রবিবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিশ্বজুড়ে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি

আবদুল কাদের

বিশ্বজুড়ে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি

বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি। বিশ্বের অন্যতম এই পরাশক্তি ৮০টি দেশে তাদের ৭৫০টি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। সামরিক ঘাঁটি ছাড়াও মোট ১৫৯টি দেশে তাদের ১৭ লাখ ৩০ হাজারের বেশি সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। যদিও এর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে বলে ধারণা সমর বিশেষজ্ঞদের। পৃথিবীর সাত মহাদেশেই রয়েছে একাধিক মার্কিন ঘাঁটি। তালিকা থেকে বাদ যায়নি বরফের মহাদেশ অ্যান্টার্টিকাও। সেখানেও তিন তিনটি মিলিটারি গবেষণা কেন্দ্র বসিয়ে রেখেছে এই সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি। দেখে নেওয়া যাক বিশ্বের কোন কোন অঞ্চলের কোন দেশগুলোতে বেশি তৎপর পরাশক্তি আমেরিকা...

 

কোন দেশে কত সামরিক ঘাঁটি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ৮০টি দেশে প্রায় ৭৫০টি সামরিক ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণ করে। যে কোনো অজুহাতে যে কোনো দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মার্কিন হস্তক্ষেপের পেছনে এ ঘাঁটিগুলোর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে অনুগত শাসক শ্রেণি তৈরি অথবা কোনো দেশকে সর্বদা কূটনৈতিক চাপে রাখার ক্ষেত্রেও এসব সামরিক ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অস্ত্র। বিশ্বের সাতটি মহাদেশে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ তালিকা থেকে বাদ যায়নি বরফরাজ্য অ্যান্টার্টিকা মহাদেশেও।

মার্কিন সামরিক ঘাঁটি সাধারণত

দুটি প্রধান বিভাগের অধীনে বা আওতায় পড়ে

বড় ঘাঁটি বা ঘাঁটি : ৪ হেক্টর (১০ একর) বা ১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের সামরিক স্থাপনা মার্কিন বাহিনীর ‘বড় ঘাঁটি’ হিসেবে বিবেচিত। যেখানে সাধারণত ২০০ জনের বেশি মার্কিন সামরিক কর্মী থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩৯ বা ৬০ শতাংশ বিদেশি ঘাঁটি এই বিভাগের অধীনে রয়েছে।

ছোট ঘাঁটি বা লিলি প্যাডস : এই ঘাঁটিগুলো ছোট; তাই এগুলো ‘লিলি প্যাডস’ হিসেবে বিবেচিত। ৪ হেক্টর (১০ একর) থেকে ছোট বা ১০ মিলিয়ন ডলারের কম মূল্যের সামরিক স্থাপনাগুলোয় আছে সমবায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং ফরোয়ার্ড অপারেটিং সাইট। বাকি ৪০ শতাংশ ঘাঁটি এই বিভাগের আওতাধীন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা এ বিষয়ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ওয়াশিংটন ডিসির আমেরিকান ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড ভাইন বলেন, ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৮০টি দেশে প্রায় ৭৫০টি ঘাঁটি রয়েছে। প্রকৃত সংখ্যাটা আরও বেশি হতে পারে, কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দফতর পেন্টাগন সমস্ত তথ্য প্রকাশ করে না। ১২০টি সক্রিয় সামরিক ঘাঁটিসহ ৭৫০টির বেশি মার্কিন ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণ করে পরাশক্তি আমেরিকা। আর জাপানে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যক মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে, তারপরে জার্মানির ১১৯টি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ৭৩টি রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরে সামরিক ঘাঁটির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য। তাদের রয়েছে মাত্র ১৪৫টি সামরিক ঘাঁটি। প্রায় তিন ডজন সামরিক ঘাঁটি নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া। আর চীনের মাত্র পাঁচটি। এটি বোঝায় পাঁচটি সামরিক ঘাঁটি নিয়ে চীন রয়েছে চতুর্থ অবস্থানে। এক কথায়, অন্যান্য সমস্ত দেশের মিলিত সামরিক ঘাঁটির চেয়ে তিনগুণ বেশি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। পেন্টাগন সদর দফতরের অধীনে আমেরিকার ১১টি সামরিক আদেশ ঘাঁটিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। আফ্রিকান দেশগুলোতে জাতির স্বার্থরক্ষায় কাজ করে ‘আফ্রিকা কমান্ড’। মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর সরাসরি মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নজরদারি করে থাকে। আর ইউরোপ, ইউরেশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ থাকে ‘ইউরোপীয় কমান্ড’-এর ওপর। পরিশেষে ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড, সাউদার্ন এবং নর্দার্ন কমান্ডও নিয়ন্ত্রণ করে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর ‘পেন্টাগন’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭৮ বছর পার হয়েছে। এত বছর পরও আমেরিকার জার্মানিতে ৫০টি, ইতালিতে সাতটি এবং জাপানে ১৩০টি ঘাঁটি রয়েছে। কোরীয় উপদ্বীপে আছে ১৫টি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, বুলগেরিলা, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, সৌদি আরব, কাতার ও কেনিয়াসহ বিশ্বের ৮০টি দেশ ঘাঁটি গড়ে তুলেছে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

 

সামরিক বাহিনীতে কত খরচ?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের প্রথম পাঁচটি বৃহত্তম এবং সবচেয়ে সজ্জিত সশস্ত্র বাহিনীর একটি। প্রতিরক্ষা খাতে এই বিশ্ব মোড়লদের বার্ষিক বাজেট যে কাউকে চমকে দেবে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক বাহিনীতে ৭৭৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনীর পেছনে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে। যা তালিকায় থাকা পরবর্তী ১০টি দেশের সম্মিলিত বাজেটের চেয়েও বেশি। প্রতিরক্ষা বাজেটে চীন ২৫২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। ভারত ৭৩ বিলিয়ন ডলার, রাশিয়া ৬২ বিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাজ্য ৫৯ বিলিয়ন ডলার। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির কস্টস অব ওয়ার প্রজেক্টের তথ্য অনুসারে, বিগত ২০ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বযুদ্ধ’-এর জন্য ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় করেছে। যার মধ্যে কেবল আফগানিস্তানে ব্যয় করেছে ২.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। ইরাক এবং সিরিয়ার যুদ্ধে ২.১ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ৩৫৫ বিলিয়ন ডলার অন্যান্য যুদ্ধের ব্যয় করা হয়।

 

১৯৫০-২০২১ : যেভাবে এগিয়েছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি

গত ৭২ বছরে মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রায় ২০০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে তাদের সেনা মোতায়েন করেছে। আমেরিকান ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড ভাইন তার ‘ইধংব ঘধঃরড়হ’ বইতে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি পরিচালনার কারণে কী পরিমাণ অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং মানুষের জীবনহানি হচ্ছে তার একটি হিসাব নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন। অবাক করা তথ্য হচ্ছে- ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। আর মার্কিন সামরিক ঘাঁটির বেশির ভাগ আবির্ভূত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। এরপর আমেরিকা বিশ্ব মোড়লে পরিণত হয় এবং জাপান ও জার্মানিতে শান্তিরক্ষীর দায়িত্ব পালন করে। কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধ এবং স্নায়ুযুদ্ধকালেও বিভিন্ন দেশে ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে আমেরিকা। সে সময় তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কমিউনিজম বিস্তারের অজুহাত দেখিয়ে সমগ্র বিশ্বে সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বিশ্বব্যাপী তাদের সৈন্য মোতায়েন করেছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দেখে নেওয়া যাক-

১৯৫০-১৯৫৩

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে জাপান, জার্মানি ও ইতালি ছিল এক পক্ষে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখনো যুদ্ধে যোগ না দিলেও মিত্র দেশগুলোকে ব্যাপক সামরিক-বেসামরিক সহায়তা দিচ্ছিল। এর আওতায় ১৯৪০ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত পুরনো ৫০টি ডেস্ট্রয়ার শ্রেণির যুদ্ধজাহাজ ব্রিটেনকে দিয়ে দেয় আমেরিকা। বিনিময়ে তারা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে থাকা আটটি ব্রিটিশ নৌ-ঘাঁটি নিজেদের ব্যবহারের জন্য ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়ে নেয়। প্রাথমিকভাবে এভাবে বিদেশে সামরিক ঘাঁটি বানানোর কাজ শুরু করেছিল মার্কিন সামরিক বাহিনী। বিশ্বযুদ্ধে জাপান, জার্মানি ও ইতালি (এক পক্ষ) পরাজিত হয়। যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে মিত্রদের কাছে জাপানিদের আত্মসমর্পণের পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কোরিয়াকে বিভক্ত করে। যা ছিল জাপানি শাসনের অধীনে। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়ার বাহিনী চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রমণ করে। শুরু হয় কোরিয়ান যুদ্ধ। তখন দক্ষিণ কোরিয়ার মিত্রশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিপুল সৈন্য মোতায়েন করে। যে যুদ্ধে ২০ থেকে ৩০ লাখ বেসামরিক মানুষ মারা গিয়েছিল। তবে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের তথ্য মতে, সে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৩ হাজার ৭৩৯ জন নিহত হয়েছে। সে যুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক শান্তি চুক্তি হয়নি।

১৯৯০-১৯৯১

১৯৯০ সালের ২ আগস্ট ইরাকি সেনাবাহিনী দক্ষিণের তেলসমৃদ্ধ দেশ কুয়েতে আক্রমণ করে। এক সপ্তাহ পরে ৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপারেশন ডেজার্ট শিল্ডের অংশ হিসেবে সৌদি আরবে হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েন করে। সংক্ষিপ্ত ওই যুদ্ধে প্রায় ৬ লাখ ৯৪ হাজার ৫৫০ আমেরিকান সৈন্য ওই অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচডব্লিউ বুশ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। একই বছরের ৩ এপ্রিল জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে সংঘাতের অবসানে একটি প্রস্তাব পাস করে।

২০০১-২০২১

৯/১১ হামলার পরের সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সশস্ত্র সংগঠন আল-কায়েদাকে ধ্বংসের অজুহাতে ২০০১ সালে আফগানিস্তান এবং সাদ্দাম সরকারের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে এই অজুহাতে ২০০৩ সালে ইরাক উভয়ের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এরপরই মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সৈন্যসামন্ত বৃদ্ধি পায়। ২০০১-২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ সৈন্য আফগানিস্তানে এবং ১৫ লাখেরও বেশি সৈন্য ইরাকে কাজ করেছে। ধারণা করা হয়, যুদ্ধে ৯ লাখেরও বেশি লোককে হত্যা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে বেশির ভাগ ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুটির বেসামরিক মানুষ।

 

ইউরোপীয় অঞ্চল

ইউরোপে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির যাত্রা শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে। এই মহাদেশে অন্তত ৬০ হাজার মার্কিন সেনা রয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সেনা ও সামরিক ঘাঁটি রয়েছে জার্মানিতে। ইউরোপের এই দেশটিতে প্রায় ৩৩ হাজার ৯০০ মার্কিন সৈন্য রয়েছে। যদিও ২০০৬ সালে এর সংখ্যাটা ছিল ৭২ হাজার ৪০০। তবে ২০২০ সালে জার্মানিতে অবস্থানরত মার্কিন সৈন্যের সংখ্যা অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসে। ইউরোপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক সৈন্য ও ঘাঁটি মোতায়েন রয়েছে ইতালিতে। ইতালিতে রয়েছে প্রায় ১২ হাজার ৩০০ মার্কিন সৈন্য। আর যুক্তরাজ্যে মোতায়েন রয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৩০০ মার্কিন সৈন্য। জার্মানির রামস্টেইন বিমান ঘাঁটি ইউরোপে মার্কিন সেনা ও সামরিক সরবরাহের বৃহত্তম কেন্দ্র। ১ হাজার ২০০ হেক্টর (৩ হাজার একর) জায়গায় রয়েছে ল্যান্ডস্টুল আঞ্চলিক মেডিকেল সেন্টার, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নির্মিত বৃহত্তম মার্কিন সামরিক হাসপাতাল। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে রামস্টেইন ঘাঁটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। যুদ্ধে হাজার হাজার আহত সৈন্যের চিকিৎসা এই হাসপাতালে করা হয়েছিল। প্রায় সব মার্কিন ঘাঁটির মতো রামস্টেইনেও রয়েছে হাসপাতাল, স্কুল, পাওয়ার স্টেশন, অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স এবং অনেক সুযোগ-সুবিধা নির্মিত। যা প্রায়ই ‘বার্গার কিংস এবং বোলিং অ্যালি’ হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া নরওয়ের সাতটি ঘাঁটিতে ৭৩৩ সেনা, স্পেনের চারটি ঘাঁটিতে ৩১৬৮ সেনা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করা তুরস্কের ১৩টি ঘাঁটিতে আছে ১ হাজার ৬৮৫ মার্কিন সেনা। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য একমাত্র মুসলিম এই দেশটি থেকেই ইরাক আক্রমণ পরিচালনা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধি ও ধরে রাখার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাব ঠেকানো। গ্রিস, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ডসহ গোটা ইউরোপকে ঘিরেই রয়েছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি।

 

মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল

ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুসারে, ২০০১ সাল থেকে প্রায় ১৯ লাখ থেকে ৩০ লাখ মার্কিন সেনাসদস্য আফগানিস্তান এবং ইরাকে কাজ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি হলো- আল উদেইদ বিমান ঘাঁটি, যা কাতারের রাজধানী দোহার ঠিক পশ্চিমে অবস্থিত। ১৯৯৬ সালে এই সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এখানে প্রায় ১১ হাজার আমেরিকান এবং কোয়ালিশন সার্ভিস সদস্য রয়েছেন। ২৪ হেক্টর (৬০ একর) এলাকাজুড়ে বিস্তৃত সামরিক স্থাপনাটিতে প্রায় ১০০টি বিমানের পাশাপাশি অত্যাধুনিক ড্রোনও রয়েছে। ৯/১১ হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের অধীনে ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর মার্কিন সামরিক বাহিনী ইরাকে হামলা চালায়। তার নেতৃত্বাধীন জোটটি তৎকালীন আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে ৯/১১ হামলার দায় স্বীকারকারী আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তোলে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির কস্টস অব ওয়ার প্রকল্পের তথ্য অনুসারে, এই যুদ্ধে আনুমানিক ২ লাখ ৪১ হাজার মানুষ মারা যায়। এ ছাড়াও আরও কয়েক হাজার মানুষ (যাদের বেশির ভাগই বেসামরিক লোক) ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে ক্ষুধা, রোগ এবং বোমার আঘাতে মারা যায়। এরপর ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করেছিল। ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার অভিযোগ তোলে আমেরিকা। যদিও এর কোনো প্রমাণ মেলেনি। ২০০৭ সালে দেশটিতে ১ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান নেয়। বর্তমানে ইরাকি সরকারের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তির অংশ হিসেবে দেশটিতে প্রায় ২ হাজার ৫০০ মার্কিন সেনা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতের প্রায় ১৩ হাজার সৈন্য রয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুদেশ সিরিয়ায় আসাদ বিরোধী বিদ্রোহীদের সাহায্যে ২ হাজার হাজারের বেশি মার্কিন সেনা তৎপর আছে। সৌদি আরবে রয়েছে ৩ হাজার, দ্বীপরাষ্ট্র বাহরাইনে রয়েছে ৭ হাজার মার্কিন সৈন্য।

 

আফ্রিকা অঞ্চল

আফ্রিকায় কোনো যুদ্ধ করছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তথাপি আফ্রিকা মহাদেশের বেশ কয়েকটি দেশেই রয়েছে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি। নেভি সিলস গ্রিন বিরেটস এবং আরও বেশ কয়েকটি বিশেষ বাহিনী অন্তত ২০টি আফ্রিকান দেশে অবস্থান করছে। ১ হাজার সামরিক ঠিকাদারসহ প্রায় সাড়ে ৭ হাজার মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা মোতায়েন রয়েছে আফ্রিকায়। সাম্প্রতিককালের নাইজার অভ্যুত্থানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রায় ১ হাজার ১০০ মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। লিবিয়া, সোমালিয়া, নাইজেরিয়াসহ অনেক দেশেই মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ও সৈন্য রয়েছে। এ ছাড়াও আলজেরিয়া, বুরুন্ডি, শাদ, কঙ্গো, জিবুতি, মিসর, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, সুদান, দক্ষিণ সুদান, তিউনিশিয়া ও উগান্ডার মতো দেশগুলোতেও মার্কিন বাহিনীর সেনা সদস্যরা কাজ করছে।

 

দূর প্রাচ্য

দূর প্রাচ্যের দেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘাঁটি। এ অঞ্চলে চীন ও তার মিত্র উত্তর কোরিয়ার প্রভাব ঠেকাতে বৃহৎ সামরিক প্রস্তুতি গড়ে তুলেছে আমেরিকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) শেষ হওয়ার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানে তাদের সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। আর কোরিয়ান যুদ্ধের (১৯৫০-১৯৫৩) পর থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটি স্থাপন করেছে আমেরিকা। বিদেশে মোতায়েন করা সমস্ত মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ প্রায় ৮০ হাজার ১০০ আমেরিকান কর্মী, ৫৩ হাজার ৭০০ মার্কিন সৈন্য জাপান এবং ২৬ হাজার ৪০০ মার্কিন সৈন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থান করছে। দক্ষিণ কোরিয়ার ক্যাম্প হামফ্রেসের হোস্ট অঞ্চলটির সবচেয়ে বড় বিদেশি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি, যা রাজধানী সিউল থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার (৪০ মাইল) দক্ষিণে অবস্থিত। জাপানের নিয়ন্ত্রণে থাকা কোরীয় উপদ্বীপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে দুই পরাশক্তির মদদে। দক্ষিণ কোরিয়া আমেরিকার সহায়তা লাভ করে এবং উত্তর কোরিয়া চীন ও রাশিয়ার সাহায্যে লড়াই শুরু করে।

 

ল্যাটিন আমেরিকা

ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশেই রয়েছে মার্কিন সেনারা। আমেরিকার চিরশত্রু কিউবা উপকূলের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত গুয়ানতানামো বে নৌঘাঁটি দেশটির সবচেয়ে পুরনো বিদেশি সামরিক ঘাঁটি। ১১৬ বর্গ কিলোমিটার (৪৫ বর্গমাইল) এলাকা বিস্তৃত সামরিক ঘাঁটিটি ১৯ শতকের শেষ থেকে আজ অবধি আমেরিকান নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই দ্বীপকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কিউবার মধ্যে সম্পর্ক চরমে ওঠে। যার শুরুটা হয়েছিল ১৮৯৮ সালে। যদিও ১৯০৩ সালে আমেরিকা স্থায়ীভাবে লিজ নেয়। এই দ্বীপটিতে ৭৩৩ মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। এ ছাড়া হন্ডুরাসের দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ৩৬৯ সেনা রয়েছে। কলাম্বিয়া, পানামা, নিকারাগুয়া, গুয়েতেমালা, ব্রাজিলেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বিদ্যমান।

 

ওশেনিয়া ও অ্যান্টার্কটিকা

ওশেনিয়া মহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দুই দেশ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে রয়েছে মার্কিন ঘাঁটি ও সেনা উপস্থিতি। অস্ট্রেলিয়ায় মার্কিন নৌবাহিনীর একটি মাত্র ঘাঁটি রয়েছে। আর নিউজিল্যান্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি সামরিক ঘাঁটি সক্রিয় রয়েছে। দেশগুলো যেন মার্কিন বলয় থেকে বের হতে না পারে সে জন্য সেখানকার রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিদের ওপর কড়া নজর রাখে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া পৃথিবীর দুর্গমতম, উচ্চতম, শীতলতম, শুষ্কতম তথা নির্জনতম জনমানবহীন মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা। নির্জন এই বরফের রাজ্য অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশেও তিনটি সামরিক গবেষণাগার স্থাপন করেছে পরাশক্তি আমেরিকা। ১৯৬২ সাল থেকে এই মহাদেশের বুকে কাজ করে চলেছে মার্কিন পরমাণু চুল্লি ম্যাকমার্ডো স্টেশন।

 

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি বসানোর চিন্তা পেন্টাগনের

ইন্দো-ওয়েস্ট প্যাসিফিক (ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর) নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কমতি নেই। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের কথা ভাবছে বিশ্বের শীর্ষ এই পরাশক্তি। এ ছাড়াও এ অঞ্চলে নতুন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের পাশাপাশি পুরনো ঘাঁটি নতুন জায়গায় সরিয়ে আনার কথাও ভাবা হচ্ছে। যদিও জটিল ভৌগোলিক গঠনের ইন্দো-প্যাসিফিকে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুব একটা সহজ নয়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অনেকে নিজ ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রকে ঘাঁটি স্থাপন করতে দিতে রাজি নয়। এ ক্ষেত্রে সংঘাত এড়িয়ে চলার বিষয়ে রয়েছে আঞ্চলিক ভূরাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশও। এ ছাড়াও রসদ-সংক্রান্ত জটিলতার বিষয়টিও বড়। সামরিক ও ভূরাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ইন্দো-প্যাসিফিকে দক্ষিণ এশীয় পরিমণ্ডলে নৌঘাঁটি স্থাপনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থান হলো বঙ্গোপসাগর বা সংলগ্ন এলাকা। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সামরিক ঘাঁটি করতে দেওয়ার মতো সহযোগী দেশ খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ বহরের (সারফেস শিপ) ৬০ শতাংশই ইন্দো-প্যাসিফিকে মোতায়েনের পরিকল্পনা রয়েছে। এ জন্য সংলগ্ন আরব সাগর, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং বঙ্গোপসাগরে নিরাপদ স্থানের খোঁজে রয়েছে মার্কিন নৌবাহিনী। ইউরেশিয়া টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি বসাতে সামরিক ও কূটনৈতিক সব চ্যানেলকেই কাজে লাগানো হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর