বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মোনালিসার কারিগর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি

আবদুল কাদের

মোনালিসার কারিগর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি
রেনেসাঁ যুগের প্রতিভাবান এই মানুষটি প্রায় ৫০০ বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু তার প্রতিভা আজও মানবসভ্যতাকে মুগ্ধ করে...

রেনেসাঁ যুগের পথিকৃৎ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯)। সবার কাছে তিনি এই নামেই বেশি পরিচিত। তবে তার পুরো নাম লিওনার্দো ডি সার পিয়েরো দা ভিঞ্চি। প্রতিভাবান এই মানুষটির বিখ্যাত পেইন্টিং ‘মোনালিসা’ এখনো বিশ্ববাসীকে মোহিত করছে অনবদ্য রহস্যে। ইতালির রেনেসাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা তিনি। বিশ্বজুড়ে তিনি চিত্রকর হিসেবে পরিচিত হলেও এর বাইরে তিনি ভাস্কর, স্থপতি, সংগীত, শারীরিক বিজ্ঞান, প্রকৌশলী, একজন উদ্ভাবক, লেখক এবং বিজ্ঞানী হিসেবে নিজের বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।

লিওর জীবনকাহিনি রোমাঞ্চে ভরপুর। ১৪৫২ সালে লিওনার্দো ফ্লোরেন্সের ভিঞ্চি নগরীর একটি গ্রামে জš§গ্রহণ করেন। বাবা (মেসার পিয়েরো ফরুওসিনো ডি আন্তোনিও দা ভিঞ্চি) ছিলেন জমিদার ও আইনজীবী এবং মা (ক্যাটেরিনা) ছিলেন স্থানীয় দাসী। লিওনার্দো ছিলেন তাদের ভালোবাসার ফসল। যদিও তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি। পাঁচ বছর বয়সে লিওনার্দো বাবার কোলে চড়ে ইতালির ভিঞ্চি গ্রাম থেকে ফ্লোরেন্সে এসেছিলেন। ঘরোয়া লেখাপড়া করলেও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না তার। তাই তো তিনি নিজেকে ‘ওমো সানজা লেটারে’ (অক্ষরবিহীন মানুষ) বলে মনে করতেন। গ্রিক এবং ল্যাটিন শিক্ষায় বেশ দুর্বল ছিলেন লিওনার্দো। গাণিতিক শিক্ষায়ও তার ছিল নানা সমস্যা। তবে প্রকৃতির প্রতি ভীষণ আগ্রহ থাকায় বেশির ভাগ সময় লিওনার্দো বাইরেই কাটাতেন। তবুও তার সৃজনশীলতার অনেক দিক মানবসভ্যতাকে উপকৃত করে চলেছে।

তরুণ লিওনার্দো একটু বড় হলে- তাকে আন্দ্রে ডেল ভেরোচ্চির কাছে শিক্ষার জন্য পাঠানো হয়। ভেরোচ্চির কাছে তিনি কেবল ছবিই আঁকেননি; পাশাপাশি রং মেশানো, ঘর মোছাসহ নানা কাজ করেছিলেন। তবে আর্টিস্ট লিওনার্দো ২০ বছর বয়সে এসে ভেরোচ্চির চোখ ধাঁধিয়ে দিলেন বিখ্যাত ‘দ্য ব্যাপাটিজম অব ক্রাইস্ট’ ছবিটি আঁকায় সাহায্য করে। সেই শুরু। লিওনার্দো তার ‘লাস্ট সপার’, ‘ভার্জিন অব দ্য রকস’, আর ‘মোনালিসা’ এঁকে পুরো চিত্রশিল্পের জগতেই বিস্ময় জাগিয়েছেন। এ ছাড়া একাধারে ভাস্কর, কারিগরি বিজ্ঞানী ইঞ্জিনিয়ারও ছিলেন লিওনার্দো। ফ্লোরেন্সে শিক্ষানবিসি শেষে তিনি মিলানে এসে নতুন করে জীবন শুরু করতে চেয়েছিলেন। এখানে মিলানের ডিউক, লুডোভিকো মিলানের অধীনে কাজ শুরু করেন লিওনার্দো। প্রথমে একটি অতিকায় ঘোড়ার মূর্তি দিয়ে শুরু করলেও পরে বিভিন্ন ‘ওয়ার মেশিন’ তৈরির পরিকল্পনা করেন। এর মাঝে পড়ে কামানের নকশা, স্মোক মেশিন, পোর্ট্রেবল ব্রিজ এমনকি বর্মে ঢাকা বিভিন্ন যানবাহন। তবে এর কোনোটি তৈরি হয়েছিল কি না জানা যায়নি। তিনি উড়োজাহাজ ছাড়াও প্রথম অস্ত্রসজ্জিত গাড়ি, কামান, মেশিনগান, কৃষি খেতে পানি সেচ কার্যক্রম ও প্যারাসুটেরও মডেল এঁকেছেন। তবে তার রহস্যের শিকড় বুঝি মোনালিসাতে আবদ্ধ। বলা হয়, মোনালিসার ঠোঁট আঁকতেই দশ বছর সময় নিয়েছিলেন ভিঞ্চি। মোনালিসা ছবিটি আঁকার সময় কাকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন ভিঞ্চি সেটি কে জানে! বোদ্ধাদের মতে, মডেল হিসেবে হয় লিওনার্দোর মা অথবা ফ্লোরেন্সের জনৈকা ঘেরারদিনি কাজ করেছেন। তবে এখনো এটি প্রমাণিত নয়। এ কথাও বলা হয়, লিও নিজেকে নারীরূপে এঁকে আত্মতৃপ্তি পেতেন। সে নিজে বলেছেন, মোনালিসা ভিঞ্চির প্রতিকৃতি। মোনালিসা শিল্পকর্মটি তার এতটাই সুনিপুণ হয়েছিল যে, মোনালিসাকে কখনো লাজুক, কখনো বেদনা-আক্রান্ত আবার কখনো হাস্যোজ্জ্বল এক সম্ভ্রান্ত নারী মনে হয়। শত শত বছর পরেও ইতালির বিখ্যাত এই চিত্রকরের আঁকা প্রতিটি রহস্য হয়ে থাকল।

 

বিখ্যাত লিওনার্দো

জনপ্রিয়তার শীর্ষে

কোনো কল্পকাহিনির দেবী বা মাতৃমূর্তি বা প্রেমিকার খাঁটি রূপ বা রেনেসাঁ যুগের বিখ্যাত কোনো ব্যক্তিত্ব বা রাজপরিবারের সদস্যের ছবি না। তবুও ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসার পোর্ট্রেটটি এখনো জনপ্রিয়তায় শীর্ষে। মোনালিসাকে বিশ্বের সর্বকালের বিখ্যাত চিত্রকর্ম বলে বিবেচনা করা হয়। মূলত মোনালিসার মুখের আশ্চর্য এক্সপ্রেশনের জন্যই চিত্রকর্মটি এত বিখ্যাত। ৩০ ইঞ্চি-২১ ইঞ্চির বিখ্যাত এই পোর্ট্রেটটি ১৫০৩ থেকে ১৫০৭ সালে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি পপ্লার কাঠের তৈরি সাদা প্যানেলের ওপরে তেল রং দিয়ে এঁকেছিলেন। বিখ্যাত মোনালিসাকে দেখার জন্য প্রতি বছর ৮.৫ মিলিয়ন দর্শনার্থী ল্যুভর মিউজিয়ামে পাড়ি জমান। টিকিটের মূল্য ২২.৪৮ মার্কিন ডলার।

 

পেইন্টিংয়ের রাজ্য

সারা বিশ্বে লিওনার্দো শিল্পী হিসেবেই অধিক পরিচিত ও সমাদৃত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে লিওনার্দো তার সমস্ত জীবনে খুবই অল্পসংখ্যক কিছু শিল্পকর্ম সম্পূর্ণভাবে এঁকেছেন। তবে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন ছেলেবেলা থেকেই। মাত্র ২০ বছর বয়সে শিক্ষক ভেরোচ্চির চোখ ধাঁধিয়ে দেন বিখ্যাত ‘দ্য ব্যাপটিজম অব ক্রাইস্ট’ ছবিটি আঁকায় সাহায্য করে। এখান থেকেই শুরু। ফ্লোরেন্সে শিক্ষানবিসি শেষে লিওনার্দো মিলানে চলে আসেন। ৬৭ বছরের জীবনে তিনি বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছেন তার অসংখ্য সব সৃষ্টি। ১৪৭৮ সালে ‘চ্যাপেল অব সেন্ট বার্নার্ড’ ও ‘অ্যাডোরেশন অব দি ম্যাগি’ এবং ১৪৮১ সালে ‘মঙ্ক অব সান ডোনাটো এ স্কাপিটো’ আঁকেন। ১৪৮২ থেকে ১৪৯৯ সালে তিনি ‘ভার্জিন অব দ্যা রকস্’ এবং ‘দ্যা লাস্ট সাপার’ বিস্ময়কর চিত্রকর্ম করেন। তার আঁকা আরও অসংখ্য শিল্পকর্মের মধ্যে ব্যাপটিজম অব খ্রিস্ট (১৪৭২), গিনেভ দে বেনসি (১৪৭৪-১৪৭৬), ম্যাডোনা অব দ্য কারন্যাশন (১৪৭৮-১৪৮০), লেডি উইথ এন এরমাইন (১৪৮৯-১৪৯০), দ্য ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড (১৫১০) অন্যতম। আর এসবের মধ্যে ১৫০৩ থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত চলা রহস্যময়ী মোনালিসা সবচেয়ে বেশি আলোচিত। লিও তার ‘লাস্ট সপার’, ‘ভার্জিন অব দ্যা রকস্’, আর ‘মোনালিসা’ এঁকে চিত্রশিল্পের জগতে বিস্ময় জাগিয়েছেন।

 

যত উদ্ভাবন

জীবদ্দশায় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি নানা কৌশলে নিজের সব কিছুকে গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, তার এসব ডায়েরি শুধু লেখা নয়; একেকটি ডায়েরি একেকটা গুপ্তধনের খনিতুল্য। যুদ্ধে লিওনার্দোর লেখা, কাগজ ও ডায়েরি নষ্ট হয়। ধারণা করা হয়, তার জীবদ্দশায় ৩০টিরই বেশি ডায়েরি লিখেছিলেন। এ ডায়েরিগুলো সমৃদ্ধ ছিল বিজ্ঞান, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, শল্য চিকিৎসা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে নতুন সব আবিষ্কার ও প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে। এসব ডায়েরির মধ্যে ‘কোডেক্স লিস্টার’ অন্যতম। এর বাইরেও তার উদ্ভাবনগুলো সত্যিই অসাধারণ। উড়োজাহাজ আবিষ্কারের ৪০০ বছর আগে যিনি উড়োজাহাজের মডেল এঁকেছিলেন সেই মানুষটির আবিষ্কারগুলো অসাধারণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার উদ্ভাবনগুলো সে সময়ের জন্য আকাশকুসুম ভাবনা ছিল। সুদূরপ্রসারী এই মানুষটির উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের মধ্যে আধুনিক বল বিয়ারিং, প্যারাসুট, অর্নিথপটার, মেশিন গান, ড্রাইভিং সুট, আর্মার্ড ট্যাঙ্ক, স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, সিটি অব দ্য ফিউচার, এরিয়াল স্ক্রু, রবোটিক নাইট ছিল অন্যতম। এসব কিছুই স্কেচ আকারে তিনি তার নোট বুকে রেখে গেছেন। তার আবিষ্কৃত মেশিন গান অত্যাধুনিক না হলেও বারোটা গুলি ভরা যেত এবং ফায়ার করার পর রিলোড করতে খানিকটা সময় লাগত। লিওর তৈরি ট্যাঙ্কও আধুনিক ট্যাঙ্কের মতো নিখুঁত ছিল না। তবে দুই পাশ থেকে শেল নিক্ষেপ করা যেত। ইতিহাসবিদরা মনে করেন মানবতা ধ্বংসের এই মারণাস্ত্রটি তিনি ইচ্ছা করেই চাননি। বিস্ময়কর হলেও সত্য দ্য ভিঞ্চির স্বয়ংক্রিয় গাড়ি আজকের রোবটদের মতো ছিল। কারণ এর কোনো চালক ছিল না। লিওনার্দো কাজও শুরু করেছিলেন কিন্তু সে সময়ে এত উন্নত ব্যবস্থা ছিল না।

 

মানসম্পন্ন কাজ করতে পারেননি!

১৩ শতক থেকে ১৬ শতক সময়কে ‘রেনেসাঁ যুগ’ বলা হয়। সে সময়ের মেধাবী মানুষগুলোর মধ্যে লিওনার্দো একজন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক শাখায় তিনি নানা নিদর্শন আর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। কিন্তু তার আবিষ্কারগুলোর কোনো বাস্তব রূপ দিয়ে যাননি। লিও মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, ‘আমি ঈশ্বর এবং মানবজাতিকে কষ্ট দিয়েছি। কারণ আমার মানসম্পন্ন কাজ আমি করতে পারিনি’। তাই হয়তো উদ্ভাবনগুলো মূলহীন রয়ে গেল। ইতিহাসবিদদের মতে, তার আবিষ্কারগুলো খুব প্রয়োজনীয় নয়, তা ছাড়া অনেক কাজ অসমাপ্ত থাকায় সেগুলো কোনো কাজে আসেনি। কিন্তু সে সময় তিনি যা উদ্ভাবন করেছিলেন তার বাস্তবায়ন হয়নি কেবলমাত্র উন্নত ব্যবস্থা না থাকার কারণে। লিওনার্দোর নোটবুকে অনেক স্কেচ আঁকা রয়েছে যা বিজ্ঞানসম্মত। তবে বিজ্ঞানসম্মত হলেও লিওর আবিষ্কারগুলো নিখুঁত ছিল না। তার বিভিন্ন নকশা, মেশিন, পোর্টেবল ব্রিজ এমনকি বিভিন্ন যানবাহন। তবে এর কোনোটি আসলে তৈরি করা হয়েছিল কি না এর প্রমাণ মেলেনি।

 

মৃত্যুও তাকে করেছে রহস্যময়

রহস্যের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা লিওনার্দোর জীবন। সৃষ্টিতে নানা রহস্য লুকানো ছাড়াও লিওর মৃত্যু ও সমাধি রহস্য অমীমাংসিত রয়ে গেছে। তার নোটবুকে তিনি লিখেছিলেন, ‘যেমন একটি সুন্দর দিন নিয়ে আসে শান্তির ঘুম, তেমনি সুন্দর জীবন নিয়ে আসে শান্তির মৃত্যু’। ১৫১৯ সালের ২ মে ৬৭ বছর বয়সে মারা যান লিও। কিন্তু মৃত্যু কীভাবে তাকে আঁকড়ে ধরেছিল তা নিয়ে রয়েছে নানা মতবিরোধ। কারও মতে যক্ষ্মা, কেউ বা দাবি করেছেন যৌনব্যাধি? সব কিছুকে ছাড়িয়ে বিজ্ঞানীরা আরও বড় ধাঁধা তৈরি করেছেন। তাদের ভাষ্যমতে, ভিঞ্চিকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে প্রশ্ন যতই উঠুক উত্তর কিন্তু অজানাই। ফ্রান্সের প্রাসাদ গির্জা স্যাঁ ফ্লোরত্যায় সমাধিস্থ করা হয় লিওকে। শতাব্দী কেটে গেল। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে চলছিল বিপ্লবের ঢেউ। সেই ঝড়ে ধ্বংস হয়ে গেল বড় বড় সুন্দর প্রাসাদ, ইমারত সৌধ। মৃত্যু ও সমাধি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তার মেধা ও সৃজনশীলতায় মুগ্ধ বিশ্ববাসী। অথচ লিওর শেষ কথা ছিল, ‘আমি ঈশ্বর এবং মানবজাতিকে কষ্ট দিয়েছি। কারণ আমি আমার মানসম্পন্ন কাজ করতে পারিনি’।

 

অন্যরকম

♦ লিওনার্দো ছিলেন দক্ষ (Lyre) সুরবাহার (প্রাচীন গ্রিসে ব্যবহৃত এক ধরনের তারের যন্ত্র) বাদক হিসেবে। মিলেনিয়ান কোর্টে সুরবাহার বাজানোর সময় লিওকে বিখ্যাত সংগীতশিল্পী মনে হয়েছিল। কোনো চিত্রশিল্পী বা উদ্ভাবক মনে হয়নি।

♦ ইউনিভার্সিটি অব আর্মস্টারডাম এবং দ্য ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়েসের গবেষকরা রহস্যময়ী মোনালিসাকে সফটওয়্যারে ব্যবহার করে জানায়, মোনালিসা ছবিতে ৮৩% সুখী, ৯% বিরক্তিকর, ৬% ভীতিকর এবং ২% রাগান্বিত ভঙ্গি ফুটে উঠেছে।

♦ যে মোনালিসা হাসির জন্য এত বিখ্যাত, সেই মোনালিসার ঠোঁট আঁকতেই লিওনার্দো সময় নিয়েছিলেন ১০ বছর। তবুও মোনালিসা অসম্পূর্ণ ছবি হয়েও বিখ্যাত হয়ে আছে।

♦ আধুনিক ফ্যাশনে কন্ট্যাক্টলেন্স বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু ১৫০৮ সালেই কন্ট্যাক্ট লেন্সের প্রথম প্রস্তাবনা করেছিলেন লিওনার্দো।

♦ ১৯৫৬ সালে এক দর্শক পেইন্টিংয়ের ওপর অ্যাসিড ছুড়ে মারলে এর নিচের অংশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই সালে বলিভিয়ার এক দর্শক মোনালিসাকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে মারে। এর ফলে পেইন্টিংয়ের বা কনুইয়ে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা কিনা পরে ঠিক করা হয়।

♦ লিওনার্দো মজার মানুষ ছিলেন। তিনি ভ্যাটিকানের মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য বাহারি বেশে ঘুরে বেড়াতেন। এ জন্য মাঝে মাঝে মাথায় শিংও লাগাতেন।

♦ সূর্যের আলোর সঙ্গে বায়ুমণ্ডলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিশেষ ধরনের কারণে আকাশ নীল দেখায়। আকাশের রং কেন নীল? এই তত্ত্বটির প্রথম ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন লিও।

♦ তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, অর্ধচন্দ্র অবস্থায় চাঁদ অস্পষ্ট দেখা যায় এবং রাতে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে পতিত হয়। অস্পষ্ট অবস্থায় যতটুকু আলো হয়, তার ৫০ গুণ বেশি আলো হলে পূর্ণ চন্দ্র দেখা যায়। তত্ত্বটি এখন সহজ হলেও ৫০০ বছর আগে সহজ ছিল না।

♦ ইতিহাসের সেরা চিত্রশিল্পীদের মধ্যে লিও একজন হওয়া সত্ত্বেও তার আঁকা মাত্র ১৫টি শিল্পকর্মের অস্তিত্বই কেবল মিলেছে।

 

কী আছে মোনালিসায়?

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা পোর্ট্রেট মোনালিসা সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত চিত্রকর্ম। ছবিটিতে যা ছিল তা এখনো আছে। শত শত বছর পরেও পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ মোনালিসার মুখের সে হাসি কিংবা বলা যায় অসম্পূর্ণ হাসি সেখানে যে তুলির আঁচড়, তাও আলতো করে একটা আরেকটার ওপর দিয়ে গেছেন। মোনালিসার তত্ত্ব ১ এ বলা হয়, ‘তার হাসির অর্থ সে গোপন আন্তঃসত্ত্বা।’ অপূর্ব সেই হাসির পেছনে যা আছে তাও দর্শনার্থীদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। মোনালিসার চোখের ওপর কোনো ভ্রু নেই। সহসা বোঝা দায় যে, আশ্চর্য হাসিটি কী কোনো রহস্যকে আড়াল করছে? হয়তো খুবই সাধারণ। যেমন- তার কোলে হয়তো সে সময় শিশু ছিল। যাই হোক না কেন ছবিতে কিন্তু তার কোনো ছাপ নেই। এমন ধাঁধা তৈরি হওয়ার কারণেই হয়তো মোনালিসা এত বিখ্যাত। অনেকের প্রশ্ন- কে এই মোনালিসা? কয়েক শ বছর ধরে মানুষ কম-বেশি বিশ্বাস করে আসছে দ্য ভিঞ্চির মোনালিসা ফ্লোরেন্সের তৎকালীন এক সিল্ক ব্যবসায়ীর স্ত্রী লিসা গেরারদিনির পোর্ট্রেট। চিত্র ইতিহাসবিদদের অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। তাদের ধারণা, মোনালিসা নিজেই লিওনার্দোর প্রতিকৃতি। তবে ফ্রান্সের একজন গবেষক গত ১০ বছর ধরে গবেষণার পর বলছেন, পোর্ট্রেটের রহস্যময়ী নারী অন্য কেউ ছিলেন। আর এই তত্ত্ব নিয়ে শিল্পী মহলে দারুণ কোলাহল। দ্য ভিঞ্চি মোনালিসার পোর্ট্রেটটি নিয়ে কাজ করেছিলেন ১৫০৩ সালে এবং তা চলে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত। শুরু করেছিলেন ইতালির ফ্লোরেন্সে, তারপর ফ্রান্সে। তবুও মোনালিসার ছবিটি অসম্পূর্ণই রয়ে যায়। পোর্ট্রেটটি লিসা গেরারদিনির নয়, এই তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করেন ফরাসি বিজ্ঞানী পাসকাল কোট। ২০০৪ সালে ল্যুভর কর্তৃপক্ষ তাকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে পোর্ট্রেটটির ছবি তোলার সুযোগ করে দেয়। তারপর এত বছর ধরে বিশেষ আলো এবং লেন্সের প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষণার পর বিজ্ঞানী বলেছেন, ‘পোর্ট্রেটের নারী লিসা গেরারদিনি নন, অন্য কেউ।’ ফরাসি এই বিজ্ঞানী বলেছিলেন, ‘শিল্পীর প্রতিটি আঁচড় পিঁয়াজের খোসার মতো পরতে পরতে দেখা যায়। কোনো ছবি নিয়ে প্রথম থেকে পর্যায়ক্রমে শিল্পী কীভাবে এগিয়েছেন তা আমরা বুঝতে পারি।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ক্যানভাসের মোনালিসার পেছনে ভিন্ন ভিন্ন তিনটি ছবি। তৃতীয় ছবিটি অন্য এক নারীর মুখ, ঠোঁটে কোনো হাসি নেই।’ এই বিজ্ঞানী একরকম নিশ্চিত ক্যানভাসে খালি চোখে না দেখতে পাওয়া সেই মুখই লিসা গেরারদিনির। মোনালিসার রহস্য কী আবারও নতুন মোড় নিয়েছে? পেইন্টিং ইতিহাসবিদ অ্যান্ডরু গ্রায়াম ডিক্সন বলেছেন, পাসকাল কোটের তত্ত্ব গত ১০০ বছরে শিল্প জগতের সাড়া জাগানো খবর। লিওনার্দো নিয়ে গবেষকরা এই তত্ত্বকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তারা বলেন, দ্য ভিঞ্চি লিসা গেরারদিনির মুখের ওপর অন্য নারীকে এঁকেছিলেন।

 

বিজ্ঞান ও শিল্পে সৃজনশীলতা

শত শত বছর ধরে, প্রতিটি প্রজন্ম লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। আজও তার প্রতিভায় মুগ্ধ বিশ্ববাসী। তিনি ছিলেন এক প্রতিভাবান ‘সর্বজনীন মানুষ’। কারণ, শিল্প, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে তার আগ্রহ, গণিত এবং রসায়ন থেকে জ্যোতির্বিদ্যা পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে ছিলেন অনবদ্য। ১৮ শতাব্দীতে তার বিজ্ঞানবিষয়ক কার্যক্রম অ্যারিস্টোটেলিয়ান দোভাষীদের দ্বারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তার হাত ধরে মানবসভ্যতা জানতে পেরেছিল প্রকৃতির চারটি শক্তি- ভর, ওজন, নড়াচড়া এবং আঘাত। যদিও তখনকার দিনে তিনি বিশ্ববাসীকে প্রকৃতির এসব শক্তিগুলো বোঝাতে রীতিমতো সংগ্রাম করেছিলেন। এ ছাড়া লিওনার্দো বিজ্ঞান, শিল্প এবং প্রকৌশলকে এক অনন্য উপায়ে একত্রিত করেছিলেন। লিওনার্দো মনে করতেন, শিল্পীর সৃজনশীল, মহৎ উদ্দেশ্য হলো- প্রাকৃতিক জগতকে চিত্রিত করা। তার মতে, শিল্পীকে অবশ্যই একজন বিজ্ঞানীর মতো সমগ্র বিশ্বকে বুঝতে হবে। তথ্য ও প্রযুক্তিতে ক্রমবর্ধমান আধুনিকায়ন আজকের বিশ্বকে যে আকার দিচ্ছে, তিনি কয়েক শতাব্দী আগে তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। পাশাপাশি মানুষ ও প্রাণীর শরীর নিয়ে তার কৌতূহল ছিল অনেক বেশি। চামড়ার নিচের শরীরের সমস্ত কিছুই তিনি দেখতে চেয়েছিলেন একদম গভীর থেকে। এ কৌতূহল ও আগ্রহ থেকে সিদ্ধান্ত নেন নিজেই শবদেহগুলোর ব্যবচ্ছেদ করবেন। ধারণা করা হয়, জীবদ্দশায় তিনি ৩০টির মতো শবদেহের ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন। এর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তিনি লিখে রাখার পাশাপাশি অ্যানাটমির নিখুঁত বর্ণনাও এঁকে গিয়েছিলেন। যা চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে এক বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে। ব্যবচ্ছেদের জন্য লিওনার্দো ইতালির মিলান, রোম ও ফ্লোরেন্স শহরের হাসপাতালে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেখানেই শবদেহের ওপর করতেন তিনি অস্ত্রোপচার। তার মাধ্যমে বিশ্ব জানতে পারে, মানবশরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে মস্তিষ্ক, ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ড।

 

১৯১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর মোনালিসা উদ্ধারের পর ফ্রান্সের লি পেটিট জার্নালের করা কাভার। (বাঁয়ে) চুরির দায়ে অভিযুক্ত ইতালীয় পেইন্টার ভিনসেনজো প্যারোজা, আদালত তাকে ১৮ মাসের সাজা দেয়। (ডানে)

যেভাবে চুরি হয় মোনালিসা

ঠিক কোন সময়ে ভিঞ্চি মোনালিসা আঁকা শুরু করেছিলেন সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে গবেষকরা ধারণা করছেন, ১৫০৩ সাল থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে ছবিটি এঁকেছিলেন তিনি। ভিঞ্চির ডান হাত ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৫০৫ সালে। যে কারণে মোনালিসার অঙ্কন অসম্পূর্ণ থেকে গেছে বলে গবেষকদের ধারণা। তবে বিখ্যাত পেইন্টিং মোনালিসা কীভাবে চুরি হয়েছিল সে সম্পর্কে তৎকালীন পত্রিকাগুলো বিষদ তথ্য প্রকাশ করেছিল। আজ জানব চুরি যাওয়া মোনালিসার গল্প।

১৯১১ সালের ২১ আগস্ট সকাল ৭টা ২০ মিনিট। প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে বিখ্যাত মোনালিসা নিখোঁজ হয়ে যায়। তখন এক লোক মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে আসে। কেউই ভাবতে পারেনি লোকটি চোর। দেয়ালে ফ্রেমবন্দি মোনালিসাকে নামিয়ে ফ্রেমটি খুলে ফেলে নিজের জামার ভিতরে লুকিয়ে বেরিয়ে যায়। প্রথমে ব্যাপারটি কেউই আঁচ করতে পারেনি। সবাই ভেবেছিল হয়তো পরিষ্কার করার জন্য মোনালিসা বা ছবি তোলার জন্য নিয়ে গেছে। দর্শনার্থীরা ধারণা করে এটি জাদুঘরেরই কোথাও আছে। সারা দিন মোনালিসা ফিরে না পাওয়ায় ওই দিন রাত ১১টায় পুরো জাদুঘরে তল্লাশি চালানো হয়। তল্লাশি করে খুঁজে না পেয়ে পরদিন সকালে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ প্রধান মোনালিসার সাড়ে ৬ হাজার প্রিন্টিং কপি পুরো শহরে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। উদ্দেশ্য মোনালিসা সম্পর্কে মানুষের মনে ভালোবাসা তৈরি করা। চুরির ঘটনা গণমাধ্যমগুলো বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। সব মিলিয়ে পুলিশি তদন্তও বাড়তে থাকে। পুলিশি তদন্তে সে সময়কার বিখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসো এবং কবি অ্যাপ্লিনায়েরকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু মোনালিসা মেলে না। আড়াই বছর পর মোনালিসাকে তার জš§স্থান ফ্লোরেন্সেই খুঁজে পাওয়া যায়। মোনালিসাকে চুরি করেছিল ইতালীয় ভিনসেনজো প্যারোজা। তিনি একজন পেইন্টার। তবে তিনি মূলত ঘর সজ্জার কাজ করেন। তিনি ল্যুভর জাদুঘরে কিছু সময়ের জন্য কাজ করেছিলেন। শিল্পটি বিক্রি করতে গেলে তিনি ধরা পড়েন। আদালত তার ১৮ মাসের সাজা দেয়। চুরির দায়ে প্যারোজা জেল খেটেছেন ঠিকই কিন্তু কী কারণে মোনালিসাকে চুরি করেছিলেন সে সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ খবর