বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

ইলন মাস্কের যত কাণ্ড

আবদুল কাদের

ইলন মাস্কের যত কাণ্ড

বেশ কয়েক বছর ধরে রেখেছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তকমা। করোনাকালেও তাঁর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছিল হু হু করে। তবে অর্থবিত্তে ভাটা পড়তে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগেরমাধ্যম টুইটার কেনার পর থেকে। লোকসানে লজ্জার রেকর্ড গড়েছেন তিনি। হারিয়েছেন বিশ্বের সেরা ধনীর তকমাও। বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন এই ধনকুবের।  অনেক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত আর কর্মকান্ডের জন্য বারবারই হয়েছেন সংবাদপত্রের শিরোনাম। রইল বিস্তারিত...

 

  বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা টেসলা, মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সসহ মোট আটটি কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
টেসলার ২৩ শতাংশের মালিক তিনি। কিন্তু ঋণের জন্য জামানত হিসেবে তাঁর অর্ধেকেরও বেশি শেয়ার দেখিয়েছেন।
 ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন স্পেসএক্স, এতে খরচ করেছিলেন ১২৭ বিলিয়ন ডলার; তিন বছরে এর মূল্য চার গুণ বেড়েছে।
২০২২ সালে ৪ হাজার কোটি ডলারের বেশি দিয়ে কিনে নেন টুইটার। তিনি এখন কোম্পানির আনুমানিক ৭৪ শতাংশের মালিক।
 

সবচেয়ে জঘন্য বস!

২০২২ সালে খ্যাপাটে বস হিসেবে আবির্ভূত হন বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের ইলন মাস্ক। আর কর্মীরা তাঁকে আখ্যা দিয়েছেন সবচেয়ে জঘন্য ধরনের বস হিসেবে। কারণ মাস্কের মধ্যে এমন সব বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো মানুষ একজন নিয়োগদাতার মধ্যে দেখতে মোটেও পছন্দ করে না।  ইলন মাস্কের ভাষ্য- রোবটের মতো কাজ করে যান, দরকার হলে অফিসেই ঘুমাবেন, বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই।

 

ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী, ইলন মাস্ক এই মুহূর্তে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী। ৫১ বছর বয়সী এই উদ্যোক্তার সম্পদের পরিমাণ ১৭৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। সময়ের আলোচিত অন্যতম শীর্ষ ধনকুবের ইলন মাস্ক সপ্তাহে কাজ করেন ১০০ ঘণ্টার বেশি। এ নিয়েও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছেন টেসলার এই সিইও। এ কথা বলে সম্প্রতি ইলন মাস্ক আলোচনায় এসেছেন, এমনটা নয়। এ কথা তিনি বেশ আগেই বলেছেন। সম্প্রতি তিনি আলোচনায় এসেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার কেনাকে কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটি কেনার পর একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনামে পরিণত হয়েছেন। পাশাপাশি খ্যাপাটে বস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। কর্মীরা তাঁকে আখ্যা দিয়েছেন সবচেয়ে জঘন্য ধরনের বস হিসেবে। কারণ মাস্কের মধ্যে এমন সব বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো মানুষ একজন নিয়োগদাতার মধ্যে দেখতে মোটেও পছন্দ করে না।

জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগেরমাধ্যম টুইটারের মালিক বনে যাওয়ার কদিন পরই খরচ কমাতে অর্ধেক কর্মী ছাঁটাই করে ফেলেন তিনি। কাজটি এত দ্রুত ও আধখেঁচড়াভাবে করা হয়েছিল যে কদিন পরই অনেক কর্মীকে ফের চাকরিতে ফিরে আসতে বলতে বাধ্য হয় টুইটার। আর যারা চাকরিতে থেকে যায় তাদের বলা হয়, কর্মক্ষেত্রে ‘কঠোর পরিশ্রম’ করার লিখিত অঙ্গীকার দিতে হবে। তা দিতে না পারলে তারা যেন চাকরি ছেড়ে দেন। ইলন মাস্ক বুঝতে পারেন, সংকট আসন্ন। পরিস্থিতি সামাল দিতে টুইটারের সব কার্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন। এ তো গেল অফিস ও পরিচালনাকেন্দ্রিক কান্ডকারখানা। এক ইমেইলে মাস্ক কর্মীদের বলেন, ‘দীর্ঘ সময় কাজ করতে হবে।’ যদিও আলটিমেটাম পেয়ে শত শত কর্মী নিজ থেকেই চাকরি ছেড়ে দেন। ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘পাওয়ার প্লে’ বইয়ে টিম হিগিন্স লিখেছেন, মাস্ক বেশ কয়েকবার শীর্ষ নির্বাহীদের ওপরও সবার সামনে রাগ ঝেড়েছেন। এর ফলে বেশ কয়েকজন নির্বাহী কোম্পানি ছেড়েছেন। এমন খবরও পাওয়া গেছে, সান ফ্রান্সিসকোতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের জন্য বিছানা কেনা হয়েছে, যাতে তারা অফিসেই রাত কাটাতে পারেন। মাস্কের ভাষ্য মতে, অফিসে বিছানা রাখার অর্থ হলো- রোবটের মতো কাজ করে যান, দরকার হলে অফিসেই ঘুমাবেন, বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই। সান ফ্রান্সিসকোর বিল্ডিং ইন্সপেকশন বিভাগও এই মর্মে অভিযোগ পেয়েছে যে, টুইটারের বেশ কয়েকটি কার্যালয়কে কর্মীদের জন্য মোটেল রুমে পরিণত করা হয়েছে, যা বিধিমালার পরিপন্থী। 

এর বাইরে নীতিনির্ধারণী-সংক্রান্ত বেশ কিছু এলোমেলো সিদ্ধান্ত নেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটি কেনার পর ইলন মাস্ক ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই প্ল্যাটফরমে সবাই মত প্রকাশ করতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা গেল উল্টো। ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে টুইটারে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।  যদিও নানা চড়াই-উতরাইয়ের পর ট্রাম্পের টুইটার অ্যাকাউন্ট ফেরত দেওয়া হয়। এরপরই মাস্ক ঘোষণা দিয়েছিলেন, ভেরিফাইড ব্লু টিক পাওয়ার জন্য ব্যবহারকারীকে ডলার খরচ করতে হবে। সম্প্রতি সেই ঘোষণা থেকেও সরে এলেন এই ধনকুবের।

 

কে এই ইলন মাস্ক?

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তিটি হলেন বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনকুবের ইলন মাস্ক। নানা কারণে ৫১ বছর বয়সী ইলন মাস্ক বারবারই হয়েছেন সংবাদপত্রের শিরোনাম। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়াতে জন্মগ্রহণ করা ইলন মাস্ক আটটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এগুলো- টেসলা, স্পেসএক্স, হাইপারলুপ, ওপেন এআই, নিউরালিংক, দ্য বোরিং কোম্পানি, জিপ টু, পেপ্যাল। ছেলেবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি ভীষণ আগ্রহ মাস্কের। কম্পিউটার কোডিং শিখেছেন নিজে নিজেই। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি ‘ব্লাস্টার’ নামে একটি ভিডিও গেমও বানিয়ে ফেলেছিলেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি কানাডায় চলে যান। সেখানে অন্টারিওর কিংস্টনে কুইনস ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে ট্রান্সফার হয়ে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় চলে আসেন। এখান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।  পদার্থবিদ্যা ও অর্থনীতি দুই বিষয়ে তাঁর স্নাতক। এরপর স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। কিন্তু দুই দিন পরই তাঁর মনে হয়, পদার্থবিদ্যায় পড়ার চেয়ে ইন্টারনেট সম্পর্কে জানা বেশি জরুরি। ছেড়ে দেন পড়াশোনা।  ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম উঠে আসে ড্রপআউটার হিসেবে; এখন ইলন মাস্ক ব্লুমবার্গের বিলিয়নিয়ার ইনডেক্সে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনকুবের।

 

অন্য সবার চেয়ে আলাদা টেসলার এই সিইও

১৯৭১ সালে জন্মগ্রহণ করা ইলন মাস্ক অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি অন্য সবার চেয়ে আলাদা। পড়াশোনার পাশাপাশি কম্পিউটার কোডিং করতেন। ১৯৯৯ সালের দিকে জিপ টু নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে সবার নজরে আসেন। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করেন ৩০ কোটির বেশি ডলারে। এরপর অনলাইনে লেনদেনের জন্য এক্স ডটকম (যা পরবর্তীতে পেপ্যাল নামে পরিচিত পায়) প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ২০০২ সালে ১৫০ কোটি ডলারে সেই প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দেন তিনি। সেবারই প্রথম বিশ্বের শীর্ষ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের তালিকায় উঠে আসেন ইলন মাস্ক। ২০০২ সালেই স্পেসএক্স প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। রকেট উৎক্ষেপণে আনেন যুগান্তকারী পরিবর্তন। তাঁর তৈরি রকেট এখন একাধিকবার ব্যবহার করা যায়। গাড়ির জগতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন মাস্ক। আরও দুজনকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছেন ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরির প্রতিষ্ঠান টেসলা। তাঁদের গাড়ির নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সহজ। দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমিয়ে দিয়েছে। ইলন মাস্ক সিইও হিসেবে সফল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানই মানুষের জীবনযাপনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।  এবার দেখা যাক টুইটারে নতুন কী ঘটে!

 

তাঁর যত ব্যবসা

যাত্রা শুরু

১৯৯৫ সাল, ইন্টারনেট তখন নতুন। খবরের কাগজের জন্য ইন্টারনেট সে সময় গাইড হিসেবে কাজ করবে- এমন সফটওয়্যার আবিষ্কার করলেন তরুণ উদ্ভাবক ইলন মাস্ক। যার নাম দেওয়া হলো জিপ টু। তাঁর ভাইকে নিয়ে সফটওয়্যার কোম্পানিটি দাঁড় করান মাস্ক। মাস্ক তখন কোম্পানির ৭ শতাংশ শেয়ারের মালিক। প্রথম কাজেই সফলতা পেলেন। তাঁর সফটওয়্যারটি নজরে পড়ল বিখ্যাত টেক কোম্পানি কমপ্যাকের। ১৯৯৯ সালে এই কোম্পানিটি বিক্রি করায় তাঁর পকেটে ঢুকল প্রায় ২২ মিলিয়ন ডলার।

এরপর পেপ্যাল

মানি ট্রান্সফার কোম্পানির মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে টাকা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানোর আইডিয়া প্রথম আনেন তিনি। বাস্তবায়নও করেছিলেন তিনি একই বছর (১৯৯৯ সাল) মানি ট্রান্সফার কোম্পানি এক্স ডটকম চালু করার মাধ্যমে; যা পরবর্তীকালে রূপ নেয় অনলাইন মানি ট্রানজেকশনের মাধ্যম পেপ্যালে। ২০০২ সালে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইবে পেপ্যালকে ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনে নেয়। পেপ্যালের ১১ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিলেন মাস্ক। তখন জানা যায়, তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছিল ১৬৫ মিলিয়ন ডলার!

মহাকাশ সংস্থা

মহাকাশ নিয়ে আগ্রহ ছিল মাস্কের। ২০০২ সালে স্পেস ট্রান্সপোর্ট বা মহাকাশ পরিবহনের স্বপ্ন নিয়ে ইলন মাস্ক তৈরি করেছিলেন এই মহাকাশ সংস্থা, লক্ষ্য ছিল পৃথিবীর মানুষের জীবনকে অন্য একাধিক গ্রহে পৌঁছে দেওয়া। তবে পরবর্তীকালে এই সংস্থা তৈরি করতে শুরু করে দুনিয়ার সবচেয়ে আধুনিক রকেট এবং মহাকাশযান। স্পেসএক্স থেকে ফ্যালকন-১ নামের রকেটটি উৎক্ষেপণ করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছিলেন কিন্তু হাল ছাড়েননি। মাত্র ৬০ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করা স্পেসএক্সে এখন প্রায় ৭ হাজারের বেশি দক্ষ কর্মী নিরলস কাজ করছেন।

টেসলা মোটরস

২০০৩ সালে ইলন মাস্ক এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন। দুনিয়ার সব থেকে দামি অটোমোটিভ কোম্পানি টেসলা। টেক্সাস ভিত্তিক এই সংস্থা মূলত ইলেকট্রিক গাড়ি, সোলার প্যানেল, সোলার রুফ টাইলসহ অন্য বেশ কিছু পরিচ্ছন্ন শক্তি সংক্রান্ত পণ্য উদ্ভাবন করে। মূলত বিশ্বের জ্বালানি সংকট মোকাবিলা থেকেই এই বৈদ্যুতিক গাড়ি উদ্ভাবনের ভাবনা। বছর দুয়েকের মাথায় প্রথম বৈদ্যুতিক গাড়ি নিয়ে আসে টেসলা মোটরস। পরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এর জনপ্রিয়তা। ২০০৮-এ টেসলার স্পোর্টস কার রোডস্টার বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী গাড়ির খেতাব অর্জন করে।

দ্য বোরিং কোম্পানি

২০১২ সালে দৈনন্দিন হাইপার-লুপ প্রযুক্তির ব্যবহারে আগ্রহ দেখান ইলন মাস্ক। এ জন্য নির্মাণ করেন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দ্য বোরিং কোম্পানি। এটি একটি পরিকাঠামো এবং সুড়ঙ্গ নির্মাণ পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা। এর প্রতিষ্ঠাতাও ইলন মাস্ক। এরা বিশ্বাস করে যত ঘনবসতিপূর্ণ শহরই হোক না কেন মাটির নিচে সুড়ঙ্গ পথ বানিয়ে সে শহরকে সম্পূর্ণরূপে যানজটমুক্ত রাখা সম্ভব। সে লক্ষ্যে এগিয়ে চলে নতুন এই কোম্পানি। বোরিং কোম্পানির লক্ষ্য হলো কম সময়ে এবং প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ খরচে সুড়ঙ্গ তৈরি করা।

হাইপার-লুপ

২০১৩ সালে মাস্ক যাতায়াতের এক নতুন পদ্ধতির ঘোষণা দেন। নাম দেওয়া হয় হাইপার-লুপ। এর মাধ্যমে বড় শহরগুলোয় খুব সহজেই যাতায়াত সম্ভব হবে। এই প্রযুক্তি বাস্তবায়িত হলে তা হবে দ্রুতগতির (ঘণ্টায় ৬০০ মাইল)। এটি টিউব কেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। টিউবটি একটি দেশের বিভিন্ন শহরে কিংবা কয়েকটি ভিন্ন দেশে যুক্ত থাকবে। যার ভিতরে থাকবে ক্যাপসুল আকৃতির যানবাহন। যা দিয়ে মানুষ যানজট ছাড়াই পার হতে পারবে। মাস্ক জানান, এর মাধ্যমে নিউইয়র্ক থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস যেতে সময় লাগবে মাত্র ৪৫ মিনিট।

দ্য বোরিং কোম্পানি

২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত নিউরোলিঙ্ক করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক। নিউরোটেকনোলজি কোম্পানিটি তৈরি করে ইমপ্ল্যান্ট করা যায় এমন ব্রেন মেশিনের ইন্টারফেস। এদের লক্ষ্য হলো- এমন ডিভাইস তৈরি করা যা মানুষের শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। বিশেষত প্যারালাইসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে।

ওপেন এআই

ওপেন এআই আসলে একটি অলাভজনক সংস্থা, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) গবেষণা এবং স্থাপনা সংস্থা। যাদের লক্ষ্য মানবতার স্বার্থে যন্ত্র উদ্ভাবন করা। ২০১৮ সালে এই সংস্থার বোর্ড সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন মাস্ক। কারণ তার টেসলার CEO পদের জন্য অলাভজনক এই সংস্থাটির সমস্যা হতে পারত।

 

