বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা
আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী

অন্য আলোয় কলম জাদুকর

তারা শঙ্করের কবির মতন মাঝে মধ্যে আমার বলার ইচ্ছা করে, জীবন এত ছোট ক্যানে? ওই যে একটু আগে বললাম, একটা কচ্ছপ কেন সাড়ে তিনশ বছর বাঁচে, মানুষ কেন বাঁচে না

রণক ইকরাম

অন্য আলোয় কলম জাদুকর

হুমায়ূন আহমেদ [জন্ম : ১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮ মৃত্যু : ১৯ জুলাই ২০১২ ]

১৯ জুলাই ২০১২। অন্য ৮-১০টি দিনের মতোই সাধারণ একটি দিন ছিল। আচমকা সংবাদ এলো গৃহত্যাগী জ্যোত্স্না আজন্ম অভিমানে ছেড়েছেন চেনা আঙ্গিনা। পাড়ি জমিয়েছেন অচেনা দিগন্তে। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ। আকাশে তখন সীমাহীন শূন্যতা। চারদিকে হাহাকার ধ্বনি। নীল নীল বেদনার ধূলি জমে নিশ্চুপ ক্লান্তিহীন। নিন্দুকের মুখেও তখন অতৃপ্তির আহ্লাদ। বর্ণচোরা অনুভূতির আবাদে বইয়ের পাতা থেকে একে একে বেরিয়ে আসে কল্পনার চরিত্ররা। খণ্ড খণ্ড নীলের প্রবেধ ডিঙিয়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরে কোত্থেকে যেন এগিয়ে আসে হিমু। আবেগ তাকে ছোঁয় না কখনোই। সব আবেগের ঊর্ধ্বে সে। মনের আনন্দে যখন যেটা ইচ্ছা করে, সেটাই করে বেড়ায়। নিয়ম-অনিয়মের ধার ধারে না। নিজের মতো নিজের পৃথিবী সাজানোই তার কাজ। এরপরও সেদিন ঔদাসীন্য গ্রাস করেছিল হিমুকে। নেমে পড়েছিল রাস্তায়। তবে গৃহত্যাগী জ্যোত্স্নার শবযাত্রায় শামিল হতে পথে নামেনি সে। তবে কেন নেমেছে? তখন উত্তরের যুক্তি খুঁজতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেছিলেন মিসির আলী। কোনো কিছুই তাকে বিব্রত করে না। ঘটনা যত অদ্ভুতই হোক সেটাকে স্বাভাবিক মনে করে এগিয়ে চলাই তার কাজ। কিন্তু এখন বেশ বিব্রত সে। আচমকা দাঁতে চাপা পড়ে ঠোঁট কেটে গেলে যেমন লাগে ঠিক তেমন লাগছে তার। মাথার ভিতর কোনো লজিকই কাজ করছে না। চারদিককার সুনসান নীরবতা কাটিয়ে হাই পাওয়ারের চশমা চোখে হাজির শুভ্র। এমন দিনে ঘরে বসে থাকতে পারেনি সেও। এত রাতে বাইরে বেরোনোর মানুষ সে নয়।

এরপরও তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি কেউ। ততক্ষণে রূপাও ছাদ থেকে নেমে দৌড়ে আসছে এদিকেই। সবার দৃষ্টি একজনের দিকেই। তিনি সবার মুরব্বি। তিনি অযৌক্তিক কিছু বলেন না, ভাবেন না। মিসির আলী ভেবেই চলেছেন তার মতো সবারই কী একই জিজ্ঞাসা? গল্পের সব চরিত্রই কি একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে? আজ সবাইকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। হিমুকে আজ হলুদ পাঞ্জাবিতে ঠিক মানাচ্ছে না। শুভ্র সাধারণত ওর হাই পাওয়ারের চশমাটা চোখ থেকে সরায় না। আজ বারবারই খুলছে আর পরছে। অন্যদিকে রূপার কথার জ্বালায় কারোরই টিকতে পারার কথা নয়। সেও নিশ্চুপ। গৃহত্যাগী জ্যোত্স্নার শেষ যাত্রার কথা মিসির আলীও জানে। কিন্তু তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। কারণ সে জানে মৃত্যু অমোঘ সত্য। একে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। সবার মনের অবস্থা ভেবে মুখ খুললেন তিনি। বললেন, গৃহত্যাগী জ্যোত্স্না চলে গেছে, এ জন্য আমাদের সবার মন খারাপ, সেটা আমি জানি। কিন্তু তার আজীবন থাকার কথা ছিল না। এটাও সত্যি। তিনি চলে গেছেন ঠিক। কিন্তু হিমু তোমাকে তো নিয়ে যাননি। কই রূপা তোমাকে নিয়ে গেছে? শুভ্র তুমিও তো ঠায় দাঁড়িয়ে। তোমাদের কারও তো বয়স বাড়েনি। বাড়েনি আমার বয়সও। এরপরও কিসের অস্তিত্ব সংকটে সন্ত্রস্ত তোমরা? তিনি আসলে আমাদের ছেড়ে যাননি। তিনি আমাদের মাঝেই ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। এই যে হিমু, তুমি যখন হলুদ পাঞ্জাবি পরে জ্যোত্স্না দেখতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা পাকাবে, তখন তিনি আড়ালে দাঁড়িয়ে হাসবেন। রূপা, তুমি যখন হিমুর জন্য অপেক্ষা করবে, তখন দেখবে ঠিক তিনি তোমার পাশে সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়ে। আর শুভ্র চশমাটা খুলে চোখ বন্ধ করে একবার অনুভব কর তো কী দেখতে পাও? তিনি কি আছেন? না, অবশ্যই আছেন তিনি আমাদেরই মাঝে বেঁচে থাকবেন আজ, কাল, পরশু। যুগ থেকে যুগান্তর কাল থেকে কালান্তর। কলম জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন ছয় বছর হয়ে গেছে। কিন্তু সত্যি কি চলে যেতে পেরেছেন তিনি? মোটেও না। তিনি কেবল তার শরীর ত্যাগ করেছেন। মানুষের অমরত্ব তার বয়সে নয়, কর্মে। হুুমায়ূন আহমেদ তার শরীর ত্যাগ করেছেন বটে, কিন্তু রেখে গেছেন তার অবারিত কর্ম। তার উপন্যাস, গল্প, নাটক, চলচ্চিত্র কিংবা গানগুলো তার সঙ্গে যায়নি। তার সৃষ্টির বিশালত্বের কাছে আগেই হার মেনেছে ব্যক্তি হুুমায়ূনের দোষ-ত্রুটি। বাংলা সাহিত্যে রস, আনন্দ আর উপভোগের যে আধুনিক ধারা, তার পথিকৃৎ হুমায়ূন আহমেদ। তিনি সংসার ত্যাগ করে আকাশচারী হয়েছেন। কিন্তু তার সৃষ্টি বেঁচে থাকবে আজীবন। সাহিত্যের নতুন যে ধারা তিনি তৈরি করে দিয়ে গেছেন সেই পথে হাঁটছে বা হাঁটার চেষ্টা করবে তারই অনুজ সাহিত্যিকরা। কখনো সেই সব সাহিত্যের কলম ধরে আবার কখনো তার নিজের চরিত্রগুলোর মাঝে হেঁটে বেড়াবেন হুুমায়ূন আহমেদ। আজকের পাঠকের কাছে যে হিমু-মিসির আলী চিরচেনা, আগামী দিনের পাঠকের কাছে একই চরিত্র ধরা দেবে নতুন বিস্ময়ে। জোছনা ও জননীর গল্পে আজকের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে। একই বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকবে আগামী প্রজন্ম। শ্যামল ছায়া উপন্যাস বা চলচ্চিত্র আরেক প্রজন্মের কাছে নতুন হয়ে ধরা দেবে। এভাবেই হুমায়ূন আহমেদ টিকে থাকবেন ততদিন যতদিন বাংলা সাহিত্য টিকে থাকবে। এ আলো কখনো নেভার নয়।

 

২৫ মে ২০১২। নুহাশ পল্লী। তখন ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সে সময় তার সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ প্রতিদিনের। জীবনের নানা গল্প তিনি শুনিয়েছিলেন। পূর্বে প্রকাশিত এই প্রতিবেদকের নেওয়া সাক্ষাৎকারের কয়েক ঝলক...

‘লোকজন আগ্রহ নিয়ে আমার বই পড়ছে, এটাই আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি’

হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন শিক্ষক, নাট্যকার, নির্মাতা, গীতিকার। ছবিও এঁকেছেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি নিজেকে কী হিসেবে দেখতে ভালোবাসেন। তিনি বলেছিলেন তার এত পরিচয় ভালো লাগে না। তার ভাষায়—

আমি একজন লেখক। নিজেকে আমি ‘ফিকশন রাইটার’ বলতেই পছন্দ করি। ফিল্মমেকিং অন্যরকম একটা বিষয়। নিজেকে কখনোই ফিল্মমেকার বলি না। ছোটবেলা থেকে ছবি দেখার ব্যাপারে খুব আগ্রহ ছিল। লেখালেখি, ছবি দেখা পুরোটাই পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। কোনো বাবা এমন রসিক আর সংস্কৃতিমনা হতে পারেন, সেটা আমার বাবাকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হতো। তো যা বলছিলাম, ছোটবেলা থেকেই ছবি দেখতাম। বড় হওয়ার পর মনে হতো এত সুন্দর ছবি দেখি অথচ আমাদের এখানে ভালো ছবি বানানো হচ্ছে না। আরেকটা আক্ষেপ ছিল। সেটি হচ্ছে, আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবির অভাব। নিজে মুক্তিযুদ্ধ না করলেও পতাকার জন্য বাবাকে হারিয়েছি। তাই একটা দায়বোধ ছিল। ভাবতাম এতবড় একটা মুক্তিযুদ্ধ হলো অথচ সেটা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো ছবি নেই। এই আফসোস থেকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটা ছবি বানালাম ‘আগুনের পরশমণি’। এই ছবিটি নির্মাণ করতে সব খরচ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তারপর থেকে চালিয়ে যাচ্ছি ছবি বানানো। এর বাইরে যখন যেটা ইচ্ছা করে সেটাই করার চেষ্টা করি। আমি আসলে আনন্দের জন্য বাঁচি। আর আমাকে কলম জাদুকর বললে বাড়িয়ে বলা হবে। বাংলা সাহিত্যে অনেক বড় বড় জাদুকর তৈরি হয়েছে। আমাকে বাংলা সাহিত্যের একজন দীন সেবক বলা যেতে পারে। সেবা করে যাচ্ছি। সেবা করার যে সুযোগটা পেয়েছি এতেই আমি খুশি। লোকজন আগ্রহ নিয়ে আমার বই পড়ছে, এটাই আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি। আর কতটুকু দিতে পেরেছি না পেরেছি সেটি ভাববে সমালোচকরা, সমাজবিদরা। আমার কাজ হচ্ছে শুধু লেখালেখি করা।

পথ চলতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এতটা পথ পেরিয়ে এসে, জীবনের শেষ উপলব্ধি মানে রিয়েলাইজেশনটা...

শেষ রিয়েলাইজেশন হচ্ছে ‘জীবন অনেক, অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার’। তারা শঙ্করের কবির মতন মাঝে মধ্যে আমার বলার ইচ্ছা করে, জীবন এত ছোট ক্যানে? ওই যে একটু আগে বললাম, একটা কচ্ছপ কেন সাড়ে তিনশ বছর বাঁচে, মানুষ কেন বাঁচে না। জীবনটা আমার খুব ছোট মনে হয়। তোমাদের মনে হয় না? নাকি এখনো টের পাও নাই? টের পাইবা...

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর