সোমবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিপজ্জনক পেশা

তানভীর আহমেদ

কর্ম আয়ের উৎস। জীবিকা অর্জনের জন্য মানুষকে বিভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়। কিন্তু পেশার মাঝেও রয়েছে ভিন্নতা। বেশ কিছু পেশা রয়েছে যেগুলো অন্যসব পেশার চেয়ে একটু বেশি আকর্ষণীয় ও চ্যালেঞ্জিং। ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে এ ধরনের পেশাকে বলা হয় দুঃসাহসিক পেশা। এ নিয়ে আজকের রকমারি-

 

উঁচু দালানের পরিচ্ছন্নতাকর্মী

আকাশচুম্বী দালান নির্মাণের হিড়িক পড়েছে উন্নত বিশ্বে। ৮০ তলা থেকে শুরু ১৮০ তলা অবধি দালান নির্মাণের কাজ চলছে বিভিন্ন দেশে। আকাশচুম্বী দালান নির্মাণ করতে গিয়ে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে নির্মাণ শ্রমিকদের। উঁচু দালান নির্মাণ শ্রমিকরা বর্তমান বিশ্বের অন্যতম দুঃসাহসিক পেশায় নিয়োজিত আছেন। দালান নির্মাণের জন্য তাদের শত শত ফুট ওপরে চড়তে হচ্ছে। বাতাসের ঘূর্ণিপাকের সঙ্গে লড়াই করে তাদের কাজ করতে হয়। অনেকেই উঁচু দালান শ্রমিকের কথা বললে আকাশচুম্বী দালানের জানালার কাচ লাগানো ও পরিষ্কার করা শ্রমিক দলের কথা ভেবে থাকেন। আকাশচুম্বী দালানের রক্ষণাবেক্ষণকারী দলের মধ্যে তারা থাকেন। এ ধরনের উঁচু দালান প্রতিনিয়ত ধূলি আর বাতাসের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকে। রক্ষণাবেক্ষণকারী দলের অন্যতম কাজ থাকে দালানের বাইরের দিকে জানালার কাচ পরিষ্কার রাখা। যাতে তাতে কোনো ধূলি জমতে না পারে। এ ধরনের কাজের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে তাদের শত শত ফুট ওপরে দড়িতে ঝুলে কাজ করতে হয়। এই দড়ি তখন তাদের জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে একমাত্র ব্যবধান হয়ে থাকে। আকাশচুম্বী দালান নির্মাণ শ্রমিকদের এ ছাড়াও বিভিন্ন কাজের জন্য সত্যিকারের ঝুঁকি নিতে হয়।

 

অতিকায় বৃক্ষের কাঠুরে

আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো কাঠ। কাঠ বনজ সম্পদ। গহিন অরণ্য থেকে এই কাঠ সংগ্রহ করা হয় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। কাঠুরিয়াদের কাজ বিশ্বের শীর্ষ বিপজ্জনক কাজগুলোর একটি। অতিকায় বৃক্ষের কাঠ সংগ্রহের ক্ষেত্রে আধুনিক সরঞ্জামের পাশাপাশি কাঠুরিয়াদের নিজ হাতে ‘কাটার মেশিন’ ব্যবহার করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বিপদের মাত্রা বেড়ে যায়। প্রতি বছরই গাছের গুঁড়ি সংগ্রহ করতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত শ্রমিকের সংখ্যা লিপিবদ্ধ হচ্ছে সংখ্যাতত্ত্বে। গাছের মাত্রাতিরিক্ত ওজনের কারণে গাছের গুঁড়ি যেমন ভেঙে পড়তে পারে তেমনি ভেঙে ফেলতে পারে পূর্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও। এসব গাছ কাটা থেকে শুরু করে গাছের গুঁড়ি তোলা অবধি বিভিন্ন স্তরের কাজে কাঠুরিয়াদের মুখোমুখি হতে হয় সত্যিকারের বিপদের। গাছের গুঁড়ি থেকে কাঠ সংগ্রহের পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। ছোটখাটো কোনো ভুলের কারণেও বড় ধরনের বিপদের বহু ঘটনা রয়েছে লগ কর্মীদের। গাছের গুঁড়ি থেকে কাঠ সংগ্রহকারী তথা লগ শ্রমিকদের কদর রয়েছে কর্মক্ষেত্রে। আমেরিকার শীর্ষ পারিশ্রমিক পাওয়া শ্রমিকের তালিকায়ও তারা রয়েছে ওপরের দিকে। তাদের কাজে অন্যতম বিপদের একটি গাছ উপড়ে যাওয়া। এ ছাড়া যেসব যন্ত্র ব্যবহার করে তারা গাছের গুঁড়ি সংগ্রহ করেন সেগুলো ব্যবহার করতে গিয়েও প্রায়শ মারাত্মকভাবে আহত হন তারা।

 

গভীর সমুদ্রের জেলে

সমুদ্রের বুকে সম্পদের কমতি নেই। মৎস্য সম্পদ তার একটি। জেলেদের মাছ সংগ্রহের জন্য যেতে হয় গভীর সমুদ্রে। বিশ্বের শীর্ষ বিপজ্জনক পেশার মধ্যে অনেকেই শুরুতে রাখেন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া শ্রমিকদের। এর অন্যতম প্রধান কারণ তাদের বেশির ভাগ সময়ই প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পড়তে হয়। কখনো কখনো সঠিক আবহাওয়া পূর্বাভাস থাকার পরও পূর্বনির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সমুদ্রে থেকে যেতে হয়। এ সময় তাদের কাছে সুচিকিৎসা ও খাবার পানি হয়ে ওঠে জীবন ও মৃত্যুর মাঝে প্রধান নিয়ামক। এসবের পাশাপাশি সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় মুখোমুখি হতে হয় বিপৎসংকুল পরিবেশকে। মাছ ধরতে গিয়ে জাহাজডুবি, মাছের আঘাতে আহত হওয়া, প্রবল সামুদ্রিক ঢেউয়ে পথ হারিয়ে ফেলাসহ বিভিন্ন গুরুতর বিপদের সঙ্গে লড়াই করতে হয় জেলেদের। মাঝ সমুদ্রে মাছ আরোহণকারী কোনো জেলে বা জেলে জাহাজে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সাহায্য পৌঁছানো আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। বেশির ভাগ সময় তাদের নিরুপায় হয়ে অপেক্ষা করতে হয়। মাছ ধরতে আসা একজন জেলে প্রতি ঘণ্টায় আয় করেন ১৬.০৭ মার্কিন ডলার। প্রতি বছরের হিসাবে তা প্রায় ৩৩ হাজার ৪৩০ মার্কিন ডলার। প্রতি ১ লাখ জেলের মধ্যে দুর্ঘটনায় মারা যান প্রায় ১১৭ জন।

 

খনি শ্রমিক

খনি শ্রমিকদের পেশা নিয়ে বহুবার আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। খনি শ্রমিক মাটির শত শত ফুট নিচে নেমে খনিজ পদার্থ সংগ্রহ করে থাকেন। এদের মধ্যে কয়লা শ্রমিকদের কথা বেশি আলোচিত। অন্ধকার গুহায় কঠোর পরিশ্রমের কাজ বলেই জানেন এই পেশাকে। বাস্তবেও খনি শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কয়লা খনি ছাড়াও হীরক খনি, তেল ও গ্যাস উত্তোলনে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় শ্রমিকদের। খনি শ্রমিকদের ঝুঁকির পরিমাণ বেশি বলেই এ পেশাকে শীর্ষ দুঃসাহসিক পেশা হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। খনি অভ্যন্তরে বড় বিপদগুলোর মধ্যে রয়েছে গুহার দেয়াল ভেঙে পড়া, অক্সিজেন সরবরাহ লাইনে ত্র“টি, লিফট কাজ না করা বা ভেঙে পড়া ও বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়া। প্রায়ই বিভিন্ন দেশের কয়লা খনি ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ উত্তোলনের সময় মাটির নিচে গুহা ভেঙে পড়া ও বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার মতো মারাত্মক দুর্ঘটনার কথা শুনতে পাওয়া যায়। তবে খনি শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্যও এখন আধুনিক সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। যে কারণে ধীরে ধীরে খনি দুর্ঘটনা কমে এসেছে। এখন আগের মতো মারাত্মক মৃত্যু ঝুঁকি মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া থাকে। খনি শ্রমিকদের এক সময় আয় খুব কম থাকলেও এ যুগে এসে তাদের চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে। এখন আধুনিক বিশ্বে শ্রমিক নিরাপত্তা ও আয়ের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। একজন মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারের বার্ষিক বেতন ৭৩ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারের বেশি। সবমিলিয়ে খনি শ্রমিকদের পেশায় ঝুঁকি উল্লেখ করার মতো।

 

যাত্রীবাহী বিমানের পাইলট

বিশ্বের আকর্ষণীয় পেশাগুলোর মধ্যে অন্যতম উড়োজাহাজের পাইলট। বিমানচালকের পেশায় আয়ও খুব ভালো। কিন্তু বিপজ্জনক পেশার তালিকায় শুরুর দিকেই রয়েছে বিমানচালকের পেশা। যাত্রীবাহী বিমানচালক বিশ্বের সবচেয়ে জটিল ও চ্যালেঞ্জিং পেশার একটি। এখানে মুহূর্তের জন্যও সচেতনতা হারালে চলে না। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি কাজ গুরুত্বপূর্ণ। আকাশে বিমান উঠে যাওয়ার আগেই বিমানচালক ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের কাজ শুরু হয়। বিমানে যাত্রীদের নিরাপত্তা দেওয়া থেকে শুরু করে ছোটখাটো সব শৃঙ্খলা নিশ্চিত করাও তাদের কার্যতালিকাভুক্ত। বিমান উড্ডয়নের জন্য উড়োজাহাজ প্রস্তুত কিনা তা যাচাই করে নিশ্চিত হয়েই তারা বিমান নিয়ে আকাশে উড়াল দেন। একটি ককপিটের দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যাবে একজন পাইলটকে কতটা দক্ষ ও সচেতন হতে হয়। রেডিওতে প্রতিটি মুহূর্তে বেস সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে নির্দেশনা অনুযায়ী বিমান পরিচালনা করতে হয়। এ ছাড়া অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সদা প্রস্তুত থাকতে হয় তাদের। দুর্ঘটনাপ্রবণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পাইলটদের বিশেষ দক্ষতা বাঁচিয়ে দিতে পারে যাত্রীদের। সব মিলিয়ে যে কোনো পরিস্থিতিতেই পাইলটকে হতে হয় সর্বেসর্বা।

সর্বশেষ খবর