সোমবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

অনিয়মে আদানি সাম্রাজ্যে ধস

তানভীর আহমেদ

অনিয়মে আদানি সাম্রাজ্যে ধস

প্রায় দুই যুগ ধরে ভারতে ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন গৌতম আদানি। সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ, খনি, রেল, অবকাঠামো এমন অর্ধশতাধিক ব্যবসা রয়েছে তার। গড়ে তুলেছেন টাকার পাহাড়। হয়ে যান বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী!  এবার পরিকল্পনা ছিল শেয়ার বিক্রি করে বড় তহবিল সংগ্রহ করবেন। ঠিক তার আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিনডেনবার্গ রিসার্চ ফার্ম এক প্রতিবেদন প্রকাশ করল। তাদের দাবি, শেয়ার কারসাজি এবং আর্থিক লেনদেনে প্রতারণা চালিয়ে আসছে আদানি গ্রুপ। বেআইনি লেনদেন, কর ফাঁকি ও আইন ভেঙে নথিভুক্ত সংস্থা থেকে অন্যখানে অর্থ সরিয়ে নিয়েছে আদানি শিল্পগোষ্ঠী। আর তাতেই রাতারাতি মুখ থুবড়ে পড়েছে আদানি গোষ্ঠীর সংস্থাগুলোর শেয়ার দর।  অনিয়মে নড়ে উঠল আদানি সাম্রাজ্যের ভিত...

 

কারা চালায় হিনডেনবার্গ রিসার্চ ফার্ম

আদানি গ্রুপের শেয়ার কেলেঙ্কারির প্রতিবেদনটি করেছে হিনডেনবার্গ রিসার্চ ফার্ম। যুক্তরাষ্ট্রের এ ফার্মটির কাজ হলো কোনো সংস্থার শেয়ার বিক্রিতে কারসাজি হচ্ছে কি না, বাজার থেকে সংস্থাগুলো যে ঋণ নিচ্ছে তাতে স্বচ্ছতা রয়েছে কি না- এমন বিষয় যাচাই করা। হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতার নাম নাথান অ্যান্ডারসন। একসময় ইসরায়েলে অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক পাস করেছেন। পড়াশোনা শেষে ‘ফ্যাক্টসেট রিসার্চ সিস্টেমস আইএনসি’ নামে এক সংস্থায় ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। ২০১৭ সালে হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিষ্ঠা করেন অ্যান্ডারসন। আমেরিকার বৈদ্যুতিক ট্রাক নির্মাণকারী সংস্থা নিকোলা করপোরেশনের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তুলেছিল হিনডেনবার্গ রিসার্চ। তার অভিযোগের পর শেয়ারবাজারে হইচই পড়ে যায়। পরে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে নিকোলার প্রতিষ্ঠাতা ট্রেভর মিল্টনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন আমেরিকার একটি আদালত।  এবার আদানি শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগের ক্ষেত্রেও একই দাবি করেছে হিনডেনবার্গ।

 

কী আছে সেই প্রতিবেদনে

হিনডেনবার্গের প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, দশককাল ধরে শেয়ার কারসাজি এবং আর্থিক লেনদেনে প্রতারণা চালিয়ে আসছে আদানি গ্রুপ। এ নিয়ে দুই বছর ধরে তদন্ত চালিয়েছে বলে জানায় হিনডেনবার্গ রিসার্চ। আদানি গ্রুপের কোম্পানির শেয়ার গত কয়েক বছরে ৫০০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। গৌতম আদানির ১৩ হাজার কোটি ডলার সম্পদের ১০ হাজার কোটি ডলারই অর্জিত হয়েছে গত তিন বছরে স্টক জালিয়াতির মাধ্যমে। আদানি গ্রুপ অন্য লোকের ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচুর শেয়ার কিনে নিজের শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে। আদানির পাঁচ কোম্পানি এ ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। এই পাঁচ বড় কোম্পানি শেয়ারবাজার থেকে ‘ডি-লিস্টিং’ তথা বাদ পড়তে পারে। এই কোম্পানিগুলোর শেয়ারে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত পতন হতে পারে। একই সঙ্গে হিনডেনবার্গ আর্থিক হিসাবে জালিয়াতির অভিযোগও এনেছে। আদানি শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে করস্বর্গ (ট্যাক্স হ্যাভেন) ব্যবহারের অভিযোগ তোলা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। মরিশাস, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো যেসব দেশে আয়কর ছাড়ের সুবিধা আছে, সে রকম কিছু দেশে আদানি পরিবারের মালিকানাধীন ভুয়া কোম্পানি আছে।  সেগুলোর মাধ্যমে বেআইনি লেনদেন, কর ফাঁকি ও আইন ভেঙে নথিভুক্ত সংস্থা থেকে অন্যখানে অর্থ সরিয়ে নিয়েছে আদানি শিল্পগোষ্ঠী।

 

আদানি গ্রুপের কত টাকা ক্ষতি হলো

প্রতিবেদনটি প্রকাশ্যে আসতেই ভারতের শেয়ারবাজারে শোরগোল পড়ে যায়। রাতারাতি মুখ থুবড়ে পড়েছে আদানি গোষ্ঠীর সংস্থাগুলোর শেয়ার। আদানির মূল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আদানি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এরই মধ্যে তারা ২৫০ কোটি ডলারের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। আদানি গ্রিন এনার্জি লিমিটেড ও আদানি টোটাল গ্যাসের মতো কিছু সহযোগী সংস্থা দৈনিক ২০ শতাংশ পতনের সীমা স্পর্শ করেছে। আদানি গ্রুপের ১০টি কোম্পানির বাজার মূলধন প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা কমেছে। ২৪ জানুয়ারি যেখানে আদানি গ্রুপের মার্কেট ক্যাপ ছিল ১৯ লাখ কোটি টাকা, তা ২৭ জানুয়ারিতে কমে হয় ১৫ লাখ কোটি টাকা। আদানি গ্রুপের অন্য কোম্পানিগুলোর শেয়ার দরেও টালমাটাল অবস্থা। মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জে তাদের শেয়ারগুলো লেনদেন বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক ভারতীয় ব্যাংক ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বীমা কোম্পানি আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলোতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে বা ঋণ দিয়েছে। আদানি গ্রুপকে বড় ধরনের ঋণ দেওয়া বীমা ও ব্যাংকগুলোতে এক ধরনের উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।  আদানি গোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। তবে এ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ব্যবসায়ী সংস্থার ঋণ-মূল্যের সমপরিমাণ সম্পত্তি রয়েছে ব্যাংকের হাতে। ফলে ব্যাংকের অর্থ সুরক্ষিত।

লস হাজার কোটি ডলার

প্রতিবেদন প্রকাশের পর রীতিমতো ধস নেমেছে ভারতের আদানি গ্রুপের শেয়ার ও গৌতম আদানির মোট সম্পদে। এতে দুই দিনে ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার মূল্যের বাজার মূলধন খুইয়েছেন ভারতীয় এ ধনকুবের।

২৪ জানুয়ারি হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়। ২৭ জানুয়ারির মধ্যে ভারতের আদানি এন্টারপ্রাইজের প্রায় ২০ শতাংশ শেয়ারের পতন ঘটে। ফোর্বস অনুসারে, ৯ হাজার ৭৬০ কোটি ডলারের মালিক গৌতম আদানি এখন বিশ্বের সপ্তম ধনী ব্যক্তি। আলোচিত প্রতিবেদনটি প্রকাশের আগে তার অবস্থান ছিল তৃতীয়। হঠাৎ করে শেয়ারবাজারে মূলধন হারিয়ে ধনীদের তালিকায় তার অবনমন হয়েছে। বৈশ্বিক তালিকায় অবনমন হলেও এখনো এশিয়ার শীর্ষ ধনী  আদানি।

 

কী হবে গৌতম আদানির

আদানি গ্রুপের শেয়ার কেলেঙ্কারির সঙ্গে নতুন করে আলোচনায় পুরনো অভিযোগ- ভারতের মোদি সরকারের কাছ থেকে ব্যবসায়িক নীতিগত সুবিধা পান গৌতম আদানি। এ অভিযোগ সব সময় অস্বীকার করেছেন এ ভারতীয় ধনকুবের। এবার আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ  ওঠার পর তিনি কী ধরনের তদন্তের মুখোমুখি হবেন সেটাই দেখার বিষয়।

 

চুপ করে বসে থাকব না

প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় আদানি গ্রুপ বলেছে, শেয়ার বিক্রির উদ্যোগকে বানচাল করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে তাদের ভাবমূর্তি নষ্টের চেষ্টা হচ্ছে। তারা হিনডেনবার্গ রিসার্চের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে ভাবছেন। গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, আদানি বলছেন, চুপ করে বসে থাকব না।  হিনডেনবার্গ তাদের প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, তারা এ বিষয়ে আদালতে লড়াই করতে প্রস্তুত।

 

শেয়ার বিক্রি করে তহবিল সংগ্রহে বড় ধাক্কা খেলেন আদানি

গত সপ্তাহের বড় খবর ছিল, ‘শেয়ার বিক্রি করে তহবিল সংগ্রহের তোড়জোড় চালাচ্ছে আদানি এন্টারপ্রাইজেস। ২০ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বাজারে আসবে ২৭ জানুয়ারি। যা বন্ধ হবে ৩১ জানুয়ারি।’ সেই প্ল্যান আপাতত মাটির সঙ্গে মিশে গেছে বলা যায়। হিনডেনবার্গের প্রতিবেদন প্রকাশের পর আদানি এন্টারপ্রাইজের এফপিও ইস্যুকারীদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়। শুক্রবার এই এফপিওর দাম ২০ শতাংশ কমে যায়। ফলে সেকেন্ডারি বাজারে ন্যূনতম দামের চেয়ে ১১ শতাংশ নিচে নেমে গেছে এর দাম। সেদিন লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১ শতাংশ বিক্রি হয়েছে এই এফপিও। সে কারণে এই এফপিওর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই এফপিওর মূল্যস্তর ৩ হাজার ১১২ রুপি নির্ধারণ করেছিল আদানি গোষ্ঠী। অথচ শুক্রবার বাজারে তার দাম নেমে আসে ২ হাজার ৭৬১ রুপি। এই এফপিওতে শেয়ার ছাড়া হয়েছিল সাড়ে চার কোটি। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা এখন পর্যন্ত মাত্র ৪ লাখ ৭০ হাজার ১৬০টি শেয়ার কেনার বায়না দিয়েছেন। এটা এখন স্পষ্ট, শেয়ার বিক্রি করে তহবিল সংগ্রহে বড় ধাক্কা খেলেন আদানি।

 

নগদ টাকার অভাব আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোতে

হিনডেনবার্গ রিসার্চ অনুযায়ী, স্পষ্টভাবে আদানি গোষ্ঠীতে বিনিয়োগকারীরা বিশাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২৪ থেকে ২৭ জানুয়ারি আদানি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত কোম্পানির ক্ষতির পরিমাণ : আদানি টোটাল গ্যাসে ৬ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা, আদানি এন্টারপ্রাইজ ৩ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা, আদানি পোর্টস ৩ হাজার ২০৫ কোটি টাকা, আদানি ট্রান্সমিশন ৩ হাজার ৩৬ কোটি টাকা, অম্বুজা সিমেন্টস ১ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা, আদানি গ্রিন এনার্জি ৮৭১ কোটি টাকা, এসিসি ৫৪৪ কোটি টাকা। বর্তমানে লিকুইডিটি ক্রাইসিস বা নগদ টাকার অভাবে ধুঁকছে আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলো। ফলে আদানি শিল্পগোষ্ঠী এ ক্ষতি কীভাবে কতটা সামলে উঠতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।

 

এক সময় কাজ করতেন প্যাকেজিং কারখানায়

ভারতের আহমেদাবাদে জন্ম গৌতম আদানির। স্কুলে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। মুম্বাই এসে হীরার ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু এই ব্যবসায় সুবিধা করতে না পেরে দুই বছর পর  নিজের রাজ্য গুজরাটে ফিরে আসেন। এখানে তাঁর ভাইয়ের একটি প্যাকেজিং কারখানায় কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায়। প্রায় ২৪ বছর ধরে ভারতে জ্বালানি ব্যবসা, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, খনি, রেলপথ, অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, সিমেন্ট, ওয়্যারহাউস এবং রিয়েল এস্টেট- সবখানে ছড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য- আদানি শিল্পগোষ্ঠী।

সর্বশেষ খবর