বৃহস্পতিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

তাজমহল কাহিনি

আবদুল কাদের

তাজমহল কাহিনি

যমুনার পানিতে ভাসছে আগ্রার তাজমহল

৪৫ বছরে এই প্রথম। যমুনা নদীর পানি পৌঁছে গেছে আগ্রার তাজমহলের গোড়ায়। পানি থই থই তাজমহল চত্বর। ভাসছে এই জগদ্বিখ্যাত সৌধের সামনের অংশ।

বন্যায় বিপর্যস্ত ভারতের রাজধানী। আকস্মিক বন্যার পানি রাজধানী শহর দিল্লি পেরিয়ে প্রবেশ করল আগ্রাতেও। বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে এমনটা কখনো হয়নি। যমুনা নদীর পানি এতটাই ফুঁসে উঠেছে যে, তাজমহলের পিছন দিকের বাগান সম্পূর্ণ ডুবে  গেছে। কেবলমাত্র তাজমহল নয়, ভেসে গেছে ঐতিহাসিক লালকেল্লা ও দশেরা ঘাটও। এ ছাড়াও ইদমাত-উদ-দউলার সমাধিস্থলও পানিতে ভাসছে। দিল্লির বেশির ভাগ রাস্তাই যেন পরিণত হয়েছে নদীতে। যমুনার পানিতে ভাসছে ওলিগলি।

ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পানি থই থই করছে তাজমহল চত্বরে। বন্যার পানিতে ভাসছে বিশ্বের এই অষ্টম আশ্চর্যের সামনের অংশ। যে কোনো মুহূর্তে যমুনার বন্যার পানি ঢুকে নষ্ট করতে পারে ভালোবাসার ঐতিহাসিক এই স্থাপনা। ইতোমধ্যে ভাসমান তাজমহলের ছবি হইচই ফেলে দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বলা হচ্ছে, শেষবার ১৯৭৮ সালে নদীর পানি ঢুকেছিল তাজমহল চত্বরে। প্রবল বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে দিল্লির বিভিন্ন এলাকা। যমুনার পানিতে ডুবে গিয়েছিল লালকেল্লার আশপাশ। প্লাবিত হয়েছিল দিল্লির সবচেয়ে বড় শ্মশান নিগমবোধ ঘাটও। এবার সেই যমুনার পানি ঢুকে পড়েছে তাজমহল চত্বরে। ১৯৭৮ সালের বন্যাতেও তাজমহলে পেছনের দেওয়াল পর্যন্ত পানির স্তর উঠেছিল। তারপর পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পেছনের দিকে বড় ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীকালে তা বাগানে রূপ দেওয়া হয়।

সাধারণত ৪৯৫ ফুট থাকে যমুনার পানি। কিন্তু তা বেড়ে ৪৯৭ দশমিক ৯ ফুট পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ায়, তাজমহল চত্বর জলমগ্ন। দিল্লির পাশাপাশি এবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আগ্রা ও মথুরাও। ৫০টি গ্রাম থেকে, ২০টি শহরাঞ্চল থেকে সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। মথুরায় যমুনা নদীর পানির স্তর সাধারণত থাকে ১৬৬ মিটার। যা পেরিয়ে যমুনার পানি পৌঁছে গেছে ১৬৭.২৮ মিটারে।

এদিকে তাজমহল চত্বর পানিতে ভেসে যাওয়ার চিন্তায় পড়েছেন ইতিহাসবিদরা। ইতোমধ্যে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছেন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রতিনিধিরা। তারা জানান, এখনো পর্যন্ত দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। এখনো তাজমহলের বেসমেন্ট পর্যন্ত পানি প্রবেশ করেনি। তবে যমুনার বাড়তে থাকা পানির স্তরের দিকে নজর রাখছেন তারা।

 

যে প্রেম গড়েছিল তাজমহল...

ইতিহাস কাঁপিয়ে দেওয়া প্রেমকাহিনি অনেক আছে। কিন্তু এমন প্রেমকাহিনি খুব কমই আছে যার সাক্ষী এখনো পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে। প্রিয় স্ত্রী মমতাজের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তাজমহল বানিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। আগ্রার সেই তাজমহল আজও ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় দ্রষ্টব্য স্থান। কথিত আছে, শ্বেতপাথরের তৈরি ওই তাজমহল বানানোর পরে নাকি রাজমিস্ত্রিদের হাত কেটে নিয়েছিলেন মোগল সম্রাট শাহজাহান। যাতে আর কোথাও দ্বিতীয় কোনো তাজমহল তৈরি না হতে পারে। সম্রাট শাহজাহানের অমর সৃষ্টি তাজমহলের কথা যদি ধরা হয়, তাহলে এমন নিদর্শন পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না।

এ অনন্য কীর্তির পেছনে ছিল একটি প্রেমের গল্প। শাহজাহান তখনো শাহজাহান হয়ে ওঠেননি। শাহজাদা খুররম হিসেবেই সবাই তাকে চেনে। বয়স মোটে ১৫। আগ্রার বাজার দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎই তার চোখে পড়ে এক পরমা সুন্দরীকে। শুধু চোখে পড়ে বললে ভুল হবে, তাকে মনে ধরে যায় খুররমের। মেয়েটির নাম আরজুমান্দ বানু বেগম। বয়স ১৫। পরে তাদের দুজনের বিয়ে হয়। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে এই বিয়ের আগেই পারস্যের রাজকন্যাকে বিয়ে করেন শাহজাহান। তখনো আরজুমান্দকে ঘরে তোলেননি শাহজাহান। পরে শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে ঘরে আসেন আরজুমান্দ। এই আরজুমান্দ বানুই হলেন শাহজাহানের মমতাজ। তিনি ছিলেন শাহজাহানের সবচেয়ে প্রিয়। উনিশ বছরের বিবাহিত জীবনে মমতাজের মোট ১৩ জন সন্তান হয়। চতুর্দশ সন্তানের জন্মের সময় মমতাজের মৃত্যু হয় আগ্রা থেকে বহু দূরে, বাহরামপুরে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সাত দিন সাত রাত শাহজাহান কিছু খাননি। ঘর থেকেও বের হননি। সাত দিন পর শাহজাহান বাইরে বেরোলেন।

তখন তিনি এক স্মৃতিসৌধ বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, যা বিশ্বের কাছে এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে। সেটাই আজকের তাজমহল। এই তাজমহল দেখার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন ভিড় জমান হাজারো পর্যটক। এটি ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। মজার ব্যাপার হলো- শাহজাহান ও মমতাজের প্রেমকাহিনি যতটা আলোচিত ততটাই আলোচিত যে, মমতাজ আসলে সম্রাট শাহজাহানের কততম স্ত্রী। এসব বিতর্ক চিরকাল বিতর্কই থেকে যাবে। সত্যিকার অর্থেই তিনি স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে তৈরি করেছেন এই তাজমহল।

 

এক ঝলক

♦ তাজমহল তৈরি করতে ২২ হাজার শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে শ্রমিক, রংমিস্ত্রি, সূচিকর্ম শিল্পী, পাথর কাটার শিল্পী। এটি নির্মাণে সময় লেগেছে ১৭ বছর।

♦ তাজমহল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের রং ধারণ করে। সকালে গোলাপি, বিকালে দুধ সাদা এবং রাতে সোনালি। জনশ্রুতি রয়েছে, মেয়েদের মন যেমন ক্ষণে ক্ষণে বদলায় তার ওপর নির্ভর করে তাজমহলের রং করা হয়েছে। এটি নাকি তার পরিকল্পনা ছিল।

♦ মমতাজের মৃত্যুতে সম্রাট এত বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন যে, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তার সব চুল এবং দাড়ি পেকে যায়।

♦ তাজমহলের চারদিক এমনভাবে ডিজাইন করা যে, একদিকে তাকালে অন্যদিকে আয়না দেওয়া আছে বলে মনে হয়।

 

নান্দনিক ভাস্কর্য

বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম আগ্রার তাজমহল। এর নির্মাণশৈলী আজও ভাবিয়ে তোলে আধুনিক স্থপতিদের। কারণ- তাজমহলের প্রতিটি ভাস্কর্য এবং তার নকশা একেবারে সমান মাপের। অথচ তখন সব কাজই করা হতো হাতে। এমনকি ছাঁচের ব্যবহারও ছিল না। তাও সব নকশাই সমান। এ ছাড়া তাজমহলের চারদিকে অনেকগুলো আর্চিংয়ের কাজ করা খিলান রয়েছে। যাকে বলা হয় ইয়ান। এই ইয়ানের চার পাশে পবিত্র কোরআন ও ধর্ম প্রচারের নানা বাণী খোদাই করা আছে। সাধারণভাবে আমরা কাছের জিনিস বড় দেখি আর দূরের জিনিস দেখি ছোট। কিন্তু তাজমহলের ইয়ানের একেবারে মাথার ওপরের শিলালেখ যা ছোট হওয়া সত্ত্বেও তা কিন্তু সমান আকারে নজরে পড়ে। এর কারণ- তলার হরফের তুলনায় উপরের হরফ বেশ বড়। সেগুলো এমনভাবেই ক্রমাগত নিচ থেকে উপরে বড় করা হয়েছে যে তলায় দাঁড়িয়েও সব কটি হরফ এক মাপের বলে মনে হয়। তাজমহলের সৌন্দর্যবর্ধনে অঙ্কিত শিলালিপি কিন্তু রং দিয়ে লেখা নয়। প্রথমে শ্বেতপাথরের ওপর হরফাকৃতি খোদাই করা, তারপর খোদাই করা জায়গায় সমান মাপের কালো পাথর কেটে বসিয়ে বাণী লেখা। তাজমহলের অন্তর্সজ্জাও দারুণ। পাথরের পলিশ এতই উঁচুমানের যে, এ থেকে আলো প্রতিফলিত হয়।

 

স্থাপত্যশৈলী

তাজমহল ১৮০ ফুট উঁচু যার প্রধান গম্বুজটি ২১৩ ফুট উঁচু এবং ৬০ ফুট চওড়া। চারপাশে চারটি মিনার, যার প্রতিটির উচ্চতা ১৬২.৫ ফুট। সম্পূর্ণ ভবনটির আকার ১৯০২/১০০২ ফুট। শুধু তাজমহলটি ১৮৬/১৮৬ ফুট মার্বেল পাথরের ওপর নির্মিত। এর প্রধান প্রবেশদ্বার ১৫১/১১৭ ফুট চওড়া এবং ১০০ ফুট উঁচু।

 

কী কারণে রমজান মাসে পূর্ণিমার রাতে তাজমহল দর্শন বন্ধ

মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসার অপূর্ব নিদর্শন তাজমহল। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি। প্রতি বছর সারা বিশ্ব থেকে লাখ লাখ পর্যটক আসেন এর সৌন্দর্য উপভোগে। এর মধ্যে অনেকে আবার আসেন পূর্ণিমার রাতে তাজের শোভা দেখতে। কারণ জ্যোৎস্নালোকে তাজমহলকে দেখার মজাই আলাদা। কিন্তু ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে দেখা গিয়েছিল ভিন্ন চিত্র। সেবার পবিত্র রমজানের কারণে পূর্ণিমার রাতে তাজমহল দর্শন বন্ধ রাখা হয়। নিশ্চয়ই ভাবছেন, কেন এমনটা হলো? আসলে পবিত্র রমজান মাসে মুসলিমরা তাজমহলের ভিতরের মসজিদে নামাজ পড়তে যান- যা গভীর রাত পর্যন্ত চলে। তাদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সেদিক মাথায় রেখেই কার্যত তাজমহল কর্তৃপক্ষ সেবার এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল।

সাধারণত পূর্ণিমার রাতে তাজমহলকে দেখার জন্য এক দিন আগেই আগ্রার আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (এএসআই) অফিসেই টিকিট দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু রমজানের কারণে এই মাসে রাতের তাজ দর্শনের অনুমতি বাতিল করে দেয়। তবে রমজানে পূর্ণিমার রাতে তাজের ভিতর প্রবেশ করতে না পারলেও যমুনা নদীর ওপারে ‘মেহতাব বাগ তাজ ভিউ পয়েন্ট’ থেকে দর্শকরা তাজের শোভা দেখতে পারবেন।

২০০৪ সালে তাজমহল কর্তৃপক্ষ পূর্ণিমার রাতে তাজমহল দেখানোর ব্যবস্থা শুরু করে। রাত সাড়ে ৮টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রতি ৫০ জন পর্যটকের একটি গ্রুপকে আধা ঘণ্টার জন্য পূর্ণিমার রাতে তাজমহলের শোভা দর্শনের জন্য সময় দেওয়া হয়। মূলত পূর্ণিমার রাতের আগের দুই রাত ও পরের দুই রাতের জন্যই এই টিকিট পাওয়া যায়।

 

কালো তাজমহল!

তাজমহল মানেই তো শাহজাহান-মমতাজের অমর প্রেম। তাজমহল মানেই ধবধবে সাদা শ্বেতপাথরের দারুণ সুন্দর এক স্থাপত্য, যা বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটিও বটে। কিন্তু কেমন হতো, যদি কৃষ্ণপাথরের তৈরি এক তাজমহল থাকত। তাও আবার তাজমহলের ঠিক উল্টোদিকেই। মাঝখানে বয়ে যেত যমুনা নদী। এমনই পরিকল্পনা ছিল নাকি খোদ সম্রাট শাহজাহানের!

প্রথম এই গল্পের বীজ বুনেন ফরাসি পর্যটক জ্যঁ ব্যাপটিস্ট টাভারনিয়ার। ১৬৪০ ও ১৬৫৫ সালে মুঘল রাজধানী আগ্রায় ভ্রমণ করেছিলেন টাভারনিয়ার। তার ভ্রমণ কাহিনিতে তিনি লেখেন, সম্রাট শাহজাহান যমুনার অপর পাড়ে নিজের সমাধিক্ষেত্রের নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু নিজের ছেলেদের সঙ্গে লড়াই শুরু হওয়ায় তিনি তা শেষ করতে পারেননি। স্থানীয় লোককথায় এর কিছুটা প্রমাণ মেলে। শাহজাহান নাকি যমুনার ওপর একটি সেতু বানিয়ে নদীর দুই পাড়ে নিজের ও স্ত্রীর সমাধিকে সংযুক্তও করতে চেয়েছিলেন। কালো তাজমহলের মিথ আরও ঘনীভূত হয় ১৯ শতকে এসিএল কারলেইলি নামের এক ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ যমুনার পাড়ের পুকুরে কালো মার্বেল খুঁজে পাওয়ার দাবি করার পর। পরে দেখা যায় এটি আসলে সাদা মার্বেলই ছিল। পুরনো হওয়ায় কালো হয়ে গেছে।

গবেষকদের মতে, শাহজাহান তার পূর্বপুরুষ সম্রাট বাবরের তৈরি মাহতাব বাগকে সংস্কার করে তাজমহল কমপ্লেক্সের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে স্থপতিদের অনুরোধ করেছিলেন। এটাই নাকি পরিকল্পিত দ্বিতীয় বা কালো তাজমহল নির্মাণের স্থান।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেভাবে রক্ষা পেয়েছিল

১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে ইংরেজদের অন্যতম আশঙ্কা ছিল তাজমহলের ওপর বোমাবর্ষণ করতে পারে জার্মানি ও জাপান। সেই আশঙ্কা থেকেই তাজমহলের চূড়া বাঁশ দিয়ে ঘিরে ফেলেছিল ইংরেজরা। এমনকি স্বাধীনতার পরে ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধের সময়ও এই একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে এই ব্যবস্থার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তাজমহলের চূড়া বাঁশ দিয়ে ঘিরে দিলে যুদ্ধবাজ বোমারু বিমান থেকে বহু নিচে সেই টার্গেট বাঁশের স্তূপ ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। এমনকি তৎকালীন সময়ে ছিল না জিপিএস বা স্যাটেলাইট চিত্রের সুবিধাও। ফলে রক্ষা পায় তাজমহল। শেষবারের মতো তাজমহল ঢাকা হয়েছিল ৯/১১ হামলার পরে। আমেরিকান ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হানার পরে তাজমহলের চূড়া চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া।

 

করোনাকালে তাজমহল

এবারই প্রথম নয়, আরও তিনবার পর্যটকদের আকর্ষণ তাজমহলে তালা ঝুলিয়েছে ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়। তবে ৪২ বছর পর আবারও এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। যার নেপথ্যে ছিল করোনা মহামারি (করোনা ভাইরাস)।

২০২০ সালে করোনাকালে মহা বিপর্যয় দেখেছিল বিশ্ববাসী। অজানা আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্ব। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিশ্বের নানা প্রান্তের অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন। ঘরবন্দি ছিল বিশ্বের প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ। এর প্রভাব থেকে রেহাই পায়নি মুঘল সম্রাট শাহজাহানের তাজমহলও। (২০২০ সালের ১৭ মার্চ) দীর্ঘদিনের জন্য তালা ঝুলেছিল তাজমহলের মূল ফটকে। পরবর্তীতে করোনার বিধি-নিষেধ শিথিলের পর তা চালু করা হয়।

এর আগে ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথমবার বন্ধ রাখা হয়েছিল তাজমহল। এরপর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাজমহল আবারও বন্ধ করা হয়েছিল, যাতে কোনো আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় সুরক্ষার জন্য এই স্মৃতিস্তম্ভের উপরিভাগ ঢেকে রাখা হয়। সবশেষ ১৯৭৮ সালে ভয়াবহ বন্যার সময় ভারতের ঐতিহাসিক তাজমহলের ফটকে তালা ঝুলেছিল।

 

তাজমহলের নির্মাণশৈলী

প্রাথমিক কাজেই লাগে ১৭ বছর

তাজমহল নির্মাণে রাজমিস্ত্রি, চিত্রশিল্পী, গম্বুজ নির্মাণকারী, হস্তশিল্পী, পাথরকাটার লোক ও অন্যান্য কারিগরদের আনা হয়েছিল পুরো সাম্রাজ্য এবং মধ্য এশিয়া ও ইরান থেকে। তাজমহল নির্মাণের মূল নকশা করেন ওস্তাদ আহমেদ লাহোরি। সে সময় মুঘল দালান তৈরি হতো লাল বালু, পাথর দিয়ে। তেমন কিছু নমুনা এখনো দেখতে পাওয়া যায়। যেমন হুমায়ুনের স্মৃতিসৌধ, জুমা মসজিদ, তৈমুরের স্মৃতিসৌধ। ১৬৪৮ সালে এই স্মৃতিসৌধের প্রাথমিক নির্মাণ কাজ শেষ হয়। সে হিসাবে প্রাথমিক কাজেই লাগে ১৭ বছর। নির্মাণ কাজ শেষ হলেও এর সৌন্দর্যবর্ধন চলতে থাকে। আশপাশের কয়েকটি কাজুবাগান, তিন দিকের তিনটি প্রবেশদ্বার পুরোপুরি শেষ হতে আরও পাঁচ বছর সময় লাগে। তাজমহলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের দেখা মিললেও এই সৌধ নির্মাণে বিভিন্ন ধর্মের স্থাপত্যের ছোঁয়া দেখা যায়। যেমন- তাজের মাথার ত্রিশূলটি হিন্দুদের শিবমন্দিরের অনুকরণে, মুসলমানদের মসজিদের মতো করা হয় তাজমহলের চারটি মিনার ও মাথার গম্বুজ। এটি নির্মাণে শাহজাহান প্রথম শ্বেতপাথর ব্যবহার করেন। যা আনা হয়েছিল সুদূর রাজস্থানের মাকরানা থেকে। পান্না আসে পাঞ্জাব থেকে, চীন থেকে স্ফটিক, তিব্বত, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে আসে নানা ধরনের নীলকান্তমণি। মোট ২৮ ধরনের দুষ্প্রাপ্য দামি পাথর পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে আনানো হয়। পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিশেষজ্ঞরা আসেন বুখারা থেকে, হস্তাক্ষর শিল্পীরা আসেন সিরিয়া এবং পারস্য থেকে, রত্নশিল্পীরা আসেন উত্তর ভারত থেকে, মণিকারেরা আসেন বেলুচিস্তান থেকে।

সময়ে সময়ে বদলায় তাজমহলের রং। খুব ভোরে তাজমহল গোলাপি, দিনের মধ্যভাগে সাদা ও রাতে চাঁদের আলোয় সোনালি রঙের দেখায়। ব্রিটিশ লেখক ও সাংবাদিক নিকোলাস ওয়াপশট বলেছেন, তাজমহলের তিনটি রূপ রয়েছে। ভোরবেলা এটি কুয়াশায় ভাসে, যেন মেঘের ওপর বসে আছে। দিনের তাপ বাড়ছে। তাজমহলকে শুভ্র দেখায়। আর রাতে পূর্ণিমার আলোয় সাদা মার্বেলের পুরো কমপ্লেক্সটি জ্বলজ্বল এবং চকচক করে।

ভূমিকম্পেও টলে না!

তাজমহল শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাজমহলের ভিতটি বড় ধরনের ভূমিকম্পেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ- মাটি ভরাটের পর পাতকুয়াগুলোর ওপর এক বিশাল মঞ্চ তৈরি করে তার ওপর সৌধের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়। যে কারণে এর ভিত এতটা মজবুত। এর শীর্ষের দিকে কাজ করার জন্য তৈরি করা হয় প্রকাশ্য এক ইটের তৈরি ভারা। সেই ভারা এতটাই বড় ছিল যে রাজমিস্ত্রিরা জানান, ভারা ভাঙতে তাদের কয়েক বছর সময় লেগে যাবে। তাজমহলের মূল আকৃতি অষ্টকোণী। তবে তাতে লোহার কাঠামো ব্যবহার করা হয়নি। পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে নির্মিত হয় এই সৌধ। যে কাউকে বিস্মিত করবে এর মাথার ওপরকার গম্বুজের কারুকাজ।

 

ফটো গ্যালারি

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর