বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

যেভাবে শীর্ষ ধনী বার্নার্ড আর্নল্ট

♦ সম্পদ ২২ লাখ ৪৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ♦ বিলাসবহুল ফ্যাশন পণ্যের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ডের মালিক তিনি

আবদুল কাদের

যেভাবে শীর্ষ ধনী বার্নার্ড আর্নল্ট

অঢেল সম্পদের মালিক হলেও অনেকটা আড়ালেই থাকতে পছন্দ করেন আর্নল্ট। তাই জেফ বেজোস, বিল গেটস, গৌতম আদানি কিংবা ইলন মাস্ককে সবাই যেভাবে চেনেন, আর্নল্টকে সেভাবে হয়তো চেনেন না।  তা সত্ত্বেও এবারের ধনীর তালিকায় প্রথম স্থানটি ঠিকই নিশ্চিত করে নিয়েছেন তিনি

 

-বিল গেটস, জেফ বেজোস, আম্বানি ও আদানিদের নাম হরহামেশা শোনা গেলেও বার্নার্ড আর্নল্টের নাম খুব কম মানুষই শুনেছেন। এতে করে আর্নল্ট শীর্ষ ধনীর স্থান দখল করায় এখন অনেকরই প্রশ্ন- কে এ ব্যক্তি? কী করে হলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী? ফ্রান্সের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বার্নার্ড আর্নল্টের প্রতিষ্ঠান এলভিএমএইচ বিলাসবহুল শৌখিন পণ্য বিক্রির জন্য শুধু ফ্রান্স নয়, সমগ্র ইউরোপ বিখ্যাত। বার্নার্ডই প্রথম ফরাসি, যে কি না প্রথমবারের মতো শীর্ষ ধনীর তকমা পেলেন। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার্স ইনডেক্স অনুসারে, বার্নার্ড আর্নল্টের মোট সম্পদের পরিমাণ ২১১ বিলিয়ন ডলার, যা টেসলার সিইও মাস্কের ১৮৮ বিলিয়ন ডলারের সম্পদকে ছাড়িয়ে গেছে। ফোর্বসের ‘রিয়েল টাইম বিলিয়নিয়ার’ তালিকার শীর্ষস্থানও দখল করে নিয়েছেন এই ধনকুবের।

 

বার্নার্ড আর্নল্ট এখন বিশ্বের শীর্ষ ধনী। বয়স ৭৪ বছর। বিল গেটস কিংবা ইলন মাস্কের মতো আলোচনায় না থাকলেও বিশ্বের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের দলে তিনি গত দুই দশকে পদচারণা ছিল তার। ফরাসী এই ধনকুবের ব্যবসায়ীর জন্ম ১৯৪৯ সালে। পারিবারিকভাবেই তিনি ধনী ছিলেন। তার নানার কনস্ট্রাকশনের ব্যবসা ছিল। বার্নার্ড আর্নল্টের বাবা বিয়ের পর শ্বশুরের কাছ থেকে সেই ব্যবসা সামলানোর দায়িত্ব পান। ফেরেট স্যাভিনেল নামে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থা ছিল বার্নার্ডের পারিবারিক ব্যবসা। আর্নল্ট ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ায় ওই ব্যবসাতেই যোগ দেন তিনি। ব্যবসায়ী হিসেবে বার্নার্ড যে দূরদর্শী তার প্রমাণ পাওয়া যায় তখনই। কারণ হুট করেই পারিবারিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবসাকে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় বদলে নেন তিনি। ১৯৮১ সালের দিকে তিনি চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। এখানে এসে শুরু করেন আবাসন ব্যবসা। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ব্যবসায়ী রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় আধিপত্য করছেন। আর্নল্ট তার ব্যবসা ইউরোপে সম্প্রসারণ করতে চেয়েছিলেন। তাই তিন বছর পর ফিরে আসেন নিজ দেশ ফ্রান্সে। ফ্রান্স ফ্যাশনের রাজধানী। গোটা বিশ্বের ফ্যাশন ট্রেন্ড ফ্রান্সের প্যারিসকে ঘিরে ঘুরপাক খায়। দামি সুগন্ধি, ওয়াইন ও পোশাক ব্যবসায় সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনি ফ্রান্সে ফিরে এসে তার নজরে পড়ে বুজ্যাঁক সঁ ফ্রেরেস। বহুজাতিক বস্ত্র সংস্থাটির অবস্থা তখন শোচনীয়। ফ্রান্সে নিজেদের দেউলিয়া করেছে বুজ্যাঁক সঁ ফ্রেরেস। তাদেরই একটি অংশ ছিল ক্রিশ্চিয়ান ডয়ের। মাত্র তিন বছরের মধ্যে এই কোম্পানি পুরোটাই নিজের করে নেন আর্নল্ট। এখন বিশ্বের শীর্ষ ফ্যাশন কোম্পানির একটি এই ডয়ের। এই ডয়েরের জন্যই বুজ্যাঁক কিনতে আগ্রহী হন বার্নার্ড। এ ছাড়া বার্নার্ডের মায়ের পছন্দের ব্র্যান্ড ছিল ডয়ের। বিলাসদ্রব্যের ব্র্যান্ড কিনে সেই ব্র্যান্ডের হয়েই ওই সংস্থাটি নিলামে কিনে নেন তিনি। বুজ্যাঁক তার হাতে আসার পর তিনি কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিলেন। একসঙ্গে প্রায় ৯ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করে দেন তিনি। ডয়ের এবং একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছাড়া বুজ্যাঁকের সব সম্পত্তি বিক্রি করে দেন বার্নার্ড।  এ ঘটনায় তীব্র সমালোচনা শুরু হয় তাকে নিয়ে। তবে ব্যবসা লাভে এনে সব সমালোচনার জবাব দেন তিনি। মাত্র দুই বছরের মধ্যেই লাভের মুখ দেখতে শুরু করে ডয়ের।

 

প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামের সামনে এক নৈশভোজের আয়োজনে স্ত্রী হেলেন মার্সিয়ার, ছেলে আন্টোইন এবং পুত্রবধূ নাটালিয়ার সঙ্গে ফরাসি ধনকুবের বার্নার্ড আর্নল্ট

পেশা জীবন

১৯৭১ সাল। আর্নল্ট পড়াশোনা শেষ করে বাবার প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। মাত্র পাঁচ বছর না পেরোতেই ১৯৭৬ সালে বাবাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, নির্মাণ কাজের চেয়ে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা বেশি লাভজনক। পুরনো প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে ফেরিনেল নামের নতুন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। যা মূলত হলিডে অ্যাকোমোডেশনের কাজ করত। কর্মদক্ষতায় আর্নল্ট ১৯৭৭ সালে ফেরিনেল-এর সিইও পদ পান। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৭৯ সালে দায়িত্ব নেন চেয়ারম্যান পদের। ব্যবসার প্রসার ঘটাতে ১৯৮৭ সালে তিনি এলভিএমএইচ গড়ে বিলাসবহুল প্রসাধনী পণ্যের বাজারে প্রবেশ করেন। তাতে বদলে গেল ভাগ্যের চাকা। এর বদৌলতে ফ্যাশন শিল্পের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডে পরিণত হন ফরাসি এই ধনকুবের। ৭৫টি কোম্পানি নিয়ে এ শিল্প গ্রুপে রয়েছে ক্রিস্টিয়ান ডিওর, লুই ভিতোঁ, ডম পেরিগনন চ্যাম্পেগন, টিএজি হিউর এবং রিমওয়ার মতো নামিদামি ব্র্যান্ড।

 

ফ্যাশন ব্র্যান্ড সাম্রাজ্যের অধিপতি

১৯৮০-এর দশকে ব্যবসায়িক যাত্রা, ১৯৯০-এর দশকে ধনকুবের হিসেবে উত্থান। বার্নার্ড আর্নল্টের হাত ধরে ইউরোপে বিলাসবহুল পণ্যের ভরসাস্থলে পরিণত হয় এলভিএমএইচ। শেম্পেইন, ওয়াইন, ফ্যাশনেবল পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, ঘড়ি, গহনা, পারফিউম ও কসমেটিক পণ্যের এক বিরাট হাব এলভিএমএইচ। শুধু ফ্রান্স না সমগ্র ইউরোপেও বিলাসবহুল পণ্যের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান এটি। লুই ভিতোঁর ব্যাগ থেকে ক্রিশ্চিয়ান ডয়েরের সুগন্ধি, হাবলটের ঘড়ি থেকে লে পার্সিয়ানের মতো প্রতিষ্ঠান এলভিএমএইচের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে সারা বিশ্বে এলভিএমএইচের সাড়ে ৫ হাজার স্টোর রয়েছে। শুধু ইউরোপ নয়; নব্বই দশকের শেষে বেইজিংয়ে লুই ভিতোঁ দোকান খুলেছেন। ফ্যাশন জগতে লুই ভিতোঁ কতটা জনপ্রিয় তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রথম সারির সেলিব্রেটিদের দিকে তাকালে। নিশ্চয়ই মনে আছে, প্যারিসে আয়োজিত ফ্যাশন সপ্তাহের রেড কার্পেটে হেঁটেছিলেন বলিউডের অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন। সেদিন তিনি পরেছিলেন ‘লুই ভিতোঁ’-এর পোশাক। হাতে ছিল এই ব্র্যান্ডেরই হাতব্যাগ। ব্রিটেনের রাজপরিবারের সদস্য ডায়ানার হাতেও দেখা গেছে লুই ভিতোঁর ব্যাগ। কেট মিডলটন এবং মেগান মর্কেলকেও প্রায়ই ব্যবহার করতে দেখা যায় বার্নার্ডের সংস্থার তৈরি বিলাসদ্রব্য। লুই ভিতোঁর মতোই আন্তর্জাতিক নামিদামি বহু ফ্যাশন ব্র্যান্ডের মালিক বার্নার্ড আর্নল্ট। এর মধ্যে ক্রিশ্চিয়ান ডয়ের, ফেন্দি, জিঁভসি, মার্ক জেকবস, স্টেলা, ম্যাককার্টনি, ট্যাগ হোইয়র, বুলগরি, টিফনি অ্যান্ড কোং-এর মতো সংস্থা রয়েছে।  ৭৫টি সংস্থার মালিকানা এখন বার্নার্ডের হাতে।

 

কত সম্পদ তার

ফরাসি ধনকুবের বার্নার্ড আর্নল্ট আন্তর্জাতিক মানের বিলাসবহুল এবং ফ্যাশন-পণ্যে সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড ‘মোয়েত এনেসি লুই ভিতোঁ’ (এলভিএমএইচ)-এর চেয়ারম্যান এবং সিইও। ধনী তালিকায় বার্নার্ড এবং তার পরিবারের মোট সম্পত্তিকেই প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে। বার্নার্ড এবং তার পরিবারের মোট সম্পত্তির পরিমাণ এখন ২২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার মধ্যে শুধু বার্নার্ডের সম্পত্তি ২১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দুই বছর করোনার ধকল সামলে চলতি বছর এ ধনকুবেরের সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২১ হাজার ১০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২২ লাখ ৪৪ হাজার ৫০০ কোটিও বেশি। এখন বার্নার্ড ও তার পরিবার এলভিএমএইচ-এর ৪৮ শতাংশ শেয়ারের মালিক। বর্তমানে এলভিএমএইচ কোম্পানির অর্থমূল্য ৩১৭.৬ বিলিয়ন ইউরো, যা পুরো ইউরোপে সর্বোচ্চ।

 

শেয়ার দিয়ে শুরু, শেষে ব্যবসার মালিক

শেয়ার কিনে পুরো ব্যবসা নিজের করে নেওয়ার কৌশল বার্নার্ড আর্নল্ট কাজে লাগাতে শুরু করেন। বর্তমান বিশ্বে ফ্যাশন ব্র্যান্ড লুই ভিতোঁকে কে না চেনে? তার পুরো নাম মোয়েথ এনেসি লুই ভিতোঁ। এই ব্যবসাটির ছিল দুটি সংস্থা- লুই ভিতোঁ এবং মোয়েথ এনেসি। দুই সংস্থার প্রধানের সঙ্গে কথা বলে একটি বিলাসদ্রব্যের বড় ব্র্যান্ড তৈরির করার পরিকল্পনা করেন বার্নার্ড। তখন লুই ভিতোঁর প্রধান ছিলেন হেনরি রিক্যামিয়ার। মোয়েথ এনেসি এবং লুই ভিতোঁ একসঙ্গে একটি ব্র্যান্ড হওয়ার পর বার্নার্ড ধীরে ধীরে শেয়ার কিনতে শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত পুরনো প্রধান রিক্যামিয়ারকে সরিয়ে নিজে বসেন তার জায়গায়। এ ঘটনার পর বার্নার্ডের পরিচিতি ফ্রান্স তো বটেই ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা বলতে শুরু করেন, বার্নার্ড কোনো সংস্থার শেয়ার কিনতে শুরু করেছেন মানে সেই সংস্থার দখল করেই ছাড়বেন তিনি। একই কৌশলে একের পর এক ব্র্যান্ডের দখল করতে পারলেও বার্নার্ড ধাক্কা খান জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ‘গুচি’ কিনতে গিয়ে। শুরুতেই সতর্ক হয়ে বার্নার্ডকে রুখে দেয় গুচি। যদিও সহজে ছাড়েননি বার্নার্ডও। ফলে আইনি লড়াই শুরু হয়। শেষে কোর্টের নির্দেশে হাল ছাড়তে হয় বার্নার্ডকেই।

 

তার ডাকনাম টার্মিনেটর!

হলিউডের ব্লকবাস্টার সিনেমার চরিত্র টার্মিনেটর। আর্নল শোয়ার্জনেগার টার্মিনেটর চরিত্রে অভিনয় করে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পান। সেই সিনেমার চরিত্রের নামটা কপালে জুটেছে বিশ্বের শীর্ষ ধনী বার্নার্ড আর্নল্টের। নামটি দিয়েছে তার কোম্পানির কর্মীরা। পরে মুখে মুখে সে নাম জায়গা করে নিয়েছে মিডিয়াতেও। কর্মী ছাঁটাই বা টার্মিনেট করেন বলেই তাকে এ নাম দেওয়া হয়েছে। বার্নার্ড আর্নল্টের ব্যবসায়িক কৌশলের একটি নতুন ব্যবসা নিজের নামে করে নিতে পারলেই সেখানকার পুরনো কর্মীদের ছাঁটাই শুরু করেন তিনি। এই ছাঁটাই আবার ছোটখাটো পরিসরে করেন না। কিছু ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়ে শুরু করেন কর্মী ছাঁটাই। বিলাসদ্রব্যের ব্র্যান্ড বুজ্যাঁক তার হাতে আসার পর তিনি একসঙ্গে প্রায় ৯ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করে দেন। শিল্পমহলে তিনি ‘টার্মিনেটর’ নামে কুখ্যাতি পান।

 

ব্যক্তিজীবনেও আলোচিত

বিশ্বের অনেক ধনকুবেরের মধ্যে আর্নল্টও প্রাইভেট বিমানে ভ্রমণ পছন্দ করেন। কোথাও ঘুরতে গেলেও ক্যামেরা পিছু ছাড়তে চায় না তার। এ কারণে নিজের প্রাইভেট বিমানটি বিক্রি করে দেন তিনি। তবে এর পেছনের কারণটি আলোচিত। বিগত কয়েক বছর ধরে বিলিয়নিয়াররা কার্বন নিঃসরণের জন্য বারবার অভিযুক্ত হতে থাকায় বার্নার্ড আর্নল্ট তার ব্যবহৃত ব্যক্তিগত জেট বিক্রি করে দিয়েছেন। এ ছাড়া আর্নল্ট লস অ্যাঞ্জেলেসে বেভারলি হিলস, ট্রাউসডেল এস্টেট এবং হলিউড হিলস পাড়ায় আবাসিক সম্পত্তির জন্য কমপক্ষে ৯৬.৪ মিলিয়ন খরচ করেছে বলে জানা গেছে। প্রায় প্রতিদিনই অবসর সময়ে টেনিস খেলে সময় কাটান এ বিলিয়নিয়ার। বর্তমানে বার্নার্ডের বয়স ৭৪ বছর হলেও নিজের কোম্পানিটিতে বিশেষ ক্ষমতাবলে ৮০ বছর পর্যন্ত প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে থাকতে পারবেন এ ধনকুবের।

ব্যবসায় ধারাবাহিক উত্থান

ফ্রেঞ্চ বিলাসবহুল শৌখিন পণ্যের প্রতিষ্ঠান এলভিএমএইচ-এর চেয়ারম্যান বার্নার্ড আর্নল্ট বিশ্বের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের তালিকার প্রথম স্থানের দখল নিয়েছেন। তবে অতীতে তার অবস্থান এখনকার মতো মসৃণ ছিল না। ১৯৮০- এর দশকে এক সাক্ষাৎকারে আর্নল্ট পরবর্তী দশকে বিশ্বের বৃহত্তম বিলাসবহুল শৌখিন পণ্যের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। ১০ বছর পর দেউলিয়া হওয়া এলভিএমএইচ বা মোয়েত এনেসি লুই ভিতোঁকে বিলাসবহুল শৌখিন পণ্যের ব্র্যান্ড হিসেবে উপস্থাপন করেন। বর্তমানে  আর্নল্ট লুই ভিতোঁ এবং সেফোরা-সহ ৭৫টি ফ্যাশন ও প্রসাধনী ব্র্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ করেন। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে আর্নল্টের এলভিএমএইচ আমেরিকান জুয়েলার্স টিফ্ফানি অ্যান্ড কোং-এ ১৫.৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, যা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বিলাসবহুল শৌখিন পণ্যের ব্র্যান্ডের বিনিয়োগ বলে মনে করা হয়। আর্নল্টের হোল্ডিং কোম্পানি আগাচে ভেনচুর ক্যাপিট্যাল ফার্ম জনপ্রিয় অ্যাপ টিকট-এর মূল বাইটড্যান্স এবং নেটফ্লিক্সের মতো বৃহৎ সাইটেও বিনিয়োগ রয়েছে বিশ্বের শীর্ষ ধনকুবেরের। ১৯৮৪ সালে আর্নল্ট ১৫ মিলিয়ন ডলার নিয়ে ক্রিশ্চিয়ান ডিওর (প্রসাধনী ব্র্যান্ড) কেনেন। এটি ছিল তার উত্থান ধারাবাহিকতার প্রাথমিক অধ্যায়। একই বছর আর্নল্ট আগাচে উইলট বাউসেক নামের একটি দেউলিয়া ঘোষিত একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে ফেঞ্চ ডিপার্টমেন্ট স্টোর এবং ক্রিশ্চিয়ান ডিওর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর আর্নল্ট কোম্পানিটির নাম বদলে রাখেন ফাইন্যান্সায়ের আগাচে। এর পর খানিক পরিবর্তন আর খরচ কমিয়ে আনেন। এমনকি তিনি তখন বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিক্রিও করে দিয়েছিলেন। এরপর আর্নল্ট ফ্যাশন হাউস কেলিন কেনেন এবং ফরাসি ডিজাইনার ক্রিশ্চিয়ান ল্যাক্রোইক্সকে অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন। ১৯৮০ এর দশকে আর্নল্ট সংবাদমাধ্যমের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার লক্ষ্য পরবর্তী দশকের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিলাসবহুল কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা।’ তারপর আর্নল্ট এলভিএমএইচ বা মোয়েত এনেসি লুই ভিতোঁর ওপর নজর রাখেন। কোম্পানির বৃহত্তর শেয়ারের মালিক হওয়ার জন্য ২.৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগও করেছিলেন। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৯ বছর পর আর্নল্ট সেই কোম্পানি (এলভিএমএইচ) চেয়ারম্যান এবং চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) বনে যান। আর্নল্ট ক্রিশ্চিয়ার ডিওরের ৯৭.৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক, যা এলভিএমএইচ-এর ৪২.২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সর্বশেষ ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার্স ইনডেক্স অনুসারে, আর্নল্টের মোট সম্পদের পরিমাণ ২১১ বিলিয়ন ডলার, যা টেসলার সিইও মাস্কের ১৮৮ বিলিয়ন ডলারের সম্পদকে ছাড়িয়ে গেছে। গত সপ্তাহে ফোর্বসের ‘রিয়েল টাইম বিলিয়নিয়ার’ তালিকার শীর্ষস্থানও দখল করে নিয়েছেন এই ধনকুবের।

১৯৯১ সালে কানাডিয়ান কনসার্ট পিয়ানোবাদক হেলেন মার্সিয়ারেরকে বিয়ে করেন বার্নার্ড আর্নল্ট

পরিবার ও সন্তান

ব্যক্তিজীবনে দুবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন শীর্ষ ধনকুবের বার্নার্ড আর্নল্ট। ১৯৭৩ সালে অ্যান ডেওয়াভ্রিনকে বিয়ে করেন। ১৯৯০ সালে আর্নল্ট-অ্যান দম্পতির বিচ্ছেদ হওয়ার আগে তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। তাদের সংসারে এক মেয়ে ডেলফাইন আর্নল্ট এবং এক ছেলে অ্যান্টোইন আর্নল্ট। আর্নল্ট ১৯৯১ সালে কানাডিয়ান কনসার্ট পিয়ানোবাদক হেলেন মার্সিয়ারের সঙ্গে পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। দ্বিতীয় বিয়ের পর আর্নল্ট-মারসিয়ারের সংসারে তিন ছেলের জন্ম হয়েছে। যাদের নাম আলেকজান্দ্রি, ফ্রেডরিক এবং জিন। ডেলফাইন, আন্টোইন, আলেকজান্দেও এবং ফ্রেডরিক- বাবার বিলাসবহুল প্রসাধনী প্রতিষ্ঠান এলভিএমএইচ-এ কর্মরত আছেন।

 

ফটো ফিচার

আর্নল্ট উত্তর ফ্রান্সের শহর রুবেইক্স থেকে এসেছেন। তিনি ফ্রান্সের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ইকোল পলিটেকনিক ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ছবিতে সেই স্কুলের শিক্ষার্থীরা

লুই ভিতোঁ এবং সেফোরাসহ ৭৫টি ফ্যাশন ও প্রসাধনী ব্র্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন আর্নল্ট। ২০২১ সালে এলভিএমএইচ আমেরিকান জুয়েলার্স Tiffany & Co-তে ১৫.৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন

আর্নল্টের বাড়িতে শোভা পায় আধুনিক ও সমসাময়িক শিল্পের সংগ্রহ। যার মধ্যে রয়েছে জিন-মিশেল বাসকিয়েট, মাউরিজিও ক্যাটেলান, ড্যামিয়েন হার্স্ট, অ্যান্ডি ওয়ারহোল ও পাবলো পিকাসো

ভায়োলিন, পিয়ানো এবং অন্যান্য শাস্ত্রীয় সুরকারদের সংগীত আর্নল্টকে ভীষণভাবে প্ররোচিত করে বলে জানা গেছে। ২০০০ সালে নিজ বাসভবনে তোলা ছবিতে বার্নার্ড আর্নল্ট

সর্বশেষ খবর