সোমবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

হারানো প্রাচীন সভ্যতার কাহিনি

তানভীর আহমেদ

হারানো প্রাচীন সভ্যতার কাহিনি

নাবাতিয়ান

নাবাতিয়ান সভ্যতা। এ সভ্যতা বেশি আলোচনায় এসেছে গবেষকদের বিশেষ বিশ্লেষণ ও গবেষণার কারণে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এ সভ্যতা মানবজাতির সভ্যতার বিকাশে বিশেষভাবে আলোচিত হয়ে আসছে। নাবাতিয়ান সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বর্তমান জর্ডান ও আশপাশের অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় বলে ধারণা করা হয়। এ শহরের গঠন বেশ রহস্যময়। পুরো শহরটাই যেন রহস্যে ঢাকা। বিস্ময়কর এ সভ্যতার শহরগুলোর মতো এর নির্মাতারাও রহস্যই থেকে গেছেন। তাদের নগর পরিকল্পনা বিশেষত্ব বহন করে। শহরের বেশির ভাগ স্থাপনাই পাথরে খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। অতিকায়  স্থাপনাগুলো অবিশ্বাস্যের চোখে দেখতে হয় স্থাপনাগুলোর স্থাপত্যশৈলী কতটা নান্দনিক ও রুচি বহন করে। পাথরের খোদাইকৃত শহরগুলো দেখে এখনো পর্যটকরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যান। নাবাতিয়ান সভ্যতার স্থাপনাগুলোর নির্মাণশৈলিতে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকরা বৈজ্ঞানিক যুক্তি দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এত আগে পাহাড় কেটে কেমন করে এসব অতিকায় পাথুরে স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে তা সত্যিকার অর্থেই এক বিস্ময়। তবে নাবাতিয়ান সভ্যতার শৈল্পিক গঠনই একমাত্র বিস্ময় নয়। এ সভ্যতার কোনো লিখিত ইতিহাস না থাকাটাও ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিস্ময়ের জন্ম দেয়। অপরূপ গঠনের নাবাতিয়ান সভ্যতা ১০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে রোমান সম্রাট ট্র্যাজান কর্তৃক বিজিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে গ্রিক-রোমান সংস্কৃতিতে হারিয়ে যায় এ সভ্যতার কীর্তিমানদের সব বীরত্বগাথা। নাবাতিয়ান সভ্যতা ধীরে ধীরে আরও পূর্ণ হয়েছে আধুনিকতায়। গ্রিক ও রোমানদের আগমনে এ আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। শিল্প ও সংস্কৃতিতে অনেকটাই এগিয়ে যায় নাবাতিয়ান সভ্যতা। ইতিহাসবেত্তাদের মতে, নাবাতিয়ান সভ্যতার এ অগ্রগতি খুব বেশি দিন ছিল না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায়ই নাকাল হয়েছে শহরটি। ফসল ফলানোর জন্যও নগরীটি খুব আদর্শ ছিল না। এসব কারণে পরবর্তীতে এ শহর ছেড়ে কোলাহল দূরে সরে যেতে শুরু করেছিল বলে ধারণা করা হয়।

 

খেমার

পৃথিবীর অন্যতম রহস্যাবৃত সভ্যতা খেমার সাম্রাজ্য। যা আজও ইতিহাসের পাতায় সমুজ্জ্বল। খেমার সাম্রাজ্য ‘অ্যাঙ্কর’ সভ্যতা নামেও পরিচিত। এ সভ্যতার স্থাপত্যশৈলী প্রশংসিত। এ সভ্যতা যোগাযোগ তৈরিকারী সভ্যতাগুলোরও একটি। স্থল যোগাযোগব্যবস্থার মূল সমস্যা বিভিন্ন খাল ও নদীর ওপর সেতু নির্মাণও ছিল যুগান্তকারী খেমার সভ্যতার অন্যতম কীর্তি। শুধু স্থাপত্যশৈলীর জন্যই এ সভ্যতা অমরত্ব লাভ করেছে। সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় প্রাসাদে গোলন্দাজদের জন্য ইস্পাতনির্মিত টাওয়ার এবং খোদাইকৃত অসাধারণ শিল্পকর্মের ইমারতগুলো শিল্পায়ন পূর্ববর্তী বিশ্বের এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। খেমার সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন কোথা থেকে, এ নিয়ে বহু তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। ইতিহাস বিশ্লেষকদের মতে, কম্বোডিয়ার প্রাচীন রাজারা খেমার সভ্যতা নির্মাণ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের দিকে এ সভ্যতা ভিয়েতনাম থাইল্যান্ড এবং লাওসে বিস্তৃতি লাভ করে। খেমার সভ্যতার কেন্দ্র ছিল ‘অ্যাঙ্কর’ নামের একটি শহর। ‘অ্যাঙ্কর’ সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ ‘শহর’। শহরের কেন্দ্রে হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর প্রতি শ্রদ্ধার স্মারক হিসেবে মন্দির নির্মাণ করে খেমাররা। তাদের কাছে মন্দিরটি দেবতাদের আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত ছিল। হিন্দু পুরানে ‘মেরু’ পর্বতকে পৃথিবীর কেন্দ্র এবং দেবতাদের আবাসভূমি বর্ণনা করা হয়েছে। এদের বেশির ভাগই বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাস্কৃতিক উৎসব পালন করত। প্রতি বছরই খেমার সাম্রাজ্যে কুস্তি প্রতিযোগিতার পাশাপাশি সামাজিক উৎসবের তালিকায় ছিল গানের আসর ও সরকারি, ধর্মীয় বিশেষ দিবস উপলক্ষে আতশবাজি পোড়ানো। বিচিত্র এ সভ্যতা পঞ্চদশ শতকে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে ঐতিহাসক ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা এখনো এ সভ্যতা ধ্বংসের কারণ নির্ণয়ে একমত হতে পারেননি।

 

মকি

মকি সভ্যতা। এক সময় যারা ‘মকিকা’ সভ্যতা নামেও পরিচিত। সময়টা তখন ৮০০ খ্রিস্টাব্দ; প্রশান্ত মহাসাগর ও আন্দিজ পর্বতমালার মধ্যবর্তী অঞ্চলে এ সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পেরুর উত্তর উপকূলীয় শুষ্ক অনুর্বর অঞ্চলে মকি সভ্যতার স্বর্ণযুগ ছিল। লিখিত ইতিহাস এবং ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী তেমন কোনো চিহ্ন না থাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক উপাদান ও স্মৃতিস্তম্বের ওপর ভিত্তি করেই প্রত্নতাত্ত্বিকরা এ সভ্যতা সম্পর্কে যৎকিঞ্চিত মতামত দিয়ে থাকেন। এসব স্মৃতিস্তম্বের মাধ্যমেই মূলত রহস্যাবৃত এ সভ্যতার উৎকর্ষের প্রমাণ খানিকটা পাওয়া যায়। এ সভ্যতার বাসিন্দারা মৃৎশিল্পের মাধ্যমে কিছুটা হলেও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের উৎকর্ষের প্রমাণ রেখে গেছে। আবিষ্কৃৃত সাদা-কালো রঙের শিল্পকর্মগুলো এ সভ্যতার সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন উপাদান যেমন যুদ্ধ ও অন্যান্য উৎসব উদযাপন বিষয়ে তাদের অলিখিত ইতিহাসের কিছুটা পরিপূরক হিসেবেই কাজ করেছে। এতকিছু সত্ত্বেও চাঁদের কলঙ্কের ন্যায় মকি সভ্যতার বাসিন্দাদের অতিমাত্রায় ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং এ থেকে উদ্ভূত যুদ্ধ-বিগ্রহ ইতিহাসবিদদের কাছে সভ্যতাটির অন্যতম কলঙ্কতিলক রূপে চিত্রিত হয়েছে। প্রাচীনকালের অন্যান্য অনেক সভ্যতার মতোই ধর্মীয় এসব গোঁড়ামির কারণে বিভিন্ন সময় রক্তক্ষয়ী অনেক যুদ্ধের সূচনা হয়েছে। আবার অনেক সময়ই মকি সভ্যতার দেবতাদের নামে শিশুদের উৎসর্গ করত। প্রত্নতাত্ত্বিকরা মন্দিরের নিচ থেকে মকির বাসিন্দাদের কাছে উচ্চ মর্যাদার আসনে স্থান পাওয়া এক দেবীমূর্তির পাশে উৎসর্গীকৃত শিশুদের কঙ্কাল আবিষ্কার করেন।

 

সিন্ধু

দ্য ইন্ডাস ভ্যালি। যতগুলো সভ্যতার কথা ইতিহাসবেত্তাদের বিস্মিত করে তার মধ্যে দ্য ইন্ডাস ভ্যালি অন্যতম। এখনো এ সভ্যতার যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে ততটুকু দেখে চোখ কপালে উঠে যায়। এর প্রধান কারণ অপূর্ব সব স্থাপত্যকর্ম। মানুষের হাতে গড়ে ওঠা সবচেয়ে নান্দনিক সভ্যতার নিদর্শন বহন করে দ্য ইন্ডাস ভ্যালি। বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত এ সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ অব্দের দিকে এ এলাকার অন্তত সাড়ে ১২ লাখ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত ছিল। এ সভ্যতায় শিল্প ও অলংকার ব্যবসার বেশ প্রসার ঘটে। এর পাশাপাশি ইন্ডাস ভ্যালির লোকেরা পরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও চালু করেছিল। যার নমুনা পাওয়া যায়। নৃতাত্ত্বিকদের খুঁজে পাওয়া নমুনায়। এ ছাড়া নগরের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রবর্তক ইন্ডাস ভ্যালি সভ্যতার লোকেরা বৃহৎ পরিসরে ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযোগী ওজন পরিমাপ পদ্ধতি চালু করেন বলে একমত হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ সভ্যতার কেন্দ্রের ইতিহাস বিখ্যাত মহেঞ্জোদারো সভ্যতা অবস্থিত। ঐতিহাসিকদের কাছে এটি পৃথিবীর প্রথমদিককার অন্যতম শহুরে সভ্যতা হিসেবে বিবেচিত।  যোগাযোগের জন্য নিজস্ব লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন করে ইন্ডাস ভ্যালি সভ্যতার লোকেরা নিজেদের বিস্তৃত ইতিহাস লিখে যায়। যদিও তাদের ভাষারীতি সম্পর্কে এখনো অজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা। সে কারণে তাদের লিখিত লিপির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। স্থাপনায় খোদাই কর্ম ও ধাতুবিদ্যার অনেকটা তাই এখনো অজানা।

 

মিনোয়ান

ইজিয়ান সাগরের ক্রীট দ্বীপে খ্রিস্টপূর্ব ২৭ থেকে ১৫ অব্দের দিকে মিনোয়ান সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন মধ্য ‘নিওলিথিক’ যুগে এখানে বসতি স্থাপন হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হওয়া মিনোয়ান সভ্যতাকে ঘিরে অনেক কল্পকাহিনি (মিথ) তৈরি হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক আর্থার ইভানস ও উইলিয়াম ডুরেন্ট আবিষ্কার করেন মিনোয়ান সভ্যতা। আর্থার ইভানসই এ সভ্যতাকে গ্রিক পুরানে বর্ণিত রাজা ‘মিনোস’ এর নামে নামকরণ করেন। দীর্ঘদিন টিকে থাকার পর মিনোয়ান সভ্যতার অ্যাক্রতিরি শহর সমুদ্রের বুকে হারিয়ে যায়। প্লেটোর ‘আটলান্টিস’ নামের গল্পটির উপজীব্যও এ ঘটনা। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ‘ক্রিট’ দ্বীপসহ পার্শ্ববর্তী ‘থেরা’ দ্বীপের উপকূলবর্তী শহর ও পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

সর্বশেষ খবর