সোমবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দিল্লির রহস্যময় লোহার পিলার

তানভীর আহমেদ

দিল্লির রহস্যময় লোহার পিলার

পৃথিবীতে অসংখ্য রহস্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এগুলো মানুষকে আকর্ষণ করে। নানা প্রশ্ন জন্মায় এ রহস্যগুলোকে নিয়ে। কৌতূহলের সবটাই যে মেটে তা কিন্তু নয়। তেমনই এক অমীমাংসিত রহস্য রয়েছে ভারতে। ১৬০০ বছর বয়স হয়েছে এক লোহার পিলারের। মরিচা ধরেনি তাতে। কেন এমন একটি লোহার পিলার বানানো হয়েছিল তা ঠিকভাবে জানা যায়নি। এ লোহার পিলারটির রহস্যভেদ না হলেও গবেষকরা কিন্তু বসে নেই। প্রতিনিয়তই এ লোহার পিলারের গঠনবৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানার চেষ্টা চলছে। দেখতে খুব সাধারণ হলেও লোহার পিলারটি সবাইকে বিস্মিত করে চলেছে। এটি রয়েছে ভারতের দিল্লিতে। ২৩ ফুট উঁচু এ পিলারটির ওজন প্রায় ছয় টনেরও বেশি। হাজার বছর ধরে খোলা বাতাসে উন্মুক্ত এ লোহার পিলারে এতটুকু মরিচা পড়েনি। পিলারটি কেন বানানো হয়েছে আর কারা বানিয়েছে সে নিয়ে নানা তর্ক রয়েছে। তবে লোহার পিলারটি হাজার বছর ধরে মানুষের মনকে গোলকধাঁধায় ঘোরাচ্ছে। যে কারণে এখনো প্রতি বছর লাখ লাখ দেশি-বিদেশি দর্শনার্থী ও ধর্মভীরু মানুষ এ পিলারটি দেখার জন্য ভিড় জমান। পিলারটি ৭.৩ মিটার লম্বা, গোড়ার দিকে ব্যাস ৪৮ সেন্টিমিটার, সরু মাথার মাপ ২৯ সেন্টিমিটার এবং ওজন প্রায় ৬.৫ টন। প্রকৃতপক্ষে কে এ পিলারটি তৈরি করেছিলেন তা ঠিক জানা যায়নি। এটি চতুর্থ বা পঞ্চম শতাব্দীতে স্থাপিত কি না গবেষকদের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। হাজার বছরেরও বেশি বয়স এটির। তবে এটির গঠনশৈলী মোটেও বিকৃত হয়নি। এর পেছনে নিশ্চিতভাবে ব্যতিক্রমী পদ্ধতি রয়েছে। যে কারণে আজও এতে কোনো মরিচা ধরেনি কিংবা ক্ষয় হয়নি। পিলারটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় চাপ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এবং এতে ব্যবহার করা হয়েছে শতকরা ৯৮ ভাগ খাঁটি লোহা। পর্যটকরা ভীষণ আবেগে পিলারটিকে ছুঁয়ে আনন্দ অনুভব করেন। পিলারটি যেন বন্ধ্যত্ব, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ও স্থায়িত্বের প্রতীক। এখন অবশ্য পিলারটির চারদিক ঘিরে দেওয়া হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের কারও কারও ধারণা, হিন্দু দেবতা বিষ্ণুুর পতাকা খোদিত এ পিলারটি খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে তৈরি হয়েছে। আর এটি তৈরি করেন গুপ্তবংশীয় রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। কোনো মন্দির নির্মাণে বা মন্দির চত্বরে স্থাপনের জন্যই পিলারটি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এটি কেমন করে বর্তমান স্থানে এলো তার কোনো সঠিক ইতিহাস নেই।  লোককাহিনি মতে, পিলারটি অলৌকিকভাবেই কুতুব কমপ্লেক্সে চলে এসেছে, কেউ এটি নিয়ে আসেনি। আর এ পিলারকে কেন্দ্র করেই কুতুব-উদ-দীন নির্মাণ করেছেন কুতুব কমপ্লেক্স। তাছাড়া পিলারটি অন্য অনেক জায়গায় অনেকে দেখেছে বলেও লোকশ্রুতি আছে।

স্তম্ভটির প্রাথমিক অবস্থান কোথায় ছিল তা নিয়ে বিতর্ক এখনো চলমান। স্তম্ভটি কুওয়াত-উল-ইসলাম মসজিদে স্থাপন করা হয়েছিল কোনো যুদ্ধের বিজয়ের স্মারক হিসেবে। কিন্তু এর আগে এটি কোথায় ছিল সেটি নিয়ে আলোচনা এখনো চলছে। স্তম্ভের ওপর একটি লোহার চাকতি বা চাকা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ চাকতিটির মূল উৎস ভারতের মধ্যপ্রদেশের উদয়গিরির গুহা। স্তম্ভটির গায়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষায় অনেক কিছু লেখা হয়েছে। সবচেয়ে প্রাচীন লেখাটি লেখা হয়েছে গুপ্ত যুগে ব্রাক্ষ্মীলিপিতে সংস্কৃত ভাষায়। এটি থেকে বোঝা যায় এটি বিষ্ণুর প্রতি সম্মানের নিদর্শন হিসেবে স্থাপন করা হয়েছিল। এ ছাড়া এতে রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সাহস ও শাসনামলের প্রশংসাগাথা বর্ণিত হয়েছে। অনেকের মতে এখানে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কথা বলা হয়েছে। সেই হিসেবে এ প্রাচীন স্তম্ভটি খ্রিস্টপূর্ব ৯১২ সালে স্থাপিত হয়েছে।

এটি কে নির্মাণ করেছেন সেটি নিয়েও বিতর্ক আছে। ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’র মতে, এ পিলারটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজা কুমারা গুপ্ত তৈরি করেন বলে মনে করেন। আর এটি নির্মাণের সময়কাল ৩২০-৫৪০ খ্রিস্টাব্দে। এ ছাড়া তারা এর গঠনগত বৈশিষ্ট্যও প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনো গবেষণায়ই পিলারটির রহস্য উদ্ধারে পরিপূর্ণ সফল হয়নি। বছরের পর বছর ধরে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ধাতুবিশেষজ্ঞদের কাছে এ স্তম্ভটি বিরাট এক বিস্ময়ের জিনিস। এ স্তম্ভকে ‘প্রাচীন ভারতীয় কামারদের দক্ষতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন’গুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়। কারণ এটির মরিচা-প্রতিরোধের উচ্চ ক্ষমতা। কীভাবে এ স্তম্ভ মরিচা-প্রতিরোধী হলো? বিশেষজ্ঞরা দেখলেন, সেই প্রাচীন আমলের ধাতব বস্তু নির্মাতা বা কামাররা এ লোহার

স্তম্ভের ওপর আয়রন হাইড্রোজেন ফসফেট স্ফটিকের স্তর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আই আই টি কানপুরের বিশেষজ্ঞ ডক্টর আর বালাসুব্রমনিয়ম জানান কীভাবে এ স্তম্ভটিকে মরিচা-প্রতিরোধী করে তৈরি করা হলো। প্রথমে লোহাকে উচ্চ তাপমাত্রায় নরম করে পিটিয়ে একটি অংশের সঙ্গে আরেকটি অংশকে জোড়া লাগানো হয়। এরপর স্তম্ভের গায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয় মরিচা-প্রতিরোধী দ্রব্যের পাতলা স্তর। লোহার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার মাঝে ছিল স্লাগ বা ধাতুমল ও অবিজারিত আয়রন অক্সাইড। আর এ লোহার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার ভিতরে ছিল অনেক বেশি পরিমাণে ফসফরাস। এ ছাড়া দীর্ঘদিন খোলা স্থানে থাকার কারণে প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক উপায়ের সংমিশ্রণে স্তম্ভটির ওপর একটি তিন স্তরবিশিষ্ট মরিচা-প্রতিরোধী ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়। স্তম্ভটির মরিচা-প্রতিরোধী হওয়ার আরেকটি কারণ এতে ব্যবহার করা ফসফরাস। প্রাচীন ভারতীয় লৌহশিল্পীরা লোহা গলানোর চুল্লিতে চুন ব্যবহার করতেন না, করতেন চুনাপাথর। চুনাপাথর ব্যবহার করেই গলন্ত লোহা থেকে ইস্পাতের উদ্ভব ঘটত। তবে স্তম্ভটি মরিচা-প্রতিরোধী হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে হাইড্রোজেন ফসফেট হাইড্রেটের একটি পাতলা স্তর, যেটি লোহার এ স্তম্ভ তৈরির পর এর গায়ের ওপর প্রলেপ হিসেবে দেওয়া হয়। এক মিলিমিটারের বিশ ভাগের এক ভাগ পুরত্বসম্পন্ন এ পাতলা স্তর ১৬০০ বছর ধরে প্রাচীন লোহার স্তম্ভকে মরিচা থেকে সুরক্ষা দিচ্ছে।  যে কারণে এখনো পিলারটি মানুষকে সমানভাবে বিস্মিত করে আসছে।

 

চুম্বকের পাহাড়

প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক পর্যটক বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাদাখে আসেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। শুটিং স্পট এবং পর্যটন স্পট হিসেবেই লাদাখ সবার কাছে বেশি পরিচিত। লাদাখের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বাইরেও কিছু রহস্য আছে। লাদাখের লেহ অঞ্চল থেকে কারগিলের দিকে যেতে ৩০ কিলোমিটার দূরত্বেই আছে সেই রহস্যময় চুম্বক পাহাড়। ওই সড়কে গেলেই সাক্ষী হওয়া যাবে এক রহস্যময় ঘটনার। আপনি যদি আপনার গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখেন, তাহলে কিছুক্ষণ পরই দেখতে পাবেন আপনার সাধের গাড়িটি ক্রমে সামনের দিকে যাচ্ছে। ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে আপনার গাড়িটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে যেন অদৃশ্য কেউ।

শুধু গাড়িই নয়, লাদাখের এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে কোনো বিমান যাওয়ার সময় খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। বিমানের গতিপথ যাতে পাল্টে না যায় সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হয় পাইলটকে। এ চুম্বক পাহাড় নিয়ে স্থানীয়দের ভিতর নানা গল্প চালু আছে। তবে সব গল্পই সেই ঐশ্বরিক বা অতিপ্রাকৃতিক শক্তির বর্ণনায় শেষ হয়। লাদাখের এ চুম্বক পাহাড় স্থানীয় জনতার বাইরে ভিন্নাঞ্চলের মানুষের কাছে আবিষ্কৃত হয় অনেক পরে।  বর্তমানে লাদাখ কর্তৃপক্ষ ওই সড়কটির দুই প্রান্তেই সাইনবোর্ড বসিয়ে দিয়েছে, যাতে কেউ দুর্ঘটনায় পতিত না হয়।

 

 

সর্বশেষ খবর