বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

গান্ধী পরিবারের ট্র্যাজেডি

তানিয়া তুষ্টি

গান্ধী পরিবারের ট্র্যাজেডি

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে গান্ধী পরিবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। একই পরিবার থেকে দীর্ঘ সময় ভারত শাসন করেছেন তারা। কংগ্রেস সভানেত্রী মা ইন্দিরা গান্ধী ও ছেলে রাজীব গান্ধী তিন মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক নেতা ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জনপ্রিয়তা ছিল বিশ্বজোড়া। এই মহান নেতাকে নির্মমভাবে গুলি করে মেরে ফেলেন তারই দেহরক্ষী সতওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিং। মা মারা যাওয়ার পর রাজীব গান্ধীকেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাকেও বোমা বিস্ফোরণে হত্যা করা হয়। বাদ পড়েনি ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী। তার অকাল মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিমান দুর্ঘটনার কথা বলা হলেও তিনিও নির্মম ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। গান্ধী পরিবারের এই ট্র্যাজেডি নিয়ে আজকের আয়োজন।

 

দেহরক্ষীর গুলিতেই চলে যায় ইন্দিরার প্রাণ

ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর আততায়ীর গুলিতে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের এই শীর্ষ নেত্রীর মৃত্যু হয়। এ সময় তিনি ছিলেন তার নয়াদিল্লির ১ নম্বর আকবর রোডের অফিসের কাছের ১ নম্বর সফদর জং রোডের বাসভবনে। ব্রিটিশ অভিনেতা পিটার উস্তিনভকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য যাওয়ার পথে সকাল ৯টা ২০ মিনিটের সময় তিনি খুন হন। তিনি যখন বাসভবনের বাগানের একটি পথ দিয়ে সতওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিংয়ের প্রহরাধীনে উইকেট গেট (বিশেষ কোনো বড় দরজার পাশে বা ভিতরে থাকা ছোট দরজা) দিয়ে বের হচ্ছিলেন, তখন তারা ইন্দিরার ওপর গুলি ছোড়ে। সাব-ইন্সপেক্টর বেয়ান্ত সিং তার সাইড আর্ম থেকে তিনটি গুলি ছোড়েন ইন্দিরার পেটে। এরপর তিনি মাটিতে পড়ে গেলে সতওয়ান্ত সিং স্টেনগান থেকে ৩০ রাউন্ড গুলি ছোড়েন। গুলি করার পর উভয়ই নিজের অস্ত্র হাত থেকে ছুড়ে ফেলেন। তখন বেয়ান্ত সিং বলেন, ‘যা করার ছিল, আমি তা করে ফেলেছি, তুমি যা করতে চাও কর’। পরবর্তী ৬ মিনিটের মধ্যে ইন্ডো-তিব্বতান বর্ডার পুলিশের রমেশ সিং জামওয়াল ও রাম শরণ বেয়ান্ত সিংকে ধরে একটি আলাদা কক্ষে নিয়ে হত্যা করে। কারণ বেয়ান্ত সিং এ কক্ষের এক কর্মকর্তার কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। অপরদিকে গান্ধীর অন্যান্য দেহরক্ষী সতওয়ান্ত সিংকে গ্রেফতার করে। তার সঙ্গে পালাতে যাওয়া অপর একজনও আটক হন। পরবর্তীতে অন্যান্য অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে ১৯৮৯ সালে ফাঁসি দেওয়া হয় দিল্লির তেহার জেলে।

১৯৮৪ সালের জুনের প্রথমদিকে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে পাঞ্জাবের অমৃতসরে শিখদের স্বর্ণমন্দিরে পরিচালিত হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ নামে সামরিক অভিযান। এ অভিযানে স্বর্ণমন্দিরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলে। বলা হয়ে থাকে, সে অভিযান ইন্দিরা সরকারের প্রতি শিখ সমাজকে ব্যাপকভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। অনুমান করা হয়, সে সূত্রেই সৃষ্ট ক্ষোভের জেরেই ইন্দিরা গান্ধী খুন হন। ইন্দিরা গান্ধীর সেক্রেটারি আর কে ধাওয়ানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ইন্দিরার পাহারা থেকে শিখ সদস্যদের সরিয়ে দিতে। আর কে ধাওয়ান তা উপেক্ষা করেন। কারণ বেয়ান্ত সিং ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর খুবই প্রিয় দেহরক্ষী। তাকে তিনি চিনতেন ১০ বছর ধরে। ঘটনার সময় অন্য খুনি সতওয়ান্ত সিংয়ের বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। ঘটনার মাত্র পাঁচ মাস আগে তাকে ইন্দিরার প্রহরী নিয়োগ করা হয়। ইন্দিরা গান্ধীর পুরো নাম ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী নেহরুে। জন্ম ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর একমাত্র সন্তান তিনি। মেয়েকে উচ্চ শিক্ষার জন্য অক্সফোর্ডে পাঠান বাবা নেহেরু। সেখানে সহপাঠী ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে গড়ে ওঠে ইন্দিরার। ১৯৪২ সালের মার্চে তাদের বিয়ে হয়। ফিরোজ গান্ধীকে বিয়ে করার পরই ইন্দিরা নেহেরু হয়ে যান ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সময় তিনি তার বাবার অতিমাত্রিক কেন্দ্রীভূত প্রশাসনের চিফ অব স্টাফ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৯ সালে নির্বাচিত হন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। ১৯৬৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর তাকে বাবার উত্তরাধিকার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী পদের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ইন্দিরা গান্ধী তা গ্রহণে অস্বীকার করে ক্যাবিনেট মিনিস্টারের পদ বেছে নেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৬ সালে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর উত্তরাধিকারী হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। অভাবনীয় গুণাবলীর অধিকারী ও মেধাসম্পন্ন রাজনীতিক ইন্দিরা গান্ধী প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় জনতা চালায় শিখবিরোধী দাঙ্গা। এ দাঙ্গায় কমপক্ষে আট হাজারের মতো লোক নিহত হয়। শুধু দিল্লিতেই নিহত হয় তিন হাজার। দাঙ্গায় সরকারি কর্মকর্তারাও জড়িয়ে পড়েন। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর ছেলে রাজীব গান্ধী হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই তিনি বলেছিলেন, ‘বড় গাছ যখন পড়ে, তখন মাটি কাঁপে’।

 

ষড়যন্ত্রে মৃত্যু সঞ্জয় গান্ধীর

ষড়যন্ত্রের শুরু ১৯৮০ সালে নয়, বহু বছর আগে থেকেই। সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যু ভারতের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে রহস্যময় ঘটনা। সঞ্জয় গান্ধীর বিমান দুর্ঘটনার আগেই তিনবার হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল।

 

২৩ জুন ১৯৮০ সালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন ইন্দিরা গান্ধীর ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী। কিন্তু এই দুর্ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলেই দেখা হয়নি কখনো। পরিচালিত তদন্ত বলে, এটি বিমান দুর্ঘটনা তবে এর পেছনে থাকা বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ্যে আসেনি। তবে তার মৃত্যুর গোপন রহস্যের বেশির ভাগই অনুমান। পরে অবশ্য রহস্যের তেমন প্রমাণও পাওয়া যায়নি। তখনকার তদন্ত এটি প্রমাণ করে যে, সঞ্জয় গান্ধীকে কোনো মহল অপসারণ করতে চেয়েছিল। আর এই ষড়যন্ত্রের শুরু ১৯৮০ সালে নয়, বহু বছর আগে থেকেই। সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যু ভারতের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে রহস্যময় ঘটনা। সঞ্জয় গান্ধীর বিমান দুর্ঘটনার আগেই তিনবার হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি অবস্থায় সঞ্জয় গান্ধীকে হত্যার প্রচেষ্টা চলছিল। এ সময় এক প্রচেষ্টায় উত্তরপ্রদেশের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রাইফেল ব্যবহার করা হয়েছিল। এ সময় সঞ্জয়ের প্রতি ক্ষোভের কারণ হিসেবে উঠে আসে তার গাড়ি ব্যবসা। নিজের ব্যবসাকে চাঙ্গা করতে টাকা তুলতে শুরু হয় জোরজবরদস্তি, ব্ল্যাকমেইলিং ইত্যাদি। জরুরি অবস্থার পর তা সাংঘাতিক রূপ নেয়। জনপথের ব্যবসায়ীদের ভয় দেখানো হয়েছিল। মূলত এগুলোই সঞ্জয়ের প্রতি ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন দূতাবাস তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটি রিপোর্ট জমা দেয়। সেখানে তথ্য আসে, সঞ্জয় গান্ধী অজ্ঞাত হামলাকারীদের দ্বারা হত্যার হুমকিতে ছিল। জরুরি সময়ের মধ্যে, তিনটি প্রচেষ্টার মধ্যে একটি পরিকল্পিত দল তৈরি করা হয়েছিল। ৩০ বা ৩১ আগস্ট সঞ্জয় গান্ধীকে তিনবার গুলি করা হয়। কিন্তু ঘাতক বড় ধরনের আঘাত ছাড়াই পালিয়ে যায়। যদিও এতে সঞ্জয় গান্ধী কিছুটা আহত হয়েছিলেন। ভারতীয় গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, সঞ্জয় গান্ধীর জীবনের তৃতীয় হত্যা প্রচেষ্টা হলো বৈদেশিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত। ১৯৭৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার রাজ্য বিভাগে একটি টেলিগ্রাফ জরিপে উল্লেখ করা হয়, সঞ্জয় গান্ধীর ওপর ইউপি হত্যার চেষ্টার কথা উল্লেখ করে এই ঘটনার বিষয়ে তথ্য দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত আক্রমণকারীরা বাইরের শক্তি দ্বারা পরিচালিত বিপ্লবীদের ওপর দোষারোপ করে। তখন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ক্ষমতায় থাকলেও মামলা তদন্তের জন্য কোনো প্রচেষ্টা করা হয়নি। পরবর্তীতে কংগ্রেস সব অভিযোগ অস্বীকার করে। ১৯৭৭ সালে কংগ্রেস সরকার পরাজিত হওয়ার পর, ক্ষমতায় এসে জনতা পার্টি যে রিপোর্ট দেয় তাতে সঞ্জয় গান্ধীর হত্যা প্রচেষ্টা সম্পর্কিত কোনো তথ্য নেই।

 

বিস্ফোরণে রাজীব গান্ধীর মৃত্যু

সে রাজীবকে অভিবাদন জানায়। তারপর তার পা স্পর্শ করার অজুহাতে পোশাকের নিচে বাঁধা আরডিএক্স ভর্তি বেল্টটি ফাটিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণে প্রাণ হারান সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকে। হত্যার দৃশ্যটি এক স্থানীয় সাংবাদিকের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল। কিন্তু সেই সাংবাদিক আর বেঁচে...

 

ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যা করা হয় ১৯৯১ সালের ২১ মে। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের শ্রীপেরামবুদুরে এক আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণে তিনি নিহত হন। রাজীব গান্ধীর জন্ম ১৯৪৪ সালের ২০ আগস্ট। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর বড় ছেলে। ভারতের ইতিহাসে  হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনা রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। এই বিস্ফোরণে রাজীব ছাড়াও আরও চৌদ্দ জন নিহত হয়েছিলেন। রাজীব গান্ধীকে হত্যা করেন তেনমোঝি রাজারত্নম নামে লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম বা এলটিটিই-এর এক নারী সদস্য।

বিরোধী দলের নেতা থাকাকালীন ১৯৯০ সালে সানডে ম্যাগাজিনের ২১ আগস্ট সংখ্যায় রাজীব গান্ধী সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরবর্তী নির্বাচনে যদি প্রধানমন্ত্রিত্ব পান তাহলে শ্রীলঙ্কায় আবার ইন্ডিয়ান শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো হবে। এই সাক্ষাৎকার প্রকাশ হওয়ার পরই লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম মরিয়া হয়ে উঠে রাজীব গান্ধীকে হত্যা করার জন্য। এলটিটিই দেখেছিল যে, রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে ইন্ডিয়ান শান্তিরক্ষী বাহিনী এসে যোগ দেবে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর সঙ্গে। তখন তাদের যুদ্ধ কঠিন হয়ে যাবে। এরই সঙ্গে যোগ হয়েছিল আগের পুষে রাখা অন্যান্য ক্ষোভ। রাজীব গান্ধীর মা ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় এলটিটিইকে সমর্থন দিয়েছিলেন। এলটিটিইর জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ পেত ইন্ডিয়ান গোয়েন্দাদের কাছে। ইন্দিরা গান্ধী মারা যাওয়ার পর রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হন। সে সময় এলটিটিই বেশ লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছিল। ইন্ডিয়ান অফিসিয়ালদের তোয়াক্কা করত না তারা। তার ওপর ‘গেরিলা মনোভাব’ ও ‘তামিলদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বীজ’ বপন করা শুরু করেছিল ভারতের তামিলনাড়ুতে বসবাসকারী তামিলদের মধ্যেও। এই পরিস্থিতিতে রাজীব গান্ধীর প্রশাসন তাদের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এতেও এলটিটিই নেতা প্রভাকরণের ঔদ্ধত্য না কমলে ইন্ডিয়ান শান্তিরক্ষী বাহিনী লাগাম টেনে ধরে। এলটিটিই এটিকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখে। তাই তারা চাচ্ছিল বদলা নিতে।

১৯৯১ সালের ২১ মে চেন্নাই (তদানীন্তন মাদ্রাজ) শহর থেকে ৩০ মাইল দূরে শ্রীপেরামবুদুর শহরে রাজীব গান্ধীর শেষ জনসভাটির আয়োজন করা হয়েছিল। এখানেই এলটিটিই জঙ্গি তেনমোঝি রাজারত্নমের আত্মঘাতী বোমার হামলায় নিহত হন রাজীব। তেনমোঝি রাজারত্নমের অপর নাম ছিল ধানু। পরবর্তীতে আত্মঘাতী বোমারুর প্রকৃত নাম জানা যায় গায়ত্রী।

হত্যার দুই ঘণ্টা আগে রাজীব চেন্নাই শহরে উপস্থিত হন। একটি সাদা অ্যাম্বাসেডরের কনভয়ে তিনি যাত্রা করেন জনসভার উদ্দেশে। গাড়ি থেকে নেমে সভামঞ্চের উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করেন। সেখানে তার বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। এ সময় অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী, কংগ্রেস দলীয় সমর্থক ও স্কুলের ছাত্রছাত্রী তাকে মালা পরিয়ে স্বাগত জানাচ্ছিলেন। রাত দশটা দশ মিনিটে হত্যাকারী ধানু তার দিকে এগিয়ে যায়। সে রাজীবকে অভিবাদন জানায়। তারপর তার পা স্পর্শ করার অজুহাতে পোশাকের নিচে বাঁধা আরডিএক্স ভর্তি বেল্টটি ফাটিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণে প্রাণ হারান সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকে। হত্যার দৃশ্যটি এক স্থানীয় সাংবাদিকের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল। সেই ক্যামেরা ও তার ফিল্ম ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু সেই সাংবাদিক আর বেঁচে ছিলেন না, নিজেও সেই বিস্ফোরণে মারা যান। বিস্ফোরণস্থলটি এখন সাতটি স্তম্ভ পরিবেষ্টিত। এই সাতটি স্তম্ভ মানবিক মূল্যবোধের প্রতীক হয়ে ভারতীয় জনগণকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। ঘটনাস্থলে নির্মিত রাজীব গান্ধী স্মারকটি বর্তমানে এই ছোট শিল্পশহরটির অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ।

 

ট্র্যাজেডিই তাদের ইতিহাস

ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধীর বাম পাশে বড় ছেলে রাজীব গান্ধী ও ডান পাশে ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী। রাজনৈতিক কারণে তিনজনকেই নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে। ভারতের রাজনীতিতে তিনজনই ছিলেন অন্যতম নীতি-নির্ধারক। কংগ্রেস সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধী ভারতকে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। অত্যন্ত বিচক্ষণ এই রাজনীতিবিদ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তার কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেন। ১৯৮৪ সালের জুনের প্রথমদিকে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে পাঞ্জাবের অমৃতসরে শিখদের স্বর্ণমন্দিরে পরিচালিত হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ নামে সামরিক অভিযান। এ অভিযানে স্বর্ণমন্দিরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলে। বলা হয়ে থাকে, সে অভিযান ইন্দিরা সরকারের প্রতি শিখ সমাজকে ব্যাপকভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ধারণা করা হয়, অমৃতসরের শিখ সম্প্রদায়ের দমন থেকে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারই দেহরক্ষী সতওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিং। অথচ এই বেয়ান্ত সিংকে তিনি ভীষণ স্নেহ করতেন। ১৯৯১ সালের ২১ মে, চেন্নাইয়ের শ্রীপেরামবুদুর শহরে রাজীব গান্ধীর শেষ জনসভাটির আয়োজন করা হয়েছিল। এখানেই এলটিটিই জঙ্গি তেনমোঝি রাজারত্নমের আত্মঘাতী বোমার হামলায় নিহত হন রাজীব। তেনমোঝি রাজারত্নমের অপর নাম ছিল ধানু। পরবর্তীকালে আত্মঘাতী বোমারুর প্রকৃত নাম জানা যায় গায়ত্রী। ১৯৮০ সালের ২৩ জুন বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন ইন্দিরা গান্ধীর ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী। কিন্তু এই দুর্ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলেই দেখা হয়নি কখনো। পরিচালিত তদন্ত বলে, এটি বিমান দুর্ঘটনা তবে এর পেছনে থাকা বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ্যে আসেনি। 

সর্বশেষ খবর