সোমবার, ৬ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাজা-রানিদের প্রেতাত্মা

রাজা-রানিদের প্রেতাত্মা

‘ভূত’ আর ‘প্রেতাত্মা’ যা-ই বলা হোক না কেন, চিরকালই তা এক অপার রহস্যের নাম। পৃথিবীতে এমন একটা মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে ছোটবেলায় ভূতের গল্প শোনেনি।  আর বড়বেলায় এসেও ভূত-প্রেত বিষয়ে মানুষের আগ্রহ এতটুকু কমেনি। লোকমুখে শোনা যায়, প্রেতাত্মা হয়ে দেখা দেন বিখ্যাত রাজা-রানিরাও। রাজা-রানিদের ভূত হিসেবে দেখা যায় ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের বিভিন্ন প্রান্তে। বিখ্যাত সেসব প্রেতাত্মাকে নিয়ে লিখেছেন - রণক ইকরাম

 

দ্বিতীয় এডওয়ার্ডের আর্তনাদ

তিনি চলে গেছেন বহু বছর আগে। ১৩২৭ সালের ২৫ জানুয়ারি ছিল তাঁর জীবনের শেষ দিন। আর বহু বছরের পুরনো সেই মানুষটি নাকি এখনো কাঁদেন। এখনো কেঁদে-কেটে পুরনো দুর্গটির আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলেন। বলা হচ্ছে, ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ডের কথা। আর এডওয়ার্ডের কান্নাধ্বনি এখনো শোনা যায় একটি প্রাচীন দুর্গ থেকে। এ দুর্গটির অবস্থান ইংল্যান্ডের গ্লুসেস্টারশায়ারের বার্নলি শহরে। এ অদ্ভুতুড়ে ঘটনার জন্য শহরের মানুষ রীতিমতো বিব্রত এবং ভীতসন্ত্রস্তও বটে। মজার ব্যাপার হলো- বিখ্যাত এ দুর্গটির সুবাদে শহরের অনেকে আবার গর্ববোধও করেন। কিন্তু এরপরও মাঝেমধ্যে যখন ওই দুর্গ থেকে যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ এবং আরও নানা বীভৎস চিৎকার ভেসে আসে তখন সত্যিই থমকে যেতে হয়। ১৩২৭ সালে এ দুর্গে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ডকে। হত্যার আগে তার ওপর চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। অমানবিক নিষ্ঠুরতার সঙ্গে গনগনে লাল শিক দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল ১৩২৭ সালের ২৫ জানুয়ারি। ওই বীভৎস নির্যাতনের কারণে দুঃসহ যন্ত্রণায় অবিরাম আর্তনাদ করেছেন তিনি, সেই আর্তনাদ এখনো নাকি মাঝে মধ্যে শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত শোনা যায়।

 

পোর্ট্রেট থেকে বেরিয়ে আসেন বার্কলি

ব্রিটেনের নর্থ আম্বারল্যান্ডের এলানইতে অবস্থিত চিলিংহাম প্রাসাদটি ভূতুড়ে বাড়ি হিসেবে দারুণ বিখ্যাত। এ প্রাসাদটি ব্রিটেনের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদগুলোর অন্যতম। ব্রিটেনে রাজতন্ত্র চলাকালে এ ক্যাসেলে বসবাস করেছেন নানা বংশের সম্রাট। এদের মধ্যে প্রজাদরদি যেমন ছিলেন, তেমনি নিষ্ঠুর-অত্যাচারী শাসকও ছিলেন। কোনো কোনো সম্রাট প্রাসাদেই গড়ে তুলেছিলেন নির্যাতন কেন্দ্র। ফলে প্রাসাদের অসংখ্য কক্ষের কোনো কোনোটি নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা লোককথা। অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে এ প্রাসাদে বাস করতেন লেডি মেরি বার্কলি নামে এক সুন্দরী সম্ভ্রান্ত মহিলা। কিন্তু তার স্বামী লড্র গ্রে ছিলেন লম্পট। আপন শ্যালিকাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গ্রে পালিয়ে বিয়ে করেন। মনের দুঃখে আত্মহত্যা করেন বার্কলি। কিন্তু প্রাসাদের ওই কক্ষে আজও নাকি ঘুরে বেড়ায় তার দুঃখভারাক্রান্ত আত্মা। চিলিংহাম প্রাসাদের বাসিন্দা এবং কর্মরত অনেক কর্মচারীর ভাষ্য- বার্কলি যে কক্ষে বাস করতেন সে কক্ষের দেয়ালেই টাঙানো আছে তাঁর একটি পোর্ট্রেট। আর মাঝরাতের সুনসান নীরবতায় মাঝেমধ্যেই তিনি পোর্ট্রেট থেকে বেরিয়ে আসেন! পিংক নামের এক কক্ষ থেকে প্রায়ই ভেসে আসে এক কিশোরের গোঙানির শব্দ এবং তা আসে মধ্যরাতে, যখন প্রকৃতি নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। ওই ঘরে যারাই রাত কাটানোর জন্য অবস্থান করেছেন তারাই দেখেছেন এক ভয়াবহ দৃশ্য! দেয়াল ফুঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসছে নীল রঙের পোশাক পরিহিত এক কিশোর!

 

ব্যভিচারী ইসাবেলাও!

দ্বিতীয় এডওয়ার্ডকে অমানবিক নির্যাতনে হত্যার পেছনে দায়ী ছিলেন তাঁর ব্যভিচারী স্ত্রী ইসাবেলা (১২৯২-১৩৫৮)। আর প্রেতাত্মা হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয় তাকেও। তার প্রেতাত্মাকে নাকি উন্মাদিনীর মতো ছুটে বেড়াতে দেখা যায় নরফোকের রাইজিং দুর্গের ওপর। এর বাইরেও এডওয়ার্ড ও ইসাবেলার পুত্র রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়ায় কেন্টের হল প্লেসে। ১৩৩০ সালে ক্ষমতায় আরোহণ করা তৃতীয় এডওয়ার্ডের প্রেতাত্মা তখনই নজরে আসে যখন ব্রিটেন কোনো হুমকির মুখে পড়ে। তা ছাড়া তাঁর প্রেতাত্মা ওই প্রাসাদের বর্তমান মালিকদের বিপদাপদ সম্পর্কে আগাম ধারণা দেয়। ওই প্রেতাত্মাকে দেখা যায় গোধূলিবেলায়। আর প্রেতাত্মা যখন দৃশ্যমান হয় তখন নাকি বিভিন্ন রকম প্রাচীন যন্ত্রসংগীত শোনা যায়।

 

মৃত টমাস উলসি হাজির

ব্রিটেনের বিখ্যাত ভূতের বাড়িগুলোর একটি হ্যাম্পটন কোর্ট। এ প্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন লর্ড চ্যান্সেলর কার্ডিনাল টমাস উলসি। রাজা অষ্টম হেনরির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার পর সেই সম্পর্ক ঠিক করার অভিপ্রায়ে এ প্রাসাদ রাজাকে উপহার দিয়েছিলেন তিনি। আর এ প্রাসাদটিই বর্তমান ইংল্যান্ডের অন্যতম আলোচিত হন্টেড হাউসে পরিণত হয়েছে। এখানে রাজপরিবারের নানা মানুষের প্রেতাত্মা দেখা যায় হরহামেশাই। এমনকি খোদ টমাস উলসি নিজেও প্রেতাত্মা হয়ে দেখা দেবেন। ১৯৬৬ সালে প্রাসাদে এক অনুষ্ঠানে কার্ডিনাল টমাস উলসিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। প্রথমে তাকে সবাই মনে করেছিল অন্য অভিনেতাদের একজন, হঠাৎ খেয়াল পড়ল এ অনুষ্ঠানে টমাস উলসি নামে কোনো চরিত্র নেই। ততক্ষণে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে পঞ্চদশ শতকের ইংল্যান্ডের এ ভাগ্যনিয়ন্তা।

 

অষ্টম হেনরি ও তাঁর স্ত্রীরা

অষ্টম হেনরি (১৪৫৭-১৫০৯) বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর ছয় স্ত্রীর কারণে! হেনরির প্রথম স্ত্রী ছিলেন ক্যাথরিন। ১৫০৯ সালে তাকে বিয়ের ২৪ বছর পর তালাক দেন হেনরি। মজার ব্যাপার হলো, ক্যাথরিন ছিলেন হেনরির ভাই আর্থারের বিধবা স্ত্রী। ওই বছরই হেনরি অন্তঃসত্ত্বা নারী অ্যানি বোলিনকে বিয়ে করেন। এ দম্পতির ঘরেই জন্ম হয় এলিজাবেথের। ১৫৩৬ সালের ১৯ মে রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও আদেশ অমান্যের অভিযোগে অ্যানির মুন্ডুপাত করা হয়। ওই মাস শেষের আগেই হেনরি জেন সেইমোরকে বিয়ে করেন। এডওয়ার্ডের জন্মের বছরখানেকের মধ্যেই জেনের মৃত্যু ঘটে। এর পর হেনরি জার্মান প্রিন্সেস অ্যান অব ক্লেভসের পোর্ট্রটে দেখে তার প্রেমে পড়ে যান। ১৫৪০ সালে তার সঙ্গে হেনরির বিয়ে হয়। তবে সেটি খুব বেশি দিন টেকেনি। ১৫৪০ সালের জুলাইয়ে হেনরি অ্যানি বোলিনের কাজিন ক্যাথরিন হাওয়ার্ডকে বিয়ে করেন। এ বিয়েও বেশিদিন টিকল না। তাকেও অ্যানি বোলিনের মতো অভিযুক্ত করে মুন্ডুপাতের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। পরের বছর ১৫৪১ সালে ক্যাথরিন হেনরির ষষ্ঠ স্ত্রী হলেন। তিনিই ১৫৪৭ সালে হেনরির মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর স্ত্রী ছিলেন। ফোর্ট প্রাসাদে এখনো নাকি দেখা দেন রাজা অষ্টম হেনরি তাঁর ছয়জন স্ত্রীকে নিয়ে। এদের মধ্যে অ্যান বোলিন ও জেন সিমুরকে হত্যা করা হয়েছিল শিরন্ডেদের মাধ্যমে। মুন্ডুহীন অবস্থাতেই ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় তাদের ছায়াশরীর। তবে ভূতের সংখ্যায় সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে টাওয়ার অব লন্ডন। অ্যান বোলিনের আত্মা নাকি উদয় হয় এখানেও।

রানি অ্যান বোলিনের প্রেতাত্মাকে দেখা যায় শেষ বিকালে হ্যাম্পটন কোর্ট প্রাসাদের করিডোরে। যারা তাকে দেখেছেন তারা বলেছেন রানিকে নাকি দেখা যায় বিষণ্ণ, উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত অবস্থায়। মনে হয় আসন্ন বিপদের খবর তিনি পেয়েছিলেন। রানি জেন সিমুরের প্রেতাত্মাকে নাকি দেখা যায় ১২ অক্টোবর। ওইদিন জন্ম নেয় তার সন্তান পরবর্তী রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ড (১৫৩৭-১৫৫৩)। জেন সিমুরের চেহারা নাকি শান্ত স্নিগ্ধ কিন্তু ক্যাথরিন হাওয়ার্ডের আত্মা নাকি সবসময় চিৎকার করে বেড়ায়। কারণ রাজা তাকে ব্যভিচারের অভিযোগে যখন গ্রেফতার করে টাওয়ারে নিয়ে যায় তখন তিনি নাকি নিজেকে নিরপরাধ দাবি করছিলেন।

 

রানি এলিজাবেথ

বিখ্যাত উইন্ডসর ক্যাসেলে নাকি এখনো ঘুরে বেড়ান প্রথম এলিজাবেথ। প্রথম হাইহিল জুতার আওয়াজ পাওয়া যায়। তার পরই দেখা যায় তাঁকে। রয়্যাল লাইব্রেরির পাশ দিয়ে হেঁটে ভিতরের ঘরে ঢুকে যান। ওখানে যারা গেছেন তাদের সবারই নাকি এ রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর