বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

অবৈধ দখলদার ইসরায়েল

আবদুল কাদের

অবৈধ দখলদার ইসরায়েল

১৯৪৮ সালে জন্মলাভ করে ইসরায়েল। যদিও ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা নিয়ে যেমন বিতর্ক রয়েছে, তেমনি বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের আপত্তি রয়েছে তাদের দখলদারিত্বপূর্ণ আচরণে। শান্তিপ্রিয় জাতি ফিলিস্তিনিদের দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য পৃথিবীর এমন কোনো আইন নেই যা ইসরায়েল অবজ্ঞা করেনি। এমন কোনো নৃশংসতা নেই যা ফিলিস্তিনিদের ওপর প্রয়োগ করেনি। চল্লিশের দশকে প্রতিষ্ঠার পর ফিলিস্তিনের মধ্যকার সমস্যা যতটুকু ছিল একবিংশ শতকে এসে সেই সমস্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কয়েক গুণ। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে চলা এই সংঘাতের এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। সময় যত গড়িয়েছে, এই দুই দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে তত বেড়েছে সহিংসতা। দখলদাররা হয়েছে আরও হিংস্র। অবৈধ দখলদার ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নিয়ে এই রকমারি...

 

আরবদের হটিয়ে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা

জায়নবাদের উত্থান :

উনিশ শতকের আশির দশকে ইউরোপে ইহুদি সম্প্রদায় ব্যাপক বিদ্বেষ ও নির্যাতনের শিকার হতে থাকে। যার ফলে ইহুদিদের মধ্যে এক মতবাদের জন্ম দেয়, যার নাম জায়নবাদ। ১৮৯৭ সালে গড়ে ওঠে জায়নবাদী সংঘ। প্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেসে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র পত্তনের লক্ষ্য ধার্য করা হয়। এই লক্ষ্য অনুযায়ী ১৯০২ সালের মধ্যেই ৩৫ হাজার ইহুদি চলে আসে ফিলিস্তিনে। তাদের হাতেই জন্ম হয় আজকের ইসরায়েল। তখন ইসরায়েলে ছিল মুসলিম নিয়ন্ত্রিত একটি ভূখণ্ড। ১৯১৪ সালের মধ্যেই আরও ৪০ হাজার ইহুদি এ এলাকায় আসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিরা সমর্থন দেয় জার্মানিকে। কারণ, তারা শত্রু রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ছিল। জায়নবাদীরা চাইছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সমর্থন পেতে। ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ তত দিনে ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন। ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর ইহুদি কমিউনিটির নেতা রথসচাইল্ডকে চিঠি দেন, যা বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত। ব্রিটিশরা ১৯১৭ সালে এই বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য ‘ইসরায়েল’ রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকার করে। ১৯২২ সালে বেলফোর ঘোষণায় পরোক্ষ সমর্থন দেয় তৎকালীন লিগ অব ন্যাশনস। ১৯২৩ সালের মধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তৃতীয় আলিয়ার (সারা বিশ্ব থেকে ইহুদিদের ইসরায়েলে আসা) ঘটনা ঘটে। এই পর্যায়ে ৪০ হাজার ইহুদি ফিলিস্তিনে আসে। আর ১৯২৯ সালের মধ্যে চতুর্থ আলিয়া হয়। এই পর্যায়ে আসে আরও ৮২ হাজার ইহুদি। ১৯৪০-এর দশকের মধ্যে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে যেতে শুরু করে এবং তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফিলিস্তিনে তখন ইহুদি-আরবদের মধ্যে সহিংসতা শুরু হয়। একই সঙ্গে সহিংসতা বাড়ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধেও।

 

যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরায়েল :

