বৃহস্পতিবার, ৯ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

অদ্ভুত শরীর বদল

রণক ইকরাম

স্রষ্টা প্রদত্ত শরীর বদলে ফেলার ক্ষমতা মানুষের নেই। কিন্তু নিজেকে সুন্দর ও অন্যরকম দেখানোর চেষ্টা মানুষের সেই প্রাচীনকাল থেকেই। রূপচর্চার নিত্যনতুন ফর্মুলার পাশাপাশি অনেক মানুষই বেছে নিয়েছেন বিচিত্র কিছু রীতিনীতি। প্রাচীনকালের কতগুলো উপজাতি তাদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে নানাভাবে বদলে ফেলে অদ্ভুত আকার ধারণ করেন। মূলত সেখান থেকেই বডি মডিফিকেশনের ধারণাটির জন্ম হয়েছে। বর্তমান আধুনিক পৃথিবীতেও অনেক মানুষ বেছে নেন কিম্ভূতকিমাকার এই রীতিকে।

 

নাকে কাঠের প্লাগ!

পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের একটি হচ্ছে নাক। পাশের ছবিটির দিকে তাকালে অবাক না হয়ে পারা যাবে না। ছবিটি ভারতের উত্তরের অরুণাচল প্রদেশের এক উপজাতীয় রমণীর। অরুণাচলের জিরো উপত্যকায় বসবাসকারী ‘আপাতানি’ উপজাতির রমণীরা সেই প্রাচীনকাল থেকেই তাদের নাকের ওপর এ ধরনের প্লাগ ব্যবহার শুরু করেন। দেখতে এবং শুনতে খুব অদ্ভুত লাগলেও তাদের ভিতর এই চর্চাটা রীতিমতো ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। তবে এর পেছনে মূল রহস্য আপাতানি রমণীদের সৌন্দর্য। তাদের সৌন্দর্য এতটাই বিখ্যাত ছিল যে অন্যান্য উপজাতির পুরুষরা তাদের অপহরণ করে নিয়ে যেত। এই উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য উপজাতি রমণীরা নিজেদের অসুন্দর করার জন্য নাকের ভিতর কাঠের প্লাগ ব্যবহার শুরু করেন। সেটাই এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে।

 

 

কত্তো লম্বা কান!

বডি মডিফিকেশনের আরেকটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হচ্ছে ইয়ার স্ট্রিচিং বা কান লম্বা করা। বর্তমানে কান ফোঁড়ানো বা অলঙ্কার ব্যবহার বৈশ্বিক রীতিতে পরিণত হলেও কান টেনে লম্বা করার বিষয়টি কেবল নির্দিষ্ট কিছু প্রাচীন উপজাতির মধ্যেই প্রচলিত। কেনিয়ার মাসাই উপজাতিদের থেকে আমাজন বেসিন হুয়ারানি উপজাতি সবখানেই কান লম্বা করতে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, আধুনিক বিশ্বের অনেকেই বিভিন্ন কারণে কান লম্বা করার শিল্প অনুশীলন করছে। এ ধরনের কীর্তির পেছনে কেবল ফ্যাশন বা ভিন্নতা নয় রয়েছে নানা কারণ। গবেষকদের মতে ধর্মীয় বিশ্বাস, শয়তানের দৃষ্টি থেকে মুক্তি, যৌন শক্তি বৃদ্ধি এবং শারীরিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য এটি করা হতো। তবে কারণ ভিন্ন হলেও গোটা বিশ্বের মানুষ এখনো কান লম্বা করার এই বিষয়টি উপভোগ করছে।

 

 

ঠোঁটের ওপর প্লেট

লিপ প্লেট বা ঠোঁটের ওপর প্লেট প্রতিস্থাপনকে ওরা ফ্যাশন বলেই মানে। এ ধরনের অদ্ভুত রীতি দেখা যায় সুদান, ইথিওপিয়া, মিসোআমেরিকা এবং উপকূলবর্তী ইকুয়েডরের কতগুলো উপজাতির মধ্যে। এর বাইরে আফ্রিকার আরও কয়েকটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাচীন এই ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। আফ্রিকায় মূলত নিচের ঠোঁটে একটি কাঠের প্লাগ বসানো হয় ঠোঁটের ফাঁকের আড়াআড়ি। মাঝের দুই দাঁতের বা চার দাঁতের সমান করে চামড়া কেটে ছিদ্র  তৈরি করে। অনেকে আবার উপরের ঠোঁটেও আরেকটি প্লেট বসায়। প্রাচীন ইতিহাস মতে, এই প্লেটের সাইজ সংশ্লিষ্ট পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও গুরুত্ব তুলে ধরার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বডি মডিফিকশনের অন্য সব রীতির মতো এটিকেও অনেক আধুনিক মানুষ অনুসরণ করছে।

 

 

জিরাফের গলা!

জিরাফকে অন্যান্য সব প্রাণীর চেয়ে একেবারে আলাদা করা হয় তাদের লম্বা গলার জন্য। আর নর্দার্ন থাইল্যান্ডের কায়ান নারীরাও তাদের গলা লম্বা দেখানোর জন্য অদ্ভুত পিতলের কয়েল পরেন। তাই তাদের লম্বা গলার অধিকারী জিরাফি ওমেন বলা হয়। বাচ্চা মেয়েরা ৫ বছর বয়সেই তাদের প্রথম কয়েলটা পরে যার ওজন সাড়ে চার পাউন্ড। পরে আস্তে আস্তে আরও কয়েল যোগ করা হয়। কিন্তু মূল রহস্যটি হলো এই রিং পরলে গলা লম্বা হয় না, বরং রিংটির ওজনে কাঁধ নিচের দিকে নেমে যায়। একটি-দুটি নয়, অনেক মেয়ে ২৫টি পর্যন্ত কয়েল পরে থাকেন। সবচেয়ে বড় বিষয় এই কয়েলগুলো তারা সারা জীবনেও খুলেন না। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে এই কয়েল নাকি খোলা যায় না। কিন্তু গলা পরিষ্কার, কয়েল পরিষ্কার ও ঠিক রাখার জন্য এটি খুলতে হয়। বছরের পর বছর ধরে এই রীতির প্রচলন রয়েছে।

 

 

কিম্ভূতকিমাকার

মানুষ তার চেহারার খুঁত ঢাকতে ব্যস্ত থাকে। অন্যদিকে কেউ কেউ আবার উল্টো খুঁত বাড়িয়ে কিম্ভূতকিমাকার করে ফেলছে চেহারাকে। বডি মডিফিকেশনের এই ধারাটিকে বলে ফেসিয়াল স্ক্যারিফিকেশন। এটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত সুদানে। তারা এটিকে তাদের নিজস্ব কৃষ্টি-কালচারের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ মনে করে। গরম ছুরি চালিয়ে যখন তাদের কালো মুখের ওপর আলপনা আঁকা হয়, অথবা কেটে নতুন শেইপ দেওয়া হয় তখন সম্মান হারানোর ভয়ে কেউ কান্নাকাটি করে না। কেবল ঐতিহ্যই নয়, একে বীরত্ব ও গৌরবের প্রতীক বলেও মানে। এটি পুরুষদের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন উপজাতির পরিচয় বহন করে। অন্যদিকে মেয়েদের জন্য এটিকে গুরুত্বপূর্ণ সৌন্দর্যের বিষয়। ডিনকা উপজাতির লোকজন নিজের পরিচয় আলাদা করার জন্য তাদের মুখের ওপর তিনটি প্যারালাল লাইনের স্থায়ী দাগ তৈরি করে।

 

 

দেহ কাটাকুটি

এটিকে বডি মডিফিকেশনের চেয়ে নির্যাতন সহ্য করা বলাই ভালো। আর তাই একে বলা হয় মিডিয়াম অ্যাক্টিভিটিস। এই অ্যাক্টিভিটিস বা কীর্তিকলাপকে কোনো ব্যাকরণের মধ্যে ফেলা যায় না। তবে বহির্বিশ্বের মানুষের কাছে এ ধরনের চর্চাকে খুব বীভৎস মনে হলেও স্থানীয় থাইদের কাছে এটি একেবারেই স্বাভাবিক ঘটনা। মিডিয়াম অ্যাক্টিভিটিসের মাধ্যমে তারা তাদের সাবালকত্ব প্রমাণ করে। তারা যে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে তা সারা বিশ্বের সামনে প্রকাশের জন্য প্রতি বছর এই অনুষ্ঠানটি হয়ে থাকে। উৎসবের নাম দ্য ভেজিটারিয়ার ফেস্টিভ্যাল। মিডিয়াম ফলোয়াররা ধারালো বস্তু দিয়ে তাদের দেহে কাটাকুটি করে থাকে। এ ছাড়া তারা জ্বলন্ত কয়লা ও ধারালো তলোয়ারের ওপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটে। সবকিছুর উদ্দেশ্য একটাই— নিজের সাবালকত্ব প্রমাণ করা।

 

 

ধারালো দাঁতের জন্য!

বডি মডিফিকেশনের আরেকটি অদ্ভুত ও ভয়াবহ রীতি এটি। মানুষের দাঁত একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। শুধু মানুষ কেন যে কোনো প্রাণীর জন্যই তার প্রতিটি অঙ্গ আলাদা আলাদা তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহন করে। আর মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব। তাদের ক্ষেত্রে আলাদা তাৎপর্য থাকবে না তা কী হয়। তাই মানুষের দাঁতেরও রয়েছে আলাদা ভূমিকা। কিন্তু বডি মডিফিকেশনের খপ্পর থেকে রক্ষা পায়নি দাঁতও। বডি মডিফিকেশনের বেশির ভাগ রীতি মানুষের বাহ্যিক অঙ্গকে কেন্দ্র করে হলেও ইতিহাস বলে যে, মুখের ভিতরকার দাঁত বদলে ফেলার রীতি বিশ্বের অনেক প্রান্তের মানুষের মধ্যে প্রচলন রয়েছে। বালি দ্বীপের কতগুলো মানুষের বিশ্বাস, দাঁত মানুষের রাগ, ঈর্ষা এবং অন্যান্য নেতিবাচক আবেগের প্রতিনিধিত্ব করে। আর তাই তারা নানাভাবে একে ভিন্ন ভিন্ন শেইপ দেওয়ার চেষ্টা করে। এর বাইরে বেশ কিছু সুদানি ও ভিয়েতনামি উপজাতিও প্রায় একই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ। মধ্য-আফ্রিকার অনেক উপজাতির ভিতর বিভিন্ন প্রাণীর দাঁতের শেপের অনুকরণের প্রচলন আছে।

 

 

কুমিরের চামড়া!

স্ক্যারিফিকেশনের ধারণাটা উপজাতিদের ছাড়িয়ে আধুনিক মানুষের মধ্যেও বেশ ভালোভাবে ছড়িয়েছে।

আর আধুনিক মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে এমনই স্ক্যারিফিকেশন হচ্ছে এলিগেটর স্কিন স্ক্যারিফিকেশন বা কুমিরের মতো চামড়া তৈরি। পাপুয়া নিউগিনির কিছুসংখ্যক উপজাতির পুরুষের মধ্যে তাদের চামড়া কেটে কুমিরের চামড়ার মতো পাল্টে ফেলার এই রীতি দেখা যায়। এটি খুব সাধারণভাবেই করে তারা। সমুদ্রের সঙ্গে জীবন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বলে কুমিরকে ভীষণ ভয় পায় এরা।

এদের বিশ্বাস, সমুদ্রে থাকা অবস্থায় কুমির যদি তাদের পিছু নেয় তাহলে পেছন থেকে দেখলে তাদেরও কুমির মনে করে ধোঁকা খাবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর