বুধবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভয়ংকর খুনি নার্সের অবিশ্বাস্য কাহিনি

ভয়ংকর খুনি নার্সের অবিশ্বাস্য কাহিনি

উত্তর ইংল্যান্ডের কাউন্টেস অব চেস্টার হাসপাতালের ঘটনা। ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে একের পর এক শিশু মারা যেতে থাকে এ হাসপাতালে। হঠাৎ করেই শিশুদের শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। নবজাতক ইউনিটে এভাবে অসুস্থ ও প্রি-ম্যাচিউর শিশুমৃত্যুর ঘটনায় অভিভাবকরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। চারদিকে সমালোচনা শুরু হয়। তদন্তে নামে পুলিশ। প্রধান সন্দেহভাজন নার্স লুসি লেটবি। নবজাতক ইউনিটে কাজের চাপ বেশি থাকায় বিরক্ত ছিলেন তিনি। তার ঘরে মেলে একটি নোট। তাতে লেখা- ‘আমি শয়তান। আমি ভয়ংকর খারাপ।’ পাঁচটি শিশুপুত্র এবং দুটি শিশুকন্যাকে হত্যার প্রমাণ পাওয়া যায়। আরও ছয় শিশুকে হত্যার চেষ্টা করেছেন তিনি। শিশুদের শরীরে ইনসুলিন দিয়ে, বায়ু ঢুকিয়ে বা জোর করে তাদের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে ওই শিশুগুলোকে খুন করেন লুসি লেটবি...। ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সিরিয়াল কিলারের ঘটনা নিয়ে লিখেছেন - তানভীর আহমেদ

 

সিরিয়াল কিলার লুসি লেটবি

যুক্তরাজ্যের কাউন্টেস অব চেস্টার হাসপাতালের নার্স লুসি লেটবি। বয়স ৩৩। ব্যান্ড-৫ নার্স তিনি। মানে নবজাতকদের দেখাশোনার জন্য আলাদা ট্রেনিং ছিল তার। হাসপাতালের নবজাতক ইউনিটে কাজ করতেন। অসুস্থ ও প্রি-ম্যাচিউর শিশুদের দেখভালের দায়িত্ব ছিল তার হাতে। নবজাতক ইউনিটে কাজের প্রচুর চাপ ছিল। যা তার ভালো লাগত না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসবকে তার আলসেমি বলেই মনে করতেন। ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০১৬ সালের জুন। এ সময়ের মধ্যে চেস্টার হাসপাতালে একের পর এক শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বিশেষজ্ঞরাও বুঝতে পারছিলেন না, কী হচ্ছে? হঠাৎ করেই হাসপাতালে কোনো কোনো নবজাতকের অবস্থা ভীষণ খারাপ হয়ে যেত। ডাক্তারদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে মারা যেত শিশুরা। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয় চারদিকে। তদন্ত শুরু হয়। তদন্তকারীরা তেমন কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তবে খটকা লাগল একটি বিষয়ে। যে শিশুরা মারা যাচ্ছে বা যাদের হঠাৎ শারীরিক অবস্থা খারাপ হতো তাদের সেবা দিয়েছিলেন নার্স লুসি। সন্দেহ হওয়ায় তাকে নবজাতক ইউনিট থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মাত্র এক বছরে সাত শিশু হত্যা ও আরও অন্তত ১০ থেকে ১৫ শিশুকে হত্যাচেষ্টারও অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। প্রধান সন্দেহভাজন হয়ে ওঠেন এ নার্স। সিরিয়াল কিলার লুসি লেটবির কাহিনি শুরু এখান থেকেই। ১৩ মাসে তিনি পাঁচটি সদ্যোজাত ছেলে এবং দুটি সদ্যোজাত মেয়েকে খুন করেছেন। মৃতদের সবাই প্রি-ম্যাচিউর অথবা অপরিপক্ব শিশু। বেছে বেছে ওই ধরনের শিশুদেরই হত্যা করতেন এ সিরিয়াল কিলার।

 

আমি শয়তান আমিই করেছি এসব ইচ্ছা করে ওদের মেরে ফেলেছি

এর আগেও লুসিকে দুবার আটক করা হয়েছিল। ২০২০ সালে তৃতীয়বার আটকের পর তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ আনা হয়। সে সময় তার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে হাসপাতালের কিছু কাগজপত্র ও হাতে লেখা একটি চিরকুট পাওয়া যায়। একটা কাগজে চোখ পড়তেই চমকে ওঠেন তদন্তকারীরা। সেখানে কালো বৃত্তের ভিতরে ইংরেজিতে লেখা- ‘হেইট’ মানে ‘ঘৃণা’। কীসের ওপর ঘৃণা? পুরো নোট পড়ে হতভম্ব হয়ে যান সবাই। খুনি লুসি বুঝতে পারছিলেন, যে পাপ তিনি করেছেন তার নৃশংসতা সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। লুসি লিখেছেন- ‘আমি ভয়ংকর খারাপ।’ বড় হাতের অক্ষরে লেখা, ‘আমি খারাপ, আমিই এ কাজ করেছি।’ আরেকটি নোটে লেটবি লিখেছেন- ‘আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আমি তাদের হত্যা করেছি। কারণ তাদের যত্ন নেওয়ার মতো ভালো মানুষ ছিলাম না আমি।’ বিচারকদের সামনে লেটবি তথ্য প্রমাণ দিয়ে বলেছে, ‘আমি শিশুদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে হত্যা করেছি। কারণ আমি তাদের যত্ন নেওয়ার মতো উপযুক্ত নই।’ নোটে তিনি লিখেছেন- ‘আমি কখনোই সন্তান নেব না, বিয়ে করব না। আমি কখনোই জানব না যে একটি পরিবার থাকতে কেমন লাগে।’ লুসি আদালতে স্বীকার করেন, যখন তাকে নবজাতক ইউনিট থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন তিনি ওই নোট লিখেছিলেন। সে সময় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ভয়ংকর ভুল করে ফেলেছেন। নোটে নিজেকে নিজেই বলেন, ‘আমি শয়তান। আমিই এসব করেছি। ইচ্ছা করে ওদের মেরে ফেলেছি।’

 

খুনের মোটিভ ১

গোপন প্রেমের গুঞ্জন

তদন্তকারীরা অভিযোগ করেছেন, কাউন্টেস অব চেস্টার হাসপাতালে কর্মরত একজন বিবাহিত ডাক্তারের সঙ্গে লুসির গোপন সম্পর্ক ছিল। ধারণা করা হচ্ছে এ চিকিৎসক ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকা     শিশুদের দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন। কোনো শিশুর অবস্থা অবনতির দিকে গেলে তাকে ডাকা হতো। মূলত তদন্তকারীরা বোঝাতে চেয়েছেন যে, ‘ব্যক্তিগত মনোযোগ’ পাওয়ার আশায় নার্স লুসি শিশুদের আঘাত করেছিল। যদিও লুসি এ অভিযোগ নাকচ করেছেন। আদালতে দেখানো প্রমাণাদি থেকে জানা যায়, এ জুটি নিয়মিত      ক্ষুদে বার্তা আদান-প্রদান করত। হার্ট ইমোজি অদলবদল করতেও দেখা গেছে তাদের। এমনকি  ২০১৬ সালে লুসিকে নবজাতক ইউনিট থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরেও তারা কয়েকবার দেখা করেছেন।

 

খুনের মোটিভ ২

নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে শুরু করেছিলেন লুসি

নির্মম শিশু খুনের মোটিভ নিয়ে এখনো নিশ্চিত তথ্য দিতে পারেনি তদন্তকারী দল। তবে দুটি বিষয় তারা আদালতে উপস্থাপন করেন। তার একটি হলো- খুনি লুসির ভিতরে ‘গড সিনড্রোম’ দেখতে পেয়েছেন তারা। সাধারণত যেসব ব্যক্তির গড সিনড্রোম থাকে তারা নিজেদের অন্যের চেয়ে উন্নত ভাবা শুরু করেন। ভাবেন তাদেরও সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করার ঐশ্বরিক ক্ষমতা রয়েছে। নিজেকে সৃষ্টিকর্তা ভাবতে শুরু করে তারা। নার্স লুসিও এতে আক্রান্ত ছিলেন কি না সে সম্ভাবনার কথা তুলেছেন তদন্তকারীরা। বিশেষ করে, তার চূড়ান্ত শিকার তিন যমজ ভাইয়ের হত্যাকান্ড এমনই ইঙ্গিত করে। একজন তদন্তকারী বলেন, ‘সে (লুসি) ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণ করছিল। তার কাছে এসব ছিল দারুণ উপভোগ্য। সে এমন সব বিষয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করছিল যা ঘটার সম্ভাবনা তার কাছে মনে হয়েছিল শতভাগ। মূলত সে ঈশ্বরের চরিত্রে অভিনয় করছিল।’

 

শিশু হত্যার বর্ণনা শুনে গা শিউরে ওঠে তদন্তকারীদের

তদন্তকারী দল যে রিপোর্ট আদালতে জমা দিয়েছেন তাতে জানা যায়, হাসপাতালে রাতের শিফটে কাজ করতেন লুসি। সেই সময়ই তিনি নবজাতক হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছেন। মামলার কৌঁসুলিরা জানিয়েছেন, লুসি কয়েকটি শিশুর দেহে ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন ও বাতাস ঢুকিয়ে এবং বাকিদের জোর করে দুধ খাইয়ে হত্যা করেছেন। কয়েকজন শিশুর ওপর একাধিকবার আক্রমণ করে তিনি তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন। এসব মৃত্যু তিনি এমনভাবে সাজাতেন যেন মনে হতো শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে এ শিশুদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় মারা যাওয়া এক সন্তানের মা বলেন, এক রাতে তার শিশুসন্তান যখন চিৎকার করে কাঁদছিল, তখন তার মনে হয়েছিল ‘কিছু একটা গলদ হয়েছে। তখন এমন শব্দ আসছিল যা একটি নবজাতক থেকে আসার কথা নয়।’ হাসপাতালের তদন্তে দেখা যায়, শিশু বিভাগে লুসি যখন সকালবেলা দায়িত্বে থাকতেন তখন শিশুগুলোর মৃত্যু হয়েছে। আবার লুসি রাতের ডিউটিতে থাকলেও একই জিনিস লক্ষ্য করা গেছে। একেকটি শিশুকে হত্যা করতে প্রায় তিনবার করে চেষ্টা চালিয়েছেন লুসি। ইনসুলিন প্রয়োগ করে যে দুটি শিশুকে খুন করা হয়েছে তাদের শরীরেও অন্তত তিনবার সুচ ফোটানো হয়েছে। একটি শিশুর ক্ষেত্রে যেমন দেখা গেছে- লুসি দায়িত্বে নেওয়ার পর মাত্র ৯০ মিনিটের মধ্যে তার মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে দেখা গেছে, শিশুটির শরীরে হাওয়া ভর্তি ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক পদ্ধতিতে তাকে মারা হয়েছে। এক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ লক্ষ্য করেন, শিশুগুলোর অস্বাভাবিক মৃত্যুর সময় তাদের আশপাশেই উপস্থিত ছিলেন লুসি। প্রাথমিকভাবে কাকতালীয় বলে মনে হলেও পরে এ দুটোর মধ্যে একটা যোগসূত্র খুঁজে পান তিনি। গত বছরের অক্টোবর থেকে লুসি লেটবির বিচার শুরু হয়।

 

বিচারক বললেন, ‘নিষ্ঠুর শিশু গণহত্যা। অথচ আপনার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই...’

ট্রায়ালে লুসি জানান, যে শিশুদের তেমন যত্ন বা চিকিৎসার প্রয়োজন নেই, সেই শিশুদের দেখভালের দায়িত্ব তাকে দেওয়া হলে তিনি খুব বিরক্ত বোধ করতেন। নবজাতক ইউনিটেই তিনি সাতটি ভয়াবহ হত্যাকান্ড ও ছয়টি হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটান। ১০ মাস বিচারের পরে নার্স লুসির আমৃত্যু কারাদন্ডের আদেশ ঘোষণা করেন যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ক্রাউন কোর্টের বিচারক জেমস গস। জামিন বা প্যারোলও পাবেন না তিনি। যুক্তরাজ্যে এর চেয়ে কঠোর শাস্তি হয় না। এখন পর্যন্ত মাত্র তিনজন নারী এ শাস্তি পেয়েছেন। লুসিকে উদ্দেশ করে বিচারক বলেন, আপনাকে আমৃতু কারাদন্ড দিচ্ছি। পাশাপাশি আমি এটাও নির্দেশ দিচ্ছি যে, জীবিত থাকা পর্যন্ত আপনার মুক্তির কোনো আবেদন যেন কোনো আদালত গ্রহণ না করেন। বিচারক বলেন, ‘আপনার ক্রিয়াকলাপের মধ্যে একটি গভীর নৃশংসতা ছিল। অথচ আপনার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। আপনি এমন কাজ করেছেন যা শিশুদের লালন-পালন এবং যত্ন নেওয়ার স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তির বিপরীত ছিল।’ অপরাধ অস্বীকার করে আদালতে হাজির হননি লুসি।

সর্বশেষ খবর