রবিবার, ২৫ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিশ্বের দীর্ঘতম যত সেতু

আবদুল কাদের

বিশ্বের দীর্ঘতম যত সেতু

বিশ্বজুড়ে এমন অসাধারণ সেতু রয়েছে; যা স্থাপত্যশৈলীতে অনন্য। সেতুগুলো প্রকৌশলীদের মহান কৃতিত্বের প্রতীক, যা সাধারণের জীবনকে করেছে সহজ। নির্মাণকৌশলে এগুলোর একেকটি ছাড়িয়ে গেছে অন্যটিকে। দৃষ্টিনন্দন সেতুগুলো বিস্মিত করে সবাইকে। দীর্ঘতম এই সেতুগুলো নিয়েও সাধারণে আগ্রহের কমতি নেই। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্র চীনেও দীর্ঘতম সেতুর সংখ্যা কম নয়। আছে যুক্তরাষ্ট্র এবং থাইল্যান্ডেও। প্রমত্ত পদ্মার বুকে নির্মিত পদ্মা সেতুও রয়েছে এ তালিকায়। বিশ্বের দীর্ঘতম কয়েকটি সেতু নিয়ে আজকের রকমারি...

 

বছর পেরিয়ে গর্বের পদ্মা সেতু

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগের গল্পে ভালোভাবে জড়িয়ে পদ্মা সেতু। যা আজকের বাংলাদেশের মানুষের গর্বের প্রতীক। গেল বছরের এই দিনে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়েছিল প্রমত্তা পদ্মার ওপর নির্মিত এই সেতু। যার নির্মাণশৈলী বা কৌশল পেয়েছে বিশ্ব স্বীকৃতি। রাজধানী ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত পদ্মা সেতু। যা দেশের সবচেয়ে বড় সেতু। মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলাকে এক করেছে প্রমত্ত পদ্মা। এর উত্তর প্রান্তে মাওয়া, লৌহজং, মুন্সীগঞ্জ এবং দক্ষিণ প্রান্তে জাজিরা, শরীয়তপুর, শিবচর ও মাদারীপুর। এর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার, প্রস্থ ৭২ ফুট। এতে আছে চার লেনের সড়ক। মাঝখানে রোড ডিভাইডার। সেতুর ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ১৮ কিলোমিটার এবং ভায়াডাক্ট পিলার রয়েছে ৮১টি। মোট পিলার ৪২টি, আর মোট পাইলিং ২৮৬টি। পানির স্তর থেকে ৬০ ফুট উচ্চতার সেতুটি নির্মাণে কাজ করেছে প্রায় ৪ হাজার মানুষ। তবে নানা প্রতিবন্ধকতায় ঠাসা ছিল স্বপ্নের সেতুর প্রারম্ভিক যাত্রা। ১৯৯৮-১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সর্বপ্রথম পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এরপর ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই, ২০০৪ সালে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সুপারিশ মেনে মাওয়া-জাজিরার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়ন, ২০০৯ সালে সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক নিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন এবং নকশা প্রণয়নে পরামর্শক নিয়োগ দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১০ সালে পরামর্শক সেতুর প্রাথমিক নকশা সম্পন্ন করে। ২০০৭ সালে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প অনুমোদন পায়। পরে নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয়ও বাড়ে। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণসহায়তার অনুমোদন দেয়। একই প্রকল্পে ২০১১ সালে যথাক্রমে জাইকা ও আইডিবি এবং এডিবির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঋণচুক্তি সই হয়। সবশেষ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। যার পুরো অর্থই ছিল সরকারি অর্থায়ন। নির্মীয়মাণ এই সেতু নিয়ে দেশ-বিদেশে জল ঘোলা কম হয়নি। তবুও লক্ষ্যে স্থির, বিপদে অবিচল থাকলে পাহাড়সম বাধাও যে ডিঙানো যায়, তার বড় নজির স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

 

ড্যানইয়াং-কুনশান গ্র্যান্ড ব্রিজ

লাখ ৬৪ হাজার ৮০০ মিটার

প্রায় ১৬০.৪ কিলোমিটার (১০২.৪ মাইল) সেতুটি পৃথিবীর দীর্ঘতম সেতু। এটি একটি রেল ফ্লাইওভার, যা সাধারণত চীনের রাজধানী বেইজিং থেকে সাংহাইয়ের হাইস্পিড রেলওয়ের একটি অংশ। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০৬ সালে। শেষ হয় ২০১০ সালে। ২০১১ সালে এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তখন থেকে সেতুটি বিশ্বের দীর্ঘতম সেতুর রেকর্ড ধরে রেখেছে। বিশ্বের চারটি রেলওয়ে সেতুর মধ্যে এটি অন্যতম, যা গিনেস ওয়ার্ল্ড বুকে বিশ্বের দীর্ঘতম সেতুর তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। সেতুটি নির্মাণে ৮.৫ বিলিয়ন থেকে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়েছে।

বিস্ময়কর তথ্য : দীর্ঘতম ড্যানইয়াং-কুনশান সেতুটি মূলত ধানি জমি, খাল, নদী এবং হৃদের ওপর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। সেতুটি সেসব অঞ্চলের ওপর দিয়ে নির্মিত হয়েছে, যা ভ্রমণকারীদের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগে সাহায্য করে। এটি মূলত একটি রেলওয়ে সেতু হিসেবে তৈরি, যা স্থানীয়দের কাছে আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

 

চাংহুয়া-কোয়াশিউং ব্রিজ

লাখ ৫৭ হাজার ৩১৭ মিটার

তাইওয়ানের দীর্ঘতম সেতুটি পৃথিবীর দীর্ঘতম রেলওয়ে ফ্লাইভার। যা তাইওয়ান হাইস্পিড রেলওয়ে নেটওয়ার্কের একটি অংশ। দীর্ঘতম এই সেতুটি মূলত তাইওয়ানের হাইস্পিড রেল পরিসেবায় নিয়োজিত। সড়কপথের পাশাপাশি তাইওয়ানের দ্রুতগতির রেলপথ এই সেতুর সঙ্গে সংযুক্ত। এর দৈর্ঘ্য ১৫৭.৩১ কিলোমিটার (৯৭.৭ মাইল) এলাকাজুড়ে বিস্তৃত, যা ২০০৭ সালে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। আন্তর্জাতিক এক জরিপে উঠে এসেছে, ২০১২ সাল নাগাদ ২০০ মিলিয়ন মানুষ পারাপারের জন্য চাংহুয়া-কোয়াশিউং সেতুটি ব্যবহার করেছে। ভূমিকম্পের সময়ও যেন ট্রেন সাবধানে যাতায়াত করতে পারে, সে লক্ষ্য সেতুর নকশা করা হয়েছে।

বিস্ময়কর তথ্য : সেতুটি বিশ্বের ভূমিকম্প প্রতিরোধী সেতুগুলোর একটি, যা ভূমিকম্পের সময় ট্রেনগুলোকে নিরাপদে থামতে সহায়তা করবে। এর নকশা এমনভাবে করা যে, ভূমিকম্পের কারণে সেতুর ক্ষতি হলেও তা যেন খুব দ্রুত মেরামত করা সম্ভব।

 

তিয়ানজিন গ্র্যান্ড ব্রিজ

লাখ ১৩ হাজার ৭০০ মিটার

১ লাখ ১৩ হাজার ৭০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুটি (৭০ মাইলেরও বেশি) পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘতম সেতু। দীর্ঘতম সেতুর তালিকায় যার অবস্থান তৃতীয়। ভৌগোলিকভাবে এটি চীনের হুবেই প্রদেশের তিয়ানজিন শহরের কাছাকাছি। এটিও বেইজিং-সাংহাই হাইস্পিড রেলওয়ে সেতু। যা ল্যাংফাং থেকে কিংজিয়ানকে একত্রিত করেছে। দীর্ঘ চার বছর হাজার হাজার শ্রমিকের প্রচেষ্টায় এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১০ সালে। ২০১১ সালে দীর্ঘতম সেতু হিসেবে এটি গিনেস ওয়ার্ল্ড বুক রেকর্ডে জায়গা করে নেয়।

বিস্ময়কর তথ্য : এটি তালিকার সুন্দর সেতু না হলেও এর গঠন অনন্য। এটি বক্স গার্ডারের মাধ্যমে নির্মিত, যার প্রতিটি ১০০ ফুটেরও বেশি লম্বা এবং প্রতিটির ওজন প্রায় ৮৬০ টন। এই গার্ডারগুলোকে সেতুর মূল রুটে বসানোর জন্য বিশেষ ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছিল।

 

ক্যান্ডি গ্র্যান্ড ব্রিজ

লাখ ১৫ হাজার ৯০০ মিটার

দীর্ঘতম সেতুটি দানিয়ান-কুনশানের মতো বেইজিং সাংহাই হাইস্পিড রেলওয়ের একটি অংশ। যার অবস্থান চীনের রাজধানী শহর বেইজিংয়ে। সেতুটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০৫.৮১ কিলোমিটার (১ লাখ ১৫ হাজার ৯০০ মিটার)। এটি চীনে অবস্থিত সেতুটি বেইজিং ও সাংহাইকে সংযুক্ত করেছে। ভূমিকম্পে অটলভাবে দাঁড়িয়ে থাকার সক্ষমতার লক্ষ্য নিয়ে সেতুটি নির্মাণ করা হয়, যা শেষ হয় ২০১০ সালে। তখনকার সময়ে এটিই ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ রেলসেতু। ৬৬ মাইল দৈর্ঘ্যরে এই দীর্ঘতম সেতুটিতে মোট ৩০৯২টি জেটি বা পিলারের পর নির্মিত হয়েছে।

বিস্ময়কর তথ্য : চীনের দীর্ঘতম রেললাইনের এই সেতুটি হংকং, ম্যাকাও এবং চীনের মূল ভূখণ্ডজুড়ে যাত্রীদের ভ্রমণের ৩ ঘণ্টারও বেশি সময়কে নামিয়ে নিয়ে এসেছে মাত্র ৩০ মিনিটে।

 

ইউনান ইউহে গ্র্যান্ড ব্রিজ

৭৯ হাজার ৭৩২ মিটার

চীনের আরেকটি দীর্ঘতম রেলওয়ে সেতু; যা পৃথিবীর পঞ্চম দীর্ঘতম সেতু। ৭৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি জাংঝো-জিয়ান হাইস্পিড রেলওয়ের একটি অংশ। এর দৈর্ঘ্য ৫০ মাইল। তবে সেতুটি বিশ্বের অন্যতম অস্বাভাবিক সেতু, কারণ- এটি লিং, লুওফু, শি এবং শি ডিসহ আরও কয়েকটি নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওয়েই নদী অতিক্রম করেছে। ২০০৮ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং ২০১০ সালে জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এক সময় এটি ছিল পৃথিবীর দীর্ঘতম সেতু।

বিস্ময়কর তথ্য : ইউনান ইউহে গ্র্যান্ড ব্রিজটি বৈশ্বিক প্রকৌশল শিল্পের আরেকটি বড় কীর্তি। এর নির্মাণে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক জড়িত ছিলেন। এর নির্মাণ সম্পন্ন করতে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন ঘনমিটার কংক্রিট এবং ৪৫ হাজার টনের বেশি ইস্পাত প্রয়োজন হয়েছিল।

 

ব্যাং না এক্সপ্রেসওয়ে

৫৪ হাজার মিটার

৩৪ মাইল (৫৪ হাজার মিটার) দীর্ঘ সেতুটি থাইল্যান্ডের দীর্ঘতম সেতু। একে বুরাফি ওয়েট এক্সপ্রেসওয়ে বলা হয়ে থাকে। ৫৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়েটিতে মোট ছয়টি লেন রয়েছে। সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে ২০০০ সালে। মাত্র চার বছর অর্থাৎ ২০০৪ সাল পর্যন্ত সেতুটি বিশ্বের দীর্ঘতম সেতুর তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করেছিল। তালিকায় সেতুর মধ্যে এটি একমাত্র সেতু, যা খুবই কম নদীপথের ওপর নির্মিত হয়েছে। এটি শুধু অল্প দূরত্বের জন্য ব্যাং পাকং নদী অতিক্রম করে।

বিস্ময়কর তথ্য : প্রয়োজন পূরণের জন্য নির্মিত সেতুটি নির্মাণে ১৮ লাখ কিউবিক মিটার কংক্রিট লেগেছিল। তবে দীর্ঘতম এই হাইওয়ে-ওভার হাইওয়ে নকশায় রয়েছে বৈচিত্র্যতা, যা একে করেছে অনন্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর