রবিবার, ৬ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইতিহাসের মহানায়ক কার্ল মার্কস

সাইফ ইমন

ইতিহাসের মহানায়ক কার্ল মার্কস

যখন পুঁজিবাদের জয়জয়কার তখন কার্ল মার্কস দেখিয়েছিলেন সমাজব্যবস্থার অসঙ্গতিগুলো। পুঁজিপতি এবং শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে যে শ্রেণি-বৈষম্য তার দিকে আঙ্গুল তুলেছেন তিনি। পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি সম্পত্তি মাত্র এক শতাংশ পুঁজিপতির দখলে থাকার নির্মম সত্য তিনি জানিয়ে গেছেন অবলীলায়। শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ-কষ্ট, হাহাকার, দরিদ্রের কষাঘাতের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আজীবন কাজ করেছেন তিনি।  এই দার্শনিককে নিয়ে আজকের রকমারি—

 

পৃথিবীকে যিনি দেখেছিলেন ভিন্ন দৃষ্টিতে

দুনিয়াটাকে পরিবর্তিত করার লক্ষ্য নিয়ে মার্কস তার মতবাদ প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হয়েছিলেন।  তাই বিপ্লবী তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবী সংগ্রাম সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। কমিউনিস্ট লিগ, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলা ও তা পরিচালনায় তিনি ছিলেন কর্ণধার। শ্রমিক শ্রেণিকে সংগঠিত করা ছিল তার সমগ্র জীবনের লক্ষ্য। কার্ল মার্কস দেড়শ বছরেরও বেশিকাল পৃথিবীর সর্বাধিক আলোচিত ব্যক্তিত্ব।

১৮৪১ সালে মার্কস বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে ‘এপিকিউরাসের’ দর্শন সম্বন্ধে একটি ‘থিসিস’ তৈরি করেন। এ সময়ে মার্কস হেগেলের মতবাদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ‘বামপন্থি হেগেলীয়’ চক্রে অংশ নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষে মার্কস ‘বন’ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু সরকার মার্কসকে তা হতে দিল না। তিনি দমে যাননি। সেই সময় কোলনের একটি পত্রিকায় মার্কস নিয়মিত লিখতে লাগলেন। এভাবেই এক সময় ১৮৪২ সালে মার্কস ওই পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হলেন। মার্কসের সম্পাদনায় এই পত্রিকার বিপ্লবী গণতান্ত্রিক মনোভাব পরস্ফুিট হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে পত্রিকাটি জনগণের সমর্থন পেতে শুরু করে। জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে সরকার এই পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। তখন মার্কস সম্পাদকের দায়িত্ব ত্যাগ করেন।

১৮৪৩ সালের শরৎকালে তিনি প্যারিসে যান একটি পত্রিকা প্রকাশের জন্য। একজন বামপন্থি হেগেলীয় আর্নল্ড রির্ডজের সাহায্যে প্যারিস থেকে মার্কস পত্রিকাটির একটিমাত্র সংখ্যাই প্রকাশ করেন। কারণ পত্রিকার কপিগুলো জার্মানিতে গোপনে প্রচার করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। একসময় রির্ডজের সঙ্গে তার মতপার্থক্য দেখা দেয়। ১৮৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস প্যারিসে আসেন এবং তখন থেকেই মার্কসের সঙ্গে তার গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। দুজন মিলে প্যারিসে তদানীন্তন বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং সংগ্রামে লিপ্ত হন। এই সংগ্রাম হলো শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে এই পৃথিবীর বুকেই সুস্থ পৃথিবীর স্বপ্ন রচনার সংগ্রাম। তারা দুজনে তখনই সর্বহারার বিপ্লবী সমাজতন্ত্রবাদের তত্ত্ব ও কৌশল রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। সংগ্রামে নিয়োজিত তাদের শিক্ষক, পথপ্রদর্শক, অনুপ্রেরণার উৎস হলেন কার্ল মার্কস ও তার শিক্ষা। সেই সময় দুনিয়ার সব শোষকের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন কার্ল মার্কস ও মার্কসবাদ। তবে কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, প্রায় দেড়শ বছর ধরে সমগ্র পৃথিবীকে সর্বাধিক আলোকিত করেছে মার্কসবাদ। মার্কসের আজীবন সহযোগী ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে তিনি মার্কসীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মতবাদই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতবাদ হিসেবে পরিচিত। এই মতবাদ শূন্য থেকে সৃষ্ট নয়। মানব সভ্যতার অগ্রগতির যে রাজপথ সেই রাজপথ থেকেই উদ্ভূত হলো বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতবাদ।

মার্কসবাদের প্রধানত তিনটি উৎস। উনবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে জ্ঞান ভাণ্ডারের বিপুল অগ্রগতি হয়েছিল। তৎকালীন বিশ্বে জ্ঞানের এই তিনটি ক্ষেত্রই মার্কসীয় মতবাদের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। দর্শন, অর্থনীতি ও শ্রেণি-সংগ্রামের তত্ত্ব— এই তিনটি অঙ্গ নিয়ে মার্কসবাদ। বামপন্থিরা মনে করে ‘মানব সমাজের অগ্রগতির ধারায় পুঁজিবাদের পতন ঘটে সমাজতন্ত্র কায়েম হবেই। মানব সমাজ সাম্যবাদের দিকে এগিয়ে যাবেই। এটা অবধারিত। মার্কসীয় মতবাদ হলো বিজ্ঞান। সেই বিজ্ঞানই আমাদের শিখিয়েছে, সমাজের এই বৈপ্লবিক রূপান্তর সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সব শোষিত-বঞ্চিত মানুষের সম্মিলিত বৈপ্লবিক সংগ্রামের মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে। দেশে দেশে পরিচালিত হবে এই বিপ্লবী সংগ্রাম।’

মার্কসীয় দর্শন শুধু বস্তুবাদই নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সম্মিলিত শ্রমের শক্তি গড়ে ওঠে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদনের নৈরাজ্য, সংকট, বাজারের জন্য প্রতিযোগিতা এবং জনসাধারণের ব্যাপক অংশের মধ্যে জীবনধারণের অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। মার্কসীয় মতবাদ অনুযায়ী সব নৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বচন ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতির পেছনে কোনো না কোনো শ্রেণির স্বার্থ রয়েছে। শোষক শ্রেণির স্বার্থ এবং শোষিত শ্রেণির স্বার্থ। মার্কসের কাছে জ্ঞান গতিশীল। মার্কস কখনো মতবাদকে আপ্তবাক্য হিসেবে মনে করেননি।  গতিশীল মানব সমাজে জ্ঞানের বিকাশও অবধারিত। তাই চূড়ান্ত জ্ঞান বলে কিছুই হয় না।

 

মার্কসবাদ

মার্কসবাদ কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক অনুশীলন ও সামাজিক তত্ত্ব।  মার্কসবাদের মর্মবস্তু মার্কস নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন, ‘দার্শনিকরা এতকাল নানাভাবে দুনিয়াটাকে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু আসল কথা হলো একে পরিবর্তিত করা।’ শোষণহীন উন্নততর পৃথিবী গড়ার মতাদর্শ হলো মার্কসবাদ। সমগ্র দুনিয়ার মেহনতী মানুষের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হাতিয়ারও বলা হয়ে থাকে এই মার্কসবাদকে। এই তত্ত্বে সামাজিক পরিবর্তনের দ্বান্দ্বিকতা ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে সামাজিক দ্বান্দ্বিক ও শ্রেণি-সম্পর্ককে ভিত্তি করে সমাজ বিশ্লেষণের বিশ্বদর্শন ও প্রক্রিয়া বয়ান করা হয়েছে। মার্কসবাদী প্রক্রিয়াকে পদ্ধতিগত অর্থনৈতিক পরিবর্তনে শ্রেণি-সংগ্রামের ভূমিকা এবং পুঁজিবাদের বিকাশের সমালোচনা ও বিশ্লেষণে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক-রাজনৈতিক জিজ্ঞাসা ও প্রয়োগে ব্যবহার করা হয়। প্রায়োগিক বিবেচনায় মার্কসবাদ হচ্ছে মালিক শ্রেণির শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন তথা মজুরি-দাসত্ব থেকে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির মতবাদ। এটি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও বৈপ্লবিক ক্রিয়ার সামগ্রিক রূপ। উনিশ শতকের জার্মান দর্শন, ইংরেজি অর্থশাস্ত্র এবং ফরাসি সমাজতন্ত্রে বৈধ উত্তরাধিকার এই মার্কসবাদ। হেগেলের দর্শন, অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডোর অর্থনীতি তত্ত্ব এবং উনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে মার্কস  সমাজের সমালোচনা করে চিন্তার সুসঙ্গত বহিঃপ্রকাশ ঘটান।

 

তার ব্যক্তিজীবন

কার্ল মার্কস ১৮১৮ সালে জার্মানির ট্রিয়র শহরে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। জন্মের সময় হাইনরিশ মার্কসের নাম ছিল Herschel Mordechai, তার বাবার নাম Levy Mordechai (১৭৪৩-১৮০৪) এবং মা’র নাম Eva Lwow (১৭৫৩-১৮২৩)। জন্মসূত্রে ইহুদিদের পণ্ডিত সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও জার্মান সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য মার্কসের বয়স যখন মাত্র ছয় বছর তখন তার পুরো পরিবারই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। কার্ল মার্কস ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা করেন। বাল্যপাঠ ও স্নাতক শেষ করার পর ইউনিভার্সিটি অব বন-এ আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তার ইচ্ছা ছিল সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে পড়া, কিন্তু তার বাবা মনে করতেন কার্ল স্কলার হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবে না।

বিরক্ত হয়ে তার পিতা তাকে কঠিন অনুশাসনের বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তিনি শ্রেণি ব্যবস্থা এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে অবিশ্বাসীদের ছোট একটি বুদ্ধিজীবীর দলে যোগ দেন। দলটির নাম কমিউনিস্ট পার্টি। এই দলের একজন গোপন সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সময় জেনি ভন নামের এক অভিজাত মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন কার্ল মার্কস। সে সময় মার্কস জীবন নিয়ে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন। তার লেখার ভাষা ছিল বাবার কাছ থেকে পাওয়া ধর্মতাত্ত্বিক তথা অতিবর্তী ঈশ্বরবাদের ভাষা। ১৮৪১ সালে মার্কস পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার পিএইচডি বিষয় ছিল ‘প্রকৃতি সম্বন্ধে দেমোক্রিতোসীয় ও এপিকুরোসীয় দর্শনের মধ্যে পার্থক্য’। উল্লেখ্য, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ তিনি বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা না দিয়ে ইউনিভার্সিটি অব জেনাতে জমা দেন। কারণ তরুণ হেগেলিয়ান র‌্যাডিকেল হওয়ার কারণে বার্লিনে তার ভাবমূর্তি ভালো ছিল না। রাজনৈতিক কারণে জার্মানি থেকে পালাতে হয় তাদের। পরবর্তীতে লন্ডনে বসবাস শুরু করেন তারা। ১৮৪৮ সালে ইউরোপ জুড়ে প্রচুর বিপ্লব সংঘটিত হয়। মার্কসকে বন্দী করা হয় এবং পরবর্তীতে বেলজিয়াম থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরই মধ্যে বিপ্লবীরা ফ্রান্সের রাজা লুই-ফিলিপকে রাজি করিয়ে মার্কসকে প্যারিসে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে। রাজার আমন্ত্রণেই তিনি প্যারিসে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় প্যারিসে জুন ডেইস আপরাইজিং নামে পরিচিত বিপ্লবটি সংঘটিত হয়, যা মার্কস প্রত্যক্ষ করেন।

 

আজও তিনি প্রাসঙ্গিক

হাসান তারিক চৌধুরী, আইনজীবী 

দুনিয়া কাঁপানো দার্শনিক কার্ল মার্কসের জন্মের ২০০ বছর হয়ে গেল। এত বছর পরও তিনি এখনো দুনিয়াকে কাঁপানোর ক্ষমতা রাখেন। তার চিন্তাধারার অনুসারীরা দুনিয়ার কোথাও না কোথাও এখনো দুনিয়াকে কাঁপাচ্ছে। হয় ব্যালটে না হয় বুলেটে।  পাশের দেশ নেপালই তো এর বড় উদাহরণ। আর দক্ষিণ আমেরিকা! সে তো প্রতিদিন মার্কসকে প্রতিধ্বনিত করছে। স্লোগানে বিপ্লবে। দার্শনিক কার্ল মার্কসকে তার অনুরাগীরা বছরজুড়ে স্মরণ করবে, বিশ্লেষণ করবে। বাংলাদেশে, ভারতে, পাকিস্তানে। দুনিয়াজুড়ে। বাংলাদেশের সরকারও এ বছর মার্কসকে স্মরণ করছে, বিশ্লেষণ করছে জাতীয় জাদুঘরের আয়োজনে। প্রায় সবখানেই মার্কসবাদী না হয়েও মার্কসকে নিয়ে মাতামাতি আছেই। এখানেই এ দার্শনিকের ক্ষমতা। অন্তত তার সময়ের দার্শনিক এবং রাষ্ট্রচিন্তকদের তুলনায়। তবে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন খুবই উদার। চাঁছাছোলা এবং ভবিষ্যত্মুখী। জীবনের জয়গান তার কাছ থেকে শিখতে হবে। ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ, ব্রুনো বাউয়ের চিরায়ত জার্মান দর্শন কিংবা ফরাসি নৈরাজ্যবাদী চিন্তক পিয়েরে জোসেফ প্রুধোর দারিদ্র্যের দর্শন থেকে মার্কস ছিলেন একেবারেই আলাদা। ভিন্নতর এবং অনেক উন্নততর। যার স্বীকৃতি পরবর্তীকালে দার্শনিকরা নিঃসংকোচে দিয়েছেন। এ সাধুমার্কা দাড়িওয়ালা দার্শনিকটি মোটেও মিনমিনে স্বভাবের ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিপ্লবী। তিনিই প্রথম হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, ‘এতকাল দার্শনিকরা শুধু দুনিয়াকে ব্যাখ্যাই করে গেছেন। এখন দরকার হলো দুনিয়াটাকে বদলানো’। তিনি এ বদলটা কী তা তার কমিউনিস্ট ইশতেহারে স্পষ্টও করেছেন। এ বদল মানুষের ওপর মানুষের শোষণ ছাড়া এক মানবসমাজ। শুধু জার্মানিতেই নয়, বিশ্বজুড়ে। ১৮৬৪ এর বিশ্ব শ্রমিক সংস্থায় তার অবদান এর প্রমাণ। তিনিই ছিলেন আসল এক মানবতাবাদী বিশ্বায়নের প্রবক্তা। তাই মার্কস এখনো ভূমিষ্ঠ হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্নি স্যান্ডার্সের ভাষণে। এ দার্শনিক আজকের যুগের বিবৃতিজীবী, ড্রইংরুম বুদ্ধিজীবী ছিলেন না। ছিলেন না আয়েশি সুবিধাভোগী সুশীল। ১৮৩৬ এ বার্লিনে এসে আইন পড়া, নামজাদা উকিল পিতার প্রতিষ্ঠিত চেম্বার কোনো কিছুই তাকে আটকাতে পারেনি। মানব মুক্তির দর্শনের সন্ধানে তিনি ছিলেন ব্যাকুল। দর্শনের অনন্ত জিজ্ঞাসা তাকে নিয়ে গেছে উচ্চতর গণিত থেকে শুরু করে জটিল অর্থনীতি, জীববিজ্ঞান কিংবা নৃবিজ্ঞানের কাছে। এসব কিছুকেই তিনি ধারণ করেছেন তার রচনায়। তবে ছিলেন মতান্ধতা এবং আপ্তবাক্যের ঘোর বিরোধী। গোঁড়ামির ক্ষেত্রে তার উচ্চারণ ছিল অনেকের চেয়েই বেশি। নিয়ত পরিবর্তনশীল বিজ্ঞানকেই আঁকড়ে ধরার কথা বলেছেন তিনি। ফলে আজ যখন কেউ মার্কসকে ব্যাকডেটেড বলে কটাক্ষ করে, তখন তাদের প্রতি করুণা ছাড়া আর কিইবা করার থাকে! ২০০ বছর পরেও মার্কস কেন প্রাসঙ্গিক? মার্কস প্রাসঙ্গিক অনেক কারণে। কারণ আজকের রাজনৈতিক পৃথিবীকে তার মতো করে কেউ বিশ্লেষণ করতে পারেনি। মুনাফাভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির আসল চেহারা তিনিই সবচেয়ে ভালো করে দেখিয়ে দিয়েছেন। আবিষ্কার করেছেন ‘বাড়তি মূল্যের তত্ত্ব’। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের রাজনৈতিক তত্ত্ব তার মতো করে আর কেউ স্পষ্ট করতে পারেনি। পুঁজিবাদ যে মুনাফা আর করপোরেট দুনিয়ার জন্ম দিয়েছে তার সব রোগ এবং এসব রোগের নানা উপসর্গ মার্কসের চেয়ে ভালো আর কেউ চিহ্নিত করতে পারেনি। ফলে সমাজতন্ত্রীরা তো বটেই, নয়া উদারবাদী দুনিয়ার চালকরাও প্রতিনিয়ত মার্কসের রচনাবলির দুয়ারে হাজিরা দেন। এসব কারণেই আজ দুই শতাব্দী পরেও মার্কস এত প্রাসঙ্গিক এবং এতটাই প্রবলভাবে আমাদের মাঝে আছেন। এখানেই শেষ নয়। মার্কসের আরও একটি শক্তির দিক হলো, তিনি দারুণভাবে বর্তমানের মাঝে ভবিষ্যেক নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। আজকের দুনিয়ায় আমরা যে পরিবেশ প্রতিবেশের সংকট নিয়ে কথা বলি, লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে আলোচনা করি, আধুনিক খাজনা তত্ত্ব নিয়ে কথা বলি, কথা বলি বিজ্ঞানের অপব্যবহার নিয়ে— এরকম হরেক বিষয়ে মার্কসের দূরদৃষ্টি তার রচনাতেই রয়েছে।  মার্কস যেহেতু আইনের ছাত্র ছিলেন, তাই আইনের ছাত্র হিসেবে আমি তার প্রতি এক ধরনের নৈকট্য অনুভব করি।

 

কার্ল মার্কসের লেখা বইসমূহ

♦          ক্রিটিক অব হেগেল’স ফিলসফি অব রাইট (১৮৪৩)

♦          ইকোনমিক অ্যান্ড ফিলসফিক ম্যানাসক্রিটস (১৮৪৪)

♦          দ্য হলি ফ্যামিলি (১৮৪৫)

♦          থিসিস অন ফয়েরবাক (১৮৪৫)

♦          দ্য জার্মান ইডিওলজি (১৮৪৫)

♦          দ্য কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (১৮৪৮)

♦          ক্রিটিক অব দ্য গোথা প্রোগ্রাম (১৮৭৫)

♦          দ্য ভেরি লং ক্যাপিটাল (১৮৬৭-৯৪)

লেখালেখির ক্ষেত্রে মার্কস তার বন্ধুপ্রতিম ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে বেশ কিছু কাজ করেছেন। জীবিতাবস্থায় জনপ্রিয়তা না পেলেও পরবর্তীতে কার্ল মার্কসের ধারণাগুলো সমগ্র বিশ্বেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। পশ্চিমা পুঁজিবাদ নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী এবং রক্ষণশীল। মৃত্যু পরবর্তীকালীন কয়েক যুগ পর থেকে শুরু করে এমনকি বর্তমান সময়েও মার্কস প্রবর্তিত ধারণাগুলো নিয়ে সমালোচকদের আগ্রহের কমতি নেই। তার লেখায় ‘পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা’ নিয়ে বেশ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা উঠে এসেছে। বিপ্লবী সংগ্রামের সর্বোচ্চ বিকাশ ফ্রান্সে ঘটেছিল। বিপ্লবের তত্ত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ ফরাসি বিপ্লবী তত্ত্ব।  তৎকালীন বিশ্বে জ্ঞানের এই তিনটি ক্ষেত্রই মার্কসীয় মতবাদের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। দর্শন, অর্থনীতি ও শ্রেণি-সংগ্রামের তত্ত্ব— এই তিনটি অঙ্গ নিয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে বস্তুবাদই একমাত্র সঙ্গতিপরায়ণ দর্শন।

সর্বশেষ খবর