১৯৪০ সালের পরবর্তী সময়। জার্মানির স্বৈরাচারী এডলফ হিটলার ইউরোপের সব ইহুদি নিধনের পণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে। প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা করে হিটলার। বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে ইহুদিরা আবার এখানে সেখানে শরণার্থী হতে থাকে যার বিশাল একটা সংখ্যা আবার ফিলিস্তিনের দিকেই আসে। আর তৎকালীন ফিলিস্তিন ছিল গ্রেট ব্রিটেনের অধিকারে। এর ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন নামের যে এলাকা, সেটি ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পরাজয়ের পর ব্রিটেন ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন ফিলিস্তিনে যারা থাকত তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল আরব, সেই সঙ্গে কিছু ইহুদি, যারা ছিল সংখ্যালঘু। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে এক ভোটাভুটিতে ফিলিস্তিনকে দুই টুকরো করে দুটি পৃথক ইহুদি এবং আরব রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হলো। যেখানের প্রায় ৫৫ শতাংশ দেওয়া হয় ইহুদিদের এবং প্রায় ৪৫ শতাংশ দেওয়া হয় ফিলিস্তিনকে। আরবদের বিরোধিতা সত্ত্বেও পরিকল্পনাটি এগিয়ে যায়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের নীলনকশায় ইহুদিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই ১৯৪৮ সালের ১৪ মে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরায়েল। এ দিন ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনের ম্যানডেট ছেড়ে দেয়। ওই দিনই ইহুদি নেতারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। পরদিন আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়। উপরন্তু প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্রের একটা বড় অংশ দখল করে ইসরায়েল। সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয়। ইহুদি ধর্মগ্রন্থের প্রথম খণ্ড ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ (তানাখ) অনুসারে, বর্তমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ভূখণ্ড হলো ইহুদিদের ‘প্রমিজড ল্যান্ড’, যেটা ঈশ্বর নবী আব্রাহাম ও তার বংশধর ইহুদি সম্প্রদায়কে দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। মূলত ঈশ্বর প্রতিশ্রুত সেই ‘প্রমিজড ল্যান্ড’ উদ্ধারের নামেই ইসরায়েলিরা বছরের পর বছর ধরে আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে অবৈধভাবে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে, করে চলেছে একের পর এক ভূমি দখল।

 

তিন ধর্মের পবিত্র স্থান জেরুজালেম :

১৯৬৭ সালে জেরুজালেম অবৈধভাবে দখল করে ইসরায়েল। এখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের পদে পদে অধিকার লঙ্ঘন ও খর্ব করছে ইহুদিবাদীরা। এই অবস্থা পরিবর্তনের বাস্তব কোনো আশাবাদ দৃশ্যমান নেই। জেরুজালেমের পুরনো শহরে ইসলাম, খ্রিস্ট ও ইহুদি ধর্মের অনুসারীরা প্রতিদিনই প্রদক্ষিণ করেন। জেরুজালেমের ধর্মীয় তাৎপর্য তাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই শহরের ধর্মীয় তাৎপর্য ৩ হাজারের বেশি বছরের। তিন ধর্মের কাছেই শহরটির তিনটি স্থাপনা পবিত্র বলে স্বীকৃত। মনে করা হয়, এই শহরের খুব কাছেই ইব্রাহিম (আ.) তাঁর ছেলেকে নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন। শহরের একটু বাইরেই জন্ম হয় যিশুখ্রিস্টের। এই শহরের পথ ধরে হেঁটে গেছেন তিনি, এখানেই তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। ইসলামের নবীদের শহর এই জেরুজালেম। আল-আকসা মসজিদ, যা পরিচিত টেম্পল-মাউন্ট নামে। ইসলামে মক্কা মদিনার পরেই জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ পবিত্রতম স্থান। মক্কার আগে, এই মসজিদের দিকে ফিরেই প্রার্থনা করা হতো। ইহুদিদের বেলায় এই আল-আকসা মসজিদের কম্পাউন্ড টেম্পল মাউন্ট নামে পরিচিত, তাদের সবচেয়ে পবিত্র স্থান। এখানেই তাদের দুটি টেম্পল ছিল, যা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইহুদিদের বিশ্বাস- তাদের শেষ টেম্পল এখানেই তৈরি হবে।

 

ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা ও মহাবিপর্যয় :

ব্রিটিশরা এই সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ছাড়ে। ইহুদি নেতারা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। বহু ফিলিস্তিনি এর প্রতিবাদ জানান এবং এরপর যুদ্ধ শুরু হয়। প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সৈন্যরাও যেখানে যায় যুদ্ধ করতে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে তখন হয় তাদের ঘরবাড়ি ফেলে পালাতে হয় অথবা চলে যেতে বাধ্য করা হয়। ফিলিস্তিনিরা এই ঘটনাকে ‘আল নাকবা’ বা ‘মহাবিপর্যয়’ বলে থাকে। পরের বছর এক যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে যখন যুদ্ধ শেষ হলো, তত দিনে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের বেশির ভাগ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। জর্ডান দখল করেছিল একটি অঞ্চল, যেটি এখন পশ্চিম তীর বলে পরিচিত। আর মিসর দখল করেছিল গাজা। জেরুজালেম নগরী ভাগ হয়ে যায়। ইসরায়েল দখল করে নগরীর পশ্চিম অংশ, আর জর্ডানের বাহিনী পূর্ব অংশ। দুই পক্ষের মধ্যে যেহেতু কখনোই কোনো শান্তিচুক্তি হয়নি, পরের দশকগুলোতে দুই পক্ষের মধ্যে এরপর আরও বহু যুদ্ধ হয়েছে।

 

১৯৪৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডে ইসরায়েলের ক্রমান্বয়ে দখলদারির চিত্র

নির্বিচারে ভূমি দখল

বর্তমান সময়ে বিশ্বে চলমান সংঘাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও দীর্ঘতম হচ্ছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে চলা এই সংঘাতের এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। কালের পরিক্রমায় ইসরায়েল এখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ হলেও ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বাধীনতা এখনো অধরাই রয়ে গেছে। বরং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে দখল করে নিয়েছে আরব ফিলিস্তিনিদের ভূমি। এই অবৈধ দখলদারিত্বের সর্বশেষ উদাহরণ- ২০২১ সালের হামাস-ইসরায়েল সংঘাত। সেবার ফিলিস্তিনে জর্ডান ভ্যালির ৯০ শতাংশ ভূমি দখল করে নিয়েছে ইসরায়েল। এই দখলদারিত্বের বীজ বপন হয়েছিল ১৯৪৬-১৯৪৭ সালে। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের অধিকাংশ ভূমি দুই-তৃতীয়াংশের বেশি (৭৭ শতাংশ) দখল করে নেয়। ১৯৪৯-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত বারবার ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে নিয়েছে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ইসরায়েল যেসব ফিলিস্তিনি এলাকা দখল করে নিয়েছিল, সেখানে তারা স্থায়ী ইহুদি বসতি গড়ে তোলে। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বড় ধরনের লড়াই হয় ২০০৮, ২০০৯, ২০১২, ২০১৪, ২০২১ এবং ২০২৩ সালে। প্রতিটি সংঘাতে ইসরায়েল অস্ত্রের মুখে ফিলিস্তিনিদের বাড়ি দখল করে নিয়েছে। এমনকি কৃষিজমিও দখল করে ইসরায়েলের সম্প্রসারণ করছে ইহুদিরা। ফলে ফিলিস্তিনিরা আজ তাদের নিজেদের ভূমিতেই ভুগছে অস্তিত্ব সংকটে।

 

১৯৪৮ সালে সংঘটিত যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিনি আরবদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়


১৯৫০ সালে সিনাই অভিযানে ইসরায়েলি সৈন্যরা গাজা দখল করে নেয়


১৯৬৭ সালে ইসরায়েল এবং আশপাশের বাকি আরব দেশগুলোর যুদ্ধ বাধে


১৯৭৩ সালে মিসর ও সিরিয়া একত্রে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করে


‘প্রথম ইন্তিফাদা’ বা প্রথম গণজাগরণের আন্দোলন হিসেবে পরিচিত


‘দ্বিতীয় ইন্তিফাদা’ : প্রেক্ষাপট ছিল অ্যারিয়েল শ্যারনের আল-আকসা মসজিদে সফর

জন্মের পর থেকেই লাগামহীন ইসরায়েলি বর্বরতা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বর ও আইন অমান্যের জাতি হিসেবে ইসরায়েল পরিচিত। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র জন্মের পর থেকে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের ওপর ইহুদিবাদী ইসরায়েলিরা বারবার বর্বরতা চালিয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দখলদার ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। এমনকি মাঝে মধ্যে বড় ধরনের কয়েকটি যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছে। ইসরায়েল নতুন করে ফের ফিলিস্তিনে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে।

দশকের পর দশক ধরে এমন বর্বরতা চলছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ- হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ। এ বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের আকস্মিক হামলার পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে আসছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য, ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলায় ৫ হাজার ৭০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। গত মঙ্গলবার এক দিনেই প্রাণ গেছে ৭ শতাধিক মানুষের। জাতিসংঘের হিসাবে, গাজায় বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ। কেবল এবারই প্রথম নয়, এর আগেও অসংখ্যবার ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বরতা ও ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে ইসরায়েল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেঁচে যাওয়া ইহুদিরা ১৯৪৮ সালে সেখানে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। ফিলিস্তিনিদের কাছে দিনটি হচ্ছে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়ের দিন। এ সময় সংঘটিত যুদ্ধে ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি গৃহহীন হয়েছিল। সে সময় ইহুদিদের সামরিক আগ্রাসন, আরব গ্রামগুলোতে হামলা, দেইর ইয়াসিন গণহত্যার মতো গণহত্যার আশঙ্কায় এই যুদ্ধ হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে আরবদের পরাজিত করে ইসরায়েল বিস্তৃত এলাকা দখল করে নেয়। দখলদাররা নিজ ভূমি থেকে অসংখ্য ফিলিস্তিনিকে বিতাড়িত করে। একইভাবে ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হয়েছিল, ১৯৭৩ সালে সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভূমি নিয়ে এবং ১৯৮২ সালের যুদ্ধ হয়েছিল লেবাননের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে। বারবার সংঘাতে জড়িয়েছে ইসরায়েল। প্রতিটি সংঘাতে ইসরায়েলের সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে লাখো ফিলিস্তিনি।

সাত দশক পর এখন ইসরায়েল বিশ্বের শুধু পারমাণবিক শক্তিধর দেশই নয়; বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রভাব খাটানো দেশগুলোরও একটি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্য মিত্রদের প্রত্যক্ষ মদদে ফিলিস্তিনিদের ওপর চালিয়ে আসছে নির্যাতন, নিপীড়ন, দখলদারি ও অস্ত্রবাজি। উদাহরণ স্বরূপ- ২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের সময় ২ হাজার ২০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে ৫৫৬ জন ছিল শিশু। বছর দুই আগে আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানই জেরুজালেমে সার্বভৌমত্ব ও ধর্ম নিয়ে সহিংসতার কারণ হিসেবে কাজ করেছে। ওই ঘটনায় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে শুরু হওয়া লড়াই ১১ দিন স্থায়ী হয়েছিল। সেবারও গাজা উপত্যকা নিরীহ ফিলিস্তিনিদের রক্তে রঞ্জিত হয়। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বড় ধরনের লড়াই হয় ২০০৮, ২০০৯, ২০১২, ২০১৪, ২০২১ এবং ২০২৩ সালে।

 

প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ

আরব-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব বিশ্বের সবচেয়ে জটিল রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর একটি। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই এই দ্বন্দ্ব চলে আসছে এবং এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রকৃত সুরাহা হয়নি। ১৯৪৮ সালে মাত্র এক দিন বয়সী রাষ্ট্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে মিসর, জর্ডান, সিরিয়া এবং ইরাক। তাদের সঙ্গে পরবর্তীতে যোগ দেয় সৌদি আরব, মরক্কো, ইয়েমেন এবং সুদান। সদ্য জন্ম নেওয়া ইসরায়েল রাষ্ট্রের অধিবাসীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বর্বরতা ভোলেনি। তাই ইসরায়েলিরা জানত তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এবার তারা প্রাণপণে লড়াই না করলে দুনিয়া থেকে ইহুদিদের নাম মুছে যেতে পারে। তাই তারা তাদের সমগ্র শক্তি দিয়ে সে যুদ্ধ লড়ে যায়। প্রায় এক বছর চলে বন্ধ হয় এই যুদ্ধ। ইসরায়েলিরা পরাজিত করে কেবল চারটি আরব রাষ্ট্রকে। এই রাষ্ট্রগুলো হলো- মিসর, সিরিয়া, জর্ডান ও ইরাক। বাকিরা সেভাবে যুদ্ধে জড়ায়নি। সুতরাং ইসরায়েল পুরো আরব বিশ্বকে পরাজিত করেনি, তারা পরাজিত করেছে আরব বিশ্বের একটি অংশকে।

 

ছয় দিনের ঐতিহাসিক যুদ্ধ

১৯৬৭ সাল নাগাদ ইসরায়েল একটি দক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তোলে এবং পরমাণু শক্তি অর্জনের কাছাকাছি চলে যায়। কিন্তু সে বছর আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ বাধে। যা দ্বিতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ নামে পরিচিত। সে সময় আরব দেশগুলো ইসরায়েলিদের সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে জানত না। মাত্র ছয় দিনে ইসরায়েল আরব বিশ্বের মিসর, জর্ডান ও সিরিয়াকে পরাজিত করে। ইসরায়েলিরা সেবার একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে চায়নি। কিন্তু জর্ডান ও সিরিয়া মিসরের পক্ষে নেমে গেলে যুদ্ধ দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। এই সিদ্ধান্তের জন্য আরব দেশগুলোকে চড়া মূল্য দিতে হয়। স্রেফ ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল সিনাই উপদ্বীপ, গাজা উপত্যকা, গোলান উপত্যকা, পশ্চিম তীর ও পুরো জেরুজালেম দখল করে নেয়। ফলে দেখা গেল, নতুন ইসরায়েল পুরনো ইসরায়েলের তিন গুণ হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল চিরস্থায়ী রাষ্ট্রে পরিণত হয়, যেটা ১৯৪৮ ও ১৯৫৬ সালের যুদ্ধে সম্ভব হয়নি। এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন ইসরায়েলের সামরিক অফিসার আইজ্যাক রবিন এবং মিসরীয় সেনাবাহিনীর মেজর গামাল আবদুল নাসের।

