বৃহস্পতিবার, ১১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

পাকিস্তানি শাসকদের ট্র্যাজেডি

তানভীর আহমেদ

পাকিস্তানি শাসকদের ট্র্যাজেডি

করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে পাকিস্তানি শাসকদের। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ৭৫ বছর কেটেছে তাদের। এ সময়ে ক্ষমতায় বসেছেন ২২ সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান। কোনো শাসকই ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। দেশটিতে বারবার এসেছে সামরিক শাসন। সামরিক ও গণ অভ্যুত্থান হয়েছে। কখনো বা কোনো সরকারপ্রধানকে পরতে হয়েছে ফাঁসির দড়ি, কখনো ঘাতকের গুলি-বোমা কিংবা সাজানো বিমান দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যু।  আবার কখনো বিরোধী দলের অনাস্থার মুখে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে তাদের...

 

পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি

লিয়াকত আলী খান : চার বছর

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।

খাজা নাজিমউদ্দিন : দুই বছরের কম

১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল নাজিমউদ্দিনকে গভর্নর জেনারেল প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন।

মোহাম্মদ আলী বগুড়া : দুই বছর

পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় ভারপ্রাপ্ত গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা তাঁকে সরিয়ে দেন।

চৌধুরী মোহাম্মদ আলী : এক বছর

১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দলের সদস্যদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এবং আইয়ুব খানের একনায়কতন্ত্র নিয়ে স্পষ্টবাদী হওয়ার কারণে চাপের মুখে পড়েন তিনি। এরপর পদত্যাগ করেন।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী : এক বছর

১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। কিন্তু ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালের ১৭ অক্টোবর পদত্যাগ করেন।

ইবরাহিম ইসমাইল চুন্দ্রিগড় : দুই মাস

১৯৫৭ সালের ১৭ অক্টোবর ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র দুই মাস।

ফিরোজ খান নূন : এক বছরের কম

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির সময় নূনকে তাঁর পদ থেকে বরখাস্ত করেন।

নুরুল আমিন : ১৩ দিন

দায়িত্ব পালনের ১৩ দিনের মাথায় ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর নুরুল আমিনকে সরিয়ে দেন ইয়াহিয়া খান।

জুলফিকার আলী ভুট্টো : পৌনে চার বছর

জেনারেল মুহাম্মদ জিয়াউল হক তাঁকে কারাবন্দি করেন। ১৯৭৯ সালে ভুট্টোর ফাঁসি হয়।

মুহাম্মদ খান জুনেজো : তিন বছর

১৯৮৮ সালের ২৯ মে জুনেজোর সরকার বরখাস্ত হয়।

বেনজির ভুট্টো : দুই বছর

১৯৯০ সালের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি গুলাম ইসহাক খান তাঁকে সরিয়ে দেন।

নওয়াজ শরিফ : তিন বছরের কম

সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান ওয়াহিদ কাকার ১৯৯৩ সালের ১৮ জুলাই নওয়াজ শরিফ ও প্রেসিডেন্ট গুলাম ইসহাক খানকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন।

বেনজির ভুট্টো : তিন বছর

রাষ্ট্রপতি ফারুক লেঘারি ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে বেনজির ভুট্টো সরকারকে বরখাস্ত করেন।

নওয়াজ শরিফ : দুই বছর

১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর জেনারেল পারভেজ মোশাররফ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন।

মীর জাফরুল্লাহ খান জামালি : ১৯ মাস

জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তাঁকে বরখাস্ত করার আগে তিনি ১৯ মাস দায়িত্ব পালন করেন।

চৌধুরী সুজাত : দুই মাস

চৌধুরী সুজাত ২০০৪ সালের ৩০ জুন পার্লামেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হন। শওকত আজিজ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন সুজাত।

শওকত আজিজ : তিন বছর

শওকত আজিজ ২০০৪ সালের ২৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ করে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি দায়িত্ব ত্যাগ করেন।

ইউসুফ রাজা গিলানি : চার বছর

২০১২ সালে শীর্ষ আদালত অবমাননার মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে গিলানিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

রাজা পারভেজ আশরাফ : এক বছরের কম

পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদ শেষ করতে গিলানির কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাজা পারভেজ আশরাফ।

নওয়াজ শরিফ : চার বছরের বেশি

২০১৭ সালের ২৮ জুলাই সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক অভিশংসিত হওয়ার আগে তিনি চার বছর ৫৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন।

শাহিদ খাকান আব্বাসি : এক বছরের কম

নওয়াজ শরিফকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর শাহিদ খাকান আব্বাসিকে ২১তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ৩১ মে তাঁর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কারণ নতুন নির্বাচনের জন্য পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়।

ইমরান খান : তিন বছরের বেশি

ছিলেন ক্রিকেট লিজেন্ড, হলেন প্রধানমন্ত্রী (আগস্ট ১৮, ২০১৮-এপ্রিল ১০, ২০২২)। জাতীয় পরিষদে বিরোধীদের অনাস্থা ভোটে হেরে গিয়ে পদ ছাড়েন প্রধানমন্ত্রীর।

 

বুকে দুটি গুলি করে তাঁকে হত্যা করে আততায়ী

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। ১৯৪৭ সালে তিনি এ পদে বসেন। কিন্তু ক্ষমতায় টিকে থাকতে পেরেছিলেন মাত্র চার বছর। পঞ্চাশের দশকের কথা। মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোকে ইরানের তেলসংশ্লিষ্ট চুক্তি পাইয়ে দিতে অনুরোধ করে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের সঙ্গে লিয়াকত আলী খানের সম্পর্ক দারুণ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন তিনি। উল্টো পাকিস্তান থেকে মার্কিন ঘাঁটি সরিয়ে নিতে বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। তারা কাজে লাগায় পাশের দেশ আফগানিস্তানকে। সিআইএ’র পরিকল্পনায় রাজি হয় তারা। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর এক জনসভায় ভাষণ দিতে ওঠেন লিয়াকত আলী খান। সে সময় সৈয়দ আকবর নামে এক আততায়ী লিয়াকত আলী খানের বুক বরাবর দুটি গুলি করেন। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায়নি লিয়াকত আলী খানকে। আলোচিত এ হত্যাকান্ডের ৬৪ বছর পর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রকাশিত এক গোপন নথি থেকে পুরো ঘটনা জানতে পারে বিশ্ববাসী।

 

’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করেন। সে সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন জেনারেল আইয়ুব খান। এ ঘটনার মাত্র ২০ দিনের মাথায় আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেন এবং নিজেই প্রেসিডেন্টের পদে বসেন। লিয়াকত আলী খান যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করে যে ভুল করেছিলেন, তা ভালোই মনে রেখেছিলেন তিনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত বিরোধী কট্টর মনোভাব ছিল তাঁর। তিনি পেশোয়ারে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় বিমানঘাঁটি গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৬৫ সালে আইয়ুব সরকার ভারতের সঙ্গে একটি বড় ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ যুদ্ধ তাশখন্দ ঘোষণার মধ্য দিয়ে নিষ্পন্ন হয়। যুদ্ধের পরিণতি পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলে তাঁর বিরুদ্ধে বিরূপ প্রভাব ফেলে। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) গণ অভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাঁর বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী, জনগণের অধিকার লুণ্ঠন ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। ১৯৭৪ সালে দীর্ঘ রোগভোগের পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

গণহত্যার পর যুদ্ধে পরাজয় আত্মসমর্পণ করে বিদায়

আইয়ুব খানকে পদত্যাগে বাধ্য করে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণ অভ্যুত্থান ঠেকাতে নির্বিচারে গ্রেফতার, নির্যাতন ও হত্যার পথে হাঁটেন তিনি। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরেও ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি তিনি। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর সেনাবাহিনী সদর দফতরে ইয়াহিয়া খান এক সভায় সামরিক হামলার নির্দেশ দেন। পরিকল্পনা হয় ২৫ মার্চ কালরাতে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের। পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক গণহত্যা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইয়াহিয়া বুঝে যান যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত। তাই তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজিকে ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মিত্রবাহিনী ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। এর দুই দিন পর  অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণবিষয়ক দলিলে স্বাক্ষর করেন নিয়াজি। ২০ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে রাষ্ট্রপতির পদে বসিয়ে দিয়ে যান।

 

রাওয়ালপিন্ডি কারাগারে মৃত্যুদন্ড কার্যকর

পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি পাকিস্তানের রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত চরিত্র। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারত-বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পর ইয়াহিয়া খানের জায়গায় প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান। ১৯৭৩ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু স্বস্তিতে ক্ষমতা ভোগ করতে পারেননি। বিশ্লেষকদের মতে, ভুট্টোর ‘একনায়কতান্ত্রিক’ আচরণের কারণে পাকিস্তানজুড়ে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও দুর্বল হতে থাকে। এ সুযোগে ১৯৭৮ সালে ভুট্টোকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউল হক। অথচ জুলফিকার আলী ভুট্টোই তাঁকে সেনাপ্রধান নিয়োগ দিয়েছিলেন। শুধু ক্ষমতা হারানোই নয়, ভুট্টোর জন্য অপেক্ষা করছিল আরও বড় দন্ড। ১৯৭৪ সালে এক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর বাবাকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন ভুট্টো। রায়ে তাঁর মৃত্যুদন্ড হয়। অবশেষে ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল মাঝরাতে রাওয়ালপিন্ডি কারাগারে ভুট্টোর মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়।

 

বিধ্বস্ত হয় প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান

জেনারেল জিয়াউল হকের পরিণতি ছিল ভয়াবহ। জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উৎখাত করে ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতায় ছিলেন ১০ বছর। ১৯৮৮ সালের ৭ আগস্ট রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ৪০০ মাইল দক্ষিণে বাহওয়ালপুর থেকে রাজধানীতে ফিরছিলেন। পাকিস্তানে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরনল্ড রাফেল ও মার্কিন সামরিক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হারবার্ট এম ওয়াসমও তাঁর সঙ্গে একই উড়োজাহাজে ছিলেন। স্থানীয় সময় বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে বাহওয়ালপুর থেকে আকাশে ওড়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয় প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান। এতে উড়োজাহাজে থাকা ৩১ আরোহীর সবাই নিহত হন। এ দুর্ঘটনা ঘিরে শুরু থেকেই রহস্যের গন্ধ পেয়েছিলেন অনেকে। এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল বলে দাবি করেন পাকিস্তানের সিনেটর মুশাহিদ হোসেইন। পাকিস্তানের একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, জিয়াউল হককে হত্যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক প্রশাসন যৌথভাবে কাজ করেছিল।

 

জনসভায় গুলি, আত্মঘাতী বোমা হামলায় খুন

জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে বেনজির ভুট্টো। বেনজির ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে জিতে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তিনি হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। রাজনীতির মাঠে নেমে তাঁকে করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়। তিনিও ক্ষমতার মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। ১৯৯০ সালে বরখাস্ত হন। ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু সেবারও মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। উৎখাত হন তিন বছর পরই। এরপর একপ্রকার স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান বেনজির। ২০০৭ সালের অক্টোবরে পুনরায় পাকিস্তানে ফেরেন। তাঁর দেশে ফেরার দিনই করাচিতে ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হন। সৌভাগ্যবশত ওই ঘটনায় বেঁচে যান বেনজির। কিন্তু দুই মাস পর সৌভাগ্য আর সঙ্গ দেয়নি তাঁকে। লিয়াকত আলী খানকে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল, রাওয়ালপিন্ডির সেই এলাকাতেই ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর এক নির্বাচনী জনসভায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন বেনজির। হামলাকারী প্রথমে তাঁর ঘাড়ে গুলি করে এবং পরে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটান।

 

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি মামলায় দন্ডিত, এখন দেশছাড়া

তিনবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নওয়াজ শরিফ। তবে কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। ১৯৯০ সালের ১ নভেম্বর প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ। তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ক্ষমতা ছাড়তে হয়। ১৯৯৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। তখন ক্ষমতা ছাড়তে হয় আড়াই বছরের মাথায়। ২০১৩ সালের নির্বাচনে জিতে ফের ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে সেবারও ক্ষমতা ছাড়তে হয় তাঁকে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুর্নীতির মামলায় ১০ বছরের কারাদন্ড দেন আদালত। একই মামলায় তাঁর মেয়ে মরিয়ম নওয়াজকেও সাত বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। নওয়াজ শরিফ জেলে যান। পরে চিকিৎসার অজুহাতে দেশ ছাড়েন। ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে তিনি লন্ডনে বসবাস করছেন। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে অযোগ্য ঘোষণা করেন। আদালতের রায়ে তাঁকে দলীয় প্রধানের পদও ছাড়তে হয়। ইমরান খানের বিদায়ের পর নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ এখন ক্ষমতায়।

 

রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ছিলেন দেশছাড়া

সেনাবাহিনী প্রধান হওয়ার প্রায় এক বছর পর পারভেজ মোশাররফ নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার কারিগর আল-কায়েদার তৎকালীন নেতা ওসামা বিন লাদেন দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানে বসবাস করছেন এবং তার অবস্থান সেনা একাডেমি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তখন মোশাররফের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। জেনারেল মোশাররফ দেশের আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে একই সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থাকতে চেয়েছিলেন। জরুরি অবস্থা জারি করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টাও চালান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে হেরে যায় তাঁর দল। তার ছয় মাস পর অভিশংসন এড়াতে পদত্যাগ করেন তিনি। পাকিস্তানে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। ২০১৪ সালে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেন আদালত। আদালত মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিলেও পরে তা বাতিল হয়।  মোশাররফ ২০১৬ সালের মার্চে পাকিস্তান ছেড়ে চলে যান। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে তাঁকে দেশ ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ তিনি মারা যান।

 

রাজনীতিতে নেমে গুলিবিদ্ধ এবার গ্রেফতার

পাকিস্তানের ক্রিকেট লিজেন্ড ইমরান খান। রাজনীতিতে নেমে চমক দেখান। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তবে তিনিও ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।  রাজনীতিতে নেমে হয়েছেন গুলিবিদ্ধ। সম্প্রতি ৬০ বিলিয়ন রুপি আত্মসাতের মামলায় গ্রেফতার হলেন...

৯ মে পাকিস্তানের স্থানীয় সময় বিকালে দুটি মামলায় হাজিরা দিতে হাই কোর্টে গিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। সেখান থেকে ফেডারেল সরকারের আধাসামরিক বাহিনী তাঁকে আটক করার পর আল-কাদির ট্রাস্ট মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এ মামলায় অভিযোগ রয়েছে- ইমরান যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সে সময় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর সঙ্গে বোঝাপড়া হয়েছিল। আর সেই বোঝাপড়ার জন্য পাকিস্তান সরকারের ক্ষতি হয়েছিল ৫ হাজার কোটি রুপি। শুধু তাই নয়, আল-কাদির বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির নামে সোহাওয়ার মৌজা বাকরালার ৪৫৮ কানাল জমির (৫৭.২৫ একর) জন্য নিজেদের প্রয়োজনমতো সুবিধা নিয়েছিলেন তেহরিক-ই-ইনসাফের একাধিক নেতা।

যেভাবে রাজনীতিতে : পাকিস্তানের ক্রিকেট লিজেন্ড ইমরান খান। ১৯৯৬ সালে তেহরিক-ই-ইনসাফ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে সবাইকে চমকে দেন। দল গঠনের পরের বছরই পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে দুটি আসনে ভোটযুদ্ধে নামেন ইমরান খান। দুই আসনেই খালি হাতে ফেরেন। ২০১৩ সালে মাত্র ১৯ শতাংশ ভোট পায় ইমরানের পিটিআই। তবে নির্বাচনে নিজ আসনে জয় পান ইমরান। রাজনীতিতে নতুন রূপে দেখা যায় তাঁকে। পাকিস্তানের তরুণ সমাজের কাছে ইমরান খানের বিপুল জনপ্রিয়তা গোটা পাকিস্তানে ছড়িয়ে যায়।

প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত : ২০১৮ সালের নির্বাচনে জনমত ও বুথ ফেরত সমীক্ষায় পাল্লা ভারী ছিল তেহরিক-ই-ইনসাফের। ঘটলও তাই। ফল গণনায় ধীরগতির অভিযোগের পাশাপাশি সরকার গঠনের দিকে অনেকটাই এগিয়ে যান ইমরান খান। ২৭২টি আসনের মধ্যে ১৩৭টি পেলেই সরকার গড়া যায়। তবে তেহরিক-ই-ইনসাফ একা পর্যাপ্ত আসন না পাওয়ায় কোয়ালিশনের পথে হাঁটেন তিনি। ক্রিকেট ছেড়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ইমরান।

অনাস্থা ভোটে পরাজয় : দেশটির ২২তম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইমরান খান। আর্থিক দুরবস্থা ও ভুল পররাষ্ট্রনীতির অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে বিরোধী দলগুলো। অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠানের কয়েক মিনিট আগে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার, ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ আসাদ কায়সার পদত্যাগ করেন। অনাস্থা ভোটে ইমরান খানের ভাগ্যনির্ধারিত হয়। ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। জাতীয় পরিষদের ৩৪২ সদস্যের মধ্যে ১৭৪ জন তাঁর প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ভোট দেন। পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারান ইমরান খান।

ফুল দেওয়ার নাম করে গুলি : পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরানকে হত্যা করার জন্য হামলাকারী ফুল দেওয়ার নাম করে একেবারে তাঁর সামনে চলে গিয়েছিলেন। তার পরই গুলি চালাতে থাকেন। গুলিতে আহত হন সাতজন। তাঁদের মধ্যে পরে একজন মারা যান। পায়ে গুলিবিদ্ধ হন ইমরান খান। ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে যান- এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে গোটা পাকিস্তানে। এ হামলার ঘটনায় একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বের হতে শুরু করে।

সর্বশেষ খবর