শুক্রবার, ১২ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা
সমরেশ মজুমদারের গল্প

সরেজমিনে

সরেজমিনে

রবীন্দ্রজয়ন্তীতে প্রয়াণ হলো প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের। উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষসহ অসংখ্য কালজয়ী উপন্যাস, গল্প, কবিতার স্রষ্টা তিনি।  গর্ভধারিণীর মতো একাধিক উপন্যাস তাঁকে বাংলাসাহিত্যে স্থায়ী জায়গা করে দিয়েছে। এই খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে নিয়মিত লিখতেন। সর্বশেষ তিনি গল্প লিখেন বাংলাদেশ প্রতিদিন ঈদ সংখ্যা ২০২৩-এ। পাঠকদের জন্য সেই গল্পটি আজ ছাপা হলো-

 

আগে অল্পবিস্তর ছিল, ইদানীং সুনাম বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই শহরটির। রাত দশটার আগে যারা ট্রেন থেকে নামে তারা হুড়মুড়িয়ে উধাও হয়ে যায় তাদের বাড়ির দিকে। রাত দশটার পরও সময় মেনে ট্রেন এসে দাঁড়ায় স্টেশনে। এখন খুব কম যাত্রীই সেই ট্রেন থেকে নেমে আসে কিন্তু স্টেশনের বাইরে পা ফেলে না। দেখা যাচ্ছে আগের থেকে অনেক যাত্রী কমে গিয়েছে ওই সময়ের পরে। মাঝরাতের ট্রেনগুলো আসে, দাঁড়ায়, চলে যায়, কিন্তু কোনো যাত্রী ওঠানামা করে না।

কিন্তু রাত দশটার পরে যারা নেমে প্ল্যাটফরমেই থেকে যায় তাদের সংখ্যা একটু একটু করে বাড়ছে। দিন দশেক আগে পশ্চিমপাড়ার কাপড়ের দোকানদার হরকুমার রায় রাত সাড়ে দশটার ট্রেন থেকে ব্যাগ হাতে নিয়ে নেমেছিল। সে সদরে গিয়েছিল আড়তদারের সঙ্গে বসে হিসাব সারতে। ফেরার পথে গোটা কয়েক নতুন শাড়ি কিনে এনেছিল যদি খদ্দেরদের পছন্দ হয় তাহলে মোটা অর্ডার দেবে।

এই ট্রেনে বেশি যাত্রী ছিল না। হরকুমার একাই ব্যাগ হাতে নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এক ঘণ্টা পরে কেউ একজন সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে জানিয়ে গেল বটগাছের নিচে যার ডেডবডি পড়ে আছে তাকে দেখতে অনেকটা হরকুমারের মতো। কে বা কারা অত রাতে নির্জন রাস্তায় হরকুমারকে পেয়ে খুন করে গিয়েছে। খবরটা পরের দিন চাউর হলো কিন্তু খুনি ধরা পড়ল না। ‘কে খুনি তাকে ঠাহরও করা গেল না।’ আর এটাই হলো সমস্যা। খুনি কে জানতে পারলে বোঝা যেত লোকটা হরকুমারের শত্রু কি না। ওই পথে যারা চলাচল করে তাদের কেন ক্ষতি করবে লোকটা, কিন্তু লোকটা ধরা পড়া দূরের কথা, পুলিশ তার পরিচয়ও বুঝতে পারছিল না। সেই থেকে একটু ভয় ভয় ভাব রাত বাড়লে ছড়িয়ে পড়তেই লোকজন দশটার আগের ট্রেনে ফিরলে স্টেশনে বাড়ির পথ ধরত। কয়েকজন সাহসী দল বেঁধে হাঁটতে শুরু করল যদি ঘড়িতে দশটা বেজে যায়।

তবে দুদিন শান্তভাবে চলে গেলে লোকের সাহস একটু একটু করে বেড়ে গেল। আগের মতো যখন তারা যাতায়াত শুরু করেছে তখন দ্বিতীয় লোকটাকে পাওয়া গেল। আশ্চর্য ব্যাপার, পরের সকালে যখন রাস্তার পাশে পুকুরের ধারে উপুড় হয়ে মৃতদেহকে পড়ে থাকতে দেখা গেল তখন ভিড় জমলো। পুলিশ এলো। জিজ্ঞাসাবাদ করে লাশ তুলে নিয়ে চলে গেল। দুজন সেপাই নিচু গলায় বলছিল লোকটা খুব চেনা চেনা। শহরের আদালতের কাঠগড়ায় ওকে একবার দেখেছিল বলে মনে হচ্ছে। খুব নামকরা চোর। দ্বিতীয়জন বলেছিল, থানায় গিয়ে বড়বাবুকে খবরটা দিয়ে দিবি।

‘পাগল, আমার যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে গালাগাল খেতে হবে।’

 

কিন্তু দ্বিতীয় মৃতদেহ মানুষকে দ্বিগুণ আতঙ্কিত করল। রাত দশটার পরে যে কয়েকটা ট্রেন এসে এই স্টেশনে দাঁড়ায় তার যাত্রী একেবারেই কমে গেল। যাত্রীরা বাধ্য হয়ে প্ল্যাটফরমেই বসে থাকেন ভোরের অপেক্ষায়। খুব সাহসী যারা তাদের কয়েকজন একত্রিত হয়ে হাতে লাঠি নিয়ে স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই কম।

তৃতীয় খুনটি হয়ে গেল তিন রাত আগে। পুলিশ এসে সারা দিন ধরে হইচই করে তল্লাশি চালাল। মুশকিল হলো, কোনো সাক্ষী পাওয়া গেল না। কেউ খুন করতে দেখেনি। আর এই তৃতীয় লোকটি যাকে খুন করা হয়েছে সে ছিল শহরের একজন পাতি মাতাল। এককালে আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল না। কিন্তু ঘুরে ঘুরে মদ্যপান করে লোকটা সর্বস্ব খুইয়েছিল, রোজ দুপুরের ট্রেন ধরে চলে যেত ঘণ্টা দেড়-দুয়েকের দূরত্বের শহরগুলোতে। আজ এই শহর, কাল ওই শহরে গিয়ে পকেটে যা নিয়ে যেত তা দিয়ে মদ কিনে গলা পর্যন্ত ভরিয়ে ট্রেনে চেপে ফিরে আসত। আসা যাওয়ার পথে সে কারও সঙ্গে কথা বলত না। স্টেশনে নেমে টলমলে পা ফেলে নিজের বাড়ির পথ ধরত। এই যে রাতের পথে কেউ স্টেশনের বাইরে যাওয়া বন্ধ করেছিল তা সম্ভবত পেঁচারাও জানত কিন্তু ট্রেনের শেষ কামরা থেকে টলমলিয়ে প্ল্যাটফরম থেকে লোকটা ওপাশের গেট দিয়ে যখন বাইরে বেরিয়ে যেত তখন কোনো টিকিট চেকার সেখানে পাহারায় থাকত না। কেউ নিষেধ করত না। লোকটা রাতের নির্জন পথ যার অনেকটা থাকত অন্ধকারে আবছা, বাদশার মতো হেঁটে চলে যেতে চাইত।

এই দৃশ্য কেউ কেউ দেখেছে। দ্যাখেনি যেদিন সে ট্রেন থেকে নেমে একা একা অন্ধকার রাস্তায় হেঁটে গিয়েছিল। মৃতদেহ পাওয়া যাওয়ার পর কৌতূহলীদের ভিড় হয়েছিল। আত্মীয়স্বজনরা এতে কান্নাকাটি করেনি। কেউ কেউ বলাবলি করল, ওর বউ নাকি বেশ কয়েক বছর আগে ওর মদ খাওয়া সহ্য করতে না পেরে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছে। লোকটা নাকি একাই থাকতেন। পুলিশ এসে মৃতদেহ তুলে নিয়ে গেল। ঘাড়ের কাছে ভয়ঙ্কর আঘাতের চিহ্ন দেখা গেল। পেছন থেকে আঘাত করে খুন করা হয়েছে ওকে।

কিন্তু কে বা কারা খুন করল তা জানা গেল না। মাতালদের শত্রু থাকাটা খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু শত্রুতা চরমে না উঠলে খুন খারাপি হয় না। পুলিশ খোঁজখবর করেও কোনো সূত্র খুঁজে পেল না। ওর আগে যারা খুন হয়েছিল তারা মদ খেত না। ওদের মধ্যে যে যোগাযোগ ছিল তার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না।

পুলিশ জানতে পারল কোন স্টেশন থেকে লোকটা ট্রেনে উঠেছিল। সেটা যদিও অন্য শহরে তবু অনুমতি নিয়ে একজন সাবইন্সপেক্টর সেখানে গেল অনুসন্ধান করতে। দেখা গেল সেই রাতে যে মাতাল ট্রেনে উঠেছিল, সে ওঠার আগে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল বলে অনেকেই তাকে মনে রেখেছে। একটা সূত্র আর একটাকে টেনে আনতে সাহায্য করে। লোকটি যেখানে বসে মদ খেয়েছিল সেখানে গিয়ে সাবইন্সপেক্টর অবাক হয়ে গেলেন। এটা শহরের একপ্রান্তে ভাটিখানার পাহারা। ভদ্র পরিবারের বসবাস নেই সেখানে। পরপর ভাটিখানায় দিশি মদ বিক্রি হচ্ছে। সেখানটায় দাম অন্য জায়গার তুলনায় বেশ সস্তা। লোকটার পরিচয় জানা না গেলেও সাবইন্সপেক্টর জানতে পারলেন ভাটিখানার লোকজন ওকে মানুদাদা বলে ডাকত। এই মানুদাদা রোজ বিকেলে স্টেশন থেকে হেঁটে ভাটিখানায় চলে আসত। তবে সব সপ্তাহের শেষে সে উধাও হয়ে যেত। তখন তাকে দেখা যেত অন্য শহরের ভাটিখানায়। সেখানে পরপর কয়েক দিন সঙ্গ দিয়ে আবার উধাও হয়ে চলে যেত অন্য শহরে।

সাবইন্সপেক্টর আরও জানতে পারলেন, সন্ধ্যে থেকে লোকটা যে দিশি মদ পান করত তার দাম দিতে হতো না। তার অনুরাগীরা মাতালরা তাকে মদ খাইয়ে যেন ধন্য হয়ে যেত। সেখান থেকে ভরপেট খেয়ে কোনোমতে স্টেশনে ফিরে যেত লোকটা। শুধু মদ খাওয়া নয়, যেতে যেতে সে গান গাইত। সেই সব রসের গানের শ্রোতারা টাকা পেত খুব। খুন হয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে মন খারাপ হয়ে গেল তাদের।

সাবইন্সপেক্টর, যার ওপর তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছিল সে বয়সে নবীন, তার চাকরির বয়সও বেশি নয়। এই খুনের তদন্তের ওপর তার চাকরির ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভর করছিল বলে সে প্রবল উৎসাহে তদন্তে নেমে পড়ল। সে শুনেছিল, তদন্ত সব সময় গোড়া থেকে শুরু করতে হয়। তাই পোশাক পরে হাতে ছড়ি নিয়ে সে লোকটি যেখানে থাকত সেখানে চলে এলো। মাঠের পাশে যে ঘরটিতে লোকটা থাকত তার চেহারা একটুও ভালো নয়। দরজায় তালা ঝুলছে। সাবইন্সপেক্টর আশপাশের বাড়ির লোকদের জিজ্ঞেসা করে জানল যে, সে একাই থাকত।

ওপাশের আমগাছের নিচে এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়েছিল, সে তাকেই জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি লোকটাকে চেনেন?’

‘চিনি মানে! চিনে চিনে চোখ পচে গেছে।’ বৃদ্ধা বলল।

‘একটু যদি ব্যাখ্যা করে বলেন!’ সবিনয়ে বলল সাবইন্সপেক্টর।

‘এর আবার ব্যাখ্যা করার কী আছে? এ্যাঁ! এই তল্লাটে যাকে জিজ্ঞাসা করবে সে একই জবাব দেবে। লোকে ভাত ডাল খায় কিন্তু ভাত ডাল চাউল কি খায়? শুনেছ কখনো?’ বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করল।

‘আজ্ঞে না।’

 

‘‘দিন দশেক আগে পশ্চিমপাড়ার কাপড়ের দোকানদার হরকুমার রায় রাত সাড়ে দশটার ট্রেন থেকে ব্যাগ হাতে নিয়ে নেমেছিল। সে সদরে গিয়েছিল আড়তদারের সঙ্গে বসে হিসাব সারতে।  ফেরার পথে গোটা কয়েক নতুন শাড়ি কিনে এনেছিল যদি খদ্দেরদের পছন্দ হয় তাহলে মোটা অর্ডার দেবে।
এই ট্রেনে বেশি যাত্রী ছিল না। হরকুমার একাই ব্যাগ হাতে নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এক ঘণ্টা পরে কেউ একজন সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে জানিয়ে গেল বটগাছের নিচে যার ডেডবডি পড়ে আছে তাকে দেখতে অনেকটা হরকুমারের মতো। কে বা কারা অত রাতে নির্জন রাস্তায় হরকুমারকে পেয়ে খুন করে গিয়েছে...  ’’

 

‘শোননি?’ কেউ কেউ মদ খায়, কিন্তু মদও যে কাউকে কাউকে খায়, খেয়ে থাকতে পারে তাও কি শোননি?

‘আজব, এটা যেন একটু অবিট!’ সাবইন্সপেক্টর ক্ষেপে গেল।

‘এই বাড়িতে যে থাকত তার পুরোটাই মদ খেয়ে ফেলেছিল। রোজ দুপুরে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যেত আর মাঝরাতে ফিরে আসত টলতে টলতে। দুই রাত আগে যেটুকু বাকি ছিল সেটুকু ফুরিয়ে যাওয়ায় স্টেশনের রাস্তায় কেউ ওকে মেরে ফেলে গিয়েছিল।’ বৃদ্ধা বলল।

সাবইন্সপেক্টর মাথা নেড়ে একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, এই বাড়িতে ওর সঙ্গে আর কে কে থাকেন?’

‘কেউ থাকে না। থাকবে কী করে? ওরকম মদোমাতালের সঙ্গে কোনো মানুষ থাকতে পারে না। ওর বউ বাচ্চাকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে গিয়েছে। যা জমি ছিল তাই বিক্রি করে চাল কিনে খেতো। মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। সেই টাকা ফুরিয়ে গেলে না খেয়ে মরত। মদ খেয়ে কি বেঁচে থাকা যায়!’

‘ওর বউ কোথায় থাকে এখন?’

‘অতশত জানি না আমি। আচ্ছা, চলি আমি।’ বৃদ্ধা চলে গেল। সাবইন্সপেক্টর লক্ষ্য করল বৃদ্ধা চলে যাওয়া মাত্র দূরে দাঁড়িয়ে কথা শোনা জনতা খুব দ্রুত চোখের আড়ালে চলে গেল।

অর্থাৎ এখন পর্যন্ত তদন্তে কিছুই পাওয়া গেল না। শুধু ওই লোকটি যে বিবাহিত এবং এক সন্তানের বাবা ছিল এটুকুই জানা গেছে এই রিপোর্ট লিখলে প্রমোশন পাওয়া যায় না। সামনে বাড়ল সে আরও খুঁজে দেখতে। রাত দশটার অনেক আগে সাবইন্সপেক্টর স্টেশনের শেষ প্রান্তের একপাশে পেছনে দাঁড়িয়েছিল। আজ সে কয়েকজন সেপাইকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে কিন্তু তাদের সে খানিকটা দূরে রেখেছে। দূর থেকে তারা লক্ষ্য রাখছে। বিপদ কখন দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। নির্জন রাতের ট্রেন যথা প্ল্যাটফরমে এসে দাঁড়াল। তখন মাত্র একজন যাত্রী শেষ কামরা থেকে নেমে এলো, এসে চারপাশে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর পকেট থেকে বিড়ির বাক্স বের করে একটা বিড়ি নিয়ে তাতে আগুন ধরাল। ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘যেমন কর্ম তেমন ফল।’

সাবইন্সপেক্টর বুঝতে পারছিল না এই লোকটাকে সে আগে দেখেছে কি না। ততক্ষণ বিড়ি টানতে টানতে প্ল্যাটফরমের প্রান্তে এসে বাইরের অন্ধকারে যেন কিছু দেখার চেষ্ট করল। কিন্তু বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল না।

সাবইন্সপেক্টর এগিয়ে গেল তার কাছে। বলল, ‘একদম ঠিক কথা।’

মুখ ফিরিয়ে তাকাল লোকটা কিন্তু কোনো ভাবান্তর হলো না, ‘আমি সব সময় ঠিক কথাই বলি। আপনি কে? এই ট্রেনে এসেছেন?’

নীরবে মাথা নাড়ল সাবইন্সপেক্টর, মুখে কিছু বলল না। তাতে তার মনে হলো মিথ্যা কথা বলা হলো না।

‘যান, চলে যান। এখানে দাঁড়িয়ে কেন?’

‘আপনি কি রোজ স্টেশনে আসেন?’

‘আলবৎ আসি। স্টেশনের এই অঞ্চলটা রাত দশটার পর আমি ছাড়া আর কারও অর্ডারে চলে না। কিন্তু তাতে আপনার কী দরকার ভাই?’

‘দুই দিন আগে একজন প্যাসেঞ্জার এখানে ট্রেন থেকে নেমে ওই রাস্তা দিয়ে বাইরে গিয়েছিল। দুঃখের কথা, যদি না বের হতেন তাহলে উনি বেঁচে থাকতেন। ওই রাস্তায় কেউ বা কারা ওকে খুন করে যায়।’ সাবইন্সপেক্টর জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি নিশ্চয়ই ব্যাপারটা শুনেছেন। যিনি খুন হয়েছেন তিনি তো এইখান দিয়ে বাইরে বেরিয়ে ছিলেন।’

‘আপনি পাগল না শিশু?’

‘এ্যাঁ!’ অবাক হলো সাবইন্সপেক্টর।

‘দুদিন আগের খুনের ব্যাপারটা বললেন, তার আগে যে কদিনের মধ্যে আরও দুজন খুন হয়েছিল তাদের কথা শোনেননি?’

সাবইন্সপেক্টর এবার উৎসাহী হলেন, এই লোকটা যখন এত খবর জানে তাহলে ওর কাছ থেকে নতুন তথ্য পাওয়া যেতে পারে। সে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনেছি। কিন্তু তাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যায়নি।’

‘জানা যাবে কী করে। নিশ্চয়ই ভালো লোক ছিল ওরা।’

‘ঠিক বুঝলাম না।’

‘খাবার যতক্ষণ টাটকা থাকে ততক্ষণ কোনো বদগন্ধ পান? পান্তা বাসি হয়ে পচে গেলে দুর্গন্ধ ছড়ায়। ওই লোক দুটোর বডি পাওয়ার পর একদিন কেটে গেলেও তার খবর পাওয়া যায়নি। তার মানে লোকটা ভালো ছিল।’

‘আর ইনি, দুই দিন আগে যিনি খুন হয়েছেন?’

‘হাড়ে হাড়ে বজ্জাত হইলে ঘরের বউ ঘর ছেড়ে চলে যায়!’

‘তিনি এখন কোথায় আছেন তা কি জানেন?’

‘কেন জানব না! আমাকে চাচা বলে ডাকত। কত কান্নাকাটি করেছে কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি। আমি তো বাইরের লোক।’

‘তার সঙ্গে দেখা করা যাবে?’

‘আমি কি তার গার্জেন যে অনুমতি দেব? কোথায় থাকে বলে দিচ্ছি, গিয়ে দেখা কর। আমাকে আর বিরক্ত করো না। আমি এখন সাধনায় বসব।’ লোকটি দ্রুত বেশ কয়েক পা সরে যেখানে জোরালো আলো দিচ্ছিল না সেখানে পৌঁছে প্ল্যাটফরমের প্রান্তের নিচু দেয়ালের ওপর বসে পড়ল বাবু হয়ে। প্রথমে দুটি হাত এক করে কপালে ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলতে বলতে নমস্কার জানাল। তারপর কাঁধের বোঝা থেকে একটা বোতল বের করে ভক্তিভরে রাখল। এবার দ্বিতীয় পকেট থেকে একটা ঠোঙা বের করে বোতলের পাশে রেখে চিৎকার করে বলল, ‘জয় বাবা ভোলানাথ!’

সাবইন্সপেক্টর কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছিল। লোকটা বোতলের ছিপি খুলে খানিকটা তরল পদার্থ মুখে ঢেলে চোখ বন্ধ করে ছিপির মুখ বন্ধ করল। তারপর চোখ খুলে ঠোঙা থেকে কিছু মুঠোয় নিয়ে মুখে পুরে পরম তৃপ্তিতে চিবুতে লাগল।

সরে এলো সাবইন্সপেক্টর। এই লোকটা এখন আর মুখ খুলবে না। বোতলের তরল পদার্থ গলায় পুরোটা না ঢালা পর্যন্ত মুখ খুলবে না ও।

সাবইন্সপেক্টর রাস্তার পাশে এসে দাঁড়াল। একেবারে সুনসান রাস্তা আধা অন্ধকারে জড়ানো। এই রাস্তায় একা একা যাওয়া মানে বিপদ ডেকে আনা। না, অযথা সমস্যা বাড়িয়ে কোনো লাভ নাই। ওপাশ থেকে একটা ট্রেন সেই সময় স্টেশনে এসে দাঁড়াল কিন্তু একজন যাত্রীও নামা ওঠা করল না।

 

পাশের গ্রামের হরিপদ রিকশাওয়ালা তার রিকশায় বসেছিল উদাস হয়ে। স্টেশনে এখন ভিড় নেই। তার যাত্রীরও অভাব। এত রোগা যে কোনো মানুষ হতে পারে তা লোকটাকে না দেখলে ভাবতে পারত না সাবইন্সপেক্টর।  তার পরনে যেহেতু ইউনিফর্ম নেই তাই তাকে পুলিশ বলে চিনতে পারছে না কেউ। রিকশার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ভাই, মন খারাপ?’

 

পরের সকালে সাবইন্সপেক্টর হাজির হলো লোকটির শ্বশুরবাড়িতে। শ্বশুরের অবস্থা আদৌ ভালো নয়। কিন্তু তিনি বাড়িতে ছিলেন না বলে লোকটির স্ত্রীর দেখা পাওয়া গেল। কথা বলার আগেই লোকটির স্ত্রী ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘কেন এসেছেন আমার কাছে? এতদিন যখন লোকটা আমার ওপর অত্যাচার করছিল তখন তো দেখতে আসেননি।’

‘এই অত্যাচারের ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না। কিন্তু-!’

‘শুনুন, যার জন্যে এসেছেন সে তিন দিন আগে নয়, অনেককাল আগেই আমার কাছে মরে গিয়েছিল। সিঁদুর পরার অভ্যাস, আমি নিজেকে বিধবা বলে ভাবি। আর এখন সে খুন হয়েছে জানার পর নতুন করে কী বিধবা হব?’

‘আপনি ওর মৃত্যুর খবর কখন পেলেন?’

‘পাব মানে? চারপাশে কাক, শকুনের তো অভাব নেই। দরজা ঠুকরে খবর দিয়ে গেল। যে অনেক দিন আগে মরে গিয়েছে তার জন্যে কি চোখে জল থাকে? তা আপনি কী চাইতে এসেছেন?’

‘উনি কেন মদে ডুবে থাকতেন?’

‘সেটা ওকেই জিজ্ঞাসা করতে পারেন। এক কাজ করুন, পাশের গ্রামে গিয়ে হরিপদ রিকশাওয়ালার খোঁজ নিন, কিছু খবর পেলেও পেতে পারেন।’

বউ দরজা বন্ধ করল।

পাশের গ্রামের হরিপদ রিকশাওয়ালা তার রিকশায় বসেছিল উদাস হয়ে। স্টেশনে এখন ভিড় নেই। তার যাত্রীরও অভাব। এত রোগা যে কোনো মানুষ হতে পারে তা লোকটাকে না দেখলে ভাবতে পারত না সাবইন্সপেক্টর। তার পরনে যেহেতু ইউনিফরম নেই তাই তাকে পুলিশ বলে চিনতে পারছে না কেউ। রিকশার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ভাই, মন খারাপ?’

লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়াল, ‘কেন? মন খারাপ হবে কেন?’

খবরটা কানে এলে মন তো খারাপ হবেই। আপনার বন্ধু ছিল সে!

‘আরে কি মুশকিল। আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’

এবার সরাসরি প্রশ্ন করল সাবইন্সপেক্টর, ‘তিন দিন আগে পাশের শহরের রাস্তায় রাতের বেলায় যে লোকটি খুন হয়েছিলেন তিনি তো আপনার বন্ধু ছিলেন।’

‘ও! কিন্তু সে আমার বন্ধু ছিল কে বলল? একদম না। হ্যাঁ, আমি তাকে খুব চিনতাম। একেবারে হাড়ে হাড়ে চেনা যাকে বলে।’ রিকশাওয়ালা বলল।

‘সে কি! আপনি ওকে অপছন্দ করতেন?’

‘কিছুই করতাম না। তা এসব কথা অযথা বলছেন কেন?’

‘যে মানুষটা খুন হয়ে গেল সে আপনার বন্ধু মানুষ ছিল-!’

‘এ্যাঁই!’ চেঁচিয়ে উঠল রিকশাওয়ালা, ‘আমার বন্ধু ছিল তা আপনাকে কে বলল?’

‘তা হলে?’

‘আমি অত্যন্ত অপছন্দ করতাম। ভাগ্যিস অন্য লোক ওকে খুন করে গেল নইলে একদিন আমিই ওকে খুন করতাম।’ হরিপদ রিকশাওয়ালা বলল।

‘আপনি খুন করতে পারেন? এর আগে কখনো খুন করেছেন?’

যেন হকচকিয়ে গেল লোকটা, ‘না না। ওটা কথার কথা। যখন এই স্টেশনে নেমে আমার সঙ্গে দাঁত বের করে কথা বলতে লাগত তখন আমি ওকে সহ্য করতে পারতাম না। মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা মানুষের একটুও ভালো থাকবে না!’

‘ওর খারাপ ব্যাপারগুলো একটু যদি বলেন!’

‘কী আর বলব। প্রত্যেক হপ্তায় এখানে আসত। একজন বিধবাকে বিয়ে করবে বলে একসঙ্গে দুই দিন থাকত। সেই মহিলার চাকরির টাকায় সংসার চলত। মহিলা বিয়ের জন্যে চাপ দিলে এখানে আসা বন্ধ করেছিল। তখন পাশের শহরে যেত।’

‘পাশের শহরে!’

‘ওখানে আমার বন্ধু জগদীশ রিকশা চালায়, ওকে জিজ্ঞাসা করলে সব জানতে পারবেন। আমার কাছ থেকে ৫০ টাকা ধার নিয়েছিল। শোধ না করে চলে গেল।’ একজন খদ্দের পেয়ে রিকশাওয়ালা তাকে বসিয়ে চলে গেল। হাতে প্রচুর সময় আছে। লোকটা সম্পর্কে জানা গেল নতুন তথ্য। নিজের বিয়ে করা বউ ছাড়াও এই শহরে আর একজনকে বউয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। মদের নেশা ছাড়া মহিলার ব্যাপারে-! সাবইন্সপেক্টর মাথা নাড়েন। তারপর স্টেশনে ঢুকে ট্রেনে উঠল।

পরের স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশাওয়ালা একজনকে জিজ্ঞাসা করে জগদীশ রিকশাওয়ালাকে খুঁজে বের করল সে। সদ্য একজনকে রিকশায় চাপিয়ে নিয়ে এসে তার কাছ থেকে ভাড়ার টাকা নিচ্ছিল জগদীশ রিকশাওয়ালা। তার ভাড়া নেওয়া হয়ে গেলে সাবইন্সপেক্টর কাছে চলে গেল। ‘নমস্কার ভাই, আপনি তো জগদীশ বাবু?’

ভাড়ার টাকা পকেটে পুরে জগদীশ বলল, ‘আপনি কে? আমার নাম জানলেন কী করে।’

সাবইন্সপেক্টর হাসল। ‘আপনার নাম তো এলাকার সবাই জানে।’

‘ও! কী বলতে চাইছেন তা বলুন।’

‘তিন দিন আগে অনেক রাতে ট্রেন থেকে নেমে বাড়িতে ফেরার পথে আপনার বন্ধু খুন হয়ে গিয়েছেন। এ খবর নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে। আপনি তো ওকে দীর্ঘদিন ধরে চেনেন। নিশ্চয়ই জানেন কে ওকে খুন করেছে।’ সাবইন্সপেক্টর জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আমি কী করে জানব? আমি থাকি এই শহরে আর যে খুন হয়েছে বহু দূরের শহরে। তবে এমনি এমনি কেউ কাউকে খুন করে না নিশ্চয়ই!’ জগদীশ বলল।

‘ওকে খুন করার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে!’

‘থাকতে পারে! আমি কী করে বলব?’

‘আপনার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল?’

‘দূর! আমি ওর সঙ্গে কথা বলতাম না। বাজে লোক।’

‘বাজে লোক বলছেন কেন?’

‘এত প্রশ্ন করছেন যখন তখন বলি। একটা লোক যদি নিজের পয়সায় মদ খায় তাহলে সে খেতেই পারে। কিন্তু মদ খাওয়ার জন্যে টাকা ধার নিয়ে শোধ করা ওর স্বভাব ছিল না। বাপ ওর বিয়ে দিয়ে যে মেয়েকে ঘরের বউ করে এনেছিল তাকে উপেক্ষা করে এখানে এক বিধবাকে সিঁদুর পরিয়েছে কিন্তু দায়িত্ব নেয়নি। আমার দেড়শ টাকা মেরে দিয়েছে লোকটা। খুন হয়ে গেছে শোনার পর টাকাটা জলে চলে গিয়েছে।’ বলতে বলতে এগিয়ে আসা একজন প্যাসেঞ্জারের দিকে হাত তুলে ইশারা করল জগদীশ রিকশাওয়ালা। প্যাসেঞ্জার আসামাত্র তাকে রিকশায় তুলে দুই প্যাডেলে চাপ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

 

থানায় ফিরে আসামাত্র বড়বাবুর ঘরে ডাক পড়ল। বড়বাবু পেটের রুগী, সব সময় মুখ বিকৃত করে থাকেন। বললেন, ‘খুনি কোথায়?’

‘আজ্ঞে, আজ পাইনি।’ সাবইন্সপেক্টর বলল।

‘কবে পাবে?’

‘খুব চেষ্টা করছি স্যার।’

‘কালকের মধ্যে না পেলে-!’ বলতে বলতে প্রায় দৌড়ে পাশের বাথরুমে ঢুকে গেলেন তিনি। এখন অন্তত পনের মিনিট ওখানেই থাকবেন। তাড়াতাড়ি বাইরে চলে এলো সাবইন্সপেক্টর।

সেই রাতে দশটায় ট্রেন চলে গেলে প্ল্যাটফরম যথারীতি ফাঁকা হয়ে গেল। প্ল্যাটফরমের শেষ প্রান্তে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল সাবইন্সপেক্টর। তার কেবলই মনে হচ্ছিল, আজ রাতে এই রাস্তায় চতুর্থ খুনটি হবে। রাত বাড়ছে প্যাঁচারাও আওয়াজ করছে না। সাবইন্সপেক্টর রাস্তায় যখন সতর্ক হয়ে হাঁটতে লাগল হঠাৎ তার ভয় এলো এইভাবে একা খুনি ধরতে আসা ঠিক হয়নি।

পরের সকালে পুলিশ ওই রাস্তায় চতুর্থ মৃতদেহকে পড়ে থাকতে দেখল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর