করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে অনেক দেশেই চলছে টিকাদানের তোড়জোড়। বেশ কিছু টিকা এরই মধ্যে অনেক দেশে সরবরাহ করা হয়েছে। সর্বশেষ নতুন আসা টিকাগুলোও কার্যকারিতার দিক থেকে সফলতা পাচ্ছে...
নতুন যত ভ্যাকসিন
অনুমোদনের অপেক্ষায় কিউরভ্যাক
জার্মান বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি কিউরভ্যাক করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে তাদের এমআরএনএভিত্তিক প্ল্যাটফরমের কাজকে গতিশীল করার ঘোষণা দেয়। এ ক্ষেত্রে ৮০ মিলিয়ন ইউরোর আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেয় ইউরোপীয় কমিশন। প্রতিষ্ঠানটি তাদের তৈরি ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করে। নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা কাজে লাগিয়েই অল্প খরচে লাখো ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী তারা। এই বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই টিকা বাজারে আনার আশা করছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেলে এর আগেই কিউরভ্যাকের টিকা বাজারে চলে আসতে পারে। কিউরভ্যাকের টিকা তৈরির পেছনে রয়েছেন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস।
মানব ট্রায়ালে সফল কোভ-ইরান বারেকাত
মানব ট্রায়ালের প্রথম পর্যায় সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ায় দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে কোভ-ইরান বারেকাত ভ্যাকসিনটি। প্রথম পর্যায়ের ফলাফল পর্যালোচনার পর গবেষণা অনুমোদন করেছে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪০০ জনের দেহে এই টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। এখন তৃতীয় পর্যায়ে ২০ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর দেহে টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে। ‘কোভ-ইরান বারেকাত’ নামের এই টিকার মানব ট্রায়ালের অংশ হিসেবে প্রথম পর্যায়ে ধাপে ধাপে ৫৬ জনের দেহে তা প্রয়োগ করা হয়। টিকা তৈরির সঙ্গে যুক্ত গবেষক দল জানিয়েছেন, প্রথম পর্যায়ে তারা প্রত্যাশিত ফল পেয়েছেন। গত ২৯ ডিসেম্বর সকালে একজন নারী স্বেচ্ছাসেবীর দেহে প্রয়োগের মাধ্যমে ইরানের তৈরি টিকার মানব ট্রায়াল শুরু করা হয়েছিল।
জনসনের এক ডোজের ভ্যাকসিন
এক মাস আগেই জনসন অ্যান্ড জনসনের উদ্ভাবিত এক ডোজের কভিড-১৯ ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয় মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ)। এটিই এখন পর্যন্ত অনুমোদন পাওয়া করোনার একমাত্র এক ডোজের ভ্যাকসিন। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র করোনাভাইরাসের তিনটি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিল। এর আগে ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্নার ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছিল দেশটি। ওই দুই সংস্থার ভ্যাকসিন নিতে হয় দুই ডোজ করে।
কার্যকর স্পুটনিক-৫
দ্য ল্যানসেট গবেষণা জার্নালে বলা হয়েছে স্পুটনিক-৫ করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে প্রায় ৯২ শতাংশ কার্যকর। আগে উৎপাদন শুরু হলেও কার্যকারিতার চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, ভ্যাকসিনটি নিরাপদ এবং হাসপাতালে ভর্তি কিংবা মৃত্যু থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেয়। স্পুটনিক ভি ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মজুদ করা যায়।
আমেরিকায় ফাইজার, মডার্না, জনসন
যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত ১০৯ মিলিয়ন ফাইজার, ৯২ মিলিয়ন মডার্না এবং ৭.৯ মিলিয়ন জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা ব্যবহার করা হয়েছে। দেশটি ১৩০ মিলিয়ন জনসংখ্যার ১৮ বছর থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ্ব নাগরিকসহ সবাই এক ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা গ্রহণ করে তালিকার শীর্ষে আছে। মহামারী বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউচির দাবি কভিডের দ্বিতীয় ঢেউ যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছু বলা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তবে পর্যাপ্ত সচেতনতা এবং কিছু নিয়ম নীতি পালন করতে পারলে খুব শিগগিরই এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ৮৪ মিলিয়ন প্রবীণ নাগরিককে ইতিমধ্যেই টিকা দেওয়া হয়েছে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৩২.৫ শতাংশ। হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে টিকা দ্রুত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ হয়েছে।
যুক্তরাজ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন যুক্তরাজ্যে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয় গত বছর শেষের দিকে। যুক্তরাজ্যের মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথ কেয়ার প্রডাক্ট রেগুলেটরি অথরিটি (এমএইচআরএ) দেশটিতে এই ভ্যাকসিন ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়। টিকাটি নিরাপদ এবং কার্যকর। এই ভ্যাকসিনের প্রয়োগে তারা মানুষের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ছে বলে প্রমাণ পেয়েছেন। ১ হাজার ৭৭ জনের শরীরে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করার পর দেখা গেছে, তাদের শরীরে কভিড-১৯ প্রতিরোধকারী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া উৎপন্ন হয়েছে শ্বেত রক্তকণিকা, যা করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে। সিএনএনের তথ্য অনুযায়ী, মডার্না ও ফাইজারের ভ্যাকসিনের তুলনায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটি সংরক্ষণ ও পরিবহন সহজ। ভ্যাকসিনটি কমপক্ষে ছয় মাসের জন্য দুই থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা যাবে। অন্যদিকে মডার্নার ভ্যাকসিন মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ৩০ দিনের জন্য সংরক্ষণ করা যায়।
রাশিয়া ভ্যাকসিন উৎপাদনে এগিয়ে
ভ্যাকসিনের প্রতীক্ষায় তখন গোটা বিশ্ব; গবেষণা চলছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এ সময় প্রথম সুখবর দিয়েছিল রাশিয়া। সবার আগে মানব শরীরে করোনা ভ্যাকসিনের সফল প্রয়োগে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল রুশ বিজ্ঞানীরা। সেই সাফল্যের পথ ধরে সব পরিকল্পনামাফিক রেজিস্টার হয় বিশ্বের প্রথম করোনা ভ্যাকসিন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট খোদ ভøাদিমির পুতিন ঘোষণা করেন বিশ্বের প্রথম ভ্যাকসিন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, বিশ্বে প্রথমবার কোনো করোনা ভ্যাকসিন রেজিস্টার হলো। আমি জানি, এতে ভাইরাসকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি হবে। আর রাশিয়ার তৈরি করোনা ভ্যাকসিনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্পুটনিক-৫’। রাশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আগেই জানিয়েছিল, এই ভ্যাকসিনটি গোটা বিশ্বে সাড়া ফেলবে। উপকার হবে সাধারণ মানুষের। গামালেই রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অ্যালেক্সান্ডার গিন্টসবার্গ বলেন, ‘এটি মানব শরীরে কোনো ক্ষতি করবে না।’ এই ভ্যাকসিন মানব শরীরে কিছু জড় বা নিষ্প্রাণ পার্টিকলস তৈরি করবে। শরীরের অ্যাডিনো ভাইরাসের উপস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এগুলো তৈরি হবে। সেখান থেকেই তৈরি হবে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করার মতো অ্যান্টিবডি।
ভারতে আইসিএমআরের সঙ্গে ভারত বায়োটেকের যৌথ উদ্যোগে ভ্যাকসিন
নতুন বছরের শুরুতেই ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অধীন একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি দ্বিতীয় একটি করোনা ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয় বলে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছিল। কোভ্যাকসিন নামের এই ভ্যাকসিনটি ভারতেই আবিষ্কৃত হয়েছে। দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা আইসিএমআরের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ভারত বায়োটেক এই ভ্যাকসিনটি তৈরি করে। এ নিয়ে ভারতে দুটি করোনা ভ্যাকসিন জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এর আগে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনাভাইরাসের টিকাকে অনুমোদনের জন্য ছাড়পত্র দিয়েছিল ওই বিশেষজ্ঞ কমিটি। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশে ব্যবহার হচ্ছে এমন কভিড-১৯ ভ্যাকসিন শিগগির জরুরি অনুমোদন দেওয়ার কথা জানিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতে মে মাস থেকে ১৮ বছরের ওপরে সবার নিবন্ধনের নির্দেশনা দিয়ে রাজ্য সরকারগুলোতে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। তবে এবার কোভ্যাকসিন কিনতে রাজ্য সরকারের জন্য ৬০০, বেসরকারি হাসপাতালে ১২০০ রুপি খরচ করতে হবে। ভারত বায়োটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষ্ণ এম ইল্লারের বলেছেন, ‘উৎপাদনসহ ভ্যাকসিনের পরীক্ষা নিরীক্ষার খরচ নিজস্ব তহবিল থেকে এসেছে। তা তুলতেই এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।’ এ ছাড়াও দেশটির টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা সেরাম ইনস্টিটিউট এই দাম রাজ্য সরকারের জন্য ৪০০ বেসরকারি হাসপাতালের জন্য ৬০০ নির্ধারণ করায় সমালোচনা শুরু হয়েছে। আবার কেন্দ্রীয় সরকারকে ১৫০ আর রাজ্য সরকারগুলোকে ৪০০ রুপিতে টিকা বিক্রি করার ঘোষণায় সমালোচনার মুখে রয়েছে সেরাম ইনস্টিটিউটও। অন্যদিকে রাশিয়ার তৈরি করোনা ভ্যাকসিন ‘স্পুটনিক ভি’ ইতিমধ্যেই ভারতে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পায়। এ ছাড়াও ভারতে আরও পাঁচটি ভ্যাকসিন অনুমোদন পেতে যাচ্ছে। সে তালিকায় রয়েছে জনসন অ্যান্ড জনসন, জাইডাস ক্যাডিলা, সেরামের নোভাভ্যাক্স ও ভারত বায়োটেকের একটি নোজাল ভ্যাকসিন। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমা দেশ ও জাপান অনুমোদিত কভিড-১৯ ভ্যাকসিনগুলো জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে ভারত।
চীনে সফল ক্যানসিনো বায়োলজিকস ও সিনোভ্যাক বায়োটেক
ভ্যাকসিনের দৌড়ে এগিয়ে থাকা ১০টির বেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটিই চীনের। চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিকসের একটি ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনা গত বছর থেকেই চলে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণ হওয়ায় চীনের তৈরি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়। দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্যদের মাঝে এক বছরের জন্য ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। চীনের সেনাবাহিনীর গবেষণা ইউনিট ও ক্যানসিনো বায়োলজিকস যৌথভাবে ভ্যাকসিনটি তৈরি করেছে। চীনের তৈরি আটটি ভ্যাকসিন দেশে এবং বিদেশে মানবদেহে পরীক্ষার অনুমোদন পায়। অ্যাড ৫-এনকোভ নামের ভ্যাকসিন নিরাপদ প্রমাণিত হয়। তাই অনেক দেশের তুলনায় করোনা ভ্যাকসিন তৈরিতে অন্যতম সফল মানা হচ্ছে চীনকে। এদিকে সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেড দাবি করেছে, তাদের করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন নিরাপদ এবং পরীক্ষায় ৯০ শতাংশ ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনটি করোনাভাইরাসকে রুখে দিতে সক্ষম। এ ছাড়া মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দ্রুত বাড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এটি দুই সপ্তাহের মধ্যে শরীরে কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি করেছে। ট্রায়ালে ৯০ ভাগ মানুষের শরীরে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। করোনা মোকাবিলায় বছরে ১০ কোটি ডোজ করোনাভ্যাক উৎপাদনের জন্য তারা সক্ষম।
নিজস্ব তিনটি ভ্যাকসিন উৎপাদনে ইরান
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় নিজেরাই প্রতিষেধক উৎপাদন করবে বলে জানিয়েছে ইরান। মোট তিনটি ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে যাচ্ছে দেশটি। এর মধ্যে দেশটির বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত করোনার তিনটি টিকা মানবদেহে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগের তৃতীয় ধাপে রয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছে তেহরান। ইরানি গবেষণা সংস্থার মুখপাত্র হুজ্জাত নিক মালাকি আশা করছেন এই টিকার কার্যকারিতা ৯০ শতাংশের উপরে বলে প্রমাণিত হবে। তবে টিকার হিউম্যান ট্রায়াল শেষ হওয়ার পরই কেবল চূড়ান্ত কথা বলা যাবে। ইরানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই টিকা তৈরির জন্য গবেষণা শুরু করে দেশটির গবেষক ও বিজ্ঞানীরা। ইরানের করোনা মোকাবিলায় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান মো. মোখবের এক বিবৃতিতে জানান, স্থানীয় বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত কোভ-ইরান বারেকাত নামে করোনার টিকা উৎপাদন শুরু করা হবে। এক মাসে ১০ লাখ ডোজ টিকা উৎপাদন করে তা দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে তুলে দেওয়া হবে। পরে আগামী জুন নাগাদ আরও ৩০ থেকে ৩৫ লাখ ডোজ উৎপাদন করা হবে। সেপ্টেম্বর নাগাদ তারা ৫ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করবে।
ডিজিটাল টিকা পাসপোর্ট
ইদানীং ডিজিটাল টিকা পাসপোর্ট কথাটি চলে এসেছে। এটি হলো টিকা গ্রহণের ‘ডিজিটাল সনদ’। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশ করোনা টিকার ডিজিটাল পাসপোর্টের কথা ভাবছে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ একটি বিস্তারিত লেখা ছাপা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, আন্তর্জাতিক পাসপোর্টের মতো করোনা টিকার আন্তর্জাতিক ডিজিটাল পাস বা পাসপোর্টের ধারণাটি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। এদিকে ইইউ আপাতত কয়েক মাসের মধ্যে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট প্রস্তুত করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। গ্রীষ্মকালে ছুটির মৌসুমের আগেই সেই ‘ডিজিটাল গ্রিন পাসপোর্ট’ প্রস্তুত করে যতটা সম্ভব পর্যটনের সুযোগ করে দিতে চান তারা। অর্থাৎ ইইউ দেশগুলোর যে সব মানুষ টিকার সব ডোজ পেয়েছেন, তাদের আলাদা করে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। কিন্তু টিকা পেলেই সংক্রমণের আশঙ্কা দূর হবে, সব ক্ষেত্রে এখনো এমন প্রমাণ না পাওয়ায় সার্টিফিকেটের উপযোগিতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
যেমন, কোনো কোনো দেশে যেতে ইয়েলো ফিভার, রুবেলা প্রভৃতির টিকার সনদ দেখাতে হয়। করোনার ক্ষেত্রে আরও ভালো হবে যদি ডিজিটাল সনদের ব্যবস্থা করা হয়। ডেনমার্ক সরকার তিন-চার মাসের মধ্যে ‘ডিজিটাল টিকা পাসপোর্ট’ চালু করবে জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন ডিজিটাল টিকা পাসপোর্টের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নির্দেশনা দিয়েছে। আমাদেরও এগিয়ে থাকতে হবে। টিকা গ্রহণের পর ডিজিটাল টিকা পাসপোর্ট দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।
টিকা নেওয়ার পরও সাবধানতা
টিকা গ্রহণে সুরক্ষা নিশ্চিত হলেও একথা নিশ্চিত বলা যায় না যে আপনি আবার সংক্রমিত হবেন না। হয়তো করোনাভাইরাস আপনার নাক-মুখের মাধ্যমে দেহে ঢুকতে পারে এবং এরপর আবার হাঁচি-কাশি অন্যকে আক্রান্ত করতে পারে। তাই এর প্রতিকারের জন্য মাস্ক পরা দরকার। আর তা ছাড়া এমনও হতে পারে যে টিকা গ্রহণের কয়েক দিন আগে-পরে হয়তো কেউ করোনায় সংক্রমিত হলো। টিকা গ্রহণের সময় হয়তো এর কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। এ অবস্থায় টিকা নিলেও অন্তত ১০-১৫ দিনের আগে এর সুফল পাওয়া যাবে না। এ অবস্থায় মাস্ক না পরলে নিজে তো বটেই, অন্য অনেকে সংক্রমিত হতে পারেন। তাই মাস্ক পরা দরকার। তবে শুধু নিজের টিকা গ্রহণই যথেষ্ট নয়। দেশে মোটামুটি হার্ড-ইমিউনিটি না হওয়া পর্যন্ত সবারই মুখে মাস্ক পরে চলাফেরা করা দরকার। তবে শুধু নিজের টিকা গ্রহণই যথেষ্ট নয়। দেশে মোটামুটি হার্ড-ইমিউনিটি না হওয়া পর্যন্ত সবারই মুখে মাস্ক পরে চলাফেরা করা দরকার। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় তাই মাস্ক ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
টিকা দেওয়ায় এগিয়ে যারা
নয় দিনের মধ্যেই বেশির ভাগ জনগণকে কভিড-১৯ এর টিকা দিয়ে ভুটান রেকর্ড করেছে। তাদের ৬১ শতাংশ জনগণ ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়েছে। এএফপি জানায়, ভারত থেকে পাওয়া অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন নিয়ে টিকা কর্মসূচি শুরু করে হিমালয়ের ছোট্ট দেশ ভুটান। দেশটির ৭ লাখ ৭০ হাজার জনগণের মধ্যে ৪ লাখ ৭০ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার ৬১ দশমিক ৩ শতাংশ। এদিকে করোনার তথ্য নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটার এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে জনসংখ্যা অনুপাতে শতাংশের হারে এগিয়ে আছে ইসরায়েল। দেশটিতে ইতিমধ্যে তার ৬২ দশমিক ১ শতাংশ জনগণকে টিকা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ৪২ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৫০ শতাংশ, স্পেনে ২৩ শতাংশ, ইতালিতে ২১ শতাংশ, জার্মানিতে ২৩ শতাংশ, বেলজিয়ামে ২৩ শতাংশ, ফ্রান্সে ২১ শতাংশ, কানাডায় ৩০ শতাংশ, নেদারল্যান্ডস ২১ শতাংশ, ব্রাজিল ১৩ শতাংশ, ভারতে ৮ শতাংশ মানুষ টিকা পেয়েছে। এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষার অপেক্ষায় আছে ১৭১টি টিকা। টিকার নিরাপত্তা নিয়ে স্বল্প পরিসরে পরীক্ষার পর্যায়ে আছে ১৯টি, বিস্তৃত পরিসরে পরীক্ষার পর্যায়ে আছে ২৫টি।
নতুন স্ট্রেইন ও বুস্টার ডোজ
টিকা তৈরিতে এগিয়ে থাকা তিনটি বড় প্রতিষ্ঠান হলো ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা। এর মধ্যে ফাইজার ও মডার্না আরএনএ প্রযুক্তির টিকা তৈরি করেছে যা পদ্ধতি হিসেবে নতুন। কিন্তু প্রতিনিয়তই ধরন পাল্টাচ্ছে করোনা। নিত্য নতুন স্ট্রেইনে মানুষ হয়ে পড়েছে দ্বিধান্বিত। আর তাই অধিক সুরক্ষার জন্যই প্রয়োজন বুস্টার ডোজ। প্রথম ডোজ টিকায় কিছু সুরক্ষা হয় ঠিকই, কিন্তু বুস্টার ডোজ গ্রহণ না করলে সেই সুরক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৫ জানুয়ারি ২০২১ বিবিসির ফিচারে জারিয়া গরভেট বিষয়টি বেশ সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। বিশেষজ্ঞরা সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছে প্রথম টিকা নেওয়ার পর দেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা রক্তের দুটি গুরুত্বপূর্ণ শ্বেতকণিকাকে সক্রিয় করে। প্রথমত প্লাজমা বি-সেল। এরা প্রধানত অ্যান্টিবডি তৈরির প্রতি মনোযোগ দেয়।
কিন্তু এই সেলগুলোর স্থায়িত্বকাল কম। তাই প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর রক্তে প্রচুর অ্যান্টিবডি থাকলেও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া না হলে এদের সংখ্যা কমে যায়। আরেকটি হলো টি-সেল। নির্দিষ্ট প্যাথোজেন চিহ্নিত করে এদের অকার্যকর করে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে এরা। এদের মধ্যে কিছু থাকে ‘মেমোরি টি-সেল’। এরা দেহে কয়েক দশক টিকে থাকে।