেয়ে হাজারগুণ ভালোভাবে নিজের অভিনবত্ব দেখাতে সমর্থ হয়েছিলেন। তার জীবনে ধর্ম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছিল। তবে বাবরের তুলনায় তার সহযোগী রাজারা ইসলামকে হালকাভাবেই নিয়েছিলেন। বাবর তার সমকালীন এক কবির কবিতার একটি লাইন প্রায়ই আওড়াতেন। লাইনটি ছিল এরকম— ‘আমি মাতাল, আধিকারিক। আমাকে শাস্তি দিন যখন আমি সংযমী।’

তবে বাবরের মতো তার সহযোগী রাজাদের মধ্যে ধর্মের প্রগাঢ় বোধ ছিল অনুপস্থিত। বাবরের আত্মজীবনী অনুসারে সেই রাজারা প্রচুর মদ পান করতেন এবং প্রাচুর্যপূর্ণ জীবন-যাপন করতেন। ব্যক্তিগত জীবনেও তারা সৎ ছিলেন না। তারা বাজারের ছেলের সঙ্গে প্রেমে পড়েছিলেন এবং তারা হিংস্রতা ও নির্মমতায় ডুবন্ত ছিলেন।

সেই সময় সমাজে ভয়ঙ্করভাবে সমকামিতার প্রচলন ছিল। সমকামিতাকে সে সময় একটি গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে বাবর নিজেও এই পাপাচারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবে বাবর নিজে সমকামী ছিলেন কিনা এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়। যুদ্ধংদেহী বীর হলেও বাবর হিংস্র ছিলেন না। একাধিক যুদ্ধজয়ের পর বাবর সৈন্যদের লুটপাটের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। এই কারণে শুরুর দিকে বাবর অনেক সৈন্য হারিয়ে ছিলেন। এরপরও নিজের আদর্শচ্যুত হননি তিনি।

 

আফগানিস্তানের কেন্দ্রে

একপর্যায়ে কাবুল দখলের আশা ছেড়ে ফারগানা কিংবা সমরখন্দের দিকে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাবর। কিন্তু হিন্দুকুশ পেরিয়ে ভাগ্য পাল্টে গেল তার। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দখল নিলেন কাবুলের। অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা মনে করেন বাবরের কাবুল দখল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা। কারণ কাবুল দখল না করলে বাবর আর কখনই হিন্দুস্তানমুখী হতেন না। বরং দিনের পর দিন সমরখন্দ আর ফারগানার চেনা বৃত্তে ঘুরে বেড়াতেন। এমনকি বাবরের শাসনামলের শুরুর দিকে বাবর অনেকগুলো বছর সমরখন্দ আর ফারগানার পেছনেই কাটিয়ে দেন। কাবুলের উর্বর ভূমিতে জেঁকে বসলেন বাদশাহ উপাধি নেওয়া বাবর। বাবর তাঁর জীবনের ১০ বছরের বেশি সময় কাটিয়েছিলেন এই কাবুলে। বাবর তাঁর আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’য় কাবুলের ভৌগোলিক বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে— ‘এখানে পূর্বে লামঘানত, পেশোয়ার, হশতনগর ও হিদুস্তানের (হিন্দুস্তান) কিছু অংশ আছে। পশ্চিমে পর্বতমালা রয়েছে। এখানে হাজারা আর নিকুদারি উপজাতির লোকেরা বসবাস করে। উত্তরে হিন্দুকুশ পর্বতমালা একে অন্য দেশগুলোর সীমানা থেকে আলাদা করেছে। এখানে কুন্দুজ আর অন্দর-আব রাজ্য রয়েছে। দক্ষিণে ফার্মুল নগজ, বান আর আফগানিস্তান।’

কাবুল দখলের কিছুদিন পর বাবরের মা কুতলুগ নিগার খানম মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনা ১৫০৫ সালের জুনে। এর মধ্যেই বাবরের কাছে খোরাসানের সুলতান হুসাইন মির্জার একটি পত্র আসে। হুসাইন মির্জা উজবেকিস্তানের শায়বানি খানের বিরুদ্ধে একটি অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছিলেন। আর এক্ষেত্রে বাবরের সাহায্য চেয়েছিলেন হুসাইন মির্জা। কারণ হুসাইন মির্জা জানতেন এই উজবেকদের সঙ্গে বাবরের পুরনো শত্রুতা। কারণ উজবেকদের বাধার মুখে বারবারই ভাগ্য বিড়ম্বিত হচ্ছিলেন বাবর। ফলে দ্রুত হুসাইন মির্জার সাহায্য করতে উদ্ধত হলেন বাবর। যুদ্ধ করার জন্য বাবর যখন খোরাসানের দিকে রওনা করলেন তখনই ১৫০৬ সালের জুন মাসে বাবরের কাছে হুসাইন মির্জার মৃত্যু সংবাদ এসে পৌঁছল। দোটানায় পড়ে গেলেন বাবর। শেষ পর্যন্ত খোরাসানের দিকেই এগোলেন বাবর। ১৫০৬ সালের নভেম্বরে বাবর খোরাসান পৌঁছলে সুলতান হুসাইন মির্জার দুই পুত্র বদিউজ্জামান ও মুহাম্মদ মুজাফফর বাবরকে স্বাগত জানাতে এলো। কারণ হুসাইন মির্জার মৃত্যুর পর খোরাসানের মসনদের উত্তরাধিকারী ছিলেন এই দুই ভাই। বাবর ভেবেছিলেন তাদের সঙ্গে নিয়েই উজবেকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবেন। সেই আশায় বাবর তাদের সঙ্গে কিছুদিন খোরাসান অবস্থান করলেন।

কিন্তু সুলতান হুসাইন মির্জার প্রায় ৮০ বছরের শাসনামলে খোরাসান যেমন সমৃদ্ধ আর ঐশ্বর্যের জনপদে পরিণত হয়েছিল তেমনি তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। হুসাইন মির্জার কোনো পুত্রই আসলে সিংহাসনের যোগ্য ছিলেন না। রাজ্য পরিচালনা কিংবা সেনাবাহিনী গোছানোর চেয়ে তাদের মনোযোগ ছিল ভোগ বিলাসিতায়। ফলে রাজ্যের শান্তি উড়ে গেল দ্রুত। এদের বিশৃঙ্খল জীবন দেখে থমকে গেলেন বাবরও। তাই এদের সঙ্গে নিয়ে উজবেকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেন বাবর। ফিরে যেতে চাইলেন কাবুল। খোরাসান থেকে কাবুলের উদ্দেশে যাত্রা শুরুর পর গৌড়বন্দ নামক জায়গায় এলে হাজারা বিদ্রোহীরা বাবরের বাহিনীকে আক্রমণ করে বসে। কিন্তু তখন বাবরের বাহিনী অনেক শক্তিশালী ছিল। ফলে যুদ্ধে টিকতে না পেরে হাজারারা পালিয়ে যায়। বাবর এখানে প্রচুর সম্পদ অর্জন করেন। কাবুলের কাছাকাছি মিনার পাহাড়ে পৌঁছতেই দুঃসংবাদ এলো কাবুল দখল হয়েছে। বাবরের অনুপস্থিতিতে তারই চাচাতো ভাই মির্জা মুহাম্মদ হুসাইন আর মির্জা খান বিদ্রোহ ঘোষণা করে কাবুলের দখল নিয়ে নিয়েছে। ফলে কাবুল ফিরে গিয়ে নিজের রাজ্য নিজেই অবরোধ করলেন বাবর। খুব একটা বেগ পেতে হলো না সেখানে। অল্প কয়েকটি সংঘর্ষের পর মুহাম্মদ হুসাইন আর মির্জা খান পালিয়ে যান। ফলে কাবুল আবারও বাবরের হাতে ফেরত আসে।

 

হুমায়ুন এলেন

কাবুল যখন হস্তগত হয়, তখন বাবরের বয়স ছিল ২৩ বছর। এই ২৩ বছরে বাবর যেমন অনেক সংগ্রাম করেছেন, তেমনি অর্জনও কিন্তু কম ছিল না। কাবুল হাতছাড়া হওয়ার পর আবার পুনরুদ্ধার করেও বাবরের মনের ভিতর তেমন শান্তি ছিল না। কারণ বাবরের তখনো কোনো সন্তান ছিল না। মনে মনে নিজের একজন সন্তানের আশা করছিলেন বাবর। ‘বাবরনামা’র বর্ণনাতে ফখরুন নিসা নামের একজন কন্যা সন্তানের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু জন্মের মাত্র এক মাস পরেই সে মারা যায়। এই কন্যার মায়ের নাম ছিল আয়েশা সুলতানা। তিনি খোরাসানের সুলতান হুসাইন মির্জার কন্যা ছিলেন। সন্তানের আশায় অস্থির বাবরের স্বস্তি আসে ১৫০৮ সালের ৬ মার্চ। সেদিনই বাবর পুত্রসন্তানের বাবা হন। বাবর তার পুত্রের নাম রাখলেন হুমায়ুন। পুরো নাম রাখা হলো নাসির উদ্দীন মুহাম্মদ হুমায়ুন। তবে শৈশবে হুমায়ুনকে ‘সুলতান হুমায়ুন খান’ আর ‘শাহ-ই-ফিরুজ কাদির’ নামেও ডাকা হতো। হুমায়ুনকে পেয়ে বাবর যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিলেন।

 

আবার সমরখন্দে

এর মধ্যেই খবর এলো বাবরের চিরশত্রু উজবেক নেতা শায়বানি খান নিহত হয়েছেন। ১৫১০ সালে পারস্যের শাহ ইসমাইলের সঙ্গে পরাজয়ের পর শায়বানি খানকে হত্যা করা হয়। এটা ছিল বাবরের জন্য অনেক বড় খুশির খবর। শায়বানি খানের মৃত্যুর পর বাদশাহ বাবর আবারও সমরখন্দের দিকে এগিয়ে গেলেন। শাহ ইসমাইলের সহায়তায় ১৫১১ সালে বাবর সমরখন্দ পুনরুদ্ধারে সমর্থ হলেন। একই বছর বাবর বুখারা জয় করে নেন। তবে সমরখন্দে বাবরের অবস্থা একটু খারাপের দিকে চলে গেল। পারস্যের শাহ ইসলাম ছিলেন শিয়া মুসলিম। সমরখন্দ দখলে বাবর পারস্যের শিয়াদের সমর্থন নেওয়ায় স্থানীয় লোকদের সমর্থন হারালেন বাবর। সমরখন্দের লোকজন রীতিমতো বাবরকে ঘৃণা করতে শুরু করে। ঠিক এই কারণে সমরখন্দের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিগড়ে গেল। জনগণের সমর্থন হারানো বাবর উবায়দুল্লাহর কাছে যুদ্ধে হেরে আবারও সমরখন্দ হাতছাড়া করলেন।

 

হুমায়ুন রাজা হলেন

১৫০৯ সালে বাবরের আরেকটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় কামরান। কামরানের মায়ের নাম গুলরুখ বেগম। ১৫১৯ বাবর আরও একজন পুত্র সন্তানের পিতা হন। দিলদার বেগমের গর্ভে জন্ম নেওয়া এই সন্তানের নাম রাখা হয় হিন্দাল। হিন্দাল শব্দটির মানে ‘হিন্দুস্তান বিজেতা’। বাবর তখন বাজুর অভিযানে ছিলেন। বাজুর আক্রমণের পর এক প্রকার প্রতিরোধ ছাড়াই বাবর বাজুর দখলে নেন। এর ঠিক পরপরই পাশের রাজ্য ভিরা দখল করে নেন বাবর। সমরখন্দ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর বাবর নিজের সাম্রাজ্য বাড়ানোর জন্য পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিলেন। সে কারণেই পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো দখলে নিয়ে নিজের শক্তি-সামর্থ্য বাড়াচ্ছিলেন। ভিরা দখলের পরপরই বাবরের কাছে খবর এলো বাদাখশানের শাসক মির্জা খানের মৃত্যু হয়েছে। বাবর জানতেন বাদাখশানের পাশেই একটি শক্তিশালী উজবেক সেনাদল ওতপেতে বসেছিল। মির্জা খানের নাবালক পুত্র শাহজাদা মির্জা সুলায়মান উজবেকদের মোকাবিলা করতে পারবেন না। বাদাখশান উজবেকদের দখলে চলে গেলে বিপদ হবে বাবরেরই। শেষে মির্জা সুলায়মানের মাতা এবং বাদাখশানবাসীদের সম্মতিতে বাবর বাদাখশানের দায়িত্ব নিলেন। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া সব সম্পত্তি মির্জা সুলায়মানকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে রাজকীয় মর্যাদা আর প্রয়োজনীয় ভূখণ্ডের জায়গির করা হলো তাকে। বাবরের প্রতিনিধি হিসেবে বাদাখশানের শাসনভার অর্পণ করা হলো মির্জা হুমায়ুনের কাছে। বাদাখশানের দায়িত্ব নেওয়ার সময় মির্জা হুমায়ুনের বয়স হয়েছিল ১৩ বছর। এ নিয়ে খানিক দ্বিধা থাকলেও সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি বাবর। কারণ প্রায় একই বয়সে ফারগানার অধিপতি হয়েছিলেন বাবর। তখনতো পিতাও ছিলেন না। পিতার অনুপস্থিতিতেও বাবর সিংহাসনে চড়তে পারেন, তাহলে পিতার উপস্থিতি সত্ত্বেও কেন পারবেন না হুমায়ুন?

 

পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর