রবিবার, ৩০ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

কুফাবাসীর বেইমানি

কুফাবাসীর বেইমানি

ইয়াজিদের অনুসারীদের অনেকে কুফায় অবস্থান করতেন। তারা দেখলেন, হজরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহির হাতে চল্লিশ হাজার লোক বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। তারা ইয়াজিদকে এ বিষয়টি জানিয়ে উসকানিমূলক চিঠি দিল। ইয়াজিদকে লিখলেন, তুমি তো নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছো। তোমার বিরুদ্ধে কুফায় বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠছে। তোমার পক্ষে প্রতিরোধ করা খুবই কষ্টসাধ্য হবে। তোমার বিরুদ্ধে চল্লিশ হাজার লোক বাইয়াত হয়েছেন। আরও লোক বাইয়াত হচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে তাহলে এমন এক ভয়ানক ঝড়-তুফানের সৃষ্টি হবে। তোমাকে খড়-কুটার মতো উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তুমি যেভাবেই হোক প্রতিরোধের চেষ্টা করো। ইয়াজিদ এ খবর পেলেন। খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেন। তাই ইয়াজিদের কাছেও তার রাজত্ব হুমকির সম্মুখীন মনে হলো। তখন কুফার গভর্নর ‘নোমান বিন বশীর’ যিনি হজরত ইমাম মুসলিমের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার নেয়নি। তাকে পদচ্যুত করলো। তার স্থলে ইবনে জিয়াদ ওরফে ‘উবাইদুল্লাহ’ যে বড় জালিম ও কঠোর ব্যক্তি ছিল। যে বসরার গভর্নর ছিলেন। তাকে কুফার গভর্নর নিয়োগ করলেন। তার কাছে চিঠিতে বলা হলো-‘তুমি বসরার গভর্নর থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে কুফারও গভর্নর নিয়োগ করা হলো। তুমি শিগগির কুফায় আমার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়েছে। যেভাবে হোক দমিয়ে ফেলো। তোমাকে পূর্ণ ইখতিয়ার দেওয়া হলো। ইবনে জিয়াদ ইয়াজিদের পক্ষ থেকে পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে কুফায় আসলেন। কুফায় এসে সর্বপ্রথম বড় বড় সর্দার ছিল এবং যারা হজরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহির সঙ্গে ছিল ও বাইয়াত গ্রহণ করেছিল। তাদের সবাইকে বন্দী করে ফেললেন। পরে কুফার গভর্নর হাউসে নজরবন্দি করে রাখা হলো। ওই চল্লিশ হাজার ব্যক্তি যারা তাঁর হাতে বাইয়াত করেছিল। তারা সবাই সমবেত হলো। তিনি হুকুম দিলেন, গভর্নর ভবন ঘেরাও কর। হজরত মুসলিম সেই চল্লিশ হাজার অনুসারীদের নিয়ে গভর্নর ভবন ঘেরাও করলেন। তখন অবস্থা এমন উত্তপ্ত ছিল, তিনি একটু ইশারা করলে এক মূহূর্তের মধ্যে গভর্নর ভবন ধূলিসাৎ করে ফেলত। ইবনে জিয়াদ কোনো প্রতিরোধ করতে পারতেন না। কারণ ওই চল্লিশ হাজার লোকের মোকাবিলা করার ক্ষমতা তখন তার ছিল না। এমনকি তখন তার কাছে এত সৈন্যও ছিল না। হজরত ইমাম মুসলিম যখন চল্লিশ হাজার লোক নিয়ে গভর্নর ভবন ঘেরাও করলেন। তা দেখে ইবনে জিয়াদ খুবই ভয় পেলেন। তিনি চালাকি ও ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিলেন। যে বড় বড় সরদারদেরকে গভর্নর ভবনে নজরবন্দী করে রাখা হয়েছিল। তাদের বললেন, আপনারা যদি নিজ পরিবার-পরিজনের মঙ্গল চান তাহলে আমার পক্ষ অবলম্বন করুন। নইলে আমি আপনাদের হত্যা করার নির্দেশ দিব। আপনাদের পরিবারের ও সন্তানদের যে কঠিন পরিণতি হবে। ইবনে জিয়াদ বলল- এ মুহূর্তে গভর্নর ভবন ঘেরাও করে রেখেছে। তারা হয়তো আপনাদের ছেলে হবে। বা ভাই হবে। অন্য আত্মীয়স্বজন হবে। আমি আপনাদের গভর্নর ভবনের ছাদের ওপর উঠাচ্ছি। আপনারা নিজ নিজ আপনজনদের ডেকে বুঝান। হজরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহির সঙ্গ ত্যাগ করে। যদি আপনারা এই রকম না করেন, তাহলে সবার আগে আপনাদের হত্যা করার নির্দেশ দিব। আপনাদের কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। ইবনে জিয়াদ বললেন, চলুন, ছাদে উঠুন এবং আমি যেভাবে বলি সেভাবে করুন। সর্দারেরা সঙ্গে সঙ্গে ছাদের উপর উঠলেন। নিজ নিজ আপনজনদেরকে ডাকতে লাগলেন। আরও বললেন, ক্ষমতা এখন ইয়াজিদের হাতে। সৈন্যবাহিনী ইয়াজিদের হাতে। অস্ত্র-শস্ত্র ও ধন-সম্পদ ইয়াজিদের হাতে। ইমাম হুসাইন (রা.) অবশ্যই রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশধর। কিন্তু তার কাছে না আছে রাজত্ব। না আছে সম্পদ। না সৈন্য এবং অস্ত্র। তাই তোমরা এ ঘেরাও উঠিয়ে নাও। ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহির সঙ্গ ছেড়ে দাও। নইলে তোমাদের পরিণামও ভয়াবহ হবে। যখন বড় বড় সর্দারেরা নিজ নিজ আপনজনদেরকে বুঝাতে ও পরামর্শ দিতে লাগলেন। তখন লোকেরা অবরোধ ছেড়ে দিয়ে নীরবে চলে গেলেন। দশ-বিশজন করে এদিক-ওদিক থেকে লোক চলে যেতে লাগলেন। হজরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি চল্লিশ হাজার লোক নিয়ে গভর্নর ভবন ঘেরাও করেছিলেন কিন্তু আসরের পর মাগরিবের আগে মাত্র পাঁচশ জন লোক ছাড়া বাকি সব চলে গেলেন। এতে ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি খুবই মর্মাহত হলেন। তিনি ভাবলেন, চল্লিশ হাজার লোক থেকে সাড়ে ঊনচল্লিশ হাজার চলে গেছে। কেবল পাঁচশ জন রয়েছে। তাদের উপরও বা কতটুকু আস্থা রাখা যায়? ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন এ অবস্থা দেখলেন, তখন যে পাঁচশজন ছিলেন। তিনি তাদেরকে বললেন, চলুন আমরা জামে মসজিদে গিয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করি। নামাজের পর পরামর্শ করব কী করা যায়? সবাই বললেন, ঠিক আছে। হজরত ইমাম আলাইহি পাঁচশ লোককে নিয়ে মসজিদে গেলেন। তখন নামাজের সময় হয়ে গেছে। হজরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন। পাঁচশ জন পেছনে ইক্তিদা করলো। হজরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লহি আলাইহি তিন রাকায়াত ফরজ নামাজ পড়ার পর যখন সালাম ফিরালেন। তখন দেখলেন, ওই পাঁচশ জনের মধ্যে একজনও নেই। এখন মাগরিবের পরে একজনও নেই! এরা তারাই, যারা নিজেদেরকে আহলে বাইত-এর একান্ত ভক্ত বলে দাবি করতেন। যাদের পূর্বপুরুষেরা আহলে বাইতের অনুসারী দাবিদার ছিলেন। তারাই চিঠি লিখেছিলেন, এরাই হজরত ইমাম হুসাইনকে (রা.) কুফায় আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারাই ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহির হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল। কেবল ইবনে জিয়াদের ধর্মকেই হজরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহির সঙ্গ ছেড়ে দিল ও বিশ্বাসঘাতকতা করল। হজরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি নামাজ শেষে আল্লাহপাককে স্মরণ করছিলেন। মনে মনে ভাবছিলেন, এখন কী করা যায়? সব লোক তো আমাকে ছেড়ে চলে গেল। চিঠি পেয়ে হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এক মুহূর্তও বিলম্ব করবেন না। তিনি খুব তাড়াতাড়ি এসে যাবেন। তখন প্রতিক্রিয়া হবে। দেখবেন সব লোকেরা আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তিনি মসজিদ থেকে বের হয়ে নিজ মুরীদের কাছে গেলেন। দেখলেন, ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। ডাকাডাকি করার পরও ঘরের দরজা খুলছেন না। হজরত ইমাম রহমতুল্লাহি আলাইহি রাত্রে কুফার রাস্তায় এমনভাবে অসহায় অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। একজন সহায়-সম্বলহীন মুছাফির ঘুরাফিরা করে। তিনি অলি-গলিতে হাঁটতে লাগলেন। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় গিয়ে এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখলেন। যিনি ঘরের দরজা খুলে বসেছিলেন। তিনি তার কাছে গিয়ে পানি চাইলেন। বৃদ্ধা পানি দিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে? কোথা থেকে এসেছেন। তিনি অকপটে বললেন, আমি মুসলিম বিন আক্বীল, হজরত ইমাম হুসাইন (রা.)-এর প্রতিনিধি হয়ে কুফায় এসেছিলাম। মহিলাটি বললেন, আপনি মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি! কুফার সবাই জানে যে, আপনার হাতে হাজার হাজার লোক বাইয়াত হয়েছেন। সবাই আপনার জন্য জান-কোরবান করতে প্রস্তুত। কিন্তু আমি কী দেখছি! আপনি যে এভাবে অসহায়, একাকী ঘুরাফিরা করছেন? হজরত ইমাম আলাইহি বললেন, আমার সাথে বেইমানি করেছে তারা। তাই আপনি আমাকে এই অবস্থায় দেখছেন। কুফার কোনো ঘরের দরজা আজ আমার জন্য খোলা নেই। এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আমি রাত্রি যাপন করতে পারি। আশ্রয় নিতে পারি। বৃদ্ধা মহিলা বললেন, আমার গরিবালয় আপনার জন্য খোলা আছে। আমার জন্য এর থেকে বড় সৌভাগ্য আর কি হতে পারে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন আওলাদ আমার ঘরে মেহমান হয়েছেন। ঘরে জায়গা দিলেন। তিনি তার ঘরে আশ্রয় নিলেন। সেখানে তিনি রাত যাপন করলেন। ওই বৃদ্ধার এক ছেলে ছিল বড় নাফরমান। শেষ রাতে বৃদ্ধার সেই নাফরমান ছেলে ঘরে আসলো। এসেই মাকে জিজ্ঞাসা করলেন। তুমি চিন্তিত কেন? মা বললেন,  মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহি, যিনি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের খানদানের একজন। তিনি আমার ঘরে মেহমান। আমি খুবই আনন্দিত। তাঁর সেই নাফরমান ছেলে মনে মনে খুবই খুশি হলেন। তিনি কি জানেন ইবনে জিয়াদের ঘোষণার কথা? ইবনে জিয়াদ তো ঘোষণা করেছেন, যে ব্যক্তি হজরত মুসলিম বিন আক্বীল রহমতুল্লাহি আলাইহিকে গ্রেফতার করতে পারবে তাকে এক হাজার দিরহাম পুরস্কার দেওয়া হবে। তিনি যখন সৌভাগ্যবশত আমার ঘরে এসে গেছেন। আমি খবর দিয়ে গ্রেফতার করাব। হাজার দিরহাম পুরস্কার লাভ করব। এদিকে ছেলে অস্থির হয়ে পড়লেন। কখন সকাল হবে। কখন খবর পৌঁছাবেন। পুরস্কার লাভ করবেন। ফজর হওয়া মাত্রই সে ইবনে জিয়াদকে খবর দিল যে, হজরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি ওর ঘরেই অবস্থান করছেন। সে হলো সংবাদদাতা। সেই পুরস্কারের দাবিদার। ইবনে জিয়াদ বললেন। তোমার পুরস্কার তুমি নিশ্চয় পাবেন। প্রথমে গ্রেফতার করার ব্যবস্থা করেন। সে বললো, ঠিক আছে। আমার সঙ্গে সিপাই পাঠিয়ে দিন। তার সঙ্গে সত্তরজন সিপাই গেল। সেই মহিলাটির ঘর চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললেন। হজরত মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি এই অবস্থা দেখে তলোয়ার নিয়ে বের হলেন। সিপাইরা জঘন্যভাবে বেয়াদবি করলো। ওরা হজরত ইমাম হুসাইন (রা.)-এর কঠোর সমালোচনা করলেন। ইয়াজিদের প্রশংসা করলেন। আর তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ আনলেন। হজরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি এর যথার্থ উত্তর দিলেন। কিন্তু ইত্যবসরে তীর নিক্ষেপ করলেন। হজরত ইমাম মুসলিম আলাইহি বললেন, যদি আলোচনা করতে চাও। আর যদি তীর নিক্ষেপ করো আমিও এর যথোচিত জবাব দিব। ওরা বললো, ঠিক আছে। শক্তি থাকলে জবাব দিন।

তাদের কথা শুনে হজরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তাদের সামনা-সামনি গেলেন। তলোয়ার চালাতে শুরু করলেন। তিনি একাই সত্তরজনের সঙ্গে মোকাবিলা করতে লাগলেন। ওরা তাঁর বীরত্বপূর্ণ আক্রমণে হতভম্ভ হয়ে গেলেন। হজরত ইমাম (রা.)-এর তলোয়ার চালনার সামনে ওরা টিকতে না পেরে পিছপা হলেন। হজরত কয়েকজনকে হত্যা করতে সক্ষম হলেন। অনেককে আহত করলেন। এই অবস্থায় তিনি নিজেও আহত হলেন। একটা তীরের আঘাতে সামনের দাঁত ভেঙে গেল। রক্ত বের হচ্ছিল। তখন তিনি বৃদ্ধা মহিলাটির কাছ থেকে পানি চাইলেন। মহিলা এক পেয়ালা পানি দিলেন। যখন তিনি পানি পান করতে মুখে নিলেন। সেই পানি মুখের রক্তে লালে লাল হয়ে গেল। তিনি পানি পান করলেন না। পেয়ালাটা মাটিতে রেখে তিনি মনে মনে বললেন, পানি আমার ভাগ্যে আর নেই। আমি জান্নাতুল ফিরদাউসে গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করব।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর