সোমবার, ১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

সংগ্রামী ক’জন শ্রমিক নেতার কথা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচ.ডি

সংগ্রামী ক’জন শ্রমিক নেতার কথা

সিজার ক্যাভেজ [আমেরিকা]

এই পৃথিবীর ইতিহাস যত পুরনো, মালিক-শ্রমিক কিংবা শাসক ও শোষিতের দ্বন্দ্ব সংঘাতের ইতিহাসও ততটাই পুরনো। যুগে যুগে একাধিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার।  আর এই অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে অবদান রাখা অনেক শ্রমিক নেতা হয়ে আছেন কিংবদন্তি। তাদেরই ক’জনের কথা নিয়ে আজকের রকমারি-

 

সিজার ক্যাভেজ [আমেরিকা]

শ্রমিক আন্দোলন বিশেষত কৃষকদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে অমর হয়ে আছেন সিজার ক্যাভেজ (১৯২৭-৯৩)। গত ২৩ এপ্রিল ছিল তার ৩০তম মৃত্যু দিবস। তার হাত ধরেই গড়ে উঠেছিল আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ফার্ম ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন’ যা পরবর্তীতে ‘এগ্রিকালচারাল ওয়ার্কার্স অর্গানাইজিং কমিটি’ ও ‘ইউনাইটেড ফার্ম ওয়ার্কার্স লেবার ইউনিয়ন’-এর সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়। তাকে মূলত বাম ঘরানার রাজনীতিবিদ ও শ্রমিক নেতা এবং খ্রিস্টীয় ক্যাথলিক বলে গণ্য করা হয়।

তার কর্মজীবন শুরু হয় একজন সাধারণ কৃষি শ্রমিক হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি দুই বছর আমেরিকার নৌবাহিনীতে চাকরি করেন। নৌবাহিনীর চাকরি ছেড়ে যুক্ত হন কমিউনিটি সার্ভিস অর্গানাইজেশন বা সমাজসেবা কার্যক্রমের সঙ্গে। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি শ্রমিকদের ভোটাধিকার, জীবন বিমা ও ঋণ পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করেন। শ্রমিকদের মুখপাত্র হিসেবে একটি সংবাদপত্রের প্রকাশনা শুরু হয় সিজারের উদ্যোগে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বিনাশ করে প্রকৃত উৎপাদক তথা কৃষকদের আঙ্গুরের যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিত করতে সিজারের নেতৃত্বে ১৯৬৫ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষক ও শ্রমিকদের আন্দোলন, হরতাল ও বয়কট শুরু হয়।

দীর্ঘ পাঁচ বছর এ ধরনের প্রতিবাদ চলার পর ১৯৭০ সালে কর্তৃপক্ষ আঙ্গুর চাষিদের দাবি-দাওয়া মেনে নিতে বাধ্য হয়। এ দাবি আদায়ের সংগ্রাম চলাকালে তিনি ও তার সঙ্গীরা মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের পথ অনুসরণ করেন। তার আদর্শ পরবর্তীতে পৃথিবীর বহু দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

সামান্তবাদী ও পুঁজিপতিরা তার বিরুদ্ধে বহু কুৎসা রচনা করে এবং আইনগত ঝামেলা তৈরি করে। তবে সব বাধা অতিক্রম করে তিনি এক কিংবদন্তিতুল্য শ্রমিক নেতারূপে আবির্ভূত হন এবং ১৯৯৪ সালে মরণোত্তর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদক লাভ করেন এবং ফক’স অ্যাঞ্জেল বা জনতার দেবতা উপাধি লাভ করেন। এ ছাড়াও অসংখ্য সম্মাননা জুটেছে তার কর্মগুণে। তাঁর নামানুসারে পৃথিবীর বহু দেশে বহু স্থাপনা গড়ে উঠেছে এবং তাঁকে কেন্দ্র করে গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক লেখা হয়েছে ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।


স্যামুয়েল গমপার্স [ইংল্যান্ড-আমেরিকা]

‘বন্ধুদের নির্বাচিত কর এবং শত্রুদের হারিয়ে দাও’- এই বাণী দিয়ে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ, উদ্বুদ্ধ ও সংঘবদ্ধ করে কায়েমি তথা স্বার্থান্বেষী মহলকে বারবার পরাজিত করে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে অনুকরণীয় হয়ে আছেন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত  আমেরিকার শ্রমিক নেতা স্যামুয়েল গমপার্স (১৮৫০-১৯২৪)। পূর্ব লন্ডনের এক দরিদ্র এলাকায় একজন সাধারণ সিগারেট (সিগার) শ্রমিকের ঘরে জন্ম নেন স্যামুয়েল গমপার্স। ছয় বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হলেও মাত্র ১০ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে তাকে উপার্জনের জন্য বাবার মতোই সিগারেট শ্রমিকের জীবন বেছে নিতে হয়। তবে পড়ার প্রতি আগ্রহের কারণে তিনি শ্রমজীবীদের রাত্রিকালীন স্কুলে লেখাপড়া চালিয়ে যান। ১৩ বছর বয়সে দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত পরিবারের সঙ্গে স্যামুয়েল গমপার্স আমেরিকার নিউইয়র্কে এক শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকায় গমন করেন। এখানে পিতাপুত্র ঘরে বসেই সিগারেট (সিগার) তৈরি ও বাজারজাত করতে থাকেন। এরই মাঝে অবসরে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে স্যামুয়েল বিতর্ক ক্লাব গড়ে তোলেন। এই ক্লাবে তিনি বক্তৃতার কলাকৌশল রপ্ত করেন এবং অন্যান্য ক্লাবের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে থাকেন, যা পরবর্তীতে তাকে ভালো রাজনৈতিক বক্তা হতে সাহায্য করে। ১৫ বছর বয়সে তিনি সিগারেট শ্রমিক সংগঠনের সদস্য হন এবং পরবর্তীতে একজন শ্রমিক নেতা হয়ে ওঠেন। ২৫ বছর বয়সে তিনি সিগার শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় তার কার্যক্রম বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকার অভিযানের বিরুদ্ধে তার অবস্থান তাকে বিতর্কিত করে তোলে। ৭৩ বছর বয়সে তিনি ইনফ্লুয়েঞ্জা, ব্রঙ্কাইটিস, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তবুও তিনি দেশ থেকে দেশে অবিরাম ছুটেছেন শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। ১৯২৪ সালের ৬ ডিসেম্বর মেক্সিকোতে শ্রমিক সমাবেশে যোগ দিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বারবার চেয়েছিলেন তার মৃত্যু যেন আমেরিকার মাটিতেই হয়। শেষ ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে তাকে দ্রুত আমেরিকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পথে মারা যান কর্মবীর এ শ্রমিক নেতা। শ্রমিক অধিকার নিয়ে তিনি বেশ কিছু প্রবন্ধ ও বই লিখেছেন এবং বেশ কিছু পুরস্কার লাভ করেছেন।


আনাসুয়া সারাভাই [ভারত]

ভারতের ইতিহাসে অহংকার হয়ে আছেন আনাসুয়া সারাভাই (১৮৮৫-১৯৭২) নামের এক অনন্যা মহিলা সমাজকর্মী। গুজরাটে তার পরিচয় ‘মাতাবেন’ নামে, যার অর্থ বড় বোন। তিনি ভারতের প্রথম শ্রমিক নেত্রী এবং ভারতের প্রাচীনতম শ্রমিক সংগঠন ‘আহমেদাবাদ টেক্সটাইল লেবার অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা। ১১ নভেম্বর ১৮৮৫ সালে যখন আনাসুয়া সারাভাই জন্মগ্রহণ করেন তখন ভারতে মহিলাদের কোনো চাকরি বা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সুযোগ ছিল না। মাত্র ৯ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়ে তিনি ভাই ও বোনকে নিয়ে চাচার আশ্রয়ে চলে যান। ১৩ বছর বয়সে তাকে বিয়ে দেওয়া হলেও অল্প দিনের মধ্যেই তা ভেঙে যায়। এরপর তিনি ইংল্যান্ডে ভাইয়ের কাছে চলে যান এবং মেডিকেল বিষয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। পরবর্তীতে তা ছেড়ে অর্থনীতিতে পড়ালেখা করেন। এরপর ভারতে এসে মেয়েদের ভাগ্যোন্নয়নে মাঠে নামেন।

তিনি মূলত বস্ত্রকলে কর্মরত মহিলা শ্রমিক ও তাদের কন্যাদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই লেখাপড়া করতে পারত। তিনি মেয়েদের জন্য পৃথক টয়লেট, প্রসূতিঘর, মহিলা নিবাস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করেন। এক দিন তিনি একদল মহিলা শ্রমিকের সাক্ষাৎ পান যারা টানা ৩৬ ঘণ্টা বস্ত্রকলে কাজ করে ক্লান্ত দেহে ঘরে ফিরছিল। এমন ঘটনাকে তিনি দাস প্রথার সঙ্গে তুলনা করেন এবং প্রতিরোধে বস্ত্রকলের শ্রমিকদের নিয়ে হরতাল শুরু করেন। তার আপন ভাই তখন মিল মালিকদের সংগঠনের প্রধান ছিলেন। ফলে ভাইয়ের সঙ্গেও তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তবে সারাভাই নিজ দাবিতে অটল থাকেন এবং টানা ২১ দিন হরতাল করে দাবি আদায় করেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী ছিলেন এবং গান্ধীজিও তার আন্দোলনকে সমর্থন করতেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিঠি লিখে তার আন্দোলনের সপক্ষে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাতেন। ১ নভেম্বর ১৯৭২ সালে লাখো মহিলার চোখের জলে সিক্ত হয়ে সারাভাই পৃথিবী ত্যাগ করেন।


মেরি জোন্স [আয়ারল্যান্ড-আমেরিকা]

আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে কয়লা শ্রমিক, বস্ত্র শ্রমিক, রেল শ্রমিকসহ নানা স্তরের শ্রমিকদের সংগঠিত করা, দাবি আদায়ে প্রতিষ্ঠিত করে তোলা, দিক-নির্দেশনা প্রদান, অনুপ্রেরণা ও নির্দেশনা দেওয়া, সর্বোপরি নির্ভয়ে পেটুয়া বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিয়ে উদাহরণ স্থাপন এবং সরকারি আইনজীবীর ভাষায়, ‘মোস্ট ডেঞ্জারাস ওমেন ইন আমেরিকা’ খেতাব লাভ করেন মেরি জি হেরিস জোন্স। ১৮৪৫ থেকে ১৮৫২ সাল পর্যন্ত সাত বছর আয়ারল্যান্ডে চলে মহাদুর্ভিক্ষ। এ দুর্ভিক্ষের আগেই এক কৃষক পরিবারে জন্ম নেন জোন্স। মহা দুর্ভিক্ষের কারণে বেঁচে থাকার তাগিদে আয়ারল্যান্ডের প্রায় ১০ লক্ষাধিক পরিবার নিজ নিজ ভিটা ছেড়ে পাড়ি জমান আমেরিকায়। ১০ বছর বয়সী জোন্সের পরিবারও ছিল দেশ ছেড়ে যাওয়া সেই কাফেলায়। পরে তাদের ঠাঁই হয় উত্তর আমেরিকায়। কিন্তু উদ্বাস্তু হওয়া জোন্সের পরিবার নানা বিড়ম্বনার শিকার হয় এবং আমেরিকা ও কানাডায় যাযাবর জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। বহু ত্যাগ স্বীকার করে তিনি নির্দিষ্ট শিক্ষা গ্রহণের পর শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৬১ সালে তিনি ইস্পাত শ্রমিক জর্জকে বিয়ে করে সংসারী হন। মাত্র সাত বছরের বিবাহিত জীবনে তিনি তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তান জন্ম দেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এ সাত বছরের মধ্যে তিনি স্বামী এবং চার সন্তানের করুণ মৃত্যু অবলোকন করেন। স্বামী-সন্তান হারিয়ে তিনি শিকাগোতে তৈরি পোশাকের ছোটখাটো ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু ১৮৭১ সালে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ঘরবাড়ি ও দোকান হারিয়ে তিনি সর্বস্বান্ত হন। বেঁচে থাকার তাগিদে এ অগ্নিকান্ডের পর থেকে তিনি শ্রমিক ও না খাওয়া মানুষকে সংগঠিত করে মেহনতি মানুষের অধিকার আদায় ও সম্মানের সঙ্গে বাঁচার সংগ্রাম শুরু করতে উদ্বুদ্ধ করেন। যে করুণ ঘটনার স্মরণে মহান মে দিবসের জন্ম সেই ঘটনার সময় জোন্স শিকাগো শহরেই ছিলেন এবং খনি শ্রমিকদের দাবি আদায়ের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। ১৮৭৭ সালের সড়ক ও রেলপথ ধর্মঘট, শিকাগো শ্রমিক আন্দোলন ও ১৮৮৫ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময় তার বলিষ্ঠ ভূমিকা সবার নজর কাড়ে। শিশু শ্রম বন্ধ ও নারী-পুরুষের সমান মজুরি আদায়ে তার নিঃস্বার্থ অবদান অনস্বীকার্য। খনিতে কাজ করতে গিয়ে আহত ও অঙ্গহারা শিশুদের নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের বাসভবনের দিকে পদযাত্রা তাকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা এনে দেয়। পুঁজিপতিরা তার বিরুদ্ধে বহু মামলা-মোকদ্দমা করে। আর বিপক্ষ আইনজীবী বিশেষত সরকারের আইনজীবীদের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন ‘মোস্ট ডেঞ্জারাস ওমেন ইন আমেরিকা’। ১৯৩০ সালের ৩০ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শ্রমিকবান্ধব এ মহীয়সী নারী।


পিটার জে ম্যাকগাইভার [আমেরিকা]

পিটার জে ম্যাকগাইভার (১৮৫২-১৯০৬) ১৯ শতকে আমেরিকার একজন প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি তার সহযোগীদের নিয়ে ১৮৮১ সালে ‘ইউনাইটেড ব্রাদারহুড অব কার্পেন্টারস অ্যান্ড জয়েনার্স অব আমেরিকা’ নামক একটি শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৮৮২ সালে তিনি শ্রমিক দিবস বা মে দিবস পালনের প্রস্তাব করেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে।

নিউইয়র্কের এক দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। শ্রমিক নেতা হিসেবে পরিচিতির আগেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। যুবক বয়সে মিছিল করার অনুমতি না পেয়ে পিটার ও তার শ্রমিক দল স্থানীয় পুলিশ কমিশনারের অফিস দখল করে। ফলে তাকে আটক করা হয়। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন কাঠমিস্ত্রি এবং এ পরিচয় দিতেই তিনি গর্ববোধ করতেন। তার হাতে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘দি টয়লার’ (ঞযব ঞড়রষবৎ) নামক পত্রিকা। আমেরিকার শ্রমিকদের অভাব-অভিযোগ ও দাবি-দাওয়ার বাস্তব চিত্র তুলে ধরে এ পত্রিকা। বছরজুড়ে তিনি সমগ্র আমেরিকা ঘুরে শ্রমিকদের সুসংগঠিত করতেন। দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয় তিনি সেই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন এবং এ দাবি আদায়ে সব কাঠমিস্ত্রিকে নিয়ে হরতাল করেন। সময়ের প্রয়োজনে তিনি বহু শ্রমিক সংগঠন এবং একাধিক শ্রমিক সংগঠনের সমন্বয়ে শ্রমিক জোট তৈরি করেন। এ জন্য তিনি নিজ পকেটের অর্থ ব্যয় করে বারবার নিঃস্ব হন। শেষ জীবনে তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠলেও তার শেষ দিনগুলো দারিদ্র্যের মাঝেই অতিবাহিত হয়। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। মাত্রাতিরিক্ত মদ পানের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ২০১৪ সালে আমেরিকার ‘নিউ জার্সি হল অব ফেইম’-এ তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। শ্রমিকদের জীবন ও কর্ম-ক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও বেকার ভাতা প্রবর্তনে তার ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে আজও স্মরণ করা হয়।


লেচ ওয়ালেস [পোল্যান্ড]

পোল্যান্ডের ইতিহাসে একজন সফল শ্রমিক নেতা ও পরবর্তীতে সে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে আছেন লেচ ওয়ালেস। জার্মান কর্তৃক দখলকৃত পোল্যান্ডের পোপোও অঞ্চলে তার জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয় তার নির্মম শিকার হয় পোল্যান্ড। তখন সে দেশের জীবনযাত্রার মান ছিল নিম্নস্তরে। এ সময় লেচ ওয়ালেস ছিলেন একটি জাহাজঘাটের ইলেকট্রিশিয়ান।

কমিউনিস্ট শাসনের কারণে সে যুগে পোল্যান্ডে কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল না। এমনই এক কঠিন সময়ে লেচ ওয়ালেস পোল্যান্ডের ‘সলিডারিটি মুভমেন্ট’ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তীব্র শ্রমিক আন্দোলন শুরু করেন। এ আন্দোলনের কারণে ১৮৮৯ সালে পোল্যান্ডে কমিউনিস্ট শাসন তথা পোল্যান্ড নিয়ে দুই পরাশক্তির টানাটানি বা স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়।

জাহাজঘাটে ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ করার সময় তিনি প্রথমত স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়নের নেতা হন। এ সময় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়, সাজানো বিচার হয় এবং তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এতে তিনি দমে যাননি বরং আরও শক্তিমত্তা নিয়ে এগোতে থাকেন। এক পর্যায়ে তার ওপর ন্যস্ত হয় এক কোটিরও বেশি শ্রমিকের নেতৃত্ব। তখন তিনি আপামর জনগণ ও শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। ১৩ ডিসেম্বর ১৯৮১ তারিখে ক্রমবর্ধমান সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনের জন্য পোল্যান্ডে সামরিক শাসন জারি করা হয়, শ্রমিক আন্দোলন বেআইনি ঘোষণা করা হয় এবং লেচ ওয়ালেসকে কারাগারে পাঠানো হয়। তীব্র আন্দোলনের মুখে কারামুক্ত হন লেচ ওয়ালেস। এরপর সরকারের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে ১৯৮৯ সালে পোল্যান্ডের আইনসভা বা সংসদ নির্বাচন আদায় করেন। এ নির্বাচনে রায় শ্রমিকদের পক্ষে আসে। ১৯৯০ সালে তিনি পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার বলিষ্ঠ ভূমিকার ফলে পোল্যান্ড ক্রমান্বয়ে মার্কস ও লেনিনের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের ধারায় প্রত্যাবর্তন করে ১৯৯৫ সালের নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে তিনি হেরে যান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গবেষণা সংস্থা এবং এনজিও তাকে শতাধিক পুরস্কার ও খেতাবে ভূষিত করে।

১৯৮৩ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। বিশ্বের ৩০টি দেশ তাকে ৫০টিরও বেশি সম্মাননা প্রদান করে। অসংখ্য নামিদামি প্রকাশনা সংস্থা তাকে ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’, ‘পারসন অব সেঞ্চুরি’, ‘বেস্ট হান্ড্রেড’ প্রভৃতি খেতাব প্রদান করে। বিভিন্ন দেশে তার নামে বহু স্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সর্বশেষ খবর