 

ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি যেসব দেশ

বিশ্বের অনেক দেশ ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও এখনো অনেক দেশ তা দেয়নি। এমনকি তাদের সঙ্গে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থান করেনি। সম্প্রতি সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জের ধরে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘর্ষ বাধে। ফলে স্থগিত হয়ে পড়ে সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ। সর্বশেষ ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সৌদি আরবের মিত্র দেশ বাহরাইন, আমিরাতের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে ইসরায়েল। এ ছাড়া আফ্রিকার মুসলিম দেশ মরক্কোর সঙ্গেও ইসরায়েল শান্তি চুক্তি করতে পেরেছে। এসব দেশের মধ্যে যেমন আছে ইসলামিক দেশ, তেমনি আছে অনেক অনৈসলামিক দেশও। তবে অধিকাংশ মুসলিম দেশ মনে করে, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড অন্যায়ভাবে দখল করে রেখেছে ইসরায়েল। আর এ জন্য ইসরায়েল রাষ্ট্রকে তারা স্বীকৃতি দেয়নি। তাদের মধ্যে রয়েছে- দক্ষিণ এশিয়ার দেশ আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ, উত্তর আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়া। ইসরায়েলের সঙ্গে ভুটানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি ব্রুনাই। জিবুতি ও কোমোরোস দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, মরক্কো, উত্তর কোরিয়া, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সোমালিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো সম্পর্ক নেই।

 

দখলদার ইসরায়েলের পরম মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি বিদেশি সহায়তা পেয়ে থাকে ইসরায়েল। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র জন্ম হওয়ার পর সবার আগে তাদের স্বীকৃতি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন হ্যারি এস ট্রুম্যান। জন্ম থেকেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের একতরফা সমর্থন দিয়ে আসছে। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে মিসর, সিরিয়া ও জর্ডানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে ইসরায়েলি বাহিনী। এ যুদ্ধে ইহুদি রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনের বাকি ঐতিহাসিক জায়গা দখল করে নেয়। এর বাইরে সিরিয়া ও মিসরের কিছু অঞ্চল দখল করে। তখন থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র দ্ব্যর্থহীনভাবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। সব অন্যায় অভিযানকে সমর্থন দিয়ে আসছে। কেবল মার্কিন সরকারের সমর্থন নয়, জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৫৮ শতাংশ নাগরিক ইসরায়েলিদের প্রতি সহানুভূতিশীল।

 

ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সংঘটিত পাঁচটি যুদ্ধ

অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষ নিজেদের দেশে যাযাবর হয়ে যায়। যা মেনে নিতে পারেনি আরব বিশ্ব। এরপর থেকেই শুরু হয় আরব-ইসরায়েল সংঘাত। এ পর্যন্ত ইসরায়েল ও আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পাঁচটি যুদ্ধ হয়েছে। এদের মধ্যে প্রথম যুদ্ধের (১৯৪৮-১৯৪৯) বিষয়বস্তু ছিল- ফিলিস্তিন এবং কেবল এই যুদ্ধেই আরব রাষ্ট্রগুলোর উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলকে ধ্বংস করে দেওয়া। অন্য যুদ্ধগুলোর মূল কারণ ফিলিস্তিন ছিল না। ১৯৫৬ সালের যুদ্ধ হয়েছিল সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে; ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ হয়েছিল আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের তীব্র দ্বন্দ্ব এবং ইসরায়েলের সম্প্রসারণবাদের কারণে; ১৯৭৩ সালের যুদ্ধ হয়েছিল সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভূমি নিয়ে এবং ১৯৮২ সালের যুদ্ধ হয়েছিল লেবাননের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে। চারটি যুদ্ধে ফিলিস্তিন ছিল মূলত একটি গৌণ ইস্যু।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর