সোমবার, ২১ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

দীর্ঘকায় কৃষ্ণাঙ্গের দেশে

দীর্ঘকায় কৃষ্ণাঙ্গের দেশে

বিচিত্র সব রীতি ও প্রথা নিয়ে জীবন-জীবিকার যুদ্ধে নিয়োজিত বিশ্বের সর্বশেষ স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ দক্ষিণ সুদানের মানুষ। তেল, সোনাসহ প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা থাকলেও উত্তোলনের প্রযুক্তি ও সামর্থ্য নেই। নিজেরা হানাহানিতে লিপ্ত।  সেখানে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শান্তিরক্ষার দায়িত্বে আছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। দক্ষিণ সুদান ঘুরে এসে লিখেছেন -  শিমুল মাহমুদ

 

দক্ষিণ সুদানে ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম দিন সন্ধ্যার পর থেকেই আলোচনাটা চলছিল। বলা হচ্ছিল, রাতে সবকিছু নীরব হলে এখানে সাপ চলে আসে। ভয়াবহ বিষাক্ত সেই সাপ। যার এক ছোবলের বিষে ১৫/২০ জন পর্যন্ত মানুষ মারা যেতে পারে! আপনি ধরেন, এক জায়গায় বসে আছেন। হঠাৎ দেখবেন একটা সাপ এসে মাথা সমান উঁচু ফণা তুলে আছে। তখন তো হার্টফেল করেই মারা যাওয়ার অবস্থা হয়। এ রকম কিছু আলোচনার মধ্যেই একজন কর্মকর্তা অনেক খুঁজে তার মোবাইল ফোন থেকে একটি সাপের ভিডিও দেখালেন। বাংলাদেশ কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির মাঠের সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়া সেই ভিডিওতে দেখা যায়, মাঠের মাঝখানে কর্মকর্তাদের বসার চত্বরে একজন বসে আছেন। রাতের উজ্জ্বল আলোয় ঘাসের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে লম্বা এক সাপ। সেটি চত্বরে বসা ভদ্রলোকের পায়ের কাছে যেতেই তিনি লাফ দিয়ে চত্বরের বেষ্টনী ডিঙিয়ে দৌড়ে মাঠ পেরোলেন। তারপর ‘সাপ’, ‘সাপ’ বলে চিৎকার। ভিডিও দেখলেই ভয় ধরে যায়। সাপের ভিডিও দেখা শেষে ভদ্রলোক বললেন, আপনারা যেখানে থাকছেন সেখানকার প্রতিটি রুমের নিচের অংশটি সিল করা। সাপ, বিচ্ছু কোনো কিছুই ঢুকতে পারবে না।

এরপর সবাই রাতের খাবার খেয়ে যার যার রুমে ফিরে আসি। আমাদের জন্য অফিসাররা তাদের রুমগুলো ছেড়ে দিয়েছেন। এক রুমে আমরা তিনজন, পাশাপাশি তিন বিছানায়। সঙ্গী দুজন ইত্তেফাকের আবুল খায়ের ও মাছরাঙা টেলিভিশনের মহসীন আব্বাস।

রাতে ঘুমানোর আগে রুমটা একটু ভালোভাবে চেক করতে গিয়ে দেখি, অ্যাটাচড বাথরুমের দরজার নিচের দিকে সামান্য একটা অংশ ভাঙা। রুমমেটদের একজন বললেন, এদিক দিয়ে যদি সাপ চলে আসে। আরেকজন গিয়ে বাথরুমের কমোডের ঢাকনা নামিয়ে দিয়ে এসে ঘোষণা দিলেন, বাথরুম সেরে সবাই কমোডের ঢাকনাটা বন্ধ রাখবেন। বলা তো যায় না। ঘুমানোর প্রস্তুতি নেওয়ার আগে এক সৈনিক সালাম দিয়ে রুমে ঢুকলেন। বললেন, স্যার, এই লাঠিটা রাখেন। রাতে যদি সাপ চলে আসে তখন মারতে পারবেন। আফ্রিকার এই বিপজ্জনক জনপদে রাতের বেলা কাউকে যদি এমন করে সাপ মারার লাঠি এগিয়ে দেওয়া হয় তখন তার তো জানের বারোটা বেজে যাওয়ার কথা।

একজন বললেন, ওইদিকে কিসের শব্দ এটা? বাথরুম থেকে ফোঁস ফোঁস করে শব্দ আসছে। তখন অনেক রাত। সে রাতে আর বাথরুমে গেলেন না কেউ। সকালেও শুনি সাপের মতো হিস হিস করা শব্দ আসে বাথরুম থেকে। তিনজনই একযোগে বাথরুমে ঢুকে শব্দের উৎস খুঁজি। শব্দ আসছে বেসিনের কলের ভিতর থেকে এবং কমোডের ওপরের পানির টাংকি থেকে। প্রতিটি সেকেন্ডে একবার বিপ করে শব্দ বেরোয়। কমোড ফ্লাশ করলে বেশ জোরে শব্দ হয়।  পরে সারা দিন সাপের মতো হিস হিস শব্দ করে। পরে জানা গেল, পানি সাশ্রয়ের জন্য বাথরুমে ডিভাইস লাগানো হয়েছে।


স্বাদহীন স্বাধীনতায় দক্ষিণ সুদান

বয়সের হিসাবে দুনিয়ার সবচেয়ে কনিষ্ঠ রাষ্ট্র দক্ষিণ সুদান স্বাধীনতার একটি দশক পার করে ফেলেছে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন ছাড়াই। রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত, গোষ্ঠীগত সংঘাত, সহিংসতা এবং দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতির মধ্যে দিন পার করছে দেশটি। ২০১১ সালে স্বাধীন হওয়া দেশটি হতে পারত এক উন্নত, সমৃদ্ধ জনপদ। কিন্তু অনেক সম্ভাবনা সত্ত্বেও দক্ষিণ সুদান কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। বাংলাদেশের প্রায় পাঁচগুণ বড় এই দেশটির মাত্র দেড় কোটি মানুষ তিন বেলা ঠিকমতো খেতেও পারে না।

সুদান ভেঙে ২০১১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে দক্ষিণ সুদান। তার মাত্র দুই বছর পরেই দেশটির প্রেসিডেন্ট সালভা কির এবং তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়েক মাচারের প্রতি অনুগত বাহিনীগুলো দ্রুত লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। নির্মম এ সহিংসতায় প্রায় ৪ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এতে নতুন দেশটি গড়ে তোলার সব তৎপরতা ভন্ডুুল হয়ে যায়। দেশকে নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ে নেমে যায় সেখানকার জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো। দক্ষিণ সুদানের বৃহত্তর জাতি গোষ্ঠী নুয়েরের সদস্য মাচার এবং অন্যতম জনবহুল গোষ্ঠী ডিঙ্কার সদস্য কির। এরা দুজনই পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ান। স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার বদৌলতে দেশটিতে এখন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর তত্ত্বাবধান চলছে। ৫২টি দেশের প্রায় ১৪ হাজার শান্তিরক্ষী এখন দক্ষিণ সুদানে। দেশটির রাজধানী জুবায় সন্ধ্যার পর চলছে প্রতিদিনের কারফিউ।  সূর্যের আলো নিভে যাওয়ার পরই এক ভুতুড়ে নগরে পরিণত হয় রাজধানী।


ডিঙ্কাদের নিয়ে সর্বত্র আলোচনা

দক্ষিণ সুদানের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ডিঙ্কাদের বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘদেহী মানুষ। ডিঙ্কা পুরুষের গড় উচ্চতা ৬ ফুট ছুঁই ছুঁই। উচ্চতার কারণে বৈশ্বিক বাস্কেট বল প্রতিযোগিতায়ও ঠাঁই করে নিয়েছেন একাধিক ডিঙ্কা সদস্য। কৃষ্ণাঙ্গ দীর্ঘকায় গড়নের এ জনগোষ্ঠী দক্ষিণ সুদানের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ। সম্প্রতি দেশটিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কন্টিনজেন্টগুলো পরিদর্শনকালে ডিঙ্কা সম্প্রদায়ের অনেক সদস্যের দেখা মেলে। সর্বশেষ ২০০৮ সালে অবিভক্ত সুদানের আদমশুমারি অনুসারে ডিঙ্কা সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা প্রায় ৪৫ লাখ। তবে ২০১৩ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধে তাদের কয়েক লাখ মানুষ মারা যায়। মূলত নীলনদের উপত্যকা ও আফ্রিকান গ্রেট লেক অঞ্চলের বসতিহীন কৃষিজীবী মানুষ ডিঙ্কারা নিলোটিক ভাষায় কথা বলে। অনেকে আবার আরবি ভাষাভাষী। ডিঙ্কারা বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত তাদের অস্বাভাবিক দৈহিক উচ্চতার জন্য। বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা মানুষ বিবেচনা করা হয় তাদের। এক গবেষণায় ডিঙ্কা জাতিগোষ্ঠীর নমুনা পরীক্ষায় গড় উচ্চতা মিলেছে ১৮২ দশমিক ৬ সেন্টিমিটার বা ৫ ফুট ১১ দশমিক ৯ ইঞ্চি। দেশে ফেরার আগের দিন এক সেনা সদস্য বললেন, ভাই একটা ডিঙ্কা নিয়ে যান। সারা জীবন মাথা উঁচু করে চলবেন।  সংসারে আর কখনো মাথা নিচু করে চলতে হবে না।


যন্ত্রণাদায়ক শারীরিক বিকৃতি

ইউরোপ-আমেরিকায় শারীরিক সৌন্দর্যের অনুষঙ্গ হিসেবে অনেকে শরীরে ট্যাটু করে বা উল্কি আঁকে। এটা এখন শিল্পের পর্যায়ে। কিন্তু দক্ষিণ সুদানের কয়েকটি উপজাতির মধ্যে প্রথা হিসেবে শরীরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে দাগ সৃষ্টি করা যন্ত্রণাদায়ক শারীরিক বিকৃতির পর্যায়ে চলে গেছে। নুয়ের সম্প্রদায়ের পুরুষরা দাগযুক্ত কপাল পছন্দ করে এবং তাদের অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক ছেলেরা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার সময়ে শরীরে ট্যাটু করে। উপজাতিগুলো ধারালো উপকরণ দিয়ে নানা ভঙ্গিমায় তাদের শরীরে দাগ আঁকে। মাংসের সূক্ষ্ম ঘূর্ণন থেকে শুরু করে জটিল ডটেড প্যাটার্ন পর্যন্ত আঁকা হয় তাদের শরীরে। কারণ, তারা মনে করে এগুলো কেবল কোনো দাগ নয়। এতে সৌন্দর্য থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত সব কিছুকে বোঝায়।

শরীর কাটতে তারা ক্ষুর, ব্লেড কিংবা ধারালো ছুরি ব্যবহার করে। অনেক সময় একসঙ্গে অনেকের শরীর কেটে নিদর্শন তৈরি করা হয়। তখন শেয়ার করা ব্লেড ব্যবহার করা হয়, যা বড় রকমের স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। উপজাতীয় সম্প্রদায় মনে করেন, দাগ হলো উপজাতি নারীদের সৌন্দর্যের চিহ্ন। এটিকে ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা হিসেবেও দেখা হয়, যাতে তারা ভবিষ্যতে সন্তান প্রসবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে।

মুরসি উপজাতি শরীরের দাগকে সৌন্দর্য এবং শক্তির চিহ্ন বলে মনে করে। আফ্রিকায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শরীরে দাগ কাটা একটি ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা হয়ে উঠছে। প্রতিবেশী টোপোসা উপজাতি, যেটি ইথিওপিয়া এবং দক্ষিণ সুদান উভয় অংশেই বাস করে তারাও শরীরের চামড়া কেটে দাগ সৃষ্টি করাকে পছন্দ করে। তবে তারা মুখের ডট প্যাটার্নের সঙ্গে বিস্তৃত বডি এচিংগুলোকেও একত্রিত করেছে। স্বাস্থ্য ঝুঁকি সত্ত্বেও শরীরে দাগ কাটা উপজাতীয় জীবনে বিশাল ভূমিকা পালন করে চলেছে। তবে মুসলিম অধ্যুষিত সুদানে এই ট্যাটু বা উল্কি প্রচলিত নয়। তারা এটিকে সাধারণভাবে গ্রহণীয় বলেও মনে করে না।


পানির জন্য হাহাকার

স্থলবেষ্টিত (ল্যান্ডলকড) দক্ষিণ সুদানে পানির অনেক কষ্ট। বৃষ্টির পরিমাণ খুব কম। তাদের মাথাপিছু পানি ব্যবহারের পরিমাণও কম। দেশটির অধিকাংশ মানুষ নিয়মিত গোসল করারও সুযোগ পায় না। পানির একমাত্র উৎস হোয়াইট নাইল। এটি দীর্ঘ নীলনদের একটি খরস্রোতা ধারা। পানির এত সমস্যার মধ্যেও মাটির নিচ থেকে পানি তোলার অনুমতি দেয় না তাদের সরকার। তাদের আশঙ্কা, মাটি খননের মাধ্যমে কোনো না কোনোভাবে তাদের বিপুল খনিজ সম্পদ বেহাত হয়ে যেতে পারে। ফলে সেখানে নিয়োজিত জাতিসংঘের ৫২টি দেশের ১৪ হাজার শান্তিরক্ষী, মিশন এক্সপার্ট ও স্টাফ অফিসারকে এই নদীর পানিই পরিশোধন করে ব্যবহার করতে হয়। পানি সংগ্রহ করতে হয় নীলনদ থেকে। পানযোগ্য পানির জন্য এই দেশটিতে যেন কারবালার মাতম চলছে।

প্রতিদিন সশস্ত্র পাহারা দিয়ে পানির লরিগুলো নদীর তীরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ এক অন্য রকম যুদ্ধযাত্রা। নদীর তীরে পানি তোলার পাম্প বসানো আছে। সেখান থেকে পানিভর্তি লরিগুলো আবার সশস্ত্র পাহারা দিয়ে বিভিন্ন দেশের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এই দৃশ্য দেখে মনে হতে পারে যেন পানির জন্য যুদ্ধ চলছে। নদীতে গোসল করছে দিগম্বর হয়ে সব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। কারও প্রতি কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। গোসল সেরে সংক্ষিপ্ত কাপড় পরে যার যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। অনভ্যস্ত চোখে এই দৃশ্য অত্যন্ত অস্বস্তিকর লাগে। বাতাসে তখন ৩৯ ডিগ্রি তাপমাত্রার উত্তাপ। মানুষ কতটা অসহায় হলে এভাবে চলতে পারে!


যার যত গরু তার তত বউ

দক্ষিণ সুদানে বিয়ের বাজারে আলাদা মর্যাদায় অভিষিক্ত নিরীহ প্রাণী গরু। কেউ বিয়ে করতে চাইলে তার পর্যাপ্ত গরু থাকতে হয়। বিয়েতে মেয়ের বাবাকে সর্বনিম্ন পাঁচটি গরু উপহার দিতে হয়। কন্যা যদি হয় রূপে-গুণে অনন্যা, তাহলে ১০ থেকে ২০টা গরু দিতে হয়। সেখানে যার যত বেশি গরু আছে তার তত বেশি বউ। কেউ কেউ ১০০ থেকে ২০০ গরু মেয়ের বাবাকে দিয়ে বিয়ে করছেন। সেখানকার নিয়ম অনুযায়ী, যার যত গরু আছে, তিনি তত বেশি বিয়ে করতে পারেন। দক্ষিণ সুদানে সংঘাত-সহিংসতার মূলেও রয়েছে এই গরু। নিজেদের মধ্যে প্রধানত যুদ্ধ হয় গরু নিয়ে। যাদের অনেক গরু আছে তারা গরু পাহারার জন্য স্বয়ংক্রিয় ভারী অস্ত্র বহন করেন। বিরাট শিংয়ের জন্য বিখ্যাত সুদানি এই গরু আট ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। কমপক্ষে পাঁচটা গরু না থাকলে সারা জীবন বিয়েই করতে পারে না কেউ কেউ। এরপর ১০০ গরু থাকলে দ্বিতীয়বার বিয়ে করা যায়। এভাবে ৫ থেকে ২০টা পর্যন্ত বিয়ে করেন কেউ কেউ। অধিক পরিমাণে মাংস আর দুধ দেওয়ার কারণে চোরা শিকারিদেরও প্রধান লক্ষ্য এই গরু।


ছবি তুলতে মানা

যাত্রীবাহী বাসের সামনের গ্লাসে ইংরেজিতে লেখা, ‘ডু গুড ফর আদারস, ইট উইল কাম ব্যাক ইন আনএক্সপেক্টেড ওয়েজ।’ লেখাটা ভালো লাগায় মনের ভুলেই সামনের জিপ থেকে দুটি ছবি তুলেছিলাম। আট দিন ধরে সচেষ্ট প্রয়াসে ছবি তোলার ইচ্ছা দমন করেছি। শেষ দিনে ধরা খেলাম। শেষ দিন আর শেষ রক্ষা হলো না। একটু সামনে গিয়ে সিগন্যালে জিপ থামার পর দুই পাশ থেকে সজোরে কয়েকজনের ধাক্কা। আমার দুই পাশে চারজন বাংলাদেশের সশস্ত্র শান্তিরক্ষী। পারলে তাদের মধ্য থেকে আমাকে তুলে নিয়ে যায়। কারণ, কালো মানুষদের শান্তি নষ্ট করেছি আমি। আমাদের ড্রাইভার তাদের কোনো রকমে বোঝালেন, বেড়াতে এসেছি। না বুঝে ছবি তুলেছি। ভুল হয়ে গেছে। তারা কী বুঝলেন, জানি না। ফিরে গেলেন। তবে আমি বুঝলাম, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। আফ্রিকান মাইর থেকে বাঁচলাম। ২৫ মার্চ দুপুর ২টায় আমাদের ফেরার ফ্লাইট। আমরা ছয় সাংবাদিক যাচ্ছিলাম জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ডেপুটি ফোর্স কমান্ডারের (বাংলাদেশি মেজর জেনারেল) সাক্ষাৎকার নিতে। পথে এই ঘটনা। এর আগে ১৮ মার্চ জুবা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে

নেমেই টের পেলাম নিরাপত্তা পরিস্থিতি। আমাদের বার বার বলা হয়, এই কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের কোনো ছবি তোলা যাবে না। তারা এসব পছন্দ করে না। তারা চায় না, তাদের দারিদ্র্য মিডিয়ার সামনে যাক। তাদের দারিদ্র্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী উপহাস হোক। সেই থেকে বাইরে বেরিয়ে কোনো ছবি তুলিনি। নীল নদের স্বচ্ছ পানিতে গোসলরত দিগম্বর নারী-পুরুষের ছবি চোখের লেন্সে ধারণ করেছি। মোবাইলের ক্যামেরায় তেমন তোলা যায়নি।


আবেই সম্ভাবনার নতুন মিশন

বাংলাদেশের জন্য আফ্রিকায় নতুন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন আবেই। ইউনাইটেড ন্যাশন ইনটেরিম সিকিউরিটি ফোর্স ফর আবেই (ইউনিসিফা) এলাকায় মোতায়েন হচ্ছে পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী। ১ মার্চ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি কন্টিনজেন্টের ১৬০ সদস্যের প্রথম দল আবেই গেছে। সেনাবাহিনীর এই কন্টিনজেন্টটি নতুনভাবে সুদান ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যবর্তী বিশেষ প্রশাসিত এলাকা আবেইতে মোতায়েন করা হয়েছে। এই মিশনের সীমান্ত পর্যবেক্ষণ মেকানিজমের অংশ হিসেবে তিন দশকের বেশি সময় ধরে শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই কন্টিনজেন্ট সরাসরি অপারেশন এলাকায় জরুরি মোতায়েন করা হয়েছে। জাতিসংঘ সদর দফতরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দ্রুততার সঙ্গে এই কন্টিনজেন্টকে প্রস্তুত করেছে। কন্টিনজেন্টের অবশিষ্ট দল (মোট ৫১২ জন) এপ্রিল মাসের মধ্যে মোতায়েন করা হবে। উল্লেখ্য, সুদান ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যবর্তী আবেই অঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ মানুষের বসবাস। আয়তন ১০ হাজার ৫৪৬ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালে তারা সুদানের কোনো অংশের সঙ্গেই যেতে চায়নি। নিজেরাও এক থাকেনি। ফলাফল, শান্তিরক্ষা মিশন।


সড়কদ্বীপে বাসক গাছ

চিনতে মোটেও সমস্যা হয়নি। রাজধানী জুবার সড়কদ্বীপে শত শত বাসক গাছ। কোনো কোনোটিতে বড় বড় আকারের ফল ধরে আছে। বেড়ে উঠছে অযত্নে অবহেলায়। এই আপাত কঠিন, রুক্ষ, শুষ্ক, মরুময় দেশটিতে সর্বত্র ঔষধি গাছের বিস্তার। বাড়ির আঙিনায়, রাস্তার পাশে ও সড়কদ্বীপে অসংখ্য বাসক গাছ। সর্বত্র কৃষ্ণচূড়া, ভেরেন্ডা ও নিমগাছের ছড়াছড়ি। আর রয়েছে শজিনা গাছ। সংখ্যায় প্রচুর। গাছগুলো আমাদের শজিনার মতো এত বড় নয়। খুবই ছোট ঝাঁকড়া গাছে বড় আকারের ফল ধরে আছে। সর্বশেষ গবেষণায় শজিনাকে বলা হচ্ছে, এটি এই সময়ের সুপারফুড। সেখানে এই ছোট ছোট শজিনা গাছ দেখে আমার তো মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। কিন্তু ডাল কেটে নেওয়ার কোনো সুযোগই নেই। বিমানবন্দরে স্ক্যানে ধরা পড়লে বিপদ। অন্যদিকে গাড়ি থেকে নেমে সড়কের পাশের গাছ থেকে বীজ সংগ্রহেরও কোনো অনুমতি নেই। বেশ কয়েকজনকে বলার পর মেজর আল আমীন ভাইয়ের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত কিছু শজিনার বীজ পাওয়া গেল।

সর্বশেষ খবর