রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

রামোজি ফিল্ম সিটির কল্পকাহিনি

রামোজি ফিল্ম সিটির কল্পকাহিনি

শৈশবে কি কারও এমন মনে হতো টেলিভিশনের ওই বাক্সের মধ্যে কীভাবে মানুষগুলো ঢুকল, কীভাবেইবা তারা খাবার খায়, নাচে-গায়। ধীরে ধীরে সিনেমা শব্দের সঙ্গে পরিচয়। কীভাবে তৈরি হয় সিনেমা, এ ম্যাজিক যেন আজও অধরা। ভারত সফররত বাংলাদেশের সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সুযোগ হয়েছিল হায়দরাবাদের রামোজি ফিল্ম সিটি ঘুরে দেখার। সিনেমা তৈরির পেছনের গল্প জানার সুযোগ ছিল হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। ২ হাজার একরজুড়ে গড়ে ওঠা সিনেমার এ স্বর্গরাজ্য স্বাগত জানায় দর্শনার্থীদের। রামোজি ফিল্ম সিটি ঘুরে এসে ক্যামেরার পেছনের গল্প তুলে ধরেছেন, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জয়শ্রী ভাদুড়ী ও নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী; কাজী শাহেদ।

 

কৃত্রিমতায় গড়ে ওঠা স্বপ্নপুরী

দুপুরের কিছু সময় পর রামোজি ফিল্ম সিটির কাছাকাছি হাইওয়েতে এসে থামল বাস। ফিল্ম সিটির অফিস কক্ষে সাংবাদিক প্রতিনিধি দল। যে যেভাবে পারছেন পরিচালকের চেয়ারে বসে ক্যামেরায় চোখ রেখে ছবি তুলতে ব্যস্ত। এরই মধ্যে প্রত্যেকের জন্য সংগ্রহ করা হলো পাস। নীল স্টিকার সেঁটে দেওয়া হলো প্রত্যেককে। এরপর সবাই বাসে চেপে বসল রামোজি ফিল্ম সিটি ঘুরে দেখতে। নির্ধারিত ফিল্ম সিটির বাসে গাইড হিসেবে উঠলেন কলকাতার মেয়ে সোম দত্তা।

বাসে চেপেই অনেকের কৌতূহল ফিল্ম সিটি নিয়ে। কে বানিয়েছেন এ ফিল্ম সিটি, জমির পরিমাণ কত এমন নানা প্রশ্নে জর্জরিত সোম দত্তা। সোম দত্তা মাইকটা হাতে নিলেন। এরপর নির্ধারিত স্থানে গিয়ে জানাতে শুরু করলেন রামোজি ফিল্ম সিটির আদ্যোপান্ত।

চমৎকার বাংলায় ফিল্ম সিটি দেখিয়ে বর্ণনা দিতে থাকলেন তিনি- ‘এই যে বাঁয়ে খালি সবুজ সুন্দর মাঠটা দেখছেন- এখানেই ডার্টি পিকচারের সেই বিখ্যাত গানটার শুটিং হয়েছিল- ‘উ লা লা’ সোম দত্তা মিষ্টি হাসলেন।

পাহাড়ি ও আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগোতে থাকে গাড়ি, সোম দত্তা দেখিয়ে চললেন একের পর এক শুটিংয়ের বাড়ি, হাসপাতাল, আদালত, ট্রেন স্টেশন, সেন্ট্রাল জেল, ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, হেলিপ্যাড, বিমানবন্দর, এমনকি বিদেশি বিভিন্ন এলাকার রাস্তা-ভবন-নিদর্শক ইত্যাদি। ফিল্ম সিটির বিস্ময়কর চিত্র যেন সবার গা ঝাড়া দিয়ে চঞ্চল করে দিল। ফিল্ম সিটি তো নয়, যেন এক খণ্ড বিশ্ব।

তেলেগু চলচ্চিত্র প্রযোজক, ব্যবসায়ী, ইটিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র চেরুকুরী রামোজি রাওয়ের চিন্তাপ্রসূত এ ফিল্ম সিটি। হায়দরাবাদ শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে প্রায় ২ হাজার একর জমির ওপর ১৯৯৬ সালে নির্মিত এ সিটি যেন বাস্তব আর কল্পনা এবং প্রকৃতি ও কৃত্রিমতার মিশেলে গড়ে তোলা এক স্বপ্নপুরী। ছিমছাম পরিচ্ছন্ন রাস্তা, সবুজ ঘাসের গালিচা আর নানান রকমের ফুলের বাগানে এ সিটি যেন দক্ষ শিল্পীর নিপুণ হাতে আঁকা এক নয়নাভিরাম চিত্রপট। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি অনুযায়ী, এ ফিল্ম সিটির স্টুডিওই বিশ্বের সর্ববৃহৎ ফিল্ম স্টুডিও কমপ্লেক্স।

সোম দত্তা বলে চললেন, এখানে শুটিংয়ের সেট হিসেবে এমন বাড়ি আছে যার একেক পাশে একেক রকম নকশা এবং আলাদা দরজা, সেই একই বাড়িতে আলাদা দরজা ব্যবহার করে নায়ক-নায়িকাদের আবাসসহ একাধিক বাড়ির শুটিং শেষ করা হয়ে থাকে। আবার এমনও ভবন আছে, যেটা কোর্ট হিসেবেও ব্যবহার হয়, আবার অফিসকক্ষ হিসেবেও ব্যবহার হয়ে থাকে। কোনো হাসপাতালের সেট ব্যবহার হয় মানসিক থেকে শুরু করে সব রকমের অসুস্থতার হাসপাতাল হিসেবেও।

ফাঁকে ফাঁকে সোম দত্তা দেখিয়ে চলেন, ‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’ চিত্রায়ণের সেই হাসপাতাল, ‘মাগাধীরা’ সিনেমার ফাইটিং দৃশ্য ধারণের সেই রাস্তা, ‘রাওয়ান’ সিনেমার ফাইটিং দৃশ্য ধারণের মাঠ। হাসতে হাসতেই তিনি বলেন, কোনো নির্মাতার যদি বাজেট কম হয়, কিন্তু তিনি বিদেশি, বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকার লোকেশন দেখাতে চান চলচ্চিত্রে, তবে তারও ব্যবস্থা আছে এ ফিল্ম সিটিতে।

সোম দত্তার ভাষ্য অনুযায়ী, বিদেশি শহরগুলোর আদলে গড়ে তোলা বিস্ময়কর এভিনিউটির নাম প্রিন্সেস স্ট্রিট। ভারতের উত্তরাঞ্চলের সড়ক ও ভবনগুলোর আদলে গড়ে তোলা অংশটিকে বলা হয় নর্থ টাউন। এ ছাড়া শাস্ত্রীয় কোনো উপাখ্যান অনুযায়ী কিছু নির্মাণের জন্য আছে ‘ভগবত্ম সেট’, আছে বিভিন্ন অঞ্চলের বাগানের আদলে ‘আসকরি গার্ডেন সেট’, ইসলামী স্থাপত্য ধাঁচের ‘মুঘল গার্ডেন’, প্যাগোডার মতো করে বানানো ‘জাপানিজ গার্ডেন’, ‘সান ফাউন্টেইন গার্ডেন’ ইত্যাদি। চাহিদার যেসব জায়গা বা স্থাপনা নেই, সেগুলোও প্লাইউড, কাঠ আর স্টিলের ফ্রেমে তৈরি করে দিতে সময় নেয় না দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ।

চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য এত বিচিত্র রকমের ব্যবস্থা আছে বলেই কি না রামোজি ফিল্ম সিটিকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডস রেকর্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- ‘এটি এমন এক জায়গা, যেখানে একজন নির্মাতা চিত্রনাট্য নিয়ে ঢুকে সিনেমা নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবেন।’

সড়ক ধরে চলতে এসব সেট ঘুরতে ঘুরতে গাড়ি দাঁড়ায় বাহুবলী সিনেমার শুটিংয়ের সেটের পাশে। গাড়ি থামতেই ডেলিগেটরা ছুটে যান বিশাল সেই সেটে। পর্দায় দেখা সিনেমার সেই সিংহাসন, রথ, মামা কাটাপ্পার সঙ্গে শৈশবে গাছতলায় রাজকুমার বাহুর খেতে বসার গাছতলা, অভিনয়শিল্পীদের প্রতিকৃতি দেখার অনুভূতি সবাইকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। সাউন্ড বক্সে শিবগামী দেবীর কণ্ঠে সিনেমার বিভিন্ন সংলাপ যেন চলচ্চিত্রেই ডুবিয়ে দিচ্ছিল ডেলিগেটদের। ভারতবর্ষ তো বটেই, গোটা সিনেমা দুনিয়ার অন্যতম আলোচিত চলচ্চিত্রের সেটে এসে স্মৃতি ফ্রেমবন্দি করতে কে না চায়? ডেলিগেটরা ফিল্ম সিটির এ প্রান্তে এসে যেন উচ্ছ্বাসে মাতলেন।

তবে রামোজি ফিল্ম সিটি যে কেবল সিনেমা নির্মাণের জন্য তা নয়। এখানে আছে সব বয়সী দর্শনার্থীর বিনোদনের নানা আয়োজনও। সিনেমা নির্মাণের অভিজ্ঞতা প্রদানের জন্য অ্যাকশন থিয়েটারসহ আছে চারটি অ্যাট্র্রাকশন, পাঁচটি শো এবং সুপার জেট, স্কেটিং, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গেমসসহ হরেক রকমের রাইড। এর পাশাপাশি আছে খাবার ও শপিংয়ের ব্যবস্থা।

রামোজি ফিল্ম সিটি কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, আকর্ষণীয় এ সিটির টানে স্মৃতি জমা করতে প্রতিবছর এখানে ১৫ লাখেরও বেশি দর্শনার্থী ভিড় জমায়। এ সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছেই। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ২টা পর্যন্ত টিকিট বুক করে রাত ৯টা পর্যন্ত ঘোরা যায় ফিল্ম সিটিতে। ৯টায় বাস দর্শনার্থীদের ছেড়ে যায় হাইওয়ে টিকিট কাউন্টারে। যেখান থেকে বাস ছেড়ে যায় হায়দরাবাদের নানা প্রান্তে।

 

ফিল্ম তৈরি ১৫ মিনিটে

রামোজি ফিল্ম সিটির অ্যাকশন থিয়েটারে ঢোকার পর ইন্ট্রোডিউসিং হলে উপস্থাপক ডাকলেন অভিনয় করতে ইচ্ছুক দুই তরুণ এক তরুণীকে। তখনো কেউ আন্দাজ করতে পারছিলেন না, ভিতরে কী ঘটতে চলেছে। ইন্ট্রোডিউসিং থেকে বাংলাদেশ সাংবাদিক ডেলিগেশন টিমের তিন সদস্য অ্যাকশন হলে ঢুকলেন। উল্টো নতুন চাঁদের মতো আসনে বসা প্রায় ২০০ দর্শনার্থী। কোনো তরুণী না থাকায় তিনজনই পুরুষ সদস্য করবেন অভিনয়।

মঞ্চের পেছনে থাকা মেকআপ কক্ষে নিয়ে গিয়ে তিনজনকে দেওয়া হয় পোশাক। সেই পোশাক পরে মঞ্চে আসেন তিন অভিনেতা। মঞ্চে তিনটি মোটরসাইকেল রাখা। মঞ্চের ওপরে দুটি পর্দা। উপস্থাপক বুঝিয়ে দিলেন কার কী রোল। শুরু করেন পরের পর্ব।

উপস্থাপক তিনজনকে বললেন, মোটরসাইকেল দ্রুত গতিতে যেভাবে চালানো হয় ঠিক তেমন করে হেলেদুলে চালাতে। তিনজনই তাদের দক্ষতা দেখাতে তৎপর। নির্দেশনা অনুসারে ‘অভিনয়’ শুরু করলে করতালি-হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে অ্যাকশন হল। ফিল্মে যে শব্দ আসে, তা-ই শোনা যাচ্ছিল না।

এবার উপস্থাপিকা অ্যাকশন হল থেকে সবাইকে পাশেরই পোস্ট প্রডাকশন হলে নিয়ে গেলেন। সেখানেও দর্শনার্থীদের জন্য একই রকম সারি। মঞ্চে রাখা বক্সিং গ্লাভস, ব্লিন্ডার মেশিন, পাথর, বালু ও ঘূর্ণায়মান চাকার সঙ্গে কাপড় দেখিয়ে পরবর্তী চমকের জন্য উপস্থাপক দর্শনার্থী হল থেকে ডেকে নেন চার টেকনিক্যাল পার্সনকে। বাতি বন্ধ হতেই একজন বক্সিং গ্লাভস দিয়ে ঘুসি দিতে থাকেন। চলতে থাকে ব্লিন্ডার মেশিন অন-অফ, ঘূর্ণায়মান চাকার তালে পাথর-বালুর খেলা।

এবার পোস্ট-প্রডাকশন হল থেকে উপস্থাপক সবাইকে নিয়ে যান প্রিমিয়ার হলে। সেখানে তিনি বলেন, আগের দুই হলে যা হলো এবার তার ফল দেখুন। হলের পর্দায় চলল ২ মিনিট ২৮ সেকেন্ডের একটি ‘অসমাপ্ত ফিল্ম’। তিনজন মিলে টাকা ছিনতাই করে মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। পেছন থেকে দুজন ধাওয়া করেছে। ধাওয়া করে আটকাতে না পেরে পেছন থেকে গুলি করা হলো। তাড়া করার শব্দও মিলছে, মিলছে গুলির শব্দ। যেন সত্যি সত্যি কোনো ফিল্মের দৃশ্য। তাও একেবারে ১৫ মিনিটেরও কম সময়ে নির্মিত।

উপস্থাপক এবার মঞ্চে এসে বললেন, এখন চলচ্চিত্রে যা দেখানো হয়, তা নির্মাণ অনেকখানিই সহজ করে দিয়েছে এ ধরনের উদ্ভাবনী ধারণা ও প্রযুক্তি। এ ভিডিও সবার সামনে সহজে বানিয়ে ফেলা হলো।

 

এক পাড়াতে দেশ-বিদেশ

হেঁটে রামোজি ফিল্ম সিটি ঘুরছিলাম। বামে মোড় নিতেই হঠাৎ মনে হলো রাস্তাটা বদলে গেল। মনে হচ্ছে প্যারিসের কোনো এক রাস্তায় যেন হাঁটছি। সামনে এগিয়ে যেতেই আরও অবাক। এ সড়ক যেন আমেরিকার ব্যস্ত কোনো জনপদ। মাঝখানে স্ট্যাচু অব লিবার্টিও আছে।

অবাক হওয়া দেখে গাইড সোম দত্তা বললেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের আদলে সড়ক স্থাপনা বানানো রয়েছে রামোজি ফিল্ম সিটিতে। রেস্টুরেন্ট, হোটেল, বন, পাহাড় জঙ্গল কী নেই এখানে। প্রকৃতি, স্থাপত্য, সৃজনশীলতার এক মেলবন্ধন।

এসব স্থাপনার সামনে ছবি তোলার ধুম পড়ে গেছে দর্শনার্থীদের। স্ট্যাচু অব লিবার্টির সামনে ছবি তুলছিলেন বিজয়বড়ার এস কৃষ্ণান আইয়ার ও তার স্ত্রী সামাইরা আইয়ার। হাতে মোবাইল দিয়ে দুজনের কিছু ছবি তুলে দিতে বলেন। তাদের দেখে মনে হলো নববিবাহিত। জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল আমার ধারণা সত্যি। কৃষ্ণান বলেন, ছয় মাস আগে আমাদের বিয়ে হয়েছে। হানিমুনে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য নেই, কিন্তু এখানে ছবি তুলে, আনন্দ করে আমাদের দুঃখবোধ অনেকটাই কমেছে। আমরা দারুণ মজা করছি। এখানে আনন্দ, বিনোদনের সব ব্যবস্থা আছে। রাস্তার এক পাশে দেয়ালঘেঁষে কিছু শিল্পকর্ম আছে। পাশে আছে লাল রঙের টেলিফোন বুথ। পোজ দিয়ে ছবি তুলছিলেন দর্শনার্থীরা। শুধু সড়কই না বাড়িও বানানো আছে বিভিন্ন দেশের আদলে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মানুষের গড়ন, খাবার, সংস্কৃতির ভিন্নতার মতো বাড়ির আদল এবং অন্দর সজ্জায়ও আছে ভিন্নতা। রামোজি ফিল্ম সিটিতেও একইভাবে বিভিন্ন রাজ্যের মানুষের বাড়ির আদলে বাড়ি বানানো হয়েছে। বাঙালি বাড়িতে ছোট্ট ঝুল বারান্দায় টব বেয়ে উঠছে মানিপ্লান্টের সবুজ পাতা।

 

কারিশমা গার্ডেনের অদ্ভুত কারবার

শাহরুখ খান-রানী মুখার্জির কাভি আল বিদা না কেহেনা সিনেমার ‘তুমি দেখো না’ গান হয়তো সবার মনে আছে। কিন্তু আমার মাথায় ঘুরপাক খেত নায়িকার শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং গাছের পাতা! কীভাবে হলো এমন মিল? এ জট কোনোভাবেই খুলতে পারতাম না। গত সপ্তাহে রামোজি ফিল্ম সিটি ঘুরে মাথা পুরো পরিষ্কার হয়ে গেছে।

হায়দরাবাদের রামোজি ফিল্ম সিটিতে রয়েছে বাহারি বাগান ঝরনা। প্রথমে ঢুকতেই দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাবে ঐতিহ্যবাহী ইউরোপীয় ডিজাইনে তৈরি অ্যানজেল ফাউন্টেইন। বাস চলতে চলতেই ঘুরিয়ে দেখানো হয় এসব গার্ডেন। আমাদের গন্তব্য বিভিন্ন প্রকৃতির দৃষ্টিনন্দন এক একটা বাগান। প্রতিটি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যে ভরপুর। যেমন কোনোটা জাপানি গার্ডেন, কোনোটা বনসাই গার্ডেন, গাছ কেটে কেটে পশুপাখির আকৃতির স্যাংচুয়ারি গার্ডেন, গাছ দিয়ে তৈরি ছাতার আকৃতির বাগান, মুঘল ডিজাইনের গার্ডেন। আকর্ষণীয় ফুল, গাছ, ঝরনা আর স্থাপত্যের সংমিশ্রণে মোহনীয় সেই বাগানগুলো দৃষ্টিকে করে তুলল হতবাক। এরপর গাইড বললেন এখন আপনারা আছেন কারিশমা গার্ডেনের পাশে। এ গার্ডেনের আছে এক বিশেষত্ব। গাইড সোম দত্তা বলেন, এ গার্ডেনে আলোচিত অনেক গানের শুটিং হয়েছে। পরিচালক যে রঙের গাছের পাতা চাইবেন সেটাই লাগিয়ে দেওয়া হবে। নায়ক-নায়িকার পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে গাছের ওই রঙের পাতা লাগানো হয়। এ জন্য পরিচালককে অবশ্যই ৪৫ দিন আগে কেমন রং, ডিজাইন চাইছেন তা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিতে হবে। এভাবে সিনেমা, গানে কৃত্রিম গার্ডেন জীবন্ত হয়ে ওঠে।

 

পর্যটক টানছে বাহুবলী সেট

‘বাহুবলী’ সিরিজের স্বপ্নের মাহিষমাথি সাম্রাজ্য কিংবা দেবসেনার প্রাসাদ, সবটাই মন জুড়িয়েছে দর্শকের। গোটা ছবির সেট যেন ছিল এ ছবির গল্পের উপযুক্ত স্বপ্নের ক্যানভাস। অমরেন্দ্র বাহুবলীর স্ত্রী দেবসেনার যে রাজপ্রাসাদ ফিল্মে দেখানো হয়েছে তা শহরের বাইরের একটি পরিত্যক্ত অ্যালুমিনিয়াম কারখানাকে নতুন করে সাজিয়ে তৈরি করা হয়। এভাবেই দক্ষিণ ভারতের নানা প্রান্তে গড়ে ওঠে বাহুবলীর সেট। যার বড় অংশ আছে রামোজি ফিল্ম সিটিতে। মাহিষমাথি সাম্রাজ্য গড়ে তোলা হয়েছে এ সিটিতে।

বাহুবলী ভক্তরা মাহিষমাথির পর্দার পেছনের সফরের জন্য হায়দরাবাদে যেতে পারেন। বাহুবলীর গ্র্যান্ড সেটগুলো পর্যটকদের আসার জন্য রামোজি ফিল্ম সিটিতে সংরক্ষিত আছে। বাহুবলী সেটগুলো ১০০ একর বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত, যার সবকটিই এখন পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত।

বাহুবলী সেটগুলো রামোজি ফিল্ম সিটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। স্টুডিওর একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত বলছেন, ‘দুটি অংশে ফিল্মের সেট তৈরি করতে ৬০ কোটির বেশি রুপি খরচ হয়েছে। সেট ছাড়াও, কিছু প্রপসও দর্শকদের দেখার জন্য রাখা হয়েছে। বিশাল বাহুবলী সেট ডিজাইন করার কৃতিত্ব শুধু পুরস্কার বিজয়ী প্রডাকশন ডিজাইনার সাবু সিরিলকে নয়, তার দলকেও যায়, যারা মাহিষমাথিকে পর্দায় জীবন্ত আনতে প্রায় দেড় হাজার স্কেচ তৈরি করে। প্রি-প্রডাকশন দল দেড় হাজার স্কেচ তৈরি করেছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে ছবিটি পরে শুট করা হয়েছিল। এস এস রাজামৌলির উচ্চাকাক্সক্ষী সিরিজের বাহুবলী সিনেমা বিশাল বাজেটে তৈরি করা হয়েছে।

ছবিপ্রেমী ও সমালোচকদের মধ্যে বাহুবলী বেশ সাড়া বা আগ্রহ জাগাতে পেরেছে। বাহুবলী ছবিটিকে অনেকেই ফ্যান্টাসি ওয়ার ফিল্ম থ্রি হান্ড্রেডের সঙ্গে তুলনা করছেন। তবে ছবি রেটিংয়ের ওয়েবসাইট আইএমডিবিতে থ্রি হান্ড্রেড ছবিটির চেয়ে বাহুবলী বেশি রেটিং পেয়েছে। থ্রি হান্ড্রেড ছবির রেটিং যেখানে সাত দশমিক আট সেখানে বাহুবলীর রেটিং সাড়ে নয়। ১০ এর মধ্যে সব রেটিং হিসাব করা হয়। ছবির পরিচালক রাজামৌলি দাবি করেছেন, বাহুবলীর সঙ্গে থ্রি হান্ড্রেড ছবির কোনো মিল থাকলে তা সম্পূর্ণ কাকতালীয়।

বাহুবলী হচ্ছে এক রাজপুত্রের গল্প, যাকে শৈশবেই রাজ্য ছাড়তে হয় মার সঙ্গে পালিয়ে। পরে সেই-ই আবার সিংহাসনের দখল নিতে ফিরে আসে। কিন্তু তার আগে তাকে লড়তে হয় বিশাল এক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। ছবিতে ভালো ও মন্দের মধ্যকার যুদ্ধকে প্লট হিসেবে নেওয়া হয়। বাহুবলী ছবিতে অভিনয় করেছেন আনুশকা শেঠী, রানা দাগুবতী, তামান্না ও প্রভাস। বাহুবলী তৈরির আগে ভারতের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ছবি ছিল শাহরুখ খানের রাওয়ান। রাওয়ান তৈরিতে ২৭ দশমিক চার মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল। যেখানে বাহুবলী তৈরির খরচ ৩৯ মিলিয়ন ডলার।

হায়দরাবাদের রামোজি স্টুডিওতে এটি তেলেগু, হিন্দি, তামিল ও মালায়ালাম ভাষায় ডাবিং করা হয়েছে। প্রায় ২০০ একর জমির ওপর এ ছবির সেট তৈরি করতে সময় লেগেছে ২০০ দিন।

 

সর্বশেষ খবর