কভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর রূপ নেওয়ায় বেশির ভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্তব্ধ হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, সামনের দিনগুলোয় কোম্পানির কর্মীদের কাজে ঝুঁকি ও প্রতিবন্ধকতা অব্যাহত থাকবে। তাই একজন কর্মীকে দক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী হতে হবে। তবে এর মধ্যেও কিছু স্টার্টআপ কোম্পানি জমজমাট ব্যবসা করছে।
আবার অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো ব্যবসা করেছে এই করোনা পরিস্থিতিতে। এমন কিছু কোম্পানি নিয়েই আজকের রকমারি...
নিকেল এবং ওবলাডেনের কোম্পানি
জীবাণুমুক্ত করার উপায় খুঁজে ইউরোপজুড়ে ব্যবসা
বিমানবন্দর, রেলস্টেশন ও ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলোতে নানা মানুষের ছোঁয়ায় এস্কেলেটরের বেল্ট ও হ্যান্ডরেলিংগুলো জীবাণুর আড্ডাখানায় পরিণত হয়। সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ানো করোনা ভাইরাস মহামারীর মধ্যে যা আরও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থাকে পুঁজি করে ক্যাথারিন ওবলাডেন এবং তানজা নিকেল আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি ব্যবহার করে এগুলোকে জীবাণুমুক্ত করার উপায় বাজারে নিয়ে এসেছেন। তারা এস্কেলেটরের নিচে বসানোর জন্য ছোট একটি ইউভি লাইট বক্স তৈরি করেছেন। সেই লাইট থেকে বের হওয়া আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি এস্কেলেটরের ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস ও ভাইরাস মেরে ফেলবে। তারা বলেন, ‘সাধারণভাবে বললে এটা খুবই কার্যকর।’ এই যন্ত্র ইউরোপজুড়ে সরবরাহ করে নিকেল এবং ওবলাডেন দুজনই ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হয়েছেন এই করোনাকালে। প্রথম তাদের মাথায় জনসমাগমপূর্ণ স্থান জীবাণুমুক্ত করার পরিকল্পনা আসে এবং ২০১৬ সালে তারা একটি স্টার্টআপ প্রতিযোগিতায় জেতে।
অ্যামাজন ডটকম
অনলাইন কেনাবেচায় শীর্ষে অ্যামাজন
করোনাতেও লাভ করছে অ্যামাজন। অনলাইন কেনাবেচায় শীর্ষ প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই। ৩০ বছর আগে অ্যামাজন প্রতিষ্ঠা করেন জেফ বেজোস। গত কয়েক বছর এই প্রতিষ্ঠান দিয়েই বিশ্বের শীর্ষ ধনীর জায়গা দখল করেছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী। সাধারণ অনলাইন বই বিক্রেতা হিসেবে গ্যারেজে যাত্রা শুরু করা অ্যামাজন এখন অনলাইন রিটেইল জায়ান্ট খ্যাত প্রতিষ্ঠান। করোনাকালে মানুষ আরও বেশি ঝুঁকেছে অনলাইনের দিকে। ফলে কোম্পানিটিও ফুলেফেঁপে উঠেছে বহুগুণ। অ্যামাজন বিশ্বের এক নম্বর প্রতিষ্ঠান যা সবচেয়ে দ্রুত ১০০ বিলিয়ন বিক্রির রেকর্ড গড়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। ২০১০ সালে জেফ বেজোস ছিলেন বিশ্বের ৪৩তম শীর্ষ ধনী। বর্তমানে তিনি ১৮৩ বিলিয়ন ডলারের মালিক। গত ১০ বছরে তাঁর সম্পদ বেড়েছে ৯৭ দশমিক ৪ ডলার। তিনি অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা। করোনার প্রভাবে মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অনলাইনে কেনাকাটা করছেন। ফলে অ্যামাজনের আয় বাড়ছেই।
নিউট্রিমেডি
ঘরে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিয়ে বিশ্বের শীর্ষে
মহামারীর সময় চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সংক্রমণভীতি। হাসপাতাল বা চিকিৎসকের চেম্বারে ঝুঁকি বেশি- এই বিবেচনায় রোগীদের অনেকেই এসব স্থানে যেতে চাচ্ছেন না। কিন্তু চিকিৎসা তো দরকার! তাই তো করোনাকালে চিকিৎসা ক্ষেত্রে টেলিমেডিসিনই ভরসা। চিকিৎসক রোগীর সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন, কখনো এক্স-রে বা পরীক্ষার সুপারিশ করছেন। রোগী পরীক্ষার ফলাফল ম্যাসেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপে বা ই-মেইলে পাঠাচ্ছেন। চিকিৎসকও সেই মাধ্যম ব্যবহার করে ব্যবস্থাপত্র পাঠাচ্ছেন। আর টেলিমেডিসিন সেবায় বিশ্বের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান নিউট্রিমেডি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘মহামারীর সময় চিকিৎসার সেরা বিকল্প টেলিমেডিসিন। বিশ্বজুড়ে টেলিমেডিসিন সেবা ৫০ শতাংশ বেড়েছে।’ টেলিমেডিসিন সংস্থা নিউট্রিমেডি জানায়, ‘করোনাভাইরাসের কারণে চিকিৎসক ও রোগীরা টেলিমেডিসিন সেবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। অন্যান্য সময়ের চেয়ে করোনাকালে রোগীর পরিমাণ পাঁচগুণ বেড়েছে।’
রমরমা চলছে হোয়াইটহ্যাট জুনিয়র
কোডিং শেখানোর অনলাইন প্ল্যাটফরম
করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করেছে। করোনা মহামারীতে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিশু-কিশোরদের থাকতে হচ্ছে গৃহবন্দী। তাই স্বাভাবিকভাবেই শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ আর বিনোদনের জন্য বাবা-মাকে সাহায্য নিতে হয়েছে অ্যাপ ও গেমসের। তাতে করোনাকাল হয়ে ওঠে অনলাইন অ্যাপ ও গেমস ব্যবসায়ীদের জন্য পৌষ মাস। শিশুদের কোডিং শেখানোর এমনি একটি অনলাইন প্ল্যাটফরম ‘হোয়াইটহ্যাট জুনিয়র’। করোনাভাইরাস মহামারীতে পরিণত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে অনলাইনটি চালু হয়েছিল। লকডাউনের সময় তাদের প্রবৃদ্ধি রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ‘হোয়াইটহ্যাট জুনিয়র’-এর প্রধান নির্বাহী করন বাজাজ বলেন, ‘স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় আমাদের ব্যবসা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৫ লাখ শিক্ষার্থী অ্যাপটি ব্যবহার করেন।’ একইভাবে ‘স্কিল ফর স্কুল’ বা ‘শেয়ারজোন’-এর মতো অ্যাপের দর্শকও বৃদ্ধি পায় রকেটগতিতে। ‘শেয়ারজোন’-এর নিলস সায়েকার্ট বলেন, ‘কয়েক সপ্তাহ আগেও প্রতিদিন নতুন গ্রাহক বৃদ্ধি পেতেন ৩০০ থেকে ৫০০ জন। কিন্তু করোনাকালে তার পরিমাণ বৃদ্ধি পায় প্রায় পাঁচ থেকে ছয় গুণ হারে।’
ফেসবুক
আকাশছোঁয়া ব্যবসায়িক লাভ ফেসবুকের
মার্ক জুকারবার্গের বর্তমান সম্পত্তি ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ৭ বিলিয়ন জনসংখ্যার পৃথিবীতে এখন ফেসবুক ব্যবহারকারী অন্তত ২ বিলিয়ন। গোটা বিশ্ব ফেসবুকে আক্রান্ত। করোনাকালে ফেসবুকের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছেই। মানুষ ঘরে বসে থাকার কারণে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছেই। এর মধ্যেই ফেসবুক যোগ করেছে সবার অর্থ উপার্জনের উপায়। ফলে দিন দিন প্রতিষ্ঠানটির বাজারমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গের গত এক দশকে সম্পদ বেড়েছে ৬৮ বিলিয়ন ডলার। করোনার শুরুতে তাঁর সম্পদ ছিল ৫৪ বিলিয়ন ডলার আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৫ বিলিয়ন ডলারে। এর কারণ ঘরবন্দী মানুষ আরও বেশি করে ফেসবুকে সময় কাটিয়েছে। ফলে তাঁর আয়ও বেড়েছে ফেসবুকে। ২০০৪ সালে ফেসবুকের যখন যাত্রা তখন মার্ক জুকারবার্গের বয়স ১৯। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। কিন্তু ফেসবুক তাঁকে বানিয়ে দিয়েছে বিলিয়নিয়ার।
আলিবাবা ডট কম
ই-কমার্সে বাজিমাত আলিবাবার
করোনাকালে অনলাইন কেনাকাটা অনেক বেড়েছে। লকডাউনের সময় যখন রেস্তোরাঁসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে যখন লোকের বাড়িতে সাহায্যকারীও আসছেন না, সে সময় সকালের নাশতার রুটি, বিকালের নাশতার নানা আইটেমের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। যার ফলে খাদ্য এবং খুচরা পণ্য সরবরাহ (ডেলিভারি করা) পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়তি সুবিধা লাভ করে। ইতিমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান সংকটকালের চাহিদা পূরণে নতুন ডেলিভারি কর্মী নিয়োগ দেয়। যেমন আলিবাবা ডটকম। আলিবাবার করোনাকালে আয় করেছে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। এমনি আরেকটি কোম্পানি গ্রুবুথের ব্যবসায়িক উন্নয়ন পরিচালক ম্যাডলিন স্যান্ডলিন বলেন, ‘করোনাভাইরাস আমাদের ব্যবসার নতুন দিক উন্মোচন করেছে। ইতিমধ্যে আমরা ভোক্তার চাহিদা পূরণে নতুন ডেলিভারি কর্মী নিয়োগ দিয়েছি। শুধু তাই নয়, আমাদের অনলাইন প্ল্যাটফরমে আরও অনেক নতুন রেস্তোরাঁও যুক্ত হয়েছে।’
করোনার মধ্যেই শীর্ষ ধনী হয়েছেন ইলন মাস্ক
বিশ্বের শীর্ষ ধনী এখন টেসলা ও স্পেসএক্সের মালিক ইলন মাস্ক। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ১৮ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। করোনাকালে পুঁজিবাজারে টেসলার শেয়ারের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাস্ক তালিকায় শীর্ষে উঠে আসেন। দ্বিতীয় অবস্থানে নেমে যান বেজোস। মাস্কের সম্পদের পরিমাণ ফুলেফেঁপে উঠেছে বিদায়ী বছরে। অথচ ওই বছরের শুরুতে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৭০০ কোটি ডলার। টেনেটুনে শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় ছিলেন তিনি। তবে মাত্র ১২ মাসে সেই সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি ডলার। টেসলার ইলেকট্রিক কারের চাহিদাই এ সম্পদ বৃদ্ধির বড় কারণ। সেই সঙ্গে পুঁজিবাজারেও দ্রুত বেড়েছে শেয়ারের দর। এ ছাড়া মাত্র দেড় বছর আগে টেসলার শেয়ারের মূল্য কমে যাওয়ায় বড় ধরনের লোকসানে পড়তে হয়েছিল। এর ফলে আইনি ও নিয়ন্ত্রকদের পক্ষ থেকে মাস্কের নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অথচ এক বছরের মধ্যে পাশার দান ঘুরে গেল। টেসলার শেয়ারের দাম বেড়েছে ৯ গুণ। গত বছরের জুলাইয়ে বিনিয়োগগুরু ওয়ারেন বাফেটকে সরিয়ে বিশ্বের সপ্তম শীর্ষ ধনী হন মাস্ক। এরপর তিনি বিল গেটসকে ছাড়িয়ে ধনীর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসেন। গত বছর তিনি যে সম্পদ অর্জন করেছেন, তা মাইক্রোসফটের মালিকের ১৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারের সম্পদের চেয়েও বেশি। ইলন তাঁর যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন পে-পাল সিস্টেমের সাফল্যেও। অনলাইন প্ল্যাটফরমে লেনদেনের কথা উঠলে পে-পালের ওপরই নির্ভর করেন অনেকে। তার সফলতার গ্রাফ ওপরের দিকে উঠেছে পে-পালের সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গেই। খ্যাতি যেমন ছড়িয়েছে, তাঁর আয়ও বেড়েছে বহুগুণ। পে-সিস্টেমের উন্নয়নে এখনো কাজ করে যাচ্ছেন ইলন মাস্ক। টেসলা মটরস তাকে সানন্দেই তাদের কোম্পানির সিইওর জায়গায় বসিয়েছে।
স্বাভাবিক জীবনযাপনেই আমরা ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। আর করোনা সংক্রমণের সময় অধিকাংশ মানুষই ঘরে থাকছেন, ঘরে থেকে কাজ করতে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। লকডাউনে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে বিশ্বের কোথাও কোথাও মানুষকে ফ্রি ইন্টারনেট সার্ভিসও দেওয়া হচ্ছে। ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির সুবিধা এটিই যে, এসব কোনো সময় কিংবা দেশের সীমানা মানে না। ঠিক এ কারণেই করোনাকালে দেশি-বিদেশি সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে ওয়েব ডেভেলপার, অনলাইন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ পদের চাহিদা অনেক বেড়েছে। যার প্রভাবেই ইলন মাস্ক হয়ে উঠেছেন শীর্ষ ধনী।