খোয়ালেন ২০ হাজার কোটি ডলার

২০২২ সাল ইলন মাস্কের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জিং বছর ছিল। করোনা মহামারিতেও টেসলার সিইও মাস্কের সম্পত্তি হু হু করে বেড়েছিল। তবে গেল বছর একটি বড়সড় ধাক্কা খেলেন মাস্ক। এক লাফে ২০০ বিলিয়ন ডলার হারান। তাও আবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। ইতিহাসে এত বড় ক্ষতি এর আগে কখনোই দেখা যায়নি। ২০২১-এর জানুয়ারিতে অ্যামাজনকর্তা জেফ বেজোসের পরই ছিলেন মাস্ক, যিনি ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পত্তির মালিক ছিলেন। গাড়ি নির্মাতা সংস্থা টেসলার শেয়ার কমে যাওয়াতেই এই বিপত্তি, এমনটা মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি ১৩৭ ডলার কমেছে সেই শেয়ার। গত ২৭ ডিসেম্বর ১১ শতাংশ শেয়ার হারিয়েছে টেসলা। যুক্তরাষ্ট্রে ৭৫০০ ডলার ছাড় দিচ্ছে টেসলা। এ ছাড়া সাংহাইয়ে এই সংস্থা গাড়ি তৈরির সংখ্যাও কমিয়েছে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে নাম উঠে এসেছিল মাস্কের। ডিসেম্বর মাসে তাঁকে টপকে গেছেন ফরাসি ব্যবসায়ী বার্নার্ড আর্নল্ট। টেসলার ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গে টুইটার নিয়েও বিতর্কে জড়িয়েছেন ইলন মাস্ক। তবে টেসলা নিয়ে সমস্যার কথা মানতে নারাজ সিইও মাস্ক। বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ২০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ব্যক্তিগত সম্পদের মাইলফলক ছুঁয়েছিলেন মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ক। এরপর অবশ্য টুইটারের নিয়ন্ত্রণ নেন মাস্ক। তবে এতেও সৃষ্টি হয়েছিল নানা আলোচনা-সমালোচনা।

 

টুইটারকান্ড

টুইটার কেনার আগের কয়েক মাস বেশ জল ঘোলা করেছেন ইলন মাস্ক। টেনেছেন অযথা বিতর্কও। নিজেও টেসলার শেয়ার বিক্রি করে টুইটার কিনে নেন। ২০২১ সালের টুইটারের ৯ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনে নেন মাস্ক। হয়ে যান টুইটার গভর্নিং বোর্ডের অন্যতম সদস্য। নিয়ম অনুসারে, তাঁকেও টুইটারের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু এতে সাড়া দেননি তিনি। বরং তিনি টুইটার পুরোপুরি কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিষ্ঠানটি ৪ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারে কিনে নেওয়ার ঘোষণা দেন আলোচিত ধনকুবের। পরের ছয় মাসে যা ঘটেছিল সে রকম ঘটনা সিলিকন ভ্যালি খুব কমই দেখেছে। টুইটারের মালিকানা বদল নিয়ে চুক্তি এক দিন এগোচ্ছে তো পরদিনই ভেঙে পড়ছে- এ রকম একটা অবস্থা। শেষমেষ বিশাল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মালিক বনে যান তিনি। প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেওয়ার আগের দিন ২৬ অক্টোবর টুইটার কার্যালয়ে যান তিনি। সেখানে যাওয়ার একটি ভিডিও টুইটারে পোস্ট করেন। লাভের চেয়ে লোকসানের পরিমাণ বেশি, তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই মাস্কের। মানব ইতিহাসে প্রথমবার ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খোয়ান। বিশ্বের ধনী মানুষটি পেলেন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি লোকসানকারীর তকমা। তবে লোকসানের মূল কারণ কিন্তু টেসলার শেয়ার দরের পতন। বিপুল হারে কমেছে বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার শেয়ার। বিশেষজ্ঞরা বলেন, একটা সময় ছিল যখন সবাই বিশ্বাস করতেন যে, ইলন মাস্ক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির মাধ্যমে বিশ্বকে পাল্টে দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর টুইটার ফেজ-এর পর থেকে ইলনের নামের সঙ্গে রাজনীতি, বিতর্ক ইত্যাদি জড়িয়ে গেছে। আগের মতো চোখ বুজে ভরসা করছেন না অনেকেই। ফলে কমে যায় শেয়ারের দর, হারান শীর্ষ ধনকুবেরের খেতাব।

 

প্রতিভাবান একজন

দক্ষিণ আফ্রিকার ছেলে : জন্ম ১৯৭১ সালে; দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায়। বাবা দক্ষিণ আফ্রিকান ও মা কানাডিয়ান। তাঁর পুরো নাম ‘ইলন রিভ মাস্ক’।

শেষ করেননি শিক্ষাজীবন : স্নাতকোত্তর শেষে পিএইচডির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পান। কিন্তু অর্থ উপার্জনের নেশায় পিএচইডি অধরা থেকে যায়। তবে উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি বিশ্বের অগণিত তরুণদের আইকন।

প্রতিভাবান : মাত্র ১০ বছর বয়সেই কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে পারদর্শিতা লাভ করেন। ১২ বছর বয়সে বেসিক প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে ব্লাস্টার নামের একটি ভিডিও গেম তৈরি করেন, যা পরবর্তীতে ৫০০ ডলারে পিসি অ্যান্ড অফিস টেকনোলজির কাছে বিক্রি করেছিলেন। 

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট : বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠায় মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্স। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি স্পেসএক্স-এর সবচেয়ে আধুনিক ফ্যালকন রকেটের মাধ্যমে ২০১৮ সালের মহাকাশে পাঠানো হয়।

বেতন : টেসলার সিইও হিসেবে বছরে বেতন নেন মাত্র এক ডলার। নিজের অংশীদারিত্ব থাকা বিভিন্ন কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশসহ কিছু সুবিধা পান। বছরে ১ ডলার বেতন সিলিকন ভ্যালির ট্রেন্ড।

বিতর্কিত চরিত্র : বিতর্কের জন্ম দিতে ভালোবাসেন মাস্ক। টুইটারে নানা বিতর্কিত টুইটও করেন। শুধু তাই নয়, নিজ প্রতিষ্ঠানের সহযোগীদের সঙ্গেও নানা সময় দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৮ সালে কমেডিয়ান জো রোগানের শো-এর সরাসরি সম্প্রচারে গাঁজা সেবন করে বিতর্কের জন্ম দেন।

সমালোচনা : জীবনে সফল অথচ সমালোচনার শিকার হননি, এ রকম উদাহরণ নেই। স্কুলজীবন থেকেই তিনি অন্য শিক্ষার্থীদের চোখে ছিলেন তুচ্ছ। আবার সমালোচিত নিজের চিন্তাধারার জন্যও। এমনকি মঙ্গলগ্রহকে নিয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনাকেও অনেকে অহেতুক বলেছেন। যদিও এটা কেবলই সময়ের ব্যাপার।

পাত্তা দেননি কভিড-১৯ : করোনাভাইরাসকে পাত্তাই দেননি এই প্রযুক্তি উদ্যোক্তা। ২০২০ সালে কভিড-১৯ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া বোকামি বলে সমালোচিত হন মাস্ক। যদিও পরে তিনি কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন। লকডাউনে ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখার ঘোষণা উপেক্ষা করে নিজের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন।

 

ঘন ঘন মেজাজ বদলান ও প্রতিশ্রুতি ভাঙেন!

বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনকুবের এবং টেসলার সিইও নানা কারণে হয়েছেন আলোচিত-সমালোচিত। টুইটারের কর্তাব্যক্তি হিসেবে হাজির হন ইলন মাস্ক। সিইও পদে বসে যান তিনি। এরপর প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্তরে কর্মী ছাঁটাই শুরু করেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটি কেনার সময় কর্মী ছিল প্রায় সাড়ে ৭ হাজার। কিন্তু মাস্ক দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় অর্ধেক কর্মী ছাঁটাই করেন। এ ছাড়া তিনি ঘোষণা দেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হলে আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হবে। ইলন মাস্কের এই আহ্বানে সাড়া দেননি অনেকেই। ফলে অনেকেই নিজ থেকেই চাকরি ছেড়ে দেন। তাঁর এমন আচরণ সম্পর্কে টেসলার কর্মীরা বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে, মাস্কের নাকি ঘন ঘন মেজাজ বদলায়। বদলে যায় তাঁর প্রতিশ্রুতিও। সংবাদমাধ্যম ওয়্যারডকে টেসলার একজন সাবেক নির্বাহী বলেছিলেন, টেসলার প্রত্যেকের সঙ্গে ইলনের শোষণমূলক সম্পর্কে আছে। এ ধরনের অস্থিরচিত্ত বসেরা নিজেদের কথা মতো কাজ করেন না। হ্যাঁ, নিজেদের ভুল বুঝে সেটা স্বীকার করে সিদ্ধান্ত বদলানো ভালো ব্যাপার। কিন্তু নতুন তথ্য পেয়ে ঘন ঘন নিজের অবস্থান বদলালে কর্মীদের আস্থা ও বিশ্বাস নিমিষেই শূন্যের কোটায় নেমে আসতে পারে। তবে মাস্ক নিয়মিত এই কাজটি করেন। প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারার অসংখ্য রেকর্ডও আছে মাস্কের। কর্মীদের সঙ্গেও অনেক সময় করেছেন কথার বরখেলাপ। যেমন- ২০২০ সালে মহামারির সময় কারখানায় যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করলে টেসলা কর্মীদের বাড়িতে বসে কাজ করার অনুমতি দেন। কিন্তু এরপর সশরীরে অফিস না করার কারণে কর্মীদের চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে।

 

আমেরিকান স্টক মার্কেট কারসাজিতে জড়ান

টুইটার অধিগ্রহণের পর থেকে সময়টা ভালো যাচ্ছে না ইলন মাস্কের। টুইটার কেনার পর টুইট করে জানান, কীভাবে বদলাবেন এই কোম্পানি। সেই থেকে শুরু, একের পর এক বিতর্কে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন তিনি। টুইটার পোস্টে ইলন মাস্ক লেখেন, ‘টুইটারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আমার মতো একজন বোকা ব্যক্তি খুঁজে পেলেই সিইও পদ থেকে সরে যাব। তারপর আমি শুধু সফটওয়্যার আর সার্ভার টিমের দেখাশোনা করব।’ টুইটার নিয়ে বেশ খামখেয়ালি আচরণ ইলন মাস্ক করেছেন। এর খেসারত দিতে হয়েছে তাঁকে। অনেক বড় বড় কোম্পানি টুইটারে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে; অর্থাৎ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তিনি। এরপরই আমেরিকার স্টক মার্কেটে কারসাজির অভিযোগে বিচারব্যবস্থার মুখোমুখি হন ইলন মাস্ক। তাঁর বিরুদ্ধে আরোপিত মামলাটি ক্যালিফোর্নিয়া থেকে টেক্সাসে সরিয়ে নেওয়ার জন্য বিচারককে অনুরোধও করেছিলেন মাস্ক। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। এই আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছিলেন আদালত। জানা গেছে, ২০১৮ সালের আগস্টে তৎকালীন টেসলার সিইও ইলন মাস্ক একটি টুইট করেন। সেখানে তিনি বলেন, টেসলাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রাইভেট কোম্পানিতে নেওয়ার জন্য তাঁর কাছে পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে। ফলে তখন কোম্পানির শেয়ারের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। টুইটারে পোস্টের মাধ্যমে বিলিয়ন ডলার খরচ করার অভিযোগে শেয়ারহোল্ডাররা মাস্কের বিরুদ্ধে মামলা করেন। শুধু কি তাই! পাওনা অর্থ পরিশোধের দাবিতে মাস্কের বিরুদ্ধে এই মামলা করেছিলেন টুইটারের সাবেক সিইও পরাগ আগরওয়ালসহ শীর্ষ তিন কর্মকর্তাও